চণ্ডীদাসের সঙ্গে জ্ঞানদাসের কিছু কিছু আপাতসাদৃশ্য লক্ষ্য করে উভয়ের মধ্যে তুলনা ও প্রতিতুলনা করবার একটা প্রবণতা সমালোচকদের মধ্যে অতিশয় প্রবল। উভয়েই বাঙালি কবি এবং দুজনই বাংলা ভাষায় পদ রচনা করেছেন, অবশ্য জ্ঞানদাস ব্রজবুলি ভাষাতেও অনেক পদ লিখেছেন, সেগুলি খুব উল্লেখযোগ্য নয়। দৃষ্টিভঙ্গির বিচারে চণ্ডীদাস ও জ্ঞানদাসকে একগোত্রের কবি বলে মনে করা হয় এই কারণেই উভয়ের মধ্যে তুলনার প্রশ্ন আসে।
জ্ঞানদাসকে সাধারণভাবে চণ্ডীদাসের ভাবশিষ্য বলে অভিহিত করা হয়। এই প্রসঙ্গে চণ্ডীদাসের সঙ্গে জ্ঞানদাসের রচনার সাদৃশ্য এবং বৈসাদৃশ্য সম্বন্ধে আলোচনা করলেই পূর্বোক্ত অভিমতটির যাথার্থ্য বিচারিত হবে।
চণ্ডীদাস প্রধানত ভাবের কবি, জ্ঞানদাসও তাই। অবশ্য বৈষ্ণব কবিদের সকলেই অল্পবিস্তর ভাবলোকেরই কবি, কিন্তু তাদের মধ্যে গভীরতায় চণ্ডীদাস শ্রেষ্ঠ এবং তারপরই জ্ঞানদাসের স্থান। রাধাকৃষ্ণের প্রেমলীলা আম্বাদনে চণ্ডীদাস এবং জ্ঞানদাস উভয়ই সমপর্যায়ভুক্ত, কিন্তু চণ্ডীদাস সেই লীলার সঙ্গে যেমন একাত্মতাবোধ করেছেন, জ্ঞানদাসে সেই তন্ময়তাবোধ নেই। সম্ভবত চণ্ডীদাস চৈতনা-পূর্ব কিংবা চৈতনা-সমকালীন বলেই চৈতন্য-প্রবর্তিত ভাবধারায় প্রভাবিত হন নি, তাই এই একাত্মতাবোধ পক্ষান্তরে গৌড়ীয় বৈষ্ণব ধর্মে দীক্ষিত জ্ঞানদাসের পক্ষে মঞ্জরিভাবের অধিক ভাবনা সম্ভবপর ছিল না, তাই তাঁর আত্মবিলোপ ঘটেনি। মনে হয়, তিনি যেন একটু দূর থেকে লীলারস আস্বাদন করেই পরম পরিতৃপ্তি লাভ করেছেন, চণ্ডীদাসের মতো ভিতরে প্রবেশ করে এক হয়ে যেতে পারেন নি। চণ্ডীদাস যেমন যথাসর্বস্ব সমর্পণ করে আপনহারা হয়ে বসেছেন, জ্ঞানদাস তেমনভাবে আত্মবিসর্জন দিতে পারেননি। বরং বলা চলে, জ্ঞানদাস আপন স্বাতন্ত্র বজায় রেখেই রাধাকৃষ্ণের লীলাকে আপন অস্তরে অনুভব করছিলেন, আর চণ্ডীদাস আপন সত্তা বিসর্জন দিয়ে রাধাকৃষ্ণের লীলার মধ্যে মিশে গিয়েছিলেন। লীলা আস্বাদনে চণ্ডীদাস চেতনা হারিয়েছিলেন বলেই তার রচনায় বহিরঙ্গের প্রতি পরিপূর্ণ ঔদাসীন্য প্রকাশ পেয়েছে; পক্ষান্তরে জ্ঞানদাসের রচনায় মণ্ডননৈপুণ্য উপেক্ষণীয়। যেমন, সংসার জীবনে রাধার অবস্থা বর্ণনা করতে গিয়ে চণ্ডীদাস লিখেছেন—
‘অনুক্ষণ গৃহে মোরে গঞ্জয়ে সকলে।
নিচয় জানিও মুঞি ভখিমু গরলে।।
………………………………..
