আলোচনার গুরুত্ব: বর্তমান বিশ্বের রাষ্ট্রনীতিক চিন্তাজগতে জাতীয়তাবাদ ও আন্তর্জাতিকতা হল দুটি তাৎপর্যপূর্ণ বিষয়। বিংশ শতাব্দী থেকেই এই দুটি বিষয় ও তাদের পারস্পরিক সম্পর্ক বিষয়ক আলোচনা নানা কারণে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। আধুনিককালে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিবিদ্যার ব্যাপক উন্নতি, আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বিভিন্ন বিষয়ে রাষ্ট্রসমূহের পারস্পরিক নির্ভরশীলতা, দু-দুটি বিশ্বযুদ্ধ, আণবিক যুদ্ধের আশঙ্কা ও আতঙ্ক, বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠা ও মানবসভ্যতার অস্তিত্বরক্ষা প্রভৃতি বহুবিধ কারণে জাতীয়তাবাদ বনাম আন্তর্জাতিকতার সমস্যাটি বর্তমান দুনিয়ার বহু আলোচিত বিষয়সমূহের মধ্যে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে।

‘জাতীয়তাবাদ আন্তর্জাতিকতার শত্রু’—একটি মত: বিংশ শতাব্দীর তৃতীয় দশকে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের ভয়াবহ দিনগুলিতেই বিশ্বের শান্তিকামী মানুষের মনে উগ্র জাতীয়তাবাদের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রমুখ মনীষিগণ, জাতীয়তাবাদ ও জাতীয় রাষ্ট্রব্যবস্থা (nation-state system)-র বিরুদ্ধে সোচ্চার হন। এই শ্রেণীর চিন্তাবিদদের অভিমত হল—জাতি, জাতীয়তাবাদ ও জাতীয় রাষ্ট্র সম্পর্কিত যাবতীয় ধারণার বিলুপ্তি ব্যতিরেকে যুদ্ধের আশঙ্কা দূর করা অসম্ভব। জাতীয় রাষ্ট্রসমূহের অস্তিত্ব এবং তাদের জাতীয়তাবাদী ধ্যান-ধারণার জন্য পৃথিবীতে যুদ্ধের আবহাওয়া ও মানবসভ্যতার সংকট সৃষ্টি হয়। জাতীয় রাষ্ট্রগুলির মধ্যে অবিশ্বাস ও সন্দেহের সম্পর্ক, স্বার্থদ্বন্দ্ব প্রভৃতি কারণে বিশ্ব-মৈত্রী, সৌভ্রাতৃত্ব প্রভৃতি আন্তর্জাতিক আদর্শের প্রসার বাধাপ্রাপ্ত হয়। আন্তর্জাতিক নিয়মকানুন, বিশ্বশান্তি, সম্প্রীতি, আন্তর্জাতিক সহযোগিতা প্রভৃতি আন্তর্জাতিকতার প্রলক্ষণসমূহের প্রকাশ ও বিকাশ সম্ভব হয় না। মানবতাবাদী কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাষায়, ‘জাতীয়তাবাদ মানবসভ্যতার শত্রু’ (‘a meance to civilisation”)। জাতীয় রাষ্ট্রব্যবস্থা ও জাতীয়তাবাদের বিলুপ্তি ঘটিয়ে পৃথিবীজুড়ে একটিমাত্র সার্বভৌম বিশ্বরাষ্ট্র সৃষ্টি করতে হবে। তা হলে, জাতিসমূহের মধ্যে সংঘর্ষের সম্ভাবনা ও যুদ্ধের আতঙ্ক দূর হবে। এবং এইভাবে বিশ্বশান্তি ও মানবসভ্যতার অস্তিত্ব ও বিকাশ নিরাপদ ও নিশ্চিন্ত হবে।

জাতীয়তাবাদ ও জাতীয় রাষ্ট্রব্যবস্থা বিশ্ব যুদ্ধের কারণ নয়: জাতীয়তাবাদ বনাম আন্তর্জাতিকতা সম্পর্কিত এই বক্তব্য সর্বাংশে সত্য নয়। বিশ্বে যাবতীয় অশান্তি ও সংঘর্ষের কারণ হিসাবে জাতীয়তাবাদ ও জাতীয় রাষ্ট্রব্যবস্থাকে দায়ী করা যায় না। জাতীয়তাবাদের কারণেই বিশ্বযুদ্ধ দুটি সংঘটিত হয়েছে, একথা মোটেই ঠিক নয়। স্বদেশ ও স্বজনপ্রীতিকে মহাযুদ্ধের কারণ এবং মানবসভ্যতার সংকটের কারণ হিসাবে চিহ্নিত করা সঙ্গত নয়। আবার বিশ্বরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হলেও বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠিত হবে এমন কোন নিশ্চয়তা নেই। তা ছাড়া, জাতীয় রাষ্ট্রগুলির অস্তিত্বের বিলোপ সম্ভব নয়, কাম্য নয়। বিখ্যাত দার্শনিক বার্ট্রান্ড রাসেল (Bertrand Russel) -এর মতানুসারে ‘জাতীয় সীমানার সঙ্গে রাষ্ট্রের সীমানা প্রায় এক না হওয়া অবধি প্রকৃত আন্তর্জাতিকতা গড়ে উঠতে পারে না।’ তিনি বলেছেন: “There can be no good international system, until the boundaries of state coincide as nearly as possible with the boundaries of nations.” অর্থাৎ সার্বভৌম এই জাতীয় রাষ্ট্রগুলিই হল আন্তর্জাতিকতার ভিত্তি। আন্তর্জাতিকতার মুখ্য উদ্দেশ্য হল জাতিগুলির স্বাতন্ত্র্য বিসর্জন না দিয়েও বিভিন্ন ক্ষেত্রে ভাবের পারস্পরিক আদান-প্রদানের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক সহযোগিতার বন্ধনকে দৃঢ় করা এবং বিশ্বভ্রাতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করা।

বিকৃত জাতীয়তাবাদই আন্তর্জাতিকতার শত্রু: নবজাগরণের যুগে জাতীয়তাবাদের উদ্ভব হয়। ফরাসী বিপ্লব প্রসূত গণতান্ত্রিক চেতনা এবং বৈপ্লবিক অধিকার ও স্বাধীনতাবোধের ভিত্তিতে তা পরিণতি লাভ করে। সামত্ততান্ত্রিক যুগ অতিক্রান্ত হওয়ার পর ধনতান্ত্রিক ব্যবস্থাতেই জাতীয়তাবাদ বিকৃত বা উগ্র রূপ ধারণ করে। আর্থনীতিক স্বার্থ সাধনের জন্য ঔপনিবেশিকতার সৃষ্টি হয়। শক্তিশালী ও বৃহৎ জাতিগুলি দুর্বল ও ক্ষুদ্র জাতিগুলির উপর প্রভুত্ব প্রতিষ্ঠার এক হীন ও হিংস্র প্রতিযোগিতার সামিল হয়। এই পথেই সৃষ্টি হয়েছে দু-দুটি মহাযুদ্ধ। ধনতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার বিকাশের সঙ্গে সঙ্গেই জাতীয়তাবাদ সংকীর্ণ ও বিকৃত রূপ ধারণ করে সাম্রাজ্যবাদে পরিণত হয়েছে। সবল জাতীয় রাষ্ট্রগুলি বিকৃত জাতীয়তাবাদের প্রেরণায় প্রথমে দুর্বল রাষ্ট্রগুলির আর্থনীতিক ক্ষেত্রে আধিপত্য বিস্তার করে। তারপরে সুযোগমত প্রশাসনিক ও রাজনীতিক ক্ষেত্রে সামগ্রিক প্রভুত্ব প্রতিষ্ঠিত করে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কথায়, “বণিকের মানদণ্ড পোহালে শবরী দেখা দিল রাজদণ্ড রূপে।” বস্তুত ঊনবিংশ শতাব্দীতেই উগ্র জাতীয়তাবাদের উন্মাদনায় ইউরোপের বুর্জোয়া জাতীয় রাষ্ট্রগুলি উন্মত্ত হয়ে ওঠে। এবং এই রাষ্ট্রগুলি এশিয়া, আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকার দরিদ্র ও দুর্বল জাতিগুলির উপর ঔপনিবেশিক শাসন ও আর্থনীতিক শোষণ কায়েম করে। বিকৃত জাতীয়তাবাদ এইভাবে সাম্রাজ্যবাদী চরিত্র লাভ করে। এই সাম্রাজ্যবাদী জাতীয়তাবাদ প্রথমে আর্থনীতিক ক্ষেত্রে এবং কালক্রমে রাজনীতিক ক্ষেত্রে কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করে। এই সাম্রাজ্যবাদী বিকৃত জাতীয়তাবাদই হল মানবসভ্যতা ও আন্তর্জাতিকতার প্রধান শত্রু। বিকৃত জাতীয়তাবাদের এই সাম্রাজ্যবাদী হিংসাকুটিল রূপের সঙ্গেই আন্তর্জাতিকতার মৌলিক বিরোধ আছে।

