জালালউদ্দিন ফিরোজ খলজি (১২৯০-‘৯৬ খ্রিঃ):

খলজি মালিক ফিরোজ তথাকথিত ‘খলজি-বিপ্লব’ সংঘটিত করে এবং শেষ মামেলুক সুলতানদ্বয় কাইকোবাদ ও কায়ুমসকে যথাক্রমে হত্যা ও বন্দি করে দিল্লির সিংহাসন দখল করেন। ১২৯০ খ্রিস্টাব্দে লিখোরী প্রাসাদে তাঁর অভিষেকক্রিয়া সম্পন্ন হয়। মালিক ফিরোজ রক্তক্ষয়ী বিপ্লবের মাধ্যমে সিংহাসন দখল করলেও, তাঁর চরিত্রের মধ্যযুগীয় স্বৈরতান্ত্রিক নৃপতির কাঠিন্যের যথেষ্ট অভাব ছিল। মালিক ফিরোজ সুলতান জালালউদ্দিন ফিরোজ শাহে রূপান্তরিত হবার সঙ্গে সঙ্গে তাঁর আচরণের মধ্যেও বৈপ্লবিক রূপান্তর লক্ষ্য করা যায়। প্রচলিত ‘রুধির ও লৌহ’ (Blood and Iron) নীতির পরিবর্তে তিনি ক্ষমা ও সহনশীলতার নীতি অনুসরণ করেন। ড. হবিবউল্লাহ ফিরোজের শাসনকালকে প্রজাহিতৈষণা ও উদারতার প্রতীক’ বলে অভিহিত করেছেন। অধ্যাপক এস. আর শর্মা তাঁকে ‘Clemency King Firus’ বলে আখ্যায়িত করেছেন। কারণ যারা তাঁর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করেছে এবং অস্ত্রধারণ করেছে যে তুর্কি-আমিরদের তিনি পরাজিত করেছেন কিংবা যেসব মানুষ বা গোষ্ঠী দেশজুড়ে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির চেষ্টা করেছে,—সবাইকে তিনি গ্রহণ করেছেন ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে। সংঘর্ষের পরিবর্তে সহনশীলতার মাধ্যমে তিনি সকল সমস্যার ব্রতী হয়েছেন। এবং সম্ভবত এটিই ছিল তাঁর ব্যর্থতার অন্যতম প্রধান কারণ।

জালালউদ্দিন ফিরোজের অভ্যন্তরীণ নীতি :

আগেই আমরা দেখেছি যে, তুর্কি বংশোদ্ভূত হলেও খলজি মুসলানদের তুর্কি-মালিকরা সমপর্যায়ভুক্ত মনে করতেন না। দিল্লির সাধারণ মুসলমানদের মধ্যেও ফিরোজকে সুলতান হিসেবে গ্রহণ করার ব্যাপারে একটা দ্বিধা ছিল। দীর্ঘকাল ইলবেরি তুর্কিদের শাসনাধীনে থাকার ফলে দিল্লির জনসমাজ ফিরোজকে একজন জবরদখলকারী রূপেই প্রথমে গণ্য করেন। সামাজিক এই প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে ফিরোজ যথেষ্ট সচেতন ছিলেন। তাই তিনি দিল্লির পরিবর্তে কাইকোবাদ-নির্মিত কিলখোরী প্রাসাদেই নিজের অভিষেকক্রিয়া সম্পন্ন করেন এবং কিলখোরীর অসমাপ্ত প্রাসাদকে সম্পূর্ণ করে সেখান থেকেই শাসন চালাতে থাকেন। অবশ্য এক বছরের মধ্যেই দিল্লির জনমত পরিবর্তিত হয়। জালালউদ্দিনের উদারতা ও আপসমূলক মনোভাব তাঁকে জনপ্রিয় করে তোলে এবং জনমত সাদরে বরণ করে নেয়।