বঁধু যদি তুমি মোরে নিদারুণ হও।
মরিব তোমার আগে দাঁড়াইয়া রও।’
রাধার এই উক্তিতে কৃষ্ণের প্রতি কোনো অনুযোগ নেই, শুধু অন্তরের নিদারুণ আক্ষেপই এখানে ব্যক্ত হচ্ছে। অনুরূপ ক্ষেত্রে জ্ঞানদাস লিখেছেন—
‘শাশুড়ি ননদী কথা শুনিতে না পারি।
তোমার নিষ্ঠুরপনা সোঙরি মরি।।
চোরের রমণী যেন ফুকারিতে নারে।
এমতি রহয়ে পাড়াপড়শীর ভরে।।
এখানে শ্রীমতী যে শুধু কৃষ্ণের প্রতি অনুযোগই বর্ষণ করেছেন, তা নয়, তিনি নিখিল বেদনাকেও আপনার করে নিতে পারলেন না।
চণ্ডীদাস ও জ্ঞানদাসের দৃষ্টিভঙ্গির পার্থক্যটুকু এখানেই সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে। জ্ঞানদাস রচনার কারুকৃতি সম্বন্ধে সজাগ থেকে তুলিকায় রং লাগিয়ে চিত্র অঙ্কন করেছেন। এই চিত্র বিদ্যাপতি বা গোবিন্দদাসের মতো বর্ণাঢ্য না হলেও চণ্ডীদাসের মতো নিরাভরণ নয়। জ্ঞানদাস সচেতনভাবে শিল্পসৃষ্টির দিকে লক্ষ্য রেখেছিলেন বলেই বহিরঙ্গের বিচারে তিনি চণ্ডীদাসকে অতিক্রম করে গেছেন।
চণ্ডীদাস যত বড়ো রূপদ্রষ্টা ছিলেন, তত বড়ো রূপস্রষ্টা ছিলেন না। তাই শিল্পময় প্রকাশভঙ্গীর বিচারে তার দুর্বলতা সহজেই চোখে পড়ে। তার ভাষা সহজ, সরল এবং অনলঙ্কৃত, ঝঙ্কার উঠেছে শুধু প্রাণের বেদনায়। পক্ষান্তরে জ্ঞানদাসের কাব্যের একপ্রান্তে ভাব-বিহ্বলতা বিরাজ করলেও অপর প্রান্তে ছন্দমাধুর্যও ধ্বনিত হয়ে উঠেছে। তার রচনায় চণ্ডীদাসের আত্মহারা ব্যাকুলতা যেমন নেই, তেমনি নেই বিদ্যাপতি গোবিন্দদাসের বিপুল বর্ণচ্ছটা। বস্তুত তিনি দুই মেরুপ্রাস্তের মাঝামাঝি স্থানে অবস্থান করছেন। “চণ্ডীদাসের রসহিল্লোল জ্ঞানদাসে নাই, গোবিন্দদাসের হীরককাঠিন্যও তাহাতে পরিদৃষ্ট হয় না, কিন্তু লাবণ্যকে অনায়াসবন্ধনে বাঁধিয়া অতি চমৎকার মণিহার রচনার গৌরব তাহার প্রাপ্য।” একটু বিশেষভাবে লক্ষ্য করলেই বোঝা যাবে যে, রাধাকৃষ্ণের লীলাকাহিনী প্রতিটি বৈষ্ণব কবির হৃদয়েই প্রাণবেদনার সৃষ্টি করেছে, কিন্তু তার প্রকাশের ভাষা এক-একজন এক-একভাবে গ্রহণ করেছেন। ভাবের দিক থেকে চণ্ডীদাসের সঙ্গে জ্ঞানদাসের সাধর্ম থাকলেও রূপের দিক থেকে জ্ঞানদাস বরং বিদ্যাপতি-গোবিন্দদাসের সগোত্র। ‘চণ্ডীদাস গভীরতম প্রাণবেদনার গীতিকার আর বিদ্যাপতি, গোবিন্দদাস, জ্ঞানদাস ঐ একই প্রাণবেদনার সার্থক চিত্রকর।” ভাবের দিক থেকে চণ্ডীদাস ও জ্ঞানদাসের মধ্যে গভীর ঐক্যবোধ বর্তমান বলেই জ্ঞানদাসের রচিত কোনো পদ চণ্ডীদাসের নামে প্রচার লাভ করেছে। সনিষ্ঠ পাঠক কিন্তু এই ঐক্যবোধের মধ্যেও চণ্ডীদাস ও জ্ঞানদাসের স্বাতন্ত্র্যটুকু উপলব্ধি করে নিতে পারেন। চণ্ডীদাসের রাধা একান্তভাবেই কৃষ্ণসমর্পিতপ্রাণা, খণ্ডিতার পদেও শুধু নিজের অস্তরে দগ্ধ হচ্ছেন, তার অস্তরসত্তা কখনো বিদ্রোহী হয়ে ওঠেনি। চণ্ডীদাসের রাধা বলেন—
‘সই কেমনে ধরিব হিয়া।
আমার বধুয়া আন বাড়ি যায়, আমারি আঙিনা দিয়া।।
সে বঁধু কালিয়া না চায় ফিরিয়া, এমতি করিল কে?