আদর্শ জাতীয়তাবাদ আন্তর্জাতিকতার সহায়ক: কিন্তু আদর্শ জাতীয়তাবাদের সঙ্গে আন্তর্জাতিকতার কোন বিরোধ নেই। বিভিন্ন জাতির সংকীর্ণ স্বাজাত্যবোধ বা অহমিকা আন্তর্জাতিকতা প্রসারের পথে বাধার সৃষ্টি করে। অর্থাৎ বিকৃত বা উগ্র জাতীয়তাবাদই আন্তর্জাতিকতার পরিপন্থী—প্রকৃত জাতীয়তাবাদ নয়। প্রকৃত জাতীয়তাবাদ বস্তুত একটি মহান আদর্শ। আদর্শ জাতীয়তাবাদ মানুষের মনে স্বজাতি ও স্বদেশের প্রতি ভালবাসার সৃষ্টি করে; দেশের স্বার্থে দায়িত্ব সম্পাদনে উদ্বুদ্ধ করে; আত্মত্যাগে প্রেরণা যোগায়। দেশের ও দশের প্রতি এই ভালবাসাই ক্রমে বিশ্ববাসীর প্রতি ভালবাসায় রূপান্তরিত হয়। স্বদেশ ও স্বজনের প্রতি যার ভালবাসা থাকে না, বিশ্ববাসীকে ভালবাসা তার পক্ষে সম্ভব নয়। দেশবাসীর প্রতি প্রকৃত ভালবাসা মানুষের মনে বিশ্ববাসীর প্রতি ভালবাসার সৃষ্টি করে। জাতীয়তাবোধই হল আন্তর্জাতিকতাবোধে উত্তরণের একটি সোপান।

সুস্থ জাতীয়তাবাদ আন্তর্জাতিকতার পরিধিকে প্রসারিত করে: আদর্শ জাতীয়তাবাদ যুদ্ধের বিরোধী, যুদ্ধ প্রতিরোধ করে। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে জাতীয়তাবাদ রাষ্ট্রসমূহের মধ্যে পারস্পরিক সম্প্রীতি, সদ্ভাব, সহযোগিতা, শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান প্রভৃতি আদর্শের উপর জোর দেয়। প্রকৃত জাতীয়তাবাদ বিশ্বশান্তি ও নিরাপত্তার পক্ষে। তা অন্য জাতিকে পদানত করার কথা বা শাসন-শোষণের কথা বলে না। সুস্থ জাতীয়তাবাদ অনুসারে প্রতিটি জাতির স্বাতন্ত্র্য ও স্বকীয় বৈশিষ্ট্যের পরিপূর্ণ বিবরণের উপর জোর দেওয়া হয়। জাতীয়তাবাদ গঠনমূলক পথে বিভিন্ন জাতির বৈচিত্র্যপূর্ণ বিকাশের মধ্যে সমন্বয় সাধনের ব্যবস্থা করে। তার ফলে বিশ্বসভ্যতা বৈচিত্র্যপূর্ণ ও সমৃদ্ধশালী হয়। অর্থাৎ যথার্থ জাতীয়তাবাদ আন্তর্জাতিকতার পথকে প্রশস্ত এবং পরিধিকে প্রসারিত করে। বিশ্বের সাধারণ মানুষ পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তের নিপীড়িত-নির্যাতিত মানবগোষ্ঠীর সমর্থনে আন্তরিক সহযোগিতা জ্ঞাপন করেছে। তৃতীয় দুনিয়ার দেশগুলির মধ্যে আন্তরিক আদান-প্রদান এবং সম্প্রীতি সহযোগিতা বৃদ্ধি পেয়েছে। জাতীয়তাবাদে উদ্বুদ্ধ এই সমস্ত মানবগোষ্ঠীর মধ্যে পারস্পরিক সম্ভাব-সম্প্রীতি জাতীয়তার গণ্ডীকে অতিক্রম করেছে। ঔপনিবেশিকতাবাদ বা সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী সংগ্রাম আন্তর্জাতিক আন্দোলনের মাত্রা লাভ করেছে। এইভাবে প্রকৃত জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতেই আন্তর্জাতিক পরিধি প্রসারিত হয়েছে।

জাতীয়তাবাদ ও আন্তর্জাতিকতা পরস্পরের উপর নির্ভরশীল: আদর্শ জাতীয়তাবাদ ও আন্তর্জাতিকতা পরস্পরের পরিপূরক। জিমার্ন-এর মতে, ‘জাতীয়তাবাদের পথেই আন্তর্জাতিকতায় পৌঁছতে হয়।’ তিনি বলেছেন: “The road to internationalism lies through nationalism.” উদ্দেশ্যের দিক থেকে জাতীয়তাবাদ ও আন্তর্জাতিকতার মধ্যে কোন বিরোধ নেই। বরং উভয়ের মধ্যে সম্পর্ক অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ। জাতীয়তাবাদ ও আন্তর্জাতিকতা একে অপরের উপর নির্ভরশীল। জাতীয়তাবাদের প্রবক্তা ম্যাৎসিনি-র মতে প্রত্যেক জাতির স্বকীয়তা, বৈশিষ্ট্য ও প্রতিভার সম্যক বিকাশ তার নিজস্ব পদ্ধতিতেই সম্ভব। এটাই হল জাতীয়তাবাদের মূল লক্ষ্য; ম্যাট্‌সিনির আরও অভিমত হল জাতিসত্তার চরম বিকাশ কেবলমাত্র আন্তর্জাতিক সহযোগিতার ভিত্তিতেই সম্ভব। জাতীয়তাবাদের এই লক্ষ্যে জাতিগুলি যদি সহযোগিতা ও সৌভ্রাতৃত্বের প্রীতিপূর্ণ পথে অগ্রসর হয় তা হলে পৃথিবীব্যাপী মানবসভ্যতার সমৃদ্ধি সাধন সম্ভব হবে। লয়েড বলেছেন: Mazzini thought, each nation possessed certain talents which, taken together, formed the wealth of the human race.” ম্যাৎসিনির মতানুসারে আদর্শ জাতীয়তাবোধে উদ্বুদ্ধ জাতিসমূহের মধ্যে কোন বিরোধ বা সংঘাত থাকতে পারে না। বস্তুতপক্ষে জাতীয়তাবাদ ও আন্তর্জাতিকতা উভয়ের মূল কথা হল, ‘নিজে বাঁচ এবং অপরকে বাঁচতে দাও’ (Live and let others, live)। ম্যাট্‌সিনি-কল্পিত ইতালীর জাতীয়তাবাদ আন্তর্জাতিকতার পথেই প্রসারিত। বস্তুত জাতীয়তাবাদ ও আন্তর্জাতিকতার সার্থক সমন্বয়ের উপর মানবসভ্যতার ভবিষ্যৎ নির্ভরশীল।

আদর্শ জাতীয়তাবাদ হল একটি প্রগতিশীল শক্তি এবং আন্তর্জাতিকতার সহায়ক: ব্যক্তিমানুষের দুটি বিশেষ গুণ হিসাবে আত্মপ্রীতি ও আত্মপ্রত্যয়ের কথা বলা হয়। কিন্তু আত্মপ্রীতি মানেই অপরিহার্যভাবে অপরের প্রতি ঘৃণা বোঝায় না। তেমনি আবার আত্মপ্রত্যয় মানেই অপরকে বিশ্বাস করা বোঝায় না। জাতীয় জীবনেও একই কথা খাটে। আন্তর্জাতিকতার মূল উদ্দেশ্য হল প্রত্যেক জাতির নিজস্ব বৈশিষ্ট্যসমূহ বজায় রেখে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে একটি স্বাভাবিক ও সুস্থ পরিবেশ গড়ে তোলা। এই আন্তর্জাতিক পরিবেশে সকল জাতি সামাজিক, সাংস্কৃতিক, আর্থনীতিক প্রভৃতি ক্ষেত্রে পারস্পরিক সহযোগিতার বন্ধনে আবদ্ধ হবে। এই উদ্দেশ্যের সাফল্যের জন্য জাতীয় রাষ্ট্রের অবসান বা রাষ্ট্রের সার্বভৌমিকতাকে ক্ষুণ্ন করার দরকার হয় না। অর্থাৎ এই অর্থে জাতীয়তাবাদের সঙ্গে আন্তর্জাতিকতার কোন বিরোধ নেই। প্রতিটি জাতি উল্লিখিত পথে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের নীতির ভিত্তিতে বসবাস করবে এবং নিজেদের সকল বিরোধের মীমাংসা শান্তিপূর্ণভাবে করতে পারবে। ছোট-বড় নির্বিশেষে প্রতিটি জাতি হবে সমান ও সমমর্যাদাসম্পন্ন। এর জন্য জাতীয়তাবাদকে পরিহার করার প্রয়োজন হয় না। জাতীয়তাবাদের ভিতর থেকেই আন্তর্জাতিকতার সৃষ্টি হয়। আদর্শ জাতীয়তাবাদ নিজের জাতিকে ভালবাসতে শেখায়, সঙ্গে সঙ্গে অপর জাতিকে ভালবাসতে অনুপ্রাণিত করে। প্রকৃত প্রস্তাবে জাতীয়তাবাদ হল একটি প্রগতিশীল শক্তি। এই শক্তি সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে এবং গণতন্ত্রের স্বার্থে সংগ্রাম করতে জাতিকে উদ্বুদ্ধ করে। আদর্শ জাতীয়তাবাদ প্রগতিশীল হওয়ার জন্য তা সংকীর্ণতা ও স্বার্থপরতার বিনাশ সাধন করে এবং আন্তর্জাতিকতার পথ প্রশস্ত করে। এই জাতীয়তাবাদ কখনই আন্তর্জাতিকতার পরিপন্থী হতে পারে না। এ হল আন্তর্জাতিকতার অনুপন্থী ও সহায়ক। সাম্প্রতিককালে এশিয়া, আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকার দেশসমূহের জাতীয় মুক্তি আন্দোলনের মাধ্যমে এই ধরনের প্রগতিশীল জাতীয়তাবাদের পরিচয় পাওয়া যায়।

