জিয়াউদ্দিন বারাণী (১২৮৫-১৩৫৯ খ্রিঃ):

তুর্কি-আফগান যুগে ভারতীয় ইতিহাসের নির্ভরযোগ্য ইতিহাস হিসেবে জিয়াউদ্দিন বারাণীর রচনাবলি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। ইতিহাসের উপাদানে সমৃদ্ধ তাঁর দুটি গুরুত্বপূর্ণ রচনা হল ‘তারিখ ই-ফিরোজশাহি’ (১৩৫৮ খ্রিঃ) এবং ‘ফতোয়া-ই-জাহান্দারি। বারাণীর পিতামহ ছিলেন সুলতান বলবনের প্রিয়পাত্র। তাঁর পিতা ছিলেন আলাউদ্দিন খলজির পুত্র আরকলি খানের বিশ্বস্ত ব্যক্তি। ফলে বাল্যকাল থেকেই তুর্কি অভিজাতদের সান্নিধ্যে থাকার সুযোগ তাঁর ছিল। তাই বারাণীর রাষ্ট্রতত্ত্বে অভিজাততন্ত্রের প্রতি দুর্বলতা বারবার প্রকাশ পেয়েছে। বারাণী স্বয়ং টানা সতেরো বছর ছিলেন মহম্মদ-বিন-তুঘলকের সভাসদ। উচ্চ রাজপদে থাকার ফলে সমকালীন রাজনৈতিক ঘটনাবলি সম্পর্কে তিনি প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা অর্জনের সুযোগ পেয়েছিলেন। বারাণীর রচনায় এই অভিজ্ঞতার প্রকাশ দেখা যায়। দুর্ভাগ্যবশত মহম্মদ-বিন-তুঘলকের মৃত্যুর পর তিনি ভুলপথে রাজকীয় অন্তর্দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়েন। ষড়যন্ত্রকারী খাজা জাহানের পক্ষ সমর্থন করে বারাণী ফিরোজ শাহ তুঘলকের বিরাগভাজন হন। ফিরোজ সিংহাসনে আরোহণ করেই বারাণীকে আভিজাত্যের মর্যাদা থেকে বহিষ্কৃত করেন। এই সময় তিনি রচনা করেন বিখ্যাত ‘তারিখ-ই-ফিরোজশাহি’ গ্রন্থ। এতে বারাণী গিয়াসউদ্দিন বলবন থেকে ফিরোজ শাহের প্রথম ছয় বছরের অর্থাৎ মোট আট জন সুলতানের প্রায় একশো বছরের ইতিহাস লিপিবদ্ধ করেছেন। শেষ সুলতানের নামানুসারে গ্রন্থটির নামকরণ করেছেন। ‘তারিখ ই-ফিরোজশাহি’র সহায়ক গ্রন্থ হিসেবে ‘ফতোয়া-ই-জাহানদারি’ গ্রন্থটি বারাণী রচনা করেন। এই গ্রন্থের বিষয়বস্তু সুলতানি রাষ্ট্রের চরিত্র, সুলতানির আদর্শ, রাজার দায়িত্ব ও কর্তব্য ইত্যাদি সম্পর্কে বারাণীর অভিমত এবং সেকালে যা প্রচলিত ছিল তাদের বিবরণ।

বারাণীর রাজনৈতিক চিন্তাধারা নিঃসন্দেহে ধর্মকেন্দ্রিক। তবে ইতিহাসকার হিসেবে তিনি বাস্তববোধ এবং সত্যনিষ্ঠাকে গুরুত্ব দিতে দ্বিধা করেননি। ‘তারিখ-ই-ফিরোজশাহি’ গ্রন্থের ভূমিকাতেই তিনি ইতিহাসকার হিসেবে নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরেছেন। তাঁর মতে, ইতিহাস শুধুমাত্র বাদশাহ বা অভিজাত শাসকশ্রেণির গুণকীর্তন নয়। ইতিহাসে শাসকশ্রেণির দোষত্রুটি বা দুর্বলতাগুলি তুলে ধরাও আবশ্যিক বলে বারাণী মনে করতেন। তবে ইতিহাসকারকে ধর্মীয় সততার প্রতি নিষ্ঠাবান হওয়ার বিষয়টিকে তিনি বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছেন। বারাণী আড়াল না রেখেই বলেছেন যে, ইতিহাস রচনা বা চর্চা শুধুমাত্র সদ্বংশজাত সমাজের উচ্চশ্রেণির অধিকারের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকা বাঞ্ছনীয়। একইভাবে ইতিহাসের বিষয়বস্তু হিসেবেও নিম্নশ্রেণির মানুষদের স্থান দিতে তিনি নিষেধ করেছেন।