সম্ভবত বয়সের ভার ( সিংহাসনে বসার সময় ছিল সত্তর) এবং তুর্কি-মালিকদের বিরোধিতার জন্য ফিরোজ তাঁর শত্রুদের সঙ্গেও উদার ও সহিষ্ণু নীতি অনসুরণ করেন। অধিকাংশ তুর্কি-মালিককে তিনি স্বপদে বহাল রাখেন এবং বিদ্রোহীদেরও পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করেন। বলবনের আত্মীয় এবং সিংহাসনের অন্যতম দাবিদার মালিক চাড্ডুকে কারা-মানিকপুরের গভর্নর নিযুক্ত করেন। বৃদ্ধ মালিক ফকরুদ্দিন দিল্লির কোতোয়াল-পদে বহাল থাকেন। খাজা কতির উজিরপদে নিযুক্ত হন। তাঁর এই বদান্যতা দিল্লির মানুষকে অভিভূত করে। তারা দলবদ্ধভাবে অত্যন্ত সংকোচের সাথে ফিরোজকে দিল্লির প্রাসাদে অধিষ্ঠিত হবার জন্য আমন্ত্রণ জানায়।

ফিরোজের বদান্যতা ও উদারতা অনেকের কাছে দুর্বলতা বলে প্রতিভাত হয়। এই কারণে মালিক চাড্ডু ১২৯১ খ্রিস্টাব্দে ফিরোজের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেন। সুলতানের পুত্র আরকলি খাঁ এই বিদ্রোহ দমন করে চাড্ডু ও তাঁর সহযোগীদের বন্দি করে সুলতানের সম্মুখে উপস্থাপিত করেন। আরকলি খাঁর আশা ছিল ফিরোজ বিদ্রোহীদের কঠোর শাস্তিবিধান দ্বারা এইজাতীয় অকৃতজ্ঞতার সমুচিত জবাব দেবেন। কিন্তু সুলতান ফিরোজ তাঁদের বন্দিদশা দেখে প্রকাশ্য রাজসভায় দুঃখপ্রকাশ করেন এবং তাঁদের সম্মানে রাজকীয় ভোজসভার আয়োজন করেন। অতঃপর চাজ্জুকে সসম্মানে মুলতানে পুনর্বাসিত করেন। সুলতানের এহেন আচরণে আরকলি খাঁ ও আলাউদ্দিন অসন্তোষ প্রকাশ করলে ফিরোজ স্পষ্ট জানিয়ে দেন যে, “সিংহাসনের জন্য তিনি মুসলমানের রক্তপাত করতে রাজি নয়।”

ঠগি দস্যুদের প্রতিও ফিরোজ এই ধরনের ক্ষমা প্রদর্শন করেন। এই সকল ঠগি অকারণে হত্যা ও লুণ্ঠন দ্বারা জনজীবনকে বিপর্যস্ত করে তুলেছিল। রাজধানীর নিকটবর্তী অঞ্চল থেকে সুলতানি বাহিনী বহু দস্যুকে গ্রেপ্তার করে। কিন্তু ফিরোজ খলজি এদের শাস্তিদানের পরিবর্তে ক্ষমাপ্রদর্শন করেন এবং নৌকাযোগে বাংলার সীমান্তে পাঠিয়ে দেন। বস্তুত এই দস্যুদের আগমনের ফলে বাংলাদেশে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির ব্যাপক অবনতি ঘটেছিল। ফিরোজের এই অস্বাভাবিক আচরণ খলজি মালিকদের দারুণ অসন্তুষ্ট করে। এমনকি তারা প্রকাশ্যে ফিরোজকে সিংহাসনচ্যুত করার বিষয় আলোচনা করতে থাকেন। কিন্তু বৃদ্ধ সুলতান সে বিষয়ে নিঃস্পৃহ থাকেন। ফিরোজ যখন রণথম্ভোর বিজয়ে ব্যস্ত, সেই সময় কিছু খলজি-মালিক তাজউদ্দিন কুচি নামক জনৈক খলজিকে সিংহাসনে বসানোর সিদ্ধান্ত নেন। জালালউদ্দিন এই ঘটনা জানার পর সমস্ত মালিকদের সভা আহ্বান করে তাদের মৃদু ভর্ৎসনা করেন এবং নিজের তরবারি মাটিতে রেখে তাঁকে হত্যা করার যে-কোনো আগ্রহী ব্যক্তিকে আহ্বান জানান। অবশ্য বিদ্রোহী খলজি-মালিকেরা তাদের ভুল স্বীকার করে নেন এবং সুলতানও তাঁদের ক্ষমা করে দেন।