আদর্শ জাতীয়তাবাদকে উপেক্ষা করে আন্তর্জাতিকতার প্রতিষ্ঠা অসম্ভব: পৃথিবীর সকল জাতির মধ্যে পারস্পরিক সহযোগিতা ও সমন্বয়ের ভিত্তিতে প্রত্যেকের যুক্তিযুক্ত আশা-আকাঙ্ক্ষার বাস্তবায়ন এবং অভাব অভিযোগের নিরসনের পথে আন্তর্জাতিকতার প্রতিষ্ঠা ঘটবে। বিশ্বের বিভিন্ন জাতির মধ্যে বর্তমানে এই উপলব্ধি স্পষ্টতঃ প্রতিপন্ন হয়। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে বর্তমানে বিভিন্ন আইন ও রীতিনীতি গড়ে উঠেছে। অধিকাংশ রাষ্ট্র নিজের সার্বভৌমিকতার সীমা স্বেচ্ছায় স্বীকার করে নিয়ে আন্তর্জাতিক সংগঠনের মাধ্যমে এই সমস্ত আইন ও রীতি-নীতি মেনে নিয়েছে। প্রথম মহাযুদ্ধের পর আন্তর্জাতিকতার পথে সাফল্যের পরিচয় হিসাবে ‘রাষ্ট্রসংঘ’ গড়ে উঠেছে। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় এই আন্তর্জাতিক সংগঠনের অবসান ঘটে। এই বিধ্বংসী যুদ্ধের পর আন্তর্জাতিকতার প্রাতিষ্ঠানিক উদাহরণ হিসাবে বিশ্ববাসী সৃষ্টি করেছে ‘সম্মিলিত জাতিপুঞ্জের’। এই আন্তর্জাতিক সংগঠনের সদস্য রাষ্ট্রস সকল জাতির সমানাধিকার ও সার্বভৌমত্ব স্বীকার করতে, পারস্পরিক সহযোগিতা ও সমন্বয়ের ভিত্তিতে আন্তর্জাতিক পরিবেশ গড়ে তুলতে এবং শান্তিপূর্ণ উপায়ে আন্তর্জাতিক সমস্যাসমূহের সমাধান করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। আন্তর্জাতিকতার স্বার্থে উগ্র ও বিকৃত জাতীয়তাবাদকে পরিহার করা দরকার। কিন্তু আদর্শ জাতীয়তাবাদ দিয়ে আন্তর্জাতিকতার সমুন্নত পরিবেশ গড়ে তোলা কল্পনা বিলাস মাত্র। সান ইয়াৎসেন (Sun Yat Sen) মন্তব্য করেছেন: “We must understand that cosmopolitanism grows out of nationalism…if we discard nationalism and go and talk cosmopolitanism, we put the cart before the horse.”

উপসংহার: তবে জাতীয়তাবাদ ও আন্তর্জাতিকতাবাদের মধ্যে সমন্বয় সাধন সহজ বিষয় নয়। সত্য ভাষণের স্বার্থে স্বীকার করতেই হবে যে, জাতীয়তাবাদ ও আন্তর্জাতিকতার মধ্যে এই সমন্বয় সাধনের আন্তরিক চেষ্টা জাতীয় রাষ্ট্রগুলির মধ্যে বড় একটা দেখা যাচ্ছে না। প্রতিটি জাতির সংকীর্ণ স্বার্থের প্রাধান্য আন্তর্জাতিকতার প্রসারের পথে প্রতিবন্ধক হিসাবে প্রতিপন্ন হয়। সংকীর্ণ স্বার্থচিন্তার ঊর্ধ্বে উঠে জাতীয় রাষ্ট্রগুলি সমৃদ্ধ চিত্রে আন্তর্জাতিকতার সুমহান আদর্শকে গ্রহণ করতে পারছে না। আন্তঃরাষ্ট্রীয় সম্পর্ক নির্ধারণের ক্ষেত্রে এখনও বিভিন্ন রাষ্ট্র প্রধানত নিজেদের জাতীয় স্বার্থের চেতনার দ্বারাই প্রভাবিত হয়ে থাকে। আজও আন্তর্জাতিকতা সার্বজনীন আদর্শ হিসাবে তেমন সাড়া জাগাতে পারেনি বা জাতীয় রাষ্ট্রসমূহের আচার-আচরণের উপর তেমন প্রভাব-প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করতে পারেনি। অর্থাৎ আন্তর্জাতিকতার আদর্শের পরিবর্তে জাতীয় রাষ্ট্রগুলি তাদের সংকীর্ণ জাতীয় স্বার্থ অনুসরণের ব্যাপারে অধিক আগ্রহী। জাতীয় রাষ্ট্রগুলির এই রকম জাতীয়তাবাদী দৃষ্টিভঙ্গির জন্যই আন্তর্জাতিক নিয়মকানুন, আন্তর্জাতিক সাম্য ও সৌভ্রাতৃত্ব প্রভৃতি ধারণাসমূহ যথাযথভাবে সুস্পষ্ট রূপ ধারণ করতে পারছে না। তাই মানবসভ্যতা এখনও সংকটমুক্ত নয়। আবার বিভীষিকাময় আণবিক যুদ্ধের আশংকাজনিত আতঙ্কও শান্তিকামী বিশ্ববাসী কাটিয়ে উঠতে পারছে না।


জাতীয়তাবাদ সম্পর্কে মার্কসীয় ব্যাখ্যা

জাতীয়তাবাদ সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট ঐতিহাসিক দৃষ্টিকোণ: জাতীয়তাবাদ ও আন্তর্জাতিকতাবাদের মধ্যে সম্পর্ক বিষয়ক মার্কসীয় ব্যাখ্যা পৃথক প্রকৃতির। মার্কসবাদীদের মতানুসারে নির্দিষ্ট ঘটনাপ্রবাহের ভিত্তিতে জাতীয়তাবাদের গুণাগুণ বিচার করা বাঞ্ছনীয়। সামাজিক উৎপাদনের উপাদানসমূহের ক্রমবিকাশ ঘটে। এই ক্রমবিকাশের একটি বিশেষ স্তরে জাতীয়তাবাদের উদ্ভব হয়। এই কারণে জাতীয়তাবাদের ভূমিকার মূল্যায়নের ক্ষেত্রে সুনির্দিষ্ট ঐতিহাসিক দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করা দরকার। মার্কসবাদে বুর্জোয়া জাতীয়তাবাদের বিরোধিতা করা হয়। এবং বুর্জোয়া জাতীয়তাবাদের বিরুদ্ধে আপসহীন সংগ্রামের কথা বলা হয়। মার্কসীয় তাত্ত্বিকদের অভিমত অনুসারে পরাধীন ও নিপীড়িত জাতির জাতীয়তাবাদ হল প্রকৃতিগতভাবে প্রগতিশীল এবং গণতান্ত্রিক। মার্কসবাদে কোন জাতি বা মানবগোষ্ঠীর উপর অন্য কোন জাতি বা মানবগোষ্ঠীর আধিপত্যকে অস্বীকার করা হয়। অন্য জাতির উপর এই ধরনের কর্তৃত্ব কায়েম করার অপচেষ্টার বিরুদ্ধে নিরন্তর সংগ্রামের ডাক দেওয়া হয়। মার্কসীয় দর্শন অনুসারে ঔপনিবেশিকতাবাদ ও সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে পরিচালিত জাতীয় মুক্তি-আন্দোলন হল প্রগতিশীল প্রকৃতির। এই কারণে এই ধরনের আন্দোলনকে সমর্থন করা হয়।

শ্রমিকশ্রেণীর নেতৃত্বে জাতীয় মুক্তি আন্দোলন: পরাধীন ও নির্যাতিত মানুষের জাতীয়তাবাদের প্রকৃতি হল প্রগতিশীল ও গণতান্ত্রিক। এই মানবগোষ্ঠীর জাতীয় মুক্তি আন্দোলন হল গণতান্ত্রিক ও প্রগতিশীল। তবে এ ক্ষেত্রে একটি শর্ত আছে। এই আন্দোলনের নেতৃত্ব সংখ্যাগরিষ্ঠ মেহনতী মানুষের হাতে থাকা চাই। জাতির মুক্তি আন্দোলন শ্রমজীবী মানুষের নেতৃত্বাধীনে পরিচালিত হলে তা গুণগত বিচারে পৃথক প্রকৃতি ও মাত্রা লাভ করে। জাতীয় মুক্তি আন্দোলনের সম্মুখভাগে দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ কৃষক-শ্রমিকের অবস্থানের ফলে এই আন্দোলনের গণতান্ত্রিক ও প্রগতিশীল প্রকৃতি বজায় থাকে। কারণ এই শ্রমজীবী শ্রেণীই হল সাম্রাজ্যবাদী শাসন-শোষণের বিরুদ্ধে সব থেকে সক্রিয় ও খাঁটি প্রতিপক্ষ।