জিয়াউদ্দিন বারাণী ছিলেন আদ্যোপান্ত একজন অভিজাত ব্যক্তি। তাঁর পরিবার তিন প্রজন্ম ধরে ইলবেরি তুর্কি, খলজি ও তুঘলকদের অধীনে কর্মরত ছিল। রাজপরিবারের সাথে ছিল তাঁদের আত্মিক যোগ। তাই লেখক হিসেবেও তিনি তাঁর শ্রেণিচরিত্রের বাইরে বেরিয়ে আসতে পারেননি। সুলতানি রাজনীতির টানাপোড়েনও তাঁর রচনার ওপর প্রভাব ফেলেছিল। মহম্মদ তুঘলকের সভাসদ ও ‘নাদিম’ হিসেবে তিনি প্রায় দুই দশক কর্মরত ছিলেন। সভাপণ্ডিত ও প্রাজ্ঞ মানুষ হিসেবে সুলতান তাঁর প্রশংসাও করতেন। বারাণীর উত্থান, প্রতিষ্ঠা ও সুনামের মূল উৎস ছিলেন মহম্মদ তুঘলক। তথাপি বারাণী মহম্মদ তুঘলকের সার্বিক প্রশংসা করতে পারেননি। এজন্য ঐতিহাসিকের নির্মোহ দৃষ্টিভঙ্গি দায়ী ছিল না; এর কারণ ছিল মহম্মদ তুঘলকের ধর্মনিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গি এবং ভঙ উলেমাদের প্রতি কঠোর আচরণ। বারাণী সুলতানকে সৎ, নির্ভীক, পয়গম্বর সদৃশ যেমন বলেছেন, তেমনি অধার্মিক, হটকারী, নৃশংস বলতেও দ্বিধা করেননি। এজন্য অনেকে বারাণীর ভাগ্যবিপর্যয় ও তাঁর মননের ওপর রাজনীতির প্রতিক্রিয়াকে দায়ী করেন। ফিরোজ তুঘলকের আমলে রাজনৈতিক টানাপোড়েনে তাঁর পদচ্যুতি ঘটে। সরকারি পদমর্যাদা, সম্পত্তি সবই তাঁর হস্তচ্যুত হয়। এজন্য তিনি মহম্মদ তুঘলকের নিয়োগনীতিকে দায়ী করেন। সরকারি উচ্চপদে নিম্নবর্ণের (লোধা, শেখ, বাবু, নাজরা, মান্কা) মানুষদের নিয়োগ করে মহম্মদ যে নতুন অভিজাতশ্রেণি গড়ে তোলেন, বারাণী তাদেরকেই নিজ ভাগ্যবিপর্যয়ের জন্য দায়ী করেন।

বারাণীর ইতিহাসচর্চার সাথে তাঁর ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা ও মানসিক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার ঘনিষ্ট যোগ আছে। সুলতানদের জীবনী বর্ণনা প্রসঙ্গে তিনি বারে বারেই নিজ জীবনের টানা-পোড়েন ও হতাশাকে স্মরণ করেছেন। বলবনের শাসনব্যবস্থা বলতে গিয়ে নিজের দুর্ভাগ্যের কথা বলেছেন। জালালউদ্দিন খলজীর দরবারের বর্ণনা প্রসঙ্গে নিজের ভাগ্য-বিড়ম্বনার কথা স্মরণ করেছেন। দীর্ঘকাল একাধিক সুলতানের সংস্পর্শে থাকার সূত্রে বারাণী যেমন প্রভূত সম্মান, সুযোগ-সুবিধা পেয়েছিলেন, তেমনি মূলত রাজরোষের কারণেই তিনি সবকিছু হারিয়েছিলেন। ফিরোজ তুঘলকের শাসনের শুরুতেই বারাণীর ভাগ্য বিপর্যয় ঘটে। সকল সুযোগ-সুবিধা, ভূমিস্বত্ত্ব, সরকারী ভাষা ইত্যাদি হারিয়ে প্রায় নিঃস্ব হয়েছিলেন। শেষ জীবন কেটেছিল খাজা নিজামউদ্দিনের খানকা’র আশ্রয়ে। এইভাবে মর্যাদা ও সুযোগ সুবিধার চূড়া থেকে পথের ধূলায় নিক্ষিপ্ত হবার ফলে তিনি মানসিকভাবে ক্ষতবিক্ষত হয়েছিলেন। এমনই সময় তিনি ‘তারিখ-ই-ফিরোজশাহী’ রচনা করেন। স্বভাবতই তাঁর রচনায় ব্যক্তি জীবনের ক্ষত প্রতিফলিত হয়েছিল।

