শুধু কবিতা কেন, যে কোনো সাহিত্যবস্তুর নামকরণের মধ্যেই নিহিত থাকে সাহিত্যিকের অভিপ্রেত বার্তাটি। সেদিক থেকে সাহিত্যের নামকরণের বিশ্লেষণ সাহিত্যবস্তুর মর্ম বা তাৎপর্যটিকে বুঝে নিতেই সাহায্য করে। জীবনানন্দ বিংশ শতাব্দীর রবীন্দ্র-উত্তর যুগপর্বের জটিলতম ও দুর্বোধ্যতম কবি। যুদ্ধোত্তর জটিল সময় ও সভ্যতার অমানবিক রূপ সংবেদনশীল কবি মনে যে-সব প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করেছে, তার অভিব্যক্তিগুলি ধরা আছে জীবনানন্দের কবিতায়। কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রে জীবনানন্দের বক্তব্য ঠিক স্পষ্টভাবে ধরা পড়ে না পাঠকের বোধে। প্রায়শই যেন দুর্বোধ্য মনে হয় কিংবা রহস্যের আলোছায়ায় অর্থহীন বলে বোধ হয়। তাঁর ‘আট বছর আগের একদিন’, ‘বনলতা সেন’ ইত্যাদি কবিতার মতো ‘সুচেতনা’ কবিতাটি ততোখানি দুর্বোধ্য বা রহস্যময় না হলেও আলোচ্য কবিতাটির মর্মকথা নিয়েও পাঠক মহলে বিভ্রান্তি ও বিতর্ক আছে।
কবিতার নাম ‘সুচেতনা’। কবিতাটি জীবনানন্দের ‘বনলতা সেন’ কাব্যগ্রন্থের অন্তর্গত। কবিতাটি বহু পাঠকের কাছেই একটি অনবদ্য প্রেমের কবিতা। ‘সুচেতনা’ কবির এক মানসী প্রতিমা, এক প্রেমময়ী নারী। জীবনানন্দের ‘বনলতা সেন’ কবিতায় এই প্রেম ও কল্যাণের আশ্বাসময়ী নারীই নাটোরের বনলতা সেন নামে চিহ্নিত। চারিদিকে সফেন জীবনের সমুদ্র, ঝঞ্ঝা, হাজার বছর পথ হাঁটার ক্লান্তি, হালভাঙা নাবিকের বিভ্রান্তি ও অসহায়তার মাঝখানে আত্মার শান্ত নির্জনতায় ‘মুখোমুখি বসিবার’ এবং এক নিরাপদ শাস্ত আশ্রয়ের আশ্বাসের প্রতীক হিসাবে এসেছে ‘বনলতা সেন’। আক্ষরিক অর্থে নামপদটিকে বিশ্লেষণের কোনো প্রয়োজন ও প্রাসঙ্গিকতাই হয়তো সেই ‘বনলতা সেন’ কবিতাটিতে।
‘সুচেতনা’ কবিতাটিকেও ‘বনলতা সেন’-এর মতোই প্রেমের কবিতা হিসাবে গ্রহণ করা চলে। কেননা এখানেও ‘রণ রক্ত সফলতা’-য় সারা পৃথিবীতে শান্তি, কল্যাণ ও মানবতাসন্ধানী কবি সুচেতনাকে দেখেছেন এক ‘দূরতর দ্বীপ’-এর প্রতীকে। ‘বিকেলের নক্ষত্র’ এবং ‘দূরতম দ্বীপ’-এর মধ্যবর্তী দূরত্ব যতই অনতিক্রম্য হোক, কবি নিশ্চয় জানেন সেই দ্বীপে দারুচিনি-বনানীর ফাঁকে রয়েছে ‘বনলতা সেন’ কবিতার মতোই মুখোমুখি বসিবার ‘নির্জনতা’।
‘সুচেতনা’ যদি প্রেমের কবিতা হয় এবং সুচেতনা যদি কবির স্বপ্নময়ী প্রেমপ্রতিমা হয়, তাহলে এই কবিতার নামটিও সেই নায়িকার নামচিহ্নেই সার্থক। ‘বনলতা সেন’ কবিতার নামকরণ যে ব্যঞ্জনায় সার্থক, ‘সুচেতনা’ কবিতার নামকরণের সার্থকতাও তারই সমতুল্য। কিন্তু আমরা দেখেছি, প্রথম স্তবক থেকেই ‘সুচেতনা’ কবিতা প্রেমানুভূতিকে অতিক্রম করে অনেক বেশি করে বলেছে যুগজীবনের কথা এবং কাঙ্ক্ষিত মানবিক চেতনার কথা। অতএব কবিতাটি কালচেতনার একটি বিবৃতি হলে ‘সুচেতনা’ কবিতার নামকরণের গভীরতর বিশ্লেষণ প্রয়োজন হয়ে পড়ে।