জাতীয় বুর্জোয়াদের নেতৃত্বে মুক্তি আন্দোলন: গণতান্ত্রিক ও প্রগতিশীল চরিত্র হারিয়ে ফেললে জাতীয় মুক্তি-আন্দোলন আদর্শভ্রষ্ট হয়। তখন এই আন্দোলন বর্ণ-বিদ্বেষী বা উগ্র-জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে রূপান্তরিত হওয়ার আশঙ্কা থাকে। এরকম আশংকা দেখা দেয় যখন আন্দোলনের নেতৃত্ব জাতীয় বুর্জোয়াদের হাতে চলে যায়। অনেক ক্ষেত্রেই বুর্জোয়া শ্রেণী জাতীয় মুক্তি আন্দোলনে অংশগ্রহণ করে থাকে। জাতীয় বুর্জোয়াদের এ ধরনের সিদ্ধান্ত ও ভূমিকার পিছনের কাজ করে তাদের ভবিষ্যৎ শ্রেণীস্বার্থের বিচার-বিবেচনা। প্রসঙ্গত উল্লেখ করা দরকার যে ঔপনিবেশিক বিদেশী শাসন বুর্জোয়া শ্রেণীর আর্থ-রাজনীতিক স্বার্থের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। জাতীয় বুর্জোয়াদের উদ্দেশ্য হল দেশের উৎপাদন ব্যবস্থা, বাজার তথা রাজনীতিক ব্যবস্থার উপর নিজেদের কর্তৃত্ব কায়েম করা। সুতরাং নিজেদের শ্রেণী-স্বার্থের কথা বিবেচনা করে জাতীয় বুর্জোয়ারা জাতীয় মুক্তি আন্দোলনের সামিল হয়। তবে এই আন্দোলনের নেতৃত্ব নিজেদের কর্তৃত্বাধীনে রাখার ব্যাপারেই তারা সক্রিয় ও আন্তরিক থাকে। এই আন্দোলনে শ্রমজীবী জনতার নেতৃত্ব বা সক্রিয়তা বুর্জোয়াদের শ্রেণী স্বার্থকে বিপন্ন করে তুলতে পারে। এ ব্যাপারে জাতীয় বুর্জোয়ারা সতত সতর্ক থাকে। তারা জাতীয় মুক্তি আন্দোলনে মেহনতী মানুষের সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণের সুযোগ-সুবিধা অপহরণের চেষ্টা করে। তারা এই আন্দোলনে নিপীড়িত শ্রমিক-কৃষকের সক্রিয় ভূমিকার বিরোধিতা করে।

প্রলেতারীয় আন্তর্জাতিকতা জাতীয়তাবাদের মার্কসীয় ভাষ্য: প্রলেতারীয় আন্তর্জাতিকতার আদর্শের উপর জাতীয়তাবাদ সম্পর্কিত মার্কসীয় ধারণা প্রতিষ্ঠিত। প্রলেতারীয় আন্তর্জাতিকতার উদ্দেশ্য হল জাতীয় স্বার্থের সঙ্গে মেহনতী মানুষের আন্তর্জাতিক শ্রেণী-স্বার্থকে সংযুক্ত করা। প্রকৃত প্রস্তাবে প্রলেতারীয় আন্তর্জাতিকতার আদর্শের দিক থেকে প্রকৃত জাতীয় স্বার্থের প্রতি কোন বিরোধিতা থাকে না। প্রসঙ্গত উল্লেখ করা দরকার যে, জাত্যভিমান, পররাজ্য পদানত করা, অন্য জাতির উপর কর্তৃত্ব কায়েম করা প্রভৃতি বিষয়ের উপর এক উগ্র বা বিকৃত জাতীয়তাবাদের সৃষ্টি হয়। প্রলেতারীয় আন্তর্জাতিকতা হল এ ধরনের জাতীয়তাবাদের পরিপন্থী।

প্রলেতারীয় আন্তর্জাতিকতার অর্থ: সাধারণভাবে জাতি-বর্ণ নির্বিশেষে সকল মেহনতী মানুষের শ্রেণী সংহতিকেই বলে প্রলেতারীয় আন্তর্জাতিকতা। এই শ্রেণী-সংহতির উদ্দেশ্য হল যাবতীয় জাতিগত ও সামাজিক নির্যাতন এবং পুঁজির শাসন-শোষণ থেকে মুক্তি অর্জন করা। পুঁজি (capital) হল একটি শক্তি। এই শক্তি নির্দিষ্ট কোন গণ্ডীর মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকতে পারে না। আবার এই পুঁজির প্রকৃতি হল শোষণ। এবং পুঁজি তার এই শোষণমূলক প্রকৃতিকে প্রয়োগ করে একটি আন্তর্জাতিক শক্তি হিসাবে আত্মপ্রকাশ করে। কোন রকম বাছ-বিচার ছাড়াই পুঁজি সকল দেশের মেহনতী মানুষকে শোষণ করে। এই ঘটনা ঘটে কারণ পুঁজি বিদেশে রপ্তানী করা হয়। শোষক শ্রেণী বিদেশের বাজারে পুঁজি বিনিয়োগ করে এবং এই পথে সকল দেশের শ্রমজীবী মানুষকে শোষণ করে। এইভাবে দুনিয়া জুড়ে পুঁজির মাধ্যমে শ্রমজীবী শ্রেণীর উপর শোষণ কায়েম করার মাধ্যমে শোষক শ্রেণী এক মুনাফার পাহাড় গড়ে তোলে। অর্থাৎ পৃথিবী জুড়ে পুঁজির শাসন-শোষণ অব্যাহতভাবে চলতে থাকে। পুঁজিবাদী শাসন-শোষণের এই যাঁতাকল থেকে শ্রমজীবী শ্রেণীর মুক্তিলাভের জন্য পুঁজির রাজত্বের অবসান হওয়া দরকার। এবং তারজন্য অপরিহার্য হল মেহনতী মানুষের শ্রেণী-সংহতি বা প্রলেতারীয় আন্তর্জাতিকতা। পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থায় মেহনতী মানুষের শ্রেণীগত একটা বিশেষ অবস্থান থাকে। এবং এই অবস্থান থেকেই সৃষ্টি হয় প্রলেতারীয় আন্তর্জাতিকতার। প্রসঙ্গত উল্লেখ করা দরকার যে, প্রলেতারীয় আন্তর্জাতিকতার এক অনন্য অভিব্যক্তি ঘটেছে ‘কমিউনিস্ট ইস্তেহার’-এর ‘দুনিয়ার মজদুর এক হও’—এই আহ্বানের মাধ্যমে।

প্রলেতারীয় আন্তর্জাতিকতা জাতীয়তাবাদের বিরোধী নয়: অনেকের মতে প্রলেতারীয় আন্তর্জাতিকতা জাতীয়তাবাদের বিরোধী। কিন্তু এই বক্তব্য যথার্থ নয়। প্রলেতারীয় আন্তর্জাতিকতা হল জাতীয় বুর্জোয়াদের নৈরাজ্যবাদের বিরোধী—কোনভাবেই প্রকৃত জাতীয়তাবাদের বিরোধী নয়। প্রলেতারীয় আন্তর্জাতিকতার উদ্দেশ্য হল সকল জাতির প্রকৃত স্বার্থকে যথাযথভাবে বিকাশের ব্যবস্থা করা। পৃথিবীর সকল দেশের মেহনতী মানুষের সাধারণ স্বার্থ সংরক্ষণের উদ্দেশ্যে প্রলেতারীয় আন্তর্জাতিকতা সংগ্রামের ডাক দেয়। এবং এই সংগ্রামের লক্ষ্য হল সকল জাতির স্বার্থ সংরক্ষণ। প্রলেতারীয় আন্তর্জাতিকতার আদর্শ অনুসারে শ্রমজীবী শ্রেণীর স্বার্থের সঙ্গে জাতীয় স্বার্থকে সংযুক্ত করে দেখা হয়। এখানে জাতির ভবিষ্যৎকে মেহনতী জনতার সামাজিক মুক্তির সঙ্গে এক করে দেখা হয় এবং তদনুসারে সমস্ত বিষয়টি বিচার-বিবেচনা করা হয়। প্রলেতারীয় আন্তর্জাতিকতায় জাতীয় স্বার্থকে কোনভাবেই অবহেলা বা অস্বীকার করা হয় না। প্রলেতারীয় আন্তর্জাতিকতার আদর্শ অনুসারে সকল জাতির আত্মবিকাশের জন্য প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধার উপর জোর দেওয়া হয়।


জাতীয়তাবাদে ল্যাস্কির মতামত

ল্যাস্কির দৃষ্টিভঙ্গি ইতিহাস মনস্ক: ল্যাস্কি আন্তর্জাতিকতার আদর্শের প্রবক্তা হিসাবে পরিচিত। রাজনীতিক বিষয়াদি বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে তিনি অত্যন্ত বাস্তববাদী ও যুক্তিনিষ্ঠ এবং গোঁড়ামি ও সংকীর্ণতার বিরুদ্ধে। ল্যাস্কি সংকীর্ণ ও ব্যাপক উভয় দৃষ্টিভঙ্গি থেকেই জাতীয়তাবাদের ধারণা ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করেছেন। সংকীর্ণ জাতীয়তাবাদ ও রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমিকতার সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত অন্ধ সংস্কারের দিকগুলি তিনি তুলে ধরেছেন। এবং এই সবের বিরুদ্ধে তিনি কঠোর সমালোচনা করেছেন। তিনি দেখিয়েছেন যে সংকীর্ণ জাতীয়তাবাদই অসংখ্য আন্তর্জাতিক সমস্যার সৃষ্টি করেছে। সংকীর্ণ জাতীয়তাবাদ ও চরম সার্বভৌমিকতার ধারণাকে পরিহারের প্রয়োজনীয়তার কথা তিনি ব্যাখ্যা করেছেন। সংকীর্ণ জাতীয়তাবাদ ও চরম সার্বভৌমিকতা সঞ্জাত সমস্যাদির গঠনমূলক সমাধানের ব্যাপারে তিনি পথ নির্দেশ করেছেন। প্রকৃত প্রস্তাবে ‘জাতীয়তাবাদ ও সভ্যতা’ সম্পর্কিত আলোচনার ক্ষেত্রে অধ্যাপক ল্যাস্কি ইতিহাস-মনস্ক দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করেছেন। জাতীয়তাবাদের স্বরূপ ও সমস্যা বিচার বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে তিনি সম্পূর্ণ তথ্যনিষ্ঠ আলোচনার অবতারণা করেছেন।