একমাত্র সিধি মৌলা নামক দরবেশের সাথে আচরণে ফিরোজ খলজি তাঁর স্বভাবসুলভ আচরণ থেকে বিচ্যুত হয়েছিলেন। সিধি মৌলা ছিলেন পাক-পাটন-এর শেখ ফরিদউদ্দিন গঞ্জ-ই-শকর এর শিষ্য। কাইকোবাদের আমল থেকেই তিনি দিল্লির সন্নিকটে খান্কা নির্মাণ করে বসবাস করছিলেন। অভিজাতমহলে তাঁর ব্যাপক জনপ্রিয়তা ছিল। তাঁর শিষ্যসংখ্যা ছিল কয়েক হাজার। বলবনী অভিজাতদের অনেকেই সিধি মৌলার ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্যলাভ করেছিলেন। এমনকি ফিরোজের ধর্মপ্রাণ পুত্র ‘খান-ই-খানান ও মৌলার শিষ্য ছিলেন। যাই হোক, ফিরোজ যখন মান্দাবার অভিযানে ব্যস্ত ছিলেন, তখন বলবনী-অভিজাতরা সিধি মৌলাকে ফিরোজের পরিবর্তে দিল্লির সিংহাসনে বসানোর একটি পরিকল্পনা করেন বলে কথিত আছে। ড. নিজামীর মতে, সিধি মৌলার প্রতিদ্বন্দ্বী কোনো ধর্মীয় গোষ্ঠী এই ধরনের অপপ্রচার দ্বারা সিধি মৌলার জনপ্রিয়তা ধ্বংস করতে চেয়েছিলেন। এই ষড়যন্ত্রের সংবাদ পাওয়া মাত্র আরকলি খাঁ মৌলা-সহ ষড়যন্ত্রীদের বন্দি করেন এবং সুলতান মান্দাবার অভিযান থেকে ফিরলে তাঁর সামনে উপস্থিত করেন। এই প্রথম ফিরোজ খলজি বিদ্রোহের সংবাদে প্রচণ্ড উত্তেজিত হন এবং সিধি মৌলাকে নৃশংসভাবে হত্যার নির্দেশ দেন। আরকলি খাঁ এই সম্ভকে উন্মত্ত হাতির পদতলে পিষ্ট করে হত্যা করেন। এই বছর এক অভূতপূর্ব খরা ও ধুলিঝড়ে দিল্লিতে শিবালিক পর্বত অঞ্চল বিপর্যস্ত হয়েছিল। দেখা দিয়েছিল ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ। অনেকে মনে করেন, ধর্মপ্রাণ সন্ত সিধি মৌলার হত্যাকাণ্ডের পাপে দেশবাসীর ওপর এই অভিশাপ বর্ষিত হয়েছিল।

জালালউদ্দিন ফিরোজের মোঙ্গল আক্রমণ :

মোঙ্গল আক্রমণ প্রতিহত করার কাজে জালালউদ্দিন ফিরোজ দক্ষতা ও দৃঢ়তার পরিচয় দেন। ১২৯২ খ্রিস্টাব্দে প্রাক্তন নেতা হলাকুর পৌত্র আবদুল্লার নেতৃত্বে প্রায় দেড় লক্ষ মোঙ্গলের একটি দল ভারত আক্রমণ করে এবং সামান পর্যন্ত অগ্রসর হয়। জালালউদ্দিন তৎপরতার সঙ্গে মোঙ্গলদের গতিরোধ করেন এবং যুদ্ধে পরাজিত করে পিছু হটতে বাধ্য করেন। এই সময় চেঙ্গিজ খাঁর বংশধর হলাকু’র নেতৃত্বে কয়েক হাজার মোঙ্গল ইসলামধর্ম গ্রহণ করে ভারতে বসবাস করার ইচ্ছা প্রকাশ করে। ফিরোজ তাদের সেই অনুমতি দেন। এমনকি তিনি নিজের ভগিনীর সাথে হলাকুর বিবাহ দেন এবং ধর্মান্তরিত মোঙ্গলদের বিভিন্ন সরকারি পদে নিয়োগ করেন। এরা ‘নব-মুসলমান’ নামে পরিচিত হয়। জালালের এই কাজের মধ্যে দূরদৃষ্টির অভাব লক্ষ্য করা যায়। কারণ পরবর্তীকালে এই ‘নব-মুসলমানরা’ দিল্লি-সুলতানির অস্তিত্বের পক্ষে বিপজ্জনক হয়ে উঠেছিল।

