অথবা, জ্ঞানদাস ও গোবিন্দ দাসের কবি প্রতিভার তুলনামূলক ব্যাখ্যা উপস্থাপন কর

চৈতন্য পূর্ববর্তী দুই শ্রেষ্ঠ কবি বিদ্যাপতি ও চণ্ডীদাস রাধাকৃষ্ণের প্রেমলীলা বর্ণনায় যে বিশিষ্ট দুই রীতির প্রবর্তন করেছিলেন; চৈতন্য পরবর্তী ভক্ত বৈষ্ণব কবিগণ আরো সীমাবদ্ধ তত্ত্বদর্শনের আলোকে কমবেশি সেই ধারারই অনুকরণ করে চলেছিলেন। এই গণ্ডিবদ্ধ ভক্তি প্রেমের জগতে বিচরণ করতে গিয়েও প্রতিভাবান কয়েকজন কবির মধ্যে জ্ঞানদাস এবং গোবিন্দদাসের নাম সর্বাগ্রে স্মরণীয়।

চৈতন্যের যুগের এই দুই শক্তিমান কবি বৈষ্ণব পদ সাহিত্যে রসের ধারা বইয়ে দিয়েছেন। নিচে তাঁদের ভাব, ভাষা ও রূপ বৈচিত্র্যের তুলনামূলক আলোচনা তুলে ধরা হলো:

কবিত্বের উৎকর্ষ বিচার করলে দেখা যায় কবি জ্ঞানদাস চণ্ডীদাসের কাব্যাদর্শের অনুসরণ করে এবং তার সাথে স্বীয় মৌলিক প্রতিভার সংযোজন করে এক নতুন লিরিক প্রেমানুভূতির কবিরূপে আমাদের সামনে আবির্ভূত হয়েছে। বৃন্দাবনের রাধাকৃষ্ণের প্রেম কথার মাধ্যমে কবি যেন নরনারীর শাশ্বত প্রেমবেদনার কথাই আমাদের শুনিয়েছে। পক্ষান্তরে, কবি গোবিন্দদাস ছিলেন বিদ্যাপতির ন্যায় বিদগ্ধ ও সুপণ্ডিত। পদ রচনাদর্শে তিনি বিদ্যাপতিকেই গুরুরূপে গ্রহণ করেছিলেন। তাঁর পদে ভাবাবেগের উত্তাপের অভাব থাকলেও কাব্যের রূপ সম্পূর্ণতার অভাব কোথাও ঘটেনি। অর্থাৎ গোবিন্দদাস রূপদক্ষ শিল্পীর মতো যথাদৃষ্ট রূপকে ভাষার তুলিকায়, অপূর্ব লাবণ্যরসে রাধাকৃষ্ণের প্রেম কথা ব্যক্ত করেছেন।

পদাবলী সাহিত্যে দুই শ্রেণির পদকার আছেন। এক শ্রেণি মূলত বস্তুবিদ অথবা রূপ তন্ময়। গোবিন্দদাস এই শ্রেণির কবি। অনুভূতির গভীরতা অপেক্ষা কবিতার রূপ বিলাস ও মণ্ডনকলার দিকে তাঁর নজর। তাঁর কাব্যে ভাবের কথা থাকলেও তা বিভাবাদির হৃদয় ভাব। আবার অন্য শ্রেণির পদকর্তা আছেন যারা মূলত ভাবসিদ্ধ প্রাণতন্ময়। জ্ঞানদাস ঐ শ্রেণির গাঢ় অনুভূতির আকুতিই তাঁর পদে প্রকাশমান। বিভিন্ন অনুভূতিকে বিভিন্ন পরিবেশে তিনি চিত্তের আকুলতা দিয়ে মর্মস্পর্শী করে প্রকাশ করেছেন।

বৈষ্ণব কবিকুলের মধ্যে আধুনিককালে লিরিক প্রতিভা। বলতে যা বুঝায় তা যদি কারও থাকে তবে তা ছিল কবি জ্ঞানদাসের। তাঁর পর অনুভূতির আকুতি ছিল এবং তিনি জানতেন কেমন করে সেই অনুভূতিকে সংহত তীব্র আকারে প্রকাশ করতে হয়। বহু সময়ে রাধার কথা জ্ঞানদাসের কথা, রাধার মুখে বললেও তা কবির নিজের কথাই এবং কবির সেই ব্যক্তিগত বাণী, রস সৃষ্টির কৌশলে নিত্যকালের বাণী হয়ে উঠেছে