জাতীয়তাবাদের অর্থ সম্পর্কে ল্যাস্কির অভিমত:

ল্যাস্কি তাঁর A Grammar of Politics শীর্ষক গ্রন্থে জাতীয়তাবাদ ও সভ্যতা সম্পর্কে বিস্তারিত ভাবে আলোচনা করেছেন। ল্যাস্কির মতানুসারে সহজে জাতীয়তাবাদের সংজ্ঞা দেওয়া যায় না। কারণ নির্দিষ্ট কোন উপাদানের দ্বারা অস্তিত্ব নির্ধারণ করা যায় না। কেন মানুষের মনে জাতীয়তাবোধের উন্মেষ ঘটে তা বলা সহজসাধ্য নয়। ল্যাস্কি বলেছেন: “The idea of nationality is not easy to define, for there is no measurable factor to which it can be traced.” বস্তুত জাতীয়তার বিষয়টি বিশেষভাবে জটিল। জাতি ও বর্ণের বিভিন্নতা সত্ত্বেও জাতীয়তার সৃষ্টি হতে পারে। যেমন আমেরিকায় হয়েছে। বস্তুত য়ুরোপের সকল দেশেই জাতিগত ও বর্ণগত পার্থক্য বর্তমান। ভাষাগত বিভিন্নতা সত্ত্বেও জাতীয়তার উন্মেষ ঘটতে পারে। যেমন সুইজারল্যাণ্ডে ঘটেছে। রাজনীতিক আনুগত্যকেও এককভাবে জাতীয়তাবাদের নির্ধারক হিসাবে নির্দেশ করা যায় না। ঊনবিংশ শতাব্দীর য়ুরোপে রাজনীতিক আনুগত্য পরিবর্তনের ঘটনা অহরহ ঘটেছে। আবার নিজেদের স্বাধীন ভূখণ্ডের বিষয়টি জাতিগত স্বাতন্ত্র্য্যের চেতনা সৃষ্টির সহায়ক। এ কথা ঠিক। কিন্তু এই উপাদানটিও জাতীয় জনসমাজের অপরিহার্য উপাদান নয়। এ ক্ষেত্রে উদাহরণ হিসাবে ইহুদীদের কথা বলা যায়। আগে ইহুদীদের নিজস্ব কোন স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র-ভূমি ছিল না। ফরাসী দার্শনিক রেনাঁ (Renan) তাঁর প্রবন্ধে মন্তব্য করেছেন যে, জাতীয়তাবোধ হল মূলত মানসিক বা আত্মিক (spiritual) ধারণা। ল্যাস্কি বলেছেন: ‘আমি তাঁর সঙ্গে একমত।’ তাঁর কথায়: the idea of nationality is essentially spiritual in character.” মানসিক বা আত্মিক ধারণাই জাতীয়তাবাদের ভিত্তি রচনা করে। জাতীয়তাবাদ এক গভীর ঐক্যবোধ গড়ে তোলে। এই বোধের ভিত্তিতে একটি জাতীয় জনসমাজের মধ্যে অন্য জাতীয় জনসমাজ থেকে এক ধরনের স্বাতন্ত্র্যবোধের সৃষ্টি হয়। নিজেদের মধ্যে সাদৃশ্য সম্পর্কে তাদের মধ্যে সচেতনতা থাকে; আবার অন্যদের সঙ্গে পার্থক্য সম্পর্কেও সচেতন থাকে। বস্তুত এই রকম একটি মানবগোষ্ঠী মানসিক বা আত্মিক কারণেই অন্যদের থেকে স্বাতহ্যের চেতনা পোষণ করে। একান্তভাবে তাদের সামাজিক উত্তরাধিকার সংশ্লিষ্ট জনগোষ্ঠীর মধ্যে এই স্বাতন্ত্র্যবোধের সৃষ্টি করে। যে সামাজিক ঐতিহ্য মানবগোষ্ঠীর মধ্যে ঐক্যবোধকে জমাট করে তার কতকগুলি উপাদান আছে। এগুলি হল অভিন্ন ইতিহাস-ঐতিহ্য, বিভিন্ন ক্ষেত্রে জাতীয় সাফল্যের চেতনা প্রভৃতি। এই সমস্ত ক্ষেত্রে অভিন্নতার অস্তিত্বের চেতনা সংশ্লিষ্ট মানবগোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত ব্যক্তিবর্গের মধ্যে সাদৃশ্যের সূত্র উপলব্ধিতে সাহায্য করে বা দৃশ্যমান সাদৃশ্যগুলির উপর গুরুত্ব আরোপ করে। এই সমস্ত কারণের জন্য এই জনগোষ্ঠীর সদস্যরা পরস্পরের প্রতি সহানুভূতিশীল। তাদের স্বার্থ, উদ্দেশ্য ও আদর্শ অভিন্ন। তাদের শিল্প-সাহিত্য এবং আচার-অনুষ্ঠানও অভিন্ন এবং অন্যদের থেকে আলাদা। প্রত্যেক জাতিই তাদের দার্শনিক ও সাহিত্যিকদের নিয়ে গর্ব বোধ করে।

জাতীয়তাবাদের উন্মেষ আর্থনীতিক কারণে হয় না: জাতীয়তাবাদ একটি মানবগোষ্ঠীর মধ্যে অন্য গোষ্ঠী থেকে পৃথক হওয়ার প্রেরণা সঞ্চারিত করে। জাতীয়তাবাদ অনুরূপভাবে সংশ্লিষ্ট মানবগোষ্ঠীর মধ্যে আবার সঙ্গলিপ্সা সঞ্চারিত করে। অর্থাৎ স্বাতন্ত্র্য সম্পর্কে সচেতনতা এবং সঙ্গলিপ্সা, আপাত বিচারে এই দুই পরস্পর-বিরোধী বৈশিষ্ট্য জাতীয়তাবাদের মধ্যে বর্তমান থাকে। ল্যাস্কির অভিমত অনুসারে স্বাতন্ত্র্য সম্পর্কে সচেতনতা থেকেই সৃষ্টি হয় সঙ্গলিপ্সার। দেশপ্রেম (patriotism) একটি জনগোষ্ঠীকে অন্য একটি জনগোষ্ঠী থেকে বিচ্ছিন্ন হতে অনুপ্রাণিত করে। আবার এই দেশপ্রেমই সংশ্লিষ্ট জনগোষ্ঠীকে ঐক্যবদ্ধ থাকতে উদ্বুদ্ধ করে। জাতীয়তাবাদেরই এক অভিব্যক্তি হল এই দেশপ্রেম। প্রকৃতিগত বিচারে জাতীয়তাবাদ স্বাতন্ত্র্যসম্পন্ন। ল্যাস্কির মতানুসারে জাতীয়তাবাদের উন্মেষ আর্থনীতিক কারণে ঘটে না। স্বাতন্ত্র্যবোধজনিত বিচ্ছিন্ন হওয়ার বাসনা এবং সঙ্গলিপ্সা এর পিছনে আর্থনীতিক কারণ থাকে না। আর্থিক ক্ষয়-ক্ষতির আশঙ্কা স্বীকার করে নিয়েও জাতীয়তাবোধে উদ্বুদ্ধ জনগোষ্ঠী পৃথক হতে চায়। এই পৃথক হওয়ার পিছনে প্রেরণা যোগায় দেশপ্রেম। ল্যাস্কি বলেছেন যে, ‘ব্রিটিশ শক্তি ভারতবর্ষ ছেড়ে গেলে অব্যবস্থার সৃষ্টি হবে’, এ কথা কারোরই অজানা ছিল না। কিন্তু জনগণ দেশের স্বাধীনতার জন্য যাবতীয় ক্ষতি নির্দ্বিধায় মেনে নিয়েছে। জাতীয়তাবাদের প্রেরণা এর পিছনে কাজ করে। মানুষ একটি জাতি হিসাবে স্বাধীনভাবে বাঁচতে চায়। এবং তার জন্য আর্থিক ক্ষতি স্বীকার করতে দ্বিধা করে না। এই কারণে ল্যাস্কির অভিমত হল জাতীয়তাবাদের উন্মেষ আর্থনীতিক কারণে ঘটে না।

জাতীয়তাবাদ স্বাধীন রাষ্ট্রের দাবিতে পরিণত হয়: জাতীয়তাবাদের আদর্শ অনুসারে মনে করা হয় যে, প্রত্যেক জনসমাজের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার থাকা আবশ্যক। অন্যথায় রাজনীতিক ক্ষেত্রে নৈরাজ্যের সৃষ্টি হবে। একটি জাতির উপর অন্য একটি জাতির বলপূর্বক নিয়ন্ত্রণ কায়েম রাজনীতিক বিচারে অসঙ্গত এবং নীতিগত বিচারে বিরাট ভুল। ল্যাস্কি তাঁর A Grammar of Politics শীর্ষক গ্রন্থে বলেছেন: “…the domination of one nation over another was politically inexpedient and morally wrong.” জাতীয়তাবাদের মধ্যে স্বাধিকারের দাবি থাকে। এই দাবি হল স্বাধীন ও স্বতন্ত্র রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার দাবি। জাতীয়তাবাদী চেতনা এই স্তরে উপনীত হলে সহজেই সভ্যতার চেতনার উন্মেষ ঘটে থাকে। এ প্রসঙ্গে ল্যাস্কি মন্তব্য করেছেন: “…where nationalism invokes autonomy as its right that the needs of civilisation begin to emerge.” জাতীয়তাবোধে উদ্বুদ্ধ প্রতিটি জনগোষ্ঠীর মধ্যে স্বাতন্ত্র্যবোধের ভিত্তিতে স্বাধিকারের দাবি থাকে। তারা স্বাধীন রাষ্ট্র গঠন করতে চায়। জে. এস. মিল (John Stuart Mill)-ও এই অভিমত পোষণ করতেন যে ভৌগোলিক সীমানা এবং জাতীয় জনসমাজের সীমানা অভিন্ন হওয়া আবশ্যক। জার্মান দার্শনিক হেগেল এবং ম্যাট্‌সিনি (Mazzini)-ও সমমত পোষণ করেন। প্রত্যেক জনগোষ্ঠী একটি স্বাধীন জাতি হিসাবে একটি স্বাধীন রাষ্ট্রে বসবাস করতে চায়। অধ্যাপক ল্যাস্কিও এ ক্ষেত্রে অভিন্ন মত পোষণ করেন।