যুদ্ধোত্তর পৃথিবীতে সভ্যতার মুখোশাবৃত হিংস্রতার মূর্তি প্রকাশিত হয়ে গেছে। সভ্যতার প্রচ্ছদ খসে গিয়ে বেরিয়ে পড়েছে পাশবিক নগ্নমূর্তি। বাহাত সভ্যতা বাহা সম্পদের জৌলুষ বাড়িয়ে চললেও মানুষের কল্যাণ ও মানবতার সাধনপথ থেকে সে বিচ্যুত। পৃথিবীর রণ-রক্ত-সফলতা আদিমতম যুগ থেকে আজও পর্যন্ত মানব সভ্যতাকে অগ্রসর করলেও বাহ্যত সেই বিকাশকে ‘শেষ সত্য’ বলে জীবনানন্দ স্বীকার করেননি। কলকাতা নগরীও এই বাহ্যসম্পদের সাধনায় একদিন ‘তিলোত্তমা’ হয়ে উঠবে হয়ত। কিন্তু কবির কাছে মানবসভ্যতার ক্রমাগ্রসরমানতার একটিমাত্র লক্ষ্যই প্রার্থিত বলে মনে হয়, তা হলে মানবিক চেতনার, শুভবোধের, কল্যাণবাসনার যথার্থ বিকাশ। তাই সভ্যতার যাবতীয় জৌলুষ ও ঢক্কানিনাদের মধ্যেও কবির হৃদয় সমর্পিত থাকে সেই দূরতর সু-চেতনার প্রতি।
যখন ইতিহাসের পথ অতিক্রম করে কবি দেখতে পান আত্মীয়-পরিজনের রক্তে তাঁর হাত রক্তাক্ত হয়েছে, হৃদয় ও মস্তিষ্কে বাসা বেঁধেছে ঈর্ষা ও হিংসার কীট, যখন কবি আবিষ্কার করেন ‘পৃথিবীর গভীর গভীরতর অসুখ”, তখন সেই লক্ষ্যচ্যুত বিভ্রান্ত নৈরাশ্য ও বিষণ্ণতাপীড়িত হৃদয় কবি সমর্পণ করতে চান সেই শুভ চেতনারই কাছে। কেননা মানুষের প্রতি ভালোবাসা, পৃথিবীর প্রতি প্রেম, সু-চেতনার প্রতি আস্থায় কবির বিশ্বাস অটুট।
আধুনিক সভ্যতার বণিকমন কেবল মুনাফা খোঁজে। মানুষের জন্য সম্পদবিকাশের বাণিজ্যে অংশ নিয়ে এই বণিকমন আসলে পণ্য করেছে মানুষকেই। কবি অনুভব করেন, মানব বন্দরে উপনীত জাহাজের পণ্যগুলি আসলে ‘অগণন মানুষের শব।’ কিন্তু তাহলে কি মানুষের সভ্যতা বিকাশের এইসব সক্রিয়তা মিথ্যা। আদিতম যুগ থেকে এ পর্যন্ত মানুষের যাবতীয় প্রয়াস ও আত্মদান কি সমস্তটাই ব্যর্থ? সে রকমও মনে করেন না জীবনানন্দ। পূর্ব পূর্ব যুগে বুদ্ধ-কনফুশিয়াসের মতো যাঁরা মানুষকে কল্যাণের পথে নিয়ে যেতে চেয়েছেন, তাঁদের সেই কল্যাণপথ থেকে মানুষের সরে যাওয়াটাই তাঁর কাছে এই অগ্রগতির প্রধান ভ্রান্তি। আধুনিক যুগ সেই বুদ্ধ, কনফুশিয়াসদের মিথ্যা এবং মূক করে দিয়ে শক্তির ঔদ্ধত্যে উচ্চকণ্ঠ হয়েছে। কবির মতো সংবেদনশীল প্রাণগুলিও তাই আজ স্তম্ভিত, নির্বাক। তবু পৃথিবীর কাজের আহ্বান কবি ভোলেন না, অস্বীকার করেন না। কেননা এই কল্যাণ চেতনার আলো জ্বেলেই অবিশ্রাম প্রয়াসের পথেই ‘পৃথিবীর ক্রমমুক্তি হবে’ বলে কবির বিশ্বাস।
কিন্তু কবি একথাও স্বীকার করেন, সেই কল্যাণরাষ্ট্র পৃথিবীতে প্রতিষ্ঠিত হতে আজও বহু দেরি। পণ্য সভ্যতার হাতে সে পৃথিবী তুলে দিতে আরো বহু মনীষীর প্রয়াস প্রয়োজন এবং সেই শুভ প্রভাত আজও সুদূর পরাহত।
তবু সেই প্রভাত একদিন আসবে, কবির এই বিশ্বাস অবিচল। পৃথিবীর প্রতি ভালোবাসাও অটুট। কেননা পৃথিবীর অভিজ্ঞতা মানবজীবনের এক অমূল্য প্রাপ্তি। তাই যে রণক্লান্ত পথ দিয়ে বিষণ্ণচিত্তে কবি যাত্রা করছে এই সময়ে, সেই অভিজ্ঞতাও কবির কাছে মূল্যবান। এই যন্ত্রণার অভিজ্ঞতাই যন্ত্রণামুক্তির পথ দেখাবে, শুভ চেতনার অভাবই মানবমনের তীব্র আকাঙ্ক্ষার জন্ম দেবে সু-চেতনাকে গ্রহণ করার। আর এই মানবচেতনার এই কল্যাণবোধের প্রতি দৃঢ় আস্থার নিরিখেই সমগ্র কবিতাটির ‘সুচেতনা’ নামকরণ সার্থক।
Leave a comment