অথবা, চণ্ডীদাসের উত্তরসাধক হিসেবে জ্ঞানদাসের মূল্যায়ন কর

অথবা, জ্ঞানদাস চণ্ডীদাসের ভাবশিষ্য এবং সার্থক উত্তরসাধক – সংক্ষেপে আলোচনা কর

উত্তর : চণ্ডীদাসকে সমালোচকগণ আধ্যাত্মিক কবি বলে বর্ণনা করে থাকেন। রাধার দেহসৌন্দর্যের প্রতি কৃষ্ণের আকর্ষণ অনুরাগ বর্ণনা করতে গিয়ে চণ্ডীদাসকে কিছু কিছু আদিরসাত্মক চিত্রকল্প গ্রহণ করতে হয়েছে। সিক্তবসনা শ্রীরাধাকে দেখে কৃষ্ণের উক্তি:

চলে নীল শাড়ী নিঙ্গাড়ি নিঙ্গাড়ি

পরাণ সহিত মোর।

সেই হৈতে মোর হিয়া নহে থির

মনমথ জ্বরে ভোর ॥

অপূর্ব দেহসৌন্দর্য ফুটিয়ে তোলার ক্ষেত্রে চণ্ডীদাসের কোনো জুড়ি নেই। কিন্তু পদাবলীর চণ্ডীদাস দেহের কবি নন, আনন্দবিলাসের কবি নন। চণ্ডীদাসের পদাবলী হতে রাধার চরিত্রটি যেন জীবন লাভ করে আমাদের সামনে এসে দাঁড়ায়। অনেকে বলেছেন চণ্ডীদাসের রাধা পরিপূর্ণভাবে বিকশিত নয়। এর কারণ, হয়ত বা তাঁর পদের শান্ত, স্নিগ্ধ, সমাহিত ভাব। কোনো অতিরিক্ত সউচ্ছ্বাস তাঁর পদগুলোতে স্থান পায়নি। দীনেশ চন্দ্র সেন বলেন, “চণ্ডীদাসের বাণী সহজ, সরল ও সুন্দর।”

চণ্ডীদাসের সহজ সরল রাখালী সুরের মধ্যে মানবজীবনের দেশকালাতীত আনন্দবেদনার বাণী ধ্বনিত হয়েছে। তাঁর প্রেম- বিরহ-মিলন দেহকে অবলম্বন করেও দেহাতিচারী। তিনি রচনা সৌন্দর্যের জন্য যে সমস্ত অলঙ্কারের সাহায্য নিয়েছেন, সেগুলো একেবারে দৈনন্দিন জীবনের সঙ্গে সম্পৃক্ত।

জ্ঞানদাস চণ্ডীদাসের ভাবশিষ্য। তিনি যেভাবে তপস্বিনী শ্রীরাধার মূর্তিটি নিরাভরণ ও নিরলঙ্কার ভাষায় ফুটিয়ে তুলেছেন তা হতে চণ্ডীদাসের রাধাকে পৃথক করা যায় না। নায়িকার রূপবর্ণনা, অতৃপ্ত প্রণয়াকাঙ্ক্ষার তীব্র জ্বালা, মিলনের জন্য ব্যাকুলতা, মিলনের জন্য উল্লাস এবং বিরহের মর্মস্পর্শী আর্তি, জ্ঞানদাস চণ্ডীদাসের মতোই ফুটিয়ে তুলতে সক্ষম হয়েছেন। তাঁর পদে:

“রূপ রাগি আঁখি ঝুরে গুণে মন ভর।

প্রতি অঙ্গ লাগি কান্দে প্রতি অঙ্গ মোর॥

হিয়ার পরশ লাগি হিয়া মোর কান্দে।

পরাণ পিরীতি লাগি থির নাহি বান্ধে॥”

তাঁর পদগুলো যেন দেশকাল জয়ী কাব্যের প্রতিরূপ। রূপ বর্ণনায় তাঁর নাদাস চন্ডীদাসের চেয়েও অধিক কৃতিত্ব দেখিয়েছেন। বর্ণনায় জ্ঞানাঙ্গে এত রূপ নয়নে না ধরে’ প্রভৃতি পদ তাঁর রূপ বর্ণনার কৃতিত্ব বহন করছে। তাঁর গৌরাঙ্গ বিষয়ক পদগুলো নিম্নরূপ:

“সহচর অঙ্গে গোরা অঙ্গ হেলাইয়া।

চলিতে না পারে যেনে পড়ে মূরছিয়া ॥

অতি দুরবল দেহ ধরণে না যায়।

ক্ষিতি তলে পড়ি সহচর-মুখ চায় ॥”

চণ্ডীদাসের পদ হতে অনেক সময় জ্ঞানদাসের পদকে পৃথক করা যায় না। যেমন: ‘সুখের লাগিয়া এ ঘর বাঁধিনু’ এ পদটি কার রচনা এ সম্পর্কে সংশয় দূর করার উপায় নেই। চণ্ডীদাসের পদগুলোতে জ্ঞানদাসের অপেক্ষা ভাবের গভীরতা সহজেই ধরা পড়ে। কিন্তু জ্ঞানদাস চণ্ডীদাসের চেয়েও ভাবকে আরো সুন্দর করে প্রকাশ করতে সক্ষম হয়েছেন। চণ্ডীদাসের মতো জ্ঞানদাসের রাধাও কৃষ্ণপ্রেমে যোগিনী সেজেছেন। কিন্তু চন্ডীদাসের রাধা সর্বদাই বিষাদক্লিষ্ট। তাঁর কথাবার্তা ও আচার আচরণে সর্বদাই বিষাদের সুর বেজে ওঠে। জ্ঞানদাসের রাধারও বেদনার অন্ত নেই কিন্তু তথাপি তিনি স্বভাবত হর্ষোৎফুল্লা কথা মিলন-ব্যাকুলতা সুরসিকা নায়িকা। নায়কের রূপ বর্ণনায় আমরা জ্ঞানদাসের মৌলিক সৃজন ক্ষমতার পরিচয় পাই। এমন বৈশিষ্ট্য চণ্ডীদাসের পদেও লক্ষ করা যায়। তাই জ্ঞানদাসকে বলা হয়েছে। চণ্ডীদাসের ভাবশিষ্য ও সার্থক উত্তর সাধক।