‘রূপের পাথারে আঁখি ডুবিয়া রহিল।

যৌবনের বনে মন হারাইয়া গেল।।

ঘরে যাইতে পথ মোর হইল অফুরাণ।

অন্তরে অন্তর কাঁদে কিবা করে প্রাণ।।’ (পর্দ-৬০)

জ্ঞানদাসের বিশিষ্ট কবিমন ছিল। এই অফুরন্ত পথ, প্রেম তাঁর মনের ধর্ম। রাধার বেদনা, আকুতি বা উল্লাস তা ঐ কবিরই মর্মভেদ করে নিঃসৃত হয়েছে কবি রাধার সাথে একাত্ম হয়ে গিয়েছেন। অন্যদিকে, গোবিন্দদাস খাঁটি অর্থে লিরিক কবি নন। কাব্যের মধ্যে তাঁর অবতারণা ঘটেনি। তিনি অন্যের বেদনাকে তার লীলা ও রসকে প্রকাশ করেছেন এবং তা শেষ পর্যন্ত অপরের রয়ে গিয়েছে। গোবিন্দদাস ভক্ত কবি হলেও কৃষ্ণলীলার সাথে নিজেকে মিশিয়ে ফেলা তাঁর পক্ষে সম্ভব হয়নি; রাধার বেদনার মধ্যে নিজ বেদনা ঢেলে দিতে পারেনি। তাঁর ভক্তি যত বেড়েছে, সাধনা স্তরে উন্নীত হয়েছে, ততই ঐ রূপমুগ্ধতা এবং কৃষ্ণেন্দ্রিয় প্রীতি ইচ্ছা প্রবল হয়ে তাঁর রূপ সাধনাকে সম্পূর্ণতার দিকে এগিয়ে দিয়েছে। অর্থময় চিত্রাত্মক শব্দ সম্ভারের সাহায্যে তিনি রাধা ও কৃষ্ণ উভয়ের রূপাঙ্কন করেছেন। দৃষ্টান্ত :

নন্দ-নন্দন চন্দ-চন্দন

গন্ধ-নিন্দিত-অঙ্গ। (পদ-১৩)

অর্থাৎ মন্ময় গীতিকবিতার লক্ষণ গোবিন্দদাসের কবিতায় নেই।

গোবিন্দদাসের কাব্যে বা পদে লিরিক গুণ না থাকলেও ছিল। সংগত গুণ। এই সঙ্গীতধর্মিতা তাঁর রচনার প্রধান গুণ। সারা বাংলা সাহিত্যে রবীন্দ্রনাথ ছাড়া অপর কোনো কবির কাব্যেই এমন সুর চেতনার সন্ধান পাওয়া যায় না। গোবিন্দদাসের কবিতার সংগীতরস স্থিরচিত্রকে গতিময় করে তুলেছে এবং ভাসমান তরঙ্গোদ্বেলতা পাঠক চিত্তে আঘাত করে রস নিষ্পত্তিতে সাহায্য করেছে। উদাহরণ :

১. প্রেম-আকুল গোপ গোকুল

কুলজ-কামিনি-কন্ত।

কুসুম-রঞ্জন মঞ্জু-বস্তুল

কুঞ্জ-মন্দিরে সন্ত॥ (পদ-১৩)

নাটকীয়তা গোবিন্দদাসের পদরচনার আরেকটি বিশেষ গুণ যা জ্ঞানদাস বা অপর বৈষ্ণব কবিদের রচনায় দুর্লভ। অভিসারের পদগুলোতে তিনি নাটকীয়তা আমদানি করেছেন। এই নাট্যরস চিত্র সৌন্দর্যের সহায়ক হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ। অভিসারিকা কর্তৃক রূপায়িত হয়েছে। দৃষ্টান্ত,

‘কণ্টক গড়ি কমল-সম পদতল

মঞ্জীর চিরহি ঝাঁপি।

গাগরি-বারি ঢারি করি পিছল

চলতহি অঙ্গুলি চাপি॥ (পদ-১৫০)