বারাণীর ইতিহাসচিন্তা সম্পর্কে ঐতিহাসিকদের মূল্যায়নে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা যায়। অধ্যাপক সামসুল হক্ বারাণীকে একজন সত্যনিষ্ঠ ইতিহাসবিদ’ হিসেবে বর্ণনা করেছেন। তাঁর মতে, বারাণী মধ্যযুগীয় সীমাবদ্ধতা অনেকটাই অতিক্রম করতে পেরেছিলেন। ইতিহাসের বিষয়বস্তুকে তিনি কেবল রাজনৈতিক পরিস্থিতির মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে সমাজ, ধর্ম ও সংস্কৃতির মধ্যে সম্প্রসারিত করেছিলেন। সত্যভাষণ এবং ক্ষমতাবান মানুষের দোষত্রুটি উল্লেখ করার কাজেও তিনি যথেষ্ট সাহস দেখিয়েছেন (“Barani can claim superiority to many a historian of the Middle Ages in having made the scope of his book wider and more comprehensive as well as in his fearlessness in the truth and condemning the action of great man when necessary.”)। কিন্তু এই মূল্যায়ন সঠিক নয়। সরকারি পৃষ্ঠপোষকতাধন্য বারাণী বহুক্ষেত্রে তাঁর পৃষ্ঠপোষকদের ত্রুটিগুলি এড়িয়ে গেছেন বলে ফেরিস্তা মনে করেন। ধর্মের তাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্যের প্রতি প্রশ্নহীন আস্থা তাঁর লেখনীকে প্রভাবিত করত বলে ঐতিহাসিক হেনরী ইলিয়ট মনে করেন। তাই তিনি বারাণীকে ‘পক্ষপাতদুষ্ট ইতিহাসবিদ’ বলে আখ্যায়িত করেছেন। অধ্যাপক হবিবুল্লাহ এতটা কঠোর না হলেও, মনে করেন যে, বারাণীর ইতিহাসে তাঁর মনোজগতের প্রতিফলন যতটা ঘটেছে, বাস্তব অবস্থার প্রতিফলন ততটা ঘটেনি। পিটার হার্ডি-র মতে, বারাণীর ইতিহাস হল ধর্মশাস্ত্রের অঙ্গ।

সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও বারাণীর রচনার ইতিহাসমূল্য অসীম। ধর্মীয় আনুগত্য থাকলেও তিনি ধর্ম ও ঐতিহ্যকে অতিক্রম করে বাস্তব সত্যের অনুসন্ধান করতে প্রয়াসী হয়েছেন। মহম্মদ হাবিবের মতে, “তিনি শুধু ঘটনার বিবরণের মধ্যে ইতিহাসকে সীমাবদ্ধ রাখেননি; ইতিহাসকে তিনি সমাজের দর্পণ রূপে তুলে ধরতে চেষ্টা করেছেন।” নিজামীর মতে, “গোঁড়া ও রক্ষণশীল হলেও বারাণী স্বীকার করেছেন যে, ভারতের রাজনীতিতে কঠোরভাবে শরিয়তি আইনের প্রয়োগ সম্ভব নয়। রাষ্ট্রের প্রয়োজনে সুলতানের অনুশাসন বা ‘জাওবিৎ’ জারিকে তিনি অনিবার্য বলেই মেনে নিয়েছেন। আসলে এক গভীর মানসিক দ্বিধা ও দোদুল্যমানতা তাঁকে আচ্ছন্ন করে রাখত। তাই তাঁর রচনায় বৈপরীত্য দেখা যায়।”