একটি জাতি আর একটি জাতির উপর কর্তৃত্ব করবে না: স্বাধিকার বা স্বাধীন রাষ্ট্রের অধিকারের দাবি হিসাবে জাতীয়তাবাদের ইতিহাস অপেক্ষাকৃত আধুনিককালের। পোল্যাও বিভাগের আগে এ রকম পরিস্থিতি পরিলক্ষিত হয়নি। পোল্যাণ্ড বিভাগের মাধ্যমেই স্বতন্ত্র ও স্বাধীন রাষ্ট্র গঠনের মাধ্যমে নিজেদের স্বতন্ত্র সত্তা প্রতিষ্ঠার অভিপ্রায় প্রবলভাবে প্রতিপন্ন হয়। পোল্যাণ্ডের নাগরিকদের মধ্যে বিভিন্ন ক্ষেত্রে বহু বৈষম্য ছিল। তার ফলে পোল্যাও দ্বিধাবিভক্ত হয়। যে-কোন জাতিকে যদি দমিয়ে রাখার চেষ্টা করা হয়, তা হলে সংশ্লিষ্ট জাতি স্বাধীনতা দাবি করবেই। এই তত্ত্ব ইতিহাসের আলোচনার উপর প্রতিষ্ঠিত। এ ক্ষেত্রে উদাহরণ হিসাবে ফ্রান্স ও আমেরিকার কথা বলা যায়। ক্ষেত্রবিশেষে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করার উদ্দেশ্যে জনগোষ্ঠী শাসকচক্রের বিরুদ্ধে সংগ্রামের সামিল হয়। এ ক্ষেত্রে উদাহরণ হিসাবে ইতালীর কথা বলা হয়। অনেক সময় আবার মানবগোষ্ঠী ধর্মীয় কারণের জন্য বিদ্রোহী হয়। এ ক্ষেত্রে দৃষ্টান্ত হিসাবে তুরস্কের কথা বলা হয়। ল্যাস্কির অভিমত অনুসারে একটি জাতি আর একটি জাতির উপর কর্তৃত্ব করবে না’— এই হল জাতীয়তাবাদের মূল কথা। এবং বলা হয় যে প্রত্যেক জাতির জন্য পৃথক বাসভূমি থাকতে হবে। জাতীয় রাষ্ট্র (nation-state) হবে মানব সংগঠনের সর্বোচ্চ একক। যে-কোন জনসমাজের পৃথক রাষ্ট্র গঠন করার অধিকার আছে। জাতীয়তাবাদ এই অধিকারকে স্বীকার ও সমর্থন করে। ঊনবিংশ শতকে এই তত্ত্ব বিশেষভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়।

স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র: সুতরাং জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্রের দাবিকে উপেক্ষা করা যায় না। আবার নিজের নির্দিষ্ট এলাকার মধ্যে স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র সকল ক্ষেত্রে সর্বময় কর্তৃত্ব প্রয়োগ করতে চায়। এই রাষ্ট্র ইচ্ছামত দেশ শাসন করে এবং কোন বৈদেশিক রাষ্ট্রের হস্তক্ষেপকে বরদাস্ত করে না। নিজের আন্তর্জাতিক সীমানা, শুল্কনীতি, বিদেশীদের নাগরিকত্ব, সংখ্যালঘুদের সুযোগ-সুবিধা প্রভৃতি বিষয়ে দেশের সরকার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। সরকারের কাঠামো, ধর্মাচরণ, আচার-অনুষ্ঠান প্রভৃতি রাষ্ট্রের আভ্যন্তরীণ বিষয় হিসাবে বিবেচিত হয়। ল্যাস্কির মতানুসারে যুদ্ধ জাতীয়তাবোধের উদ্দীপক হিসাবে কাজ করে। পররাষ্ট্রের সঙ্গে যুদ্ধ সম্পর্কে দেশের নাগরিকদের সঙ্গে মতপার্থক্য থাকতে পারে। কিন্তু অন্য রাষ্ট্রের সঙ্গে দেশের যুদ্ধ বেধে গেলে সমগ্র জাতি ঐক্যবদ্ধ হয়ে দাঁড়ায়। এর কারণ হল জাতীয়তাবোধ। এ প্রসঙ্গে ল্যাস্কির আরও অভিমত হল যে নেপোলিয়নের সামরিক অভিযান য়ুরোপের বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর মধ্যে গভীর আতঙ্কের সৃষ্টি করে। এই সময়েই জাতীয়তাবাদী আদর্শ বিশেষভাবে বিকশিত হয়।

ল্যাস্কির মতানুসারে বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকে দেখা যায় যে, শিল্পোন্নয়ন (Industrialism) এবং যুদ্ধবিগ্রহ (warfare) জাতীয়তাবাদের বিকাশে সাহায্য করে, আবার জাতীয়তাবাদের বিকাশে বাধারও সৃষ্টি করে। অর্থাৎ ল্যাস্কি দুটি পরস্পর-বিরোধী প্রবণতার কথা বলেছেন। ঊনবিংশ শতাব্দীতেই এর প্রকাশ ঘটে। শিল্প বিকাশের ফলেই সৃষ্টি হয়েছে যুদ্ধাবস্থার শিল্প-বিকাশ ও যুদ্ধাবস্থার ফলে দুটি পরস্পর-বিরোধী প্রবণতা জাতীয়তাবাদের শক্তি বৃদ্ধিতে সাহায্য করেছে, আবার জাতীয়তাবাদের দুর্বলতাকে প্রকট করে তুলেছে। অধ্যাপক ল্যাঙ্কি এ বিষয়ে বিস্তারিতভাবে আলোচনা করেছেন।

শিল্পোন্নয়ন ও বহির্বাণিজ্যের সঙ্গে জাতীয়তাবাদ সম্পর্কযুক্ত: শিল্পবিপ্লবের পরিণতি হিসাবে য়ুরোপের দেশগুলিতে শিল্পোৎপাদন অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি পায়। উৎপন্ন পণ্যসামগ্রী উদ্বৃত্ত হতে থাকে। উদ্বৃত্ত পণ্যসামগ্রীর বিকিকিনির জন্য উৎপাদক দেশগুলি নিজেদের ভৌগোলিক এলাকা অতিক্রম করে বিদেশে বাজার গড়ে তোলার ব্যাপারে উদ্যোগী হয়। অর্থাৎ আধুনিক শিল্পের বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে বিশ্ব-বাজার (World-market) -এর প্রতিষ্ঠা অপরিহার্য হয়ে পড়ে। এবং এই বিশ্ব-বাজার প্রতিষ্ঠিত হওয়ার ফলে বিভিন্ন উৎপাদক দেশগুলির মধ্যে প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে যায়। এই প্রতিযোগিতা বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়ে। প্রত্যেক উৎপাদককে তার উদ্বৃত্ত পণ্যসামগ্রীর জন্য ক্রমান্বয়ে নতুন নতুন বাজারের সন্ধানে সক্রিয় থাকতে হয়। প্রতিযোগী উৎপাদক দেশগুলি একে অপরের ক্ষমতাকে সংকুচিত করতে উদ্যোগী হয়। দেশের ভিতরে এই উদ্দেশ্যে সংস্কারমূলক শুল্কনীতি গ্রহণ করা হয়। পণ্যসামগ্রীর উপর শুল্ক আরোপ করে প্রতিযোগিতা হ্রাস করার চেষ্টা করা হয়। কিন্তু বৈদেশিক বাজারের ক্ষেত্রে উৎপাদক দেশগুলির ক্ষেত্রে এই প্রতিযোগিতা মরণ-বাঁচনের লড়াই-এ পরিণত হয়। বহির্বাণিজ্যের ক্ষেত্রে বাণিজ্যিক সংস্থাগুলি নিজেদের দেশের পতাকা নিয়ে অগ্রসর হয়। এই সমস্ত বাণিজ্যিক শক্তি বিদেশের মাটিতে বাজার স্থাপন করে এবং সঙ্গে সঙ্গে নিজেদের জাতীয় পতাকা উড়িয়ে দেয়। এইভাবে বহির্বিশ্বে উপনিবেশ স্থাপনের সূত্রপাত ঘটে। এই সময় জাতীয়তাবাদের উন্মেষ ঘটে। বহির্বিশ্বে বাজার দখলকে কেন্দ্র করে বাণিজ্যিক সংস্থাগুলির মধ্যে সংঘাতের সৃষ্টি হয়। এই অবস্থায় জাতীয়তাবাদের আবির্ভাব ঘটে। প্রকৃত প্রস্তাবে বহির্বাণিজ্য এবং জাতীয়তাবাদ পরস্পরের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে সম্পর্কযুক্ত। বাণিজ্যিক গোষ্ঠীগুলি আন্তর্জাতিক স্তরে ব্যবসা-বাণিজ্যের বিস্তারের সঙ্গে সঙ্গে শিক্ষা-দীক্ষা, সভ্যতা-সংস্কৃতি, ইতিহাস-ঐতিহ্য প্রভৃতিকেও বিদেশে চালান করতে থাকে। এইভাবে জাতীয়তাবাদের প্রসার ঘটে ও সমৃদ্ধি সাধিত হয়।