অন্যদিকে, অভিসার চিত্রণে গোবিন্দদাসের তুলনায় জ্ঞানদাসের পদগুলো অনেকটা নিষ্প্রভ। জ্ঞানদাসের রাধা ধ্যানময়ী। আপন উপলব্ধির গভীরে প্রবেশ করে সে আত্মহারা। অবস্থানগত বাস্তব দূরত্বের সমস্যা তাঁর কাছে গুরুত্বহীন। এই দূরত্ব নিরসনের জন্য অভিসার গমনের তাই প্রশ্ন উঠে না। যে মুষ্টিমেয় অভিসার পর্যায়ের কবিতা তিনি লিখেছেন তাতেও রসাবেদন ফোটাতে ব্যর্থ হয়েছেন।

জ্ঞানদাসের পদাবলী রাধার মানসিকতার যে পরিচয় বহন করে তার বিশিষ্টতা অতি স্পষ্ট। জগৎ এবং জীবনকে, প্রেমের অনুভূতিকে, তার বেদনা ও চিত্ত চাঞ্চল্যকে কবি রাধার দৃষ্টিতেই দেখেছেন, কৃষ্ণের দৃষ্টিতে নয়। কৃষ্ণের প্রেমানুভব জ্ঞানদাসের রচনায় আদৌ সার্থক হয়ে উঠেনি। কৃষ্ণের পূর্বরাগের বর্ণনায় গোবিন্দদাসের কবিতা সৌন্দর্য সৃষ্টির আবেগে যেমন বিশ্বরূপ সঙ্কলন করে উচ্ছ্বসিত হয়ে বলেছে,

যাঁহা যাঁহা নিকসয়ে তনু তনু জ্যোতি।

তাঁহা তাঁহা বিজুরি চমকময় হোতি ৷৷ (পদ-৫২)

জ্ঞানদাসের রচনায় তাঁর চিহ্নমাত্র মিলে না। তাঁর কৃষ্ণের পূর্বরাগের অধিকাংশ পদই ব্রজবুলি ভাষায় লেখা। কিন্তু রাধার অধিকাংশ পদ বাংলা ভাষায় লেখা।

জ্ঞানদাস বিশেষ সাফল্য অর্জন করেছেন অনুরাগের পদে। একবার মিলনের স্বাদ পেয়ে রাধা আর কৃষ্ণকে ছেড়ে দিতে রাজি নয়। তাঁকে বুক চিরে সেখানে প্রাণ সেখানে ধরে রাখতে চায়- এই হলো অনুরাগের আকুলতা। এই অনুরাগেই সর্ব ইন্দ্রিয় দিয়ে রাধাকৃষ্ণ প্রেমের আস্বাদন করতে ব্যাকুল হয়ে বলতে পারে,

‘রূপ লাগি আঁখি ঝুরে গুণে মন ভোর।

প্রতি অঙ্গ লাগি কান্দে প্রতি অঙ্গ মোর ৷৷

হিয়ার পরশ লাগি হিয়া মোর কান্দে।

পরাণ-পিরীতি লাগি থির নাহি বান্ধে ৷৷ (পদ-৬১)

এ প্রেম রাধাকে আত্মরসে থাকতে দেয় না। জ্ঞানদাসের মত গোবিন্দদাসও তাঁর অনুরাগের পদে প্রেমিকা সম্বিতহারা রূপ চমৎকার ভাবব্যঞ্জনায় ফুটিয়ে তুলেছেন।

জ্ঞানদাসের কবিত্বের শ্রেষ্ঠ নিদর্শন আলোচনা করতে গেলে তাঁর আক্ষেপানুরাগ বিষয়ক পদের কথা উল্লেখ করতে হয়। তাঁর পদে উচ্চতর হাহাকার অপেক্ষা অভাগা কন্ঠের অশ্রুসিক্ত আক্ষেপ ও আত্মধিক্কারই মুখ্য হয়েছে। রাধার অভিযোগ কেবল কৃষ্ণের প্রতিই সীমাবদ্ধ নয়।

‘সুখের লাগিয়া এ ঘর বাঁধিনু

অনলে পুড়িয়া গেল।

অমিয়-সাগরে সিনান করিতে

সকলি গরল ভেলা ৷৷’ (পদ-১২৪)

