আমরা জীবন ধারণের জন্য এক জীবমণ্ডল (Biosphere)-এর ওপর নির্ভরশীল। গত প্রায় 500 বছরে পৃথিবীর সম্পদ ও শক্তি অসমভাবে বণ্টিত হয়েছে। পৃথিবীর জলবায়ুগত সমস্যা নানা কারণে সৃষ্টি হয়েছে। অধিকাংশ বিজ্ঞানী জলবায়ু পরিবর্তনের যেসব কারণ সম্পর্কে একমত পােষণ করেন সেগুলােকে দুটি ভাগে ভাগ করা যায়। যথা一
-
পৃথিবীর ও বায়ুমণ্ডলের বহিস্থ কারণসমূহ বা অপার্থিব কারণ।
-
পৃথিবীর ও বায়ুমণ্ডলের অভ্যন্তরীণ কারণসমূহ বা পার্থিব কারণ।
(ক) সূর্য ও পৃথিবীর মধ্যে পারস্পরিক অবস্থানগত পরিবর্তন : কোনাে স্থানের জলবায়ুর বৈশিষ্ট্য সাধারণত নির্ভর করে পৃথিবীর অক্ষের কৌণিক অবস্থানের পরিমাণ, পৃথিবীর আহ্নিক ও বার্ষিক গতির প্রভাব, পৃথিবীর কক্ষপথের আকৃতি এবং পৃথিবী থেকে সূর্যের দূরত্বের ওপর। এসব নিয়ামকগুলাে স্বল্পকালের ভিত্তিতে স্থির বলে মনে হলেও দীর্ঘকালের ভিত্তিতে তাদের পরিবর্তন ঘটে। ফলে জলবায়ুর পরিবর্তন ঘটে থাকে। উপরােক্ত নিয়ামকের পরিবর্তন সম্পর্কে নীচে আলােচিত হল一
-
পৃথিবীর অক্ষরেখার কৌণিক মানের পরিবর্তন : পরিক্রমণকালে পৃথিবীর অক্ষ বা মেরু রেখাটি কক্ষতলের সাথে সব সময় 66-১/২ কোণে থাকে। অক্ষটি কক্ষতলের ওপর লম্বভাবে (90° কোণে) না থেকে 23-১/২ কোণ করে অবস্থান করছে। এই কৌণিক অবস্থানটি স্থির নয়। এই কৌণিক পরিমাপটি 41, 000 বছরের ব্যবধানে 22° -25° পর্যন্ত পরিবর্তিত হয়। এইসময় শীত ও গ্রীষ্মের তাপমাত্রার তারতম্য অধিক হয়।
-
পৃথিবীর কক্ষপথের পরিবর্তন : পৃথিবী যে নির্দিষ্ট উপবৃত্তাকার পথে সূর্যকে পরিক্রমণ করে চলেছে, তাকে কক্ষপথ (Orbit) বলে। পৃথিবীর কক্ষটি উপবৃত্তাকার (Elliptical)। এই উপবৃত্তাকার কক্ষ পথটির আকৃতি স্থির নয়। প্রায় 1,10,000 বছরের ব্যবধানে এর আকৃতি প্রায় বৃত্তাকার থেকে অতি উপবৃত্তাকার পর্যন্ত হয়ে থাকে। ফলে পৃথিবী ও সূর্যের মধ্যকার দূরত্বের পরিবর্তন ঘটে শীত ও গ্রীষ্ম ঋতুতে। পৃথিবীর কক্ষপথের আকৃতি যখন প্রায় বৃত্তাকার তখন পৃথিবীর সৌরশক্তি লাভের পরিমাণ বর্তমানের তুলনায় 0.014% বেড়ে যায় এবং কক্ষপথের আকৃতি যখন অতি উপবৃত্তাকার তখন পৃথিবীর সৌরশক্তি লাভের পরিমাণ বর্তমানের তুলনায় 0.17% কমে যায়।
-
