প্রশ্নঃ জ্ঞানদাসের সংক্ষিপ্ত পরিচয় দাও।

উত্তরঃ বৈষ্ণব সাহিত্য বাঙালির প্রাণের সাহিত্য। মধ্যযুগের এ সাহিত্য বিষয় ও শিল্পগুণে যুগের সীমা অতিক্রম করে আজও আমাদের কাছে নন্দিত। রাধাকৃষ্ণের প্রেম বিষয়ক পদাবলী এদেশের হিন্দু-মুসলিম রসিকজনের প্রাণের খোরাক। এ বিষয়ে হিন্দু- মুসলমান শত শত কবির নামের মধ্যে – চণ্ডীদাস, বিদ্যাপতি, জ্ঞানদাস ও গোবিন্দদাস- এ চার কবিই শ্রেষ্ঠ। জ্ঞানদাস চৈতন্য পরবর্তী কবি। যিনি চণ্ডীদাসের ভাবশিষ্য। জ্ঞানদাসের মত প্রথম শ্রেণীর কবি সব যুগেই দুর্লভ। কিন্তু তার জীবনকথা সম্পর্কে নির্ভরযোগ্য বিশেষ কোন তথ্য পাওয়া যায় না। নিত্যানন্দের ভক্তদের তালিকায় তার নাম আছে। তিনি নিত্যানন্দের কনিষ্ঠা পত্নী এবং বৈষ্ণব সমাজের নেতৃস্থানীয়া জাহ্নবী দেবীর মন্ত্রশিষ্য ছিলেন।

কাটোয়ার দশ মাইল পশ্চিমে কাঁদড়া গ্রামে ব্রাহ্মণ বংশে তার জন্ম। তিনি সম্ভবত ষোল শতকে বর্তমান ছিলেন এবং নিত্যানন্দকে প্রত্যক্ষ করেছেন। তার নিত্যানন্দ বিষয়ক পদে প্রত্যক্ষ পরিচয়ের স্পর্শ রয়েছে। খেতুরীতে অনুষ্ঠিত বৈষ্ণব সম্মেলনে তিনি উপস্থিত ছিলেন।

জ্ঞানদাস ভণিতাযুক্ত প্রায় চারশ পদ প্রচলিত। ‘যশোদার বাৎসল্যলীলা’ শীর্ষক পুঁথিতে জ্ঞানদাস ভণিতাযুক্ত কুড়িটি পদ আছে। এ পদগুলোর রচয়িতা হিসেবে কেউ কেউ দ্বিতীয় জ্ঞানদাসের কথা বলেন, কিন্তু এ বিষয়ে নির্ভরযোগ্য কোন তথ্য না থাকায় একজন জ্ঞানদাসকেই সবাই স্বীকার করে।

ব্রজবুলি ও বাংলা উভয় ভাষাতেই জ্ঞানদাস পদ লিখলেও তার বাংলা পদগুলোই উৎকৃষ্ট। তার যা কিছু প্রতিভা, কবিকৃতি ও গৌরব, তা বাংলা পদের জন্যই। ব্রজবুলিতে তিনি বিদ্যাপতিকে এবং বাংলা পদ রচনায় চণ্ডীদাসকে অনুকরণ-অনুসরণ করেছেন। তিনি যখন কৃত্রিম কবি সংস্কার ত্যাগ করে সরলভাবে গীত রচনা করেছেন, তখনই তা পাঠককে অভিভূত করেছে। শ্রেষ্ঠ কবিতার ধর্ম সারল্য ও আন্তরিকতা তাঁর বাংলা পদে রয়েছে। এজন্য কোন কোন সময় চণ্ডীদাসের পদের সাথে তাঁর পদ মিলে মিশে গেছে। ভণিতা তুলে দিলে দিব্যি চণ্ডীদাসের পদ বলে মনে হয়। অবশ্য চণ্ডীদাস যেমন ইন্দ্রিয়াতীত ও সূক্ষ্ম চেতনার ইঙ্গিত দিয়েছেন জ্ঞানদাস অনুভূতি মার্গে ততটা ঊর্ধ্বচারী হতে পারেন নি। জ্ঞানদাসের দু-একটি বাৎসল্য রসের পদ চমৎকার। তার দানখণ্ড, নৌকাখণ্ড, রসোদগার প্রভৃতি পর্যায়ের কয়েকটি পদ বৈষ্ণব সাহিত্যে অতুলনীয়।