অন্যদিকে, আক্ষেপানুরাগের পদে গোবিন্দদাসের সার্থকতা নেই।

গোবিন্দদাস যখনই রূপকল্প ব্যবহার করেছেন তখনই উপমা বা চিত্র নির্মাণে অলঙ্কারের সাহায্য নিয়েছেন। তিনি যেসব রূপচিত্র অঙ্কন করেছেন তাতে অলঙ্কারসিদ্ধ চিত্রের সাথে যুক্ত হয়েছে সংগীতাশ্রিত ভাব হিল্লোল। গোবিন্দদাস অভিসারিকা রাধার সম্মুখে পরিব্যাপ্ত বিশ্বপ্রকৃতির যে চিত্র অঙ্কন করেছেন তা জাদুমন্ত্র, ধ্বনিগুণ, ভাবগৌরবে মিলেমিশে এক অনির্বচনীয় স্তরে উত্তীর্ণ হয়েছে-

‘মন্দির বাহির কঠিন কপাট।

চলইতে শঙ্কিল পঙ্কিল বাট ৷৷ (পদ-১৪৮)

পক্ষান্তরে, জ্ঞানদাসের রূপকল্প স্বভাবিত। জ্ঞানদাসের পদ বিচার করলে দেখা যায় রূপ সৃষ্টিতে তিনি কত স্বতন্ত্র, কত স্বভাবিত-

‘দেখে এলাম তারে সই দেখে এলাম তারে।

এক অঙ্গে এত রূপ নয়নে না ধরে ৷৷’

জ্ঞানদাসের বেদনায় গভীরতা নেই, বেদনাকেও তিনি সুমিষ্ট করে প্রকাশ করেছেন। তিনি আনন্দের কবি নন, মাধুর্যের কবি। এই কারণে মাথুরের দীর্ঘ বিরহ ও তাঁর রাধার কণ্ঠে অতি উচ্চ ও তীব্র আর্তনাদে জাগাতে পারেনি। দুঃখবাদী কবি জ্ঞানদাসের চিরন্তন দুঃখ। মিলনেও দুঃখের বেদনা। অপরপক্ষে, গোবিন্দদাসের প্রধান সুরই উল্লাসের বা প্রচণ্ডতার; তাই তিনি উল্লাসের কবি।

জ্ঞানদাস ও গোবিন্দদাস- তাঁদের দৃষ্টিভঙ্গির পার্থক্য অনেকখানি। গোবিন্দদাস রাধাকৃষ্ণের যে রূপ গঠন করেছেন, তাতে ‘আমিত্ব’ নেই। কিন্তু জ্ঞানদাস ‘আমিত্ব’ বর্জিত রূপ গঠনের দিকেই যাননি। তাঁর রূপদর্শন মানেই স্বরূপ দর্শন। সমালোচকের ভাষায়,

“গোবিন্দদাসের নিকট রূপদর্শন যা, রূপ নির্মাণও তাই। তিনি দেখিলেন ও গড়িলেন- সর্বাবয়ব নিখুঁত মূর্তি। জ্ঞানদাসের দর্শনে ও নির্মাণে প্রভেদ আছে। তিনি যাহা দেখেন তাহাই আঁকিতে পারেন না। কাব্যের মধ্যে দর্শনজাত আত্মস্মৃতির ছাপটুকু থাকে। ফলে সেখানে রূপ ও স্বরূপ তন্ময় ও মন্ময়তার মেলামেশি।”

জ্ঞানদাস ও গোবিন্দদাসের কবি প্রতিভার বৈশিষ্ট্য আলোচনার সমাপ্তিতে বলা যায়, তাঁরা দু’জনেই মধ্যযুগের কবি হওয়া সত্ত্বেও প্রথমজন রোমান্টিকতা ও প্রেমে এবং দ্বিতীয়জন রূপ দক্ষতায় একালের পাঠকদের কাছেও প্রিয়। গোবিন্দদাসের ‘হীরক কাঠিন্য’ আর জ্ঞানদাসের ‘লাবণ্য গভীরতা’- তাঁদের দু’জনের রচনাকেই গৌরবের আসনে স্থান দিয়েছে।