জালালউদ্দিন ফিরোজের রাজ্যজয় :

জালালউদ্দিনের সামরিক কর্মসূচির অধিকাংশই ছিল ব্যর্থতায় ভরা। ছয় বছরের রাজত্বে তিনি মাত্র দুটি অভিযান পাঠিয়েছিলেন, যার কোনোটিই পূর্ণ সাফল্য পায়নি। ১২৯০ খ্রিস্টাব্দে তিনি রণথম্ভোরের চৌহান রানা হামিরদেবের বিরুদ্ধে একটি অভিযান পরিচালনা করেন। সুলতানি বাহিনীর প্রাথমিক সাফল্য সত্ত্বেও রাজপুতদের প্রচণ্ড প্রতিরোধের ফলে ফিরোজ এই অভিযান অসমাপ্ত রেখে দিল্লিতে ফিরে আসেন। যুক্তি হিসেবে তিনি বলেন, “এই ধরনের একশত দুর্গের থেকে একজন মুসলমানের মাথার একটি চুলের দাম অনেক বেশি।” এখানে একমাত্র ঝইন অঞ্চল তাঁর হস্তগত হয়। তবে এখানকার হিন্দুমন্দির ও বিগ্রহাদি ধ্বংস করে তিনি ধর্মীয় অসহিষ্ণুতার পরিচয় দেন।

জালালউদ্দিনের রাজত্বকালের আর একটি গুরুত্বপূর্ণ ও সফল সামরিক অভিযান ছিল দক্ষিণ ভারতের সমৃদ্ধ রাজ্য দেবগিরির বিরুদ্ধে। তবে এটি সুলতান জালালউদ্দিনের অনুমত্যানুসারে বা জ্ঞাতসারে সংঘটিত হয়নি। এই অভিযানটি পরিচালনা করেছিলেন জালালের ভ্রাতুষ্পুত্র তথা জামাতা আলাউদ্দিন খলজি এবং সুলতানের সম্পূর্ণ অজ্ঞাতসারে। ইতিপূর্বে মালব আক্রমণকালে আলাউদ্দিন ভিলসা দুর্গ লুণ্ঠনের সময় দেবগিরির ধনসম্পদের প্রাচুর্য সম্পর্কে অবহিত হন। মালব অভিযান থেকে ফিরেই তিনি দক্ষিণ ভারত অভিযানের গোপন প্রস্তুতি শুরু করেন। চান্দেরি ও মালবের সমৃদ্ধ অঞ্চল দখল করার অজুহাতে তিনি সৈন্যবল বৃদ্ধির অনুমতিও আদায় করেন ফিরোজের কাছ থেকে। অতঃপর মালিক আলা-উলস্তু-মুলক’কে কারা-মানিকপুরের দায়িত্ব দিয়ে ১২৯৪ খ্রিস্টাব্দে আট হাজার অশ্বারোহী সৈন্য নিয়ে দক্ষিণ ভারত যাত্রা করেন। দেবগিরির রাজা রামচন্দ্রদেব ও তাঁর পুত্র শংকরদেবকে পরাজিত করে তিনি বিশাল পরিমাণ সম্পদ লাভ করেন। উলসী হেগ (Wolseley Haig)-এর মতে, “আলাউদ্দিন দেবগিরি থেকে ১৭,২৫০ পাউন্ড সোনা, ২০০ পাউন্ড মুক্তা, ৫৮ পাউন্ড অন্যান্য মহার্ঘ পাথর, ২৮,২৫০ পাউন্ড রুপো এবং ১ হাজার সিল্কের থান কারায় নিয়ে এসেছিলেন।”