১. রূপলাগি আঁখি ঝুরে গুণে মন ভোর।

প্রতি অঙ্গ লাগি কান্দে প্রতি অঙ্গ মোর।৷ 

হিয়ার পরশ লাগি হিয়া মোর কান্দে। 

পরাণ পিরীতি লাগি থির নাহি বান্ধে॥

২. তোমার গরবে গরবিনী হাম রূপসী তোমার রূপে।

হেন মনে লয় ও দুটি চরণ সদা লয়্যা রাখি বুকে॥ 

৩. রূপের পাথারে আঁখি ডুবিয়া রহিল।

যৌবনের বনে মন হারাইল॥

জ্ঞানদাস চণ্ডীদাসের কত বড় ভাবশিষ্য যে একটি অতি পরিচিত পদ উভয়ের ভণিতাতেই মেলে-

সুখের লাগিয়া                 এ ঘর বাঁধিনু

আনলে পুড়িয়া গেল।

অমিয়-সাগরে             সিনান করিতে

সকলি গরল ভেল৷

চণ্ডীদাস ও জ্ঞানদাসের মধ্যে নিবিড় সাদৃশ্য থাকলেও জ্ঞানদাস শিল্পী, চণ্ডীদাস সাধক। জ্ঞানদাসে বেদনা থাকলেও তার মিলনে উৎফুল্লতা রয়েছে। তিনি কৃষ্ণের রূপ বর্ণনা করছেন-

১. “দেইখ্যা আইলাম তারে

সই দেইখ্যা আইলাম তারে।

একই অঙ্গে এত রূপ নয়নে না ধরে।”

২. কালিয়া বরণখানি চন্দনেতে মাখা

আমা হৈতে জাতিকুল নাহি গেল রাখা। 

মোহন মুরলী হাতে কদম্ব হিলন

দেখিয়া শ্যামের রূপ হইলাম অচেতন। 

দেখিতে যে সুখ উঠে কি বলিব তা

দরশ পরশ লাগি আউলাইছে গা।

রূপবর্ণনা, অতৃপ্ত প্রণয়াকাঙ্ক্ষার তীব্র জ্বালা, ব্যাকুলতা, মিলনের উল্লাস, বিরহের আর্তি ইত্যাদি বিষয়ক পদে জ্ঞানদাসের কবিকীর্তি উপচে পড়েছে। জ্ঞানদাসের রাধা বিরহকাতরা-

১. অতি দুরবল দেহ ধরন না যায়।

ক্ষিতি তলে পড়ি সহচর মুখ চায়।

চণ্ডীদাসে আছে ভাবের গভীরতা কিন্তু জ্ঞানদাস ভাবকে অধিকতর সুন্দর করে প্রকাশ করেছেন। জ্ঞানদাসের রাধার বেদনা আছে কিন্তু মিলনের ব্যাকুলতায় সুরসিকা নায়িকা।

রূপানুরাগঃ 

কি রূপ হেরিনু কালিন্দীকূলে।

অপরূপ মেঘ কদম্বমূলে ৷

যথা মেঘ না তথা বহে বারি॥ 

মোর মনে হয় বিজুরী হইয়া।

রহি জড়াইয়া ও মেঘে যাইয়া॥

রাধারূপঃ

১. কমল-বয়ান কনক কাঁতি

মুকুতা-নিকর দশন-পাঁতি

নাসা তিল মৃদু কুসুম তুল। 

কাজরে মাজল দিঠি দুকূল

চলিল হরিণ-নয়নী রাই। 

ত্রিভুবন জিনি উপমা নাই। 

২. উচু কুচযুগ কনকগিরি।

হিয়ার মাঝারে মাণিক ছিরি॥ 

পবন তরল বসন মেলি। 

দামিনী বেঢ়ল চাঁদনি বেলি॥ 

অনুরাগঃ

কিবা রূপে কিবা গুণে মোর মন বান্ধে,

মুখেতে না সরে বাণী, দুটি আঁখি কান্দে। 

মনের মরম কথা, সুন গো সজনি, 

শ্যাম বন্ধু পড়ে মনে দিবস রজনী। 

কোন বিহি সিরজিল কুলবতী বালা, 

কেবা নাহি করে প্রেম, কার এত জ্বালা?

আক্ষেপঃ 

সুখের লাগিয়া     এ ঘর বাঁধিনু

অনলে পুড়িয়া গেল।

সাগর শুকাল মানিক লুকাল

অভাগীর করম দোষে।

মূলত চৈতন্য-উত্তর কবিদের মধ্যে গোবিন্দদাস ব্যতীত জ্ঞানদাসের সমকক্ষ কোন পদকর্তা নেই।