আমার পরাণ যেমন করিছে, তেমতি হউক সে।।’
কিন্তু জ্ঞানদাসের রাধা এত সহনশীলা নন। তাঁর খণ্ডিতা রূপের মধ্যেও একটা বিদ্রোহভাষণ রয়েছে। তাই তিনি এমন উক্তি করতে পারেন, যা চণ্ডীদাসের রাধার পক্ষে কখনো সম্ভবপর নয়। জ্ঞানদাসের রাধা বলেন—
‘সই কত রাখিব হিয়া।
আমার বঁধুয়া আন বাড়ি যায়, আমার আঙ্গিনা দিয়া।।
যেদিন দেখিব আপন নয়নে, আন জন সঞে কথা।
কেশ ছিঁড়ি ফেলি বেশ দূর করি, ভাঙিব আপন মাথা।।’
চণ্ডীদাস ও জ্ঞানদাসের সাধর্মা ও পার্থক্য বিচার করে জনৈক বিদগ্ধ সমালোচক লিখেছেন, “স্বকীয় উপলব্ধির ব্যাপারে চণ্ডীদাস ও জ্ঞানদাস তুলনীয়। মৃণ্ময়তা উভয় কবিরই ছিল এবং ব্যক্তিগত হৃদয়োত্তাপ তাঁহারা কাব্যে সঞ্চারিত করিতে পারিতেন। তথাপি চণ্ডীদাস ও জ্ঞানদাসের মধ্যে ক্ষেত্র বিশেষে একটা সূক্ষ্ম পার্থক্য আছে। সে পার্থক্য কাব্যের পরিণতির ব্যাপারে। উভয় কবি একই ভাবে আরম্ভ করেন কিন্তু চণ্ডীদাস তাঁহার কাব্যের সমাপ্তিতে ব্যক্তিগত অনুভূতিকে এমনই নির্বিশেষ করিয়া ফেলেন যে, শেষ পর্যন্ত তাহার কাব্যরূপ অনেকাংশে শিথিলতা পায়। ….চণ্ডীদাসের কাব্যের বিচ্ছিন্ন পক্তি রূপের ক্ষণিক চাঞ্চল্যমাত্র সৃষ্টি করিয়া একাকারের ভাবপ্লাবনে আত্মহারা হইয়া যায়। শেষ পর্যন্ত তিনি মিষ্টিক… জ্ঞানদাসের কাব্য মিষ্টিক হইয়া পড়ে নাই। তাঁহার কাব্যের একটি মূল ধর্ম আমার মনে হয়— রোম্যান্টিকতা রোম্যান্টিক রহস্যময়তায় জ্ঞানদাসের কাব্য পূর্ণ। রহস্যময়তাটুকু তাহার নিজস্ব সম্পদ, অন্যান্য বৈষ্ণব পদকর্তার কবিধর্মের সঙ্গে জ্ঞানদাসের পার্থক্য এইখানে।”
Leave a comment