এদিকে ১২৯৫-এর শেষদিকে জালালউদ্দিন গোয়ালিয়রে শিকার অভিযানের সময় আলাউদ্দিনের দক্ষিণ ভারত অভিযান ও সম্পদ সংগ্রহের সংবাদ পান। এই সংবাদে আহম্মদ চাপ প্রমুখ বেশ শঙ্কিত হন এবং সত্বর কারায় গিয়ে আলাউদ্দিনকে কিছুটা শিক্ষা দেবার পরামর্শ দেন। কিন্তু ক্ষমাশীল সুলতান ফিরোজ এক্ষেত্রেও নিঃশঙ্কচিত্তে দিল্লি ফিরে যান। দিল্লিতে আলাউদ্দিনের ভ্রাতা উলুঘ খাঁ ছিলেন যথেষ্ট প্রভাবশালী ব্যক্তি। ফিরোজের ওপর তাঁর প্রভাবও কম ছিল না। উলুঘ খাঁ ফিরোজকে বোঝান যে, কৃতকার্যের জন্য অনুতপ্ত আলাউদ্দিন সুলতানের সম্মুখীন হতে লজ্জাবোধ করছেন। এমনকি ফিরোজের ক্ষমা না পেলে আলাউদ্দিন হয়তো দেশান্তরী হবেন কিংবা বিষপানে জীবন ত্যাগ করবেন —এই গল্পকথাও উলুঘ ফিরোজকে শোনান। সরলহৃদয় ফিরোজ নিজেই কারায় উপস্থিত হন ও অনুতপ্ত আলাউদ্দিনকে শান্ত করার সিদ্ধান্ত নেন।

উলুঘ খাঁ’র বক্তব্য পুরোটাই ছিল আলাউদ্দিনের ষড়যন্ত্রের মুখবন্ধ। উলুঘ খাঁ’র দূত মারফত আলাউদ্দিন সমস্ত ঘটনাই জানতে পারেন এবং স্নেহান্ধ পিতৃব্য সুলতানকে যথাযথ মর্যাদার সাথে অভ্যর্থনা করতে প্রস্তুত হন। সুলতান মানিকপুরে উপস্থিত হলে উলুঘ খাঁ তাঁকে সৈন্য ছাড়া দু-চারজন দেহরক্ষীসহ গঙ্গা অতিক্রম করে পশ্চিমতীরে যাওয়ার জন্য অনুরোধ করেন। কারণ সসৈন্যে সুলতানকে দেখলে লজ্জিত ও ভীত আলাউদ্দিন হয়তো আত্মহত্যা করতে পারেন। এবারেও সরলহৃদয় ফিরোজ উলুষের কথায় বিশ্বাস করলেন এবং সামান্য কয়েকজন অনুচরসহ গঙ্গা অতিক্রম করে আলাউদ্দিনের শিবিরে প্রবেশ করলেন। কিন্তু হায়রে ভাগ্য! বৃদ্ধ ফিরোজ স্নেহের আবেগে প্রিয় ভ্রাতুষ্পুত্রকে আলিঙ্গনাবদ্ধ করার সঙ্গে সঙ্গে আলাউদ্দিনের অনুচর মামুদ সেলিম ফিরোজের পিঠে অস্ত্রাঘাত করে। আহত ফিরোজ প্রাণরক্ষার জন্য ছুটতে শুরু করেন। কিন্তু আলাউদ্দিনের অপর অনুচর ইখতিয়ার উদ্দিন অস্ত্রাঘাতে তাঁর মুণ্ডচ্ছেদ করে। আহম্মদ চাপ গঙ্গার অন্য পারে ছিলেন। দ্রুত স্থান ত্যাগ করে তিনি কোনোক্রমে প্রাণরক্ষা করেন। আলাউদ্দিন মৃত সুলতানের ছিন্নমুণ্ড বর্শাবিদ্ধ করে কারা-মানিকপুর ও অযোধ্যার মানুষকে প্রদর্শন করেন এবং নিজেকে দিল্লির সুলতান বলে ঘোষণা করেন (১২৯৬ খ্রিঃ)। জালালউদ্দিন ফিরোজের মৃত্যু আবার প্রমাণ করে যে, সিংহাসনে অধিষ্ঠিত থাকার জন্য প্রয়োজন ‘রুধির ও লৌহ’ নীতির অনুশীলন; সেখানে দয়া-মায়া-উদারতা বা মানবিকতার তত্ত্ব সম্পূর্ণ অসার। অধ্যাপক শৰ্মা (S. R. Sharma) যথার্থই লিখেছেন : “He was too clement to be king in an age when blood and iron alone could tell. He was soon overtaken by a whirlwind of troubles that ended not only by removing the crown from his head, but also the head from his shoulders.”