সাম্রাজ্যবাদ: শিল্পোন্নত দেশগুলি বিশ্ববাজারে নিজেদের বাণিজ্যিক স্বার্থ সুরক্ষিত করার ব্যাপারে সব দিক থেকে উদ্যোগী হয়। এই দেশগুলি অনেক সময় উন্নয়নশীল দেশগুলিকে নানান শর্তে ঋণ দেয়। এবং সেই সমস্ত দেশে নিজেদের ব্যবসা-বাণিজ্যের সুযোগ-সুবিধাকে সব দিক থেকে কায়েম করার চেষ্টা করে। আর্থিক বিচারে দুর্বল দেশগুলির উপর তারা প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করে। অর্থাৎ কেবলমাত্র বাজার স্থাপন নয়, তারা একের পর এক উপনিবেশ গড়ে তুলতে থাকে। একেই বলা হয় সাম্রাজ্যবাদ। সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলির নজর বেশী থাকে প্রাকৃতিক সম্পদে সমৃদ্ধ দেশগুলির উপর। কালক্রমে দেখা যায় এক একটি অঞ্চলের সম্পদ-সামগ্রী এক-একটি জাতীয় রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণাধীন হয়ে পড়ে। উপনিবেশের সম্পদ-সামগ্রী একটিমাত্র ঔপনিবেশিক শক্তি ভোগ-দখল করতে থাকে। জাতীয়তাবোধে উদ্বুদ্ধ এই শিল্পোন্নত ঔপনিবেশিক শক্তি উপনিবেশগুলির সম্পদের উপর নিজের ভোগ-দখল কায়েম করে এবং অবাধে লুণ্ঠন চালায়। এটাই প্রতিপন্ন করে যে উপনিবেশগুলির সম্পদ-সামগ্রীর উপর তার ন্যায়সঙ্গত অধিকার বর্তমান। অধ্যাপক ল্যাস্কির মতানুসারে সাম্রাজ্যবাদ হল আসলে একটি আর্থনীতিক বিষয়।

সাম্রাজ্যবাদী শক্তির কাছে যুদ্ধ অপরিহার্য: সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলি জাতীয়তাবোধের অহমিকায় সমগ্র দুনিয়াকে নিজেদের দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখে। তাদের প্রত্যেকে বিশ্ববাজারে যে যার আর্থনীতিক স্বার্থ সংরক্ষণের ব্যাপারে একগুঁয়ে মনোভাব গ্রহণ করে। অন্য কারও কর্তৃত্বকে তারা অগ্রাহ্য করে। স্ব স্ব বাণিজ্যিক স্বার্থ সংরক্ষণের জন্য এবং সঙ্গে সঙ্গে সাম্রাজ্যবাদী শক্তি হিসাবে মান-মর্যাদা বজায় রাখতে তারা মরীয়া হয়ে উঠে। এইভাবে ঔপনিবেশিক শক্তিগুলির মধ্যে শত্রুতার সম্পর্ক এবং অবশেষে যুদ্ধের সৃষ্টি হয়। বিবাদ বিসম্বাদ মীমাংসার ক্ষেত্রে এই সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলি যুদ্ধকেই একমাত্র উপায় হিসাবে গণ্য করে। অর্থাৎ পরিস্থিতি এমন হয়ে দাঁড়ায় যে যুদ্ধ এড়ান যায় না, অবশ্যম্ভাবী হয়ে পড়ে। নিজের অস্তিত্ব রক্ষার জন্য একমাত্র উপায় হিসাবে সাম্রাজ্যবাদী শক্তি যুদ্ধকে আঁকড়ে ধরে। তাই সাম্রাজ্যবাদী শক্তির কাছে যুদ্ধ অপরিহার্য প্রতিপন্ন হয়। সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলি বিশ্ববাজার দখলের প্রতিযোগিতায় সামিল হয়। এই প্রতিযোগিতা থেকেই যুদ্ধবিগ্রহের সৃষ্টি হয়।

যুদ্ধ ও বিকৃত জাতীয়তাবোধ: জাতীয়তাবাদ থেকেই সাম্রাজ্যবাদের আবির্ভাব ঘটে। আবার সাম্রাজ্যবাদ থেকেই সৃষ্টি হয় যুদ্ধবিগ্রহের। এই যুদ্ধই আবার জাতীয়তাবাদের শত্রু হিসাবে প্রতিপন্ন হয়। যুদ্ধের মাধ্যমে জাতীয়তাবাদের দুর্বলতা প্রকাশ পায়। সুস্থ জাতীয়তাবাদ ছিল এক মহান আদর্শ; মানবসভ্যতার সামগ্রিক বিকাশের এক উপায় স্বরূপ। যুদ্ধ বিগ্রহের পরিস্থিতিতে এই জাতীয়তাবাদ উগ্র বা জঙ্গী-রূপ ধারণ করে। এই বিকৃত জাতীয়তাবাদের পরিপ্রেক্ষিতে ন্যায়বিচার, মানবতাবোধ, গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ প্রভৃতি আদর্শ অর্থহীন প্রতিপন্ন হয়। এইভাবে জাতীয়তাবাদ এক সর্বনাশা রূপ ধারণ করে এবং মানবসভ্যতার অস্তিত্বের পক্ষে অভিশাপ হিসাবে প্রতীয়মান হয়। উগ্র বা জঙ্গী জাতীয়তাবাদই জন্ম দেয় যুদ্ধবিগ্রহের। বিকৃত রূপ ধারণ করে জাতীয়তাবাদ মর্যাদার রাজনীতিতে পরিণত হয়েছে। ল্যাস্কি বলেছেন: “It involves the politics of prestige.” জঙ্গী জাতীয়তাবাদ ও সার্বভৌমিকতার প্রতি রাষ্ট্রসমূহের আকর্ষণ অপরিসীম। তারফলে পৃথিবী জুড়ে উদ্বেগ-উত্তেজনা বৃদ্ধি পাচ্ছে। অথচ প্রকৃত জাতীয়তাবাদ যুক্তিবাদের পথে চলে। এরকম জাতীয়তাবাদের প্রতি আনুগত্য আত্মবিকাশের অনুপন্থী এবং যুদ্ধবিগ্রহের পরিপন্থী। ল্যাস্কির মতানুসারে যুক্তিবাদী সুস্থ জাতীয়তাবাদ আত্মবিকাশের কাজে আত্মনিয়োগ করে। এই জাতীয়তাবাদ বিকৃত বা উগ্ররূপ ধারণ করতে পারে না।


জাতীয়তাবাদ ও আন্তর্জাতিকতাবাদে ল্যাস্কির দৃষ্টিভঙ্গি

কোন রাষ্ট্র এককভাবে সবকিছু স্থির করতে পারে না: অধ্যাপক ল্যাস্কি আন্তর্জাতিকতাবাদের আদর্শে আস্থাশীল ছিলেন। আন্তর্জাতিকতাবাদী হিসাবে তিনি জাতীয়তাবাদের সঙ্গে সঙ্গে সকল রাষ্ট্রের স্বাধিকার স্বীকার এবং সমন্বয় সাধনের উপর জোর দিয়েছেন। তিনি জাতীয় রাষ্ট্রগুলিকে আত্মিক স্বাতন্ত্র্য সংরক্ষণের সঙ্গে সঙ্গে কার্যগত সমন্বয় সাধন ও সংঘবদ্ধতার কথা বলেছেন। ল্যাস্কির মতানুসারে জাতীয় রাষ্ট্রগুলি পারস্পরিক সাহায্য-সহযোগিতার মাধ্যমে স্ব স্ব সর্বোচ্চ উন্নতিকে সুনিশ্চিত করতে পারে। অধ্যাপক ল্যাস্কির মতানুসারে, মানবজাতি দুটো বিকল্পের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে। এই দুটি বিকল্প হল : পারস্পরিক সহযোগিতা অথবা বিপর্যয় বা বিনাশ। বাঁচার অধিকার প্রতিটি জাতিরই আছে। কিন্তু এককভাবে কোন জাতিই বাঁচতে পারে না। এই কারণে কোন জাতি বা জাতীয় রাষ্ট্র কিভাবে বাঁচবে তা এককভাবে নির্ধারণ করার অধিকার ভোগ করতে পারে না। নৈতিক উদ্দেশ্যকে অগ্রাহ্য করে জাতীয় স্বার্থের অগ্রাধিকারকে স্বীকার করা যায় না। অন্ধ দেশপ্রেমকে সমর্থন করা যায় না। জাতীয় রাষ্ট্রের যাবতীয় কাজকর্মের প্রতি অন্ধ আনুগত্যকে দেশপ্রেম বলে না। জাতীয় স্বার্থ সংরক্ষণের অধিকার বলতে অপরের স্বার্থ ক্ষুণ্ণ করে নিজের স্বার্থের সংরক্ষণকে বোঝায় না। সকল ক্ষেত্রে ন্যায়বিচারের উপর জোর দিতে হবে। আন্তঃরাষ্ট্রীয় সম্পর্কের ক্ষেত্রে বলপ্রয়োগের রাজনীতি প্রকৃত অধিকারের দাবিকে স্বীকার করে না। ল্যাস্কি তাঁর A Grammar of Politics গ্রন্থে মন্তব্য করেছেন: “Patriotism in a citizen is not the blind following of his nation-state wherever it may lead, and rights of nation-state do not consist in safeguarding its own interests at the expense of others.”