জালালউদ্দিন ফিরোজের কৃতিত্বের মূল্যায়ন :

সুলতান জালালউদ্দিন ফিরোজ খলজি-বিপ্লব সংঘটিত করে ভারত-ইতিহাসে এক নবতম অধ্যায়ের সংযোজন করেছিলেন। সুদক্ষ সামরিক নেতা হিসাবে। নির্দিষ্ট লক্ষ্যে উপনীত হবার জন্য তিনি সত্তর বছর বয়সেও যথেষ্ট মনোবল ও দক্ষতার পরিচয় দেন। কিন্তু সুলতানি সিংহাসন দখলের পর তাঁর ভাবান্তর ঘটে। এই সময় তিনি যুদ্ধের পরিবর্তে শান্তি, সংঘাতের পরিবর্তে সমঝোতা, রূঢ়তার পরিবর্তে উদারতা এবং প্রতিহিংসার পরিবর্তে ক্ষমার নীতি অনুসরণ করে মধ্যযুগীয় স্বৈরতন্ত্রের চরিত্রকে পাল্টে দিতে চেষ্টা করেন। ফলে অভ্যন্তরীণ ও পররাষ্ট্রীয় ক্ষেত্রে সুলতানির ভিত্তি দুর্বল হয়ে পড়ে। তাঁর উদারতা ও ক্ষমার নীতির ব্যর্থতা কেবল তাঁর মাথা থেকে রাজমুকুট কেড়ে নেয়নি, তাঁর বাহুদ্বয়ের ওপর থেকে তাঁর মস্তিষ্ককেও বিচ্ছিন্ন করে দেয়। তাই বলা চলে, যুগ-বৈশিষ্ট্যের পরিপ্রেক্ষিতে জালালউদ্দিন খলজির আচরণ ছিল ভ্রান্ত; রাষ্ট্রনীতি ছিল অসার।

শাসক হিসেবে ব্যর্থ হলেও জালালউদ্দিন ছিলেন প্রকৃত অর্থেই একজন দরদি মানুষ। আত্মীয়পরিজন ও প্রজাসাধারণের প্রতি তাঁর আচরণ ছিল পিতার মতো। অভিজাতদের প্রতি তাঁর আচরণ ছিল বন্ধুর মতো। অধ্যাপক নিজামী লিখেছেন: “মৌর্য সম্রাট অশোকের মতোই মানুষের প্রতি ভালোবাসা ও আস্থার ওপর ভিত্তি করে তিনি রাষ্ট্রশাসন পরিচালনা করেছিলেন।” (“Like the reformed Asoka, he aimed at ruling by human love and faith.”)। ড. কে. এস. লাল লিখেছেন : ‘If his simplicity and his kindness were rediculed by the worldly people, his age and benevolence were revered by all.” হত্যা, ষড়যন্ত্র ও অবিশ্বাসের যুগে জালালউদ্দিনের সহনশীলতা ও আপসনীতি হয়তো ব্যর্থ হয়েছিল, কিন্তু এর মাধ্যমে তিনি সামাজিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে যে সাম্য ও মৈত্রীর পটভূমি গড়ে দেন, তার ওপরে ভিত্তি করেই খলজি সাম্রাজ্যবাদ তথা ভারত-সাম্রাজ্যের সূচনা হয়। ড. নিজামী যথার্থই লিখেছেন : “Jalal-ud-din’s reign bridge the experimental age of the Memeluks with the planned imperialist economy of Alauddin.” বস্তুত, তুর্কিদের প্রগতিবিরোধী জাতিভিত্তিক রাজনীতির অবসান ঘটিয়ে সুসংহত ইন্দো-মুসলিম রাষ্ট্রগঠনের পটভূমি রচনা করে জালালউদ্দিন স্মরণীয় হয়ে আছেন।