আন্তর্জাতিকতাবাদ: ল্যাস্কির মতানুসারে জাতীয় রাষ্ট্রের নাগরিকদের আন্তর্জাতিক আদর্শের উন্মেষ আবশ্যক। ল্যাস্কি জনস্বাস্থ্য, ভূখণ্ড, যোগাযোগ ব্যবস্থা, সংখ্যালঘু সমস্যা প্রভৃতি কতকগুলি সাধারণ আন্তর্জাতিক সমস্যার উল্লেখ করেছেন। এই সমস্ত সমস্যার সঠিক সমাধানের জন্য সামগ্রিকভাবে মানব জাতির দিক থেকে অভিন্ন উদ্যোগ আবশ্যক। কারণ এই সমস্যাগুলি হল মানবজাতির অভিন্ন সমস্যা। এই সমস্ত সমস্যার মোকাবিলার ক্ষেত্রে স্বতন্ত্র আচরণ অর্থহীন। ল্যাস্কি এ ক্ষেত্রে আইনের ঐক্য সাধনের কথা বলেছেন। মানব জাতির এই সমস্ত সাধারণ সমস্যার সুরাহা করার উদ্দেশ্যে আন্তর্জাতিকভাবে আইন প্রণয়ন করা দরকার এবং প্রয়োজনীয় প্রশাসনিক ব্যবস্থাদি অবলম্বন করা আবশ্যক। কোন রাষ্ট্র আন্তর্জাতিক কোন বিষয়ে এককভাবে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারে না। এই অধিকার কোন রাষ্ট্রেরই নেই। ল্যাস্কি এই উদ্দেশ্যে আন্তর্জাতিক কর্তৃত্বের প্রয়োজনীয়তার পরিপ্রেক্ষিতে উপযুক্ত আন্তর্জাতিক সংগঠন গড়ে তোলার কথা বলেছেন। আন্তর্জাতিক পর্যায়ে একটি আইন-বিভাগও থাকবে। তবে এ ক্ষেত্রে ছোট-বড়-মাঝারী নির্বিশেষে সকল রাষ্ট্রের মধ্যে সাম্যের নীতি মেনে চলা যাবে না। কারণ তাতে বিভিন্ন সমস্যার সৃষ্টি হবে। ল্যাস্কি এ ক্ষেত্রে জাতীয় রাষ্ট্রসমূহের সমপ্রতিনিধিত্বের অধিকার স্বীকার করেননি। তবে তিনি আন্তর্জাতিক কর্তৃত্ব প্রয়োগের ব্যাপারে প্রত্যেক জাতীয় রাষ্ট্রের প্রতিনিধিত্বের কথা বলেছেন। গুরুত্বপূর্ণ আন্তর্জাতিক সকল বিষয়ে জাতীয় রাষ্ট্র নিজেদের মধ্যে মতামত আদান-প্রদান করবে। তা হলে গুরুত্বপূর্ণ সকল বিষয়ে ঐকমত্য গড়ে উঠবে। এবং এইভাবে যে সমস্ত সিদ্ধান্ত আন্তর্জাতিক স্তরে গৃহীত হবে জাতীয় সরকার তা বলবৎ করবে। জাতীয় সরকারের বিভিন্ন বিভাগগুলিকে নমনীয় করে তোলা দরকার। তা হলে উদ্দেশ্য সাধনের ক্ষেত্রে অসুবিধা হবে না।

আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে পীড়নমূলক আচরণ অচল: ল্যাস্কির অভিমত অনুসারে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে কোন রকম পীড়নমূলক পদ্ধতি প্রয়োগ করার সুযোগ নেই। এ ক্ষেত্রে বলপ্রয়োগ বিপদের সৃষ্টি করবে। কারণ বলপ্রয়োগের মাধ্যমে বৈরী মনোভাবের সৃষ্টি হয় এবং বিচ্ছিন্নতাবাদী শক্তির উদ্ভব হয়। ল্যাস্কির মতানুসারে কোন সিদ্ধান্তকে জোর করে কারও উপর চাপিয়ে দেওয়া চলবে না। এবং এই উদ্দেশ্যে জাতীয় রাষ্ট্রের চরম সার্বভৌমিকতার তত্ত্বকে বাতিল করা একান্তভাবে অপরিহার্য। জাতীয় রাষ্ট্রের চরম সার্বভৌমিকতার নীতিকে বাতিল করে দিলে জাতীয় রাষ্ট্রগুলির মধ্যে পারস্পরিক সহযোগিতা ও সম্প্রীতির পরিবেশ গড়ে উঠবে। ল্যাস্কির মতানুসারে আন্তর্জাতিকতাবাদ এবং জাতীয় রাষ্ট্রের চরম সার্বভৌমিকতা পরস্পরের প্রতিকূল।

স্বাদেশিকতা আন্তর্জাতিকতার বিরোধী নয়: অনেকের মতে আন্তর্জাতিকতার পথে দেশপ্রেম প্রতিবন্ধকতা করে। আশঙ্কা প্রকাশ করে বলা হয় যে আন্তর্জাতিকতার উপর জোর দিলে স্বাদেশিকতা বা দেশপ্রেম প্রতিহত হবে। কিন্তু স্বাদেশিকতা হল একটি সহজাত প্রবৃত্তি। এই প্রবৃত্তিকে পরিত্যাগ করা যায় না। স্বতন্ত্র জাতীয় সত্তার উপর স্বাদেশিকতা বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করে। সুতরাং স্বাদেশিকতা আন্তর্জাতিকতার বিরোধী। এবং এই দু–এর মধ্যে বিরোধ অনপনেয়। ল্যাস্কি উপরিউক্ত ধারণাকে সমর্থন করেন না। তাঁর মতানুসারে স্বাদেশিকতা ও আন্তর্জাতিকতার মধ্যে কোন প্রকৃত বিরোধ নেই। সাধারণত সংকীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি থেকে স্বাদেশিকতার অর্থ ব্যাখ্যা করা হয়। তার ফলেই স্বাদেশিকতা ও আন্তর্জাতিকতার মধ্যে বিরোধ প্রতিপন্ন হয়। স্বার্থান্ধতা বা সংকীর্ণ অর্থে স্বাদেশিকতার সঙ্গে আন্তর্জাতিকতার বিরোধ আছে। এবং এ দু-এর সহাবস্থান সম্ভব নয়। কিন্তু ব্যাপক অর্থে স্বাদেশিকতা বলতে যা বোঝায় তার সঙ্গে আন্তর্জাতিকতার কোন বিরোধ নেই। স্বাদেশিকতার আদর্শকে সামাজিক কল্যাগের আদর্শের সঙ্গে সংযুক্ত করতে হবে। তখন স্বাদেশিকতা ও আন্তর্জাতিকতার বিরোধ অপসারিত হবে। ল্যাস্কি জাতির আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার বা স্বাদেশিকতার বিরুদ্ধে মত প্রকাশ করেননি। তাঁর মতানুসারে স্বাদেশিকতার সৃষ্টি হয় মানুষের সংঘবদ্ধভাবে বসবাস করার স্বাভাবিক প্রবৃত্তি থেকে। আবার স্বায়ত্তশাসনের বাসনার সঙ্গেও স্বাদেশিকতা সংযুক্ত থাকে। ল্যাস্কির মতে নিজের যাবতীয় বিষয় পরিচালনা ও নিয়ন্ত্রণের অধিকার প্রত্যেক জাতিরই আছে। তা অস্বীকার করা যাবে না। তবে যে কোন জাতির এই অধিকার অপরের বিষয়াদি নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতায় পরিণত হতে পারে না। স্বাদেশিকতার অর্থ হল নিজের বিষয়ে নিযুক্ত থাকার অধিকার এবং অপরের ব্যাপারে নাক না গলানোর দায়িত্ব। আন্তর্জাতিকতা স্বায়ত্তশাসনের পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায় না। স্বায়ত্তশাসনের পরিপূর্ণ স্বাধীনতা সকলের আছে। সে পথে আন্তর্জাতিকতা কোন অন্তরায় নয়। নিজের দেশের প্রতি ভালবাসা এবং আন্তর্জাতিকতার প্রতি আনুগত্য—এ দু-এর মধ্যে কোন বিরোধ নেই। ল্যাঙ্কির মতানুসারে বিকৃতভাবে স্বাদেশিকতাকে প্রয়োগ করা হয়, তাই সমস্যার সৃষ্টি হয়। তিনি স্বাদেশিকতার আর্থনীতিক ব্যাখ্যা দিয়েছেন। তাঁর মতে স্বদেশপ্রীতির কথা বলে একটি দেশের মুষ্টিমেয় কিছু মানুষের মুনাফাকেন্দ্রিক স্বার্থ সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়; এতে সর্বসাধারণের স্বার্থ রক্ষা হয় না। আন্তর্জাতিকতার আদর্শই হল এই অবস্থা থেকে মুক্তি লাভের উপায়। ল্যাস্কি জাতীয় রাষ্ট্রগুলির মধ্যে পারস্পরিক সহযোগিতার উপর জোর দিয়েছেন। তিনি ছিলেন মনেপ্রাণে একজন আন্তর্জাতিকতাবাদী। তাঁর আন্তর্জাতিকতাবাদ সংকীর্ণ জাতীয়তাবাদের স্বার্থান্ধতার বিরুদ্ধে এবং বিশ্বমৈত্রী ও মাবজাতির কল্যাণের পক্ষে।