সূর্যের অনুসূর অবস্থানের অয়ন চলন : সৌরজগতে সূর্য যেমন একটি নির্দিষ্ট পথে ভ্রমণ করছে তেমনি পৃথিবীও তার কক্ষপথে সূর্যকে প্রদক্ষিণ করছে। চলমান এই দুটি জ্যোতিষ্কের মধ্যে আমরা সূর্যের পরিভ্রমণকে বুঝতে পারি না। বর্তমান পরিভ্রমণে সূর্য পৃথিবীর উপবৃত্তকার কক্ষপথের ডানদিকের একটি কেন্দ্রবিন্দুতে অবস্থান করায় এদের মধ্যে দূরত্ব এক থাকে না। যেমন 4ঠা জুলাই অপসূর অবস্থানে সূর্য থেকে পৃথিবীর দূরত্ব সবচেয়ে বেশি (প্রায় 152 মিলিয়ন কিমি) হয়। এসময়ে উত্তর গােলার্ধে গ্রীষ্মকাল ও দক্ষিণ গােলার্ধে শীতকাল বিরাজ করে। কিন্তু সূর্য নিজস্ব কক্ষপথে ভ্রমণ করতে থাকায় 10,500 বছর পরে সে পৃথিবীর কক্ষপথের বিপরীত দিকে অর্থাৎ বাঁ-দিকের একটি কেন্দ্রবিন্দুতে অবস্থান করবে। সূর্যের এরূপ স্থান পরিবর্তনকে অয়ন চলন বলা হয়। এর ফলে তখনও 4ঠা জুলাই সূর্যের অপসূর অবস্থানের পরিবর্তে অনুসূর অবস্থানে (প্রায় 147 মিলিয়ন কিমি) এবং 3 রা জানুয়ারি অনুসূর অবস্থানে উত্তর ও দক্ষিণ গােলার্ধে যথাক্রমে শীতকাল ও গ্রীষ্মকাল একইভাবে উত্তর গােলার্ধে গ্রীষ্মকাল ও দক্ষিণ গােলার্ধে শীতকাল বিরাজ করবে। এভাবে 10,800 বছর অন্তর সূর্যের দুটি ভিন্ন অবস্থানে একই গােলার্ধে গ্রীষ্মকাল অথবা শীতকাল বিরাজ করায় উষ্ণতার ফারাক অধিক হয় যা জলবায়ুর পরিবর্তন ঘটাতে সাহায্য করে। এখন অপসূর ও অনুসূর অবস্থানে যথাক্রমে উত্তর ও দক্ষিণ গােলার্ধে গ্রীষ্মকাল বিরাজ করে। তাই দেখা গেছে যে উত্তর গােলার্ধের গ্রীষ্মকাল অপেক্ষা দক্ষিণ গােলার্ধের গ্রীষ্মকাল প্রায় 4°সে. বেশি উষ্ণ। এজন্য বলা যায় সূর্যের অয়ন চলনের ফলে জলবায়ুর পরিবর্তন অবশ্যই সম্ভব।
(খ) সূর্যের শক্তি উৎপাদনের হ্রাসবৃদ্ধি : সূর্য যে পরিমাণ শক্তি উৎপাদন করে তার হ্রাসবৃদ্ধি ঘটে এবং এই হ্রাসবৃদ্ধি নির্ভর করে সৌরদীপ্তির চক্রের ওপর। সৌরদীপ্তিতে ৪0 বছর ও 11 বছর দীর্ঘ দুটি ভিন্ন চক্র লক্ষ করা যায়। সৌরদীপ্তির পরিবর্তনের ফলে বায়ুমণ্ডলের উপরিভাগে পতিত ‘সৌর ধ্রুবকের’ পরিমাণের পরিবর্তন ঘটে। 1645-1715 খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত সময়ে সৌরদীপ্তির মাত্রা ছিল সর্বনিম্ন পর্যায়ে, ফলে পৃথিবীর তাপমাত্রা ছিল তুলনামূলকভাবে কম।
(ক) বায়ুমণ্ডলের গঠনের পরিবর্তন : পৃথিবীতে উদ্ভিদের আবির্ভাবের পূর্বে বায়ুমণ্ডলে কাবন ডাইঅক্সাইডের পরিমাণ ছিল বহুগুণ বেশি। কার্বন ডাইঅক্সাইডের উপস্থিতিতে বাতাসের উয়তাও ছিল বেশি। পরবর্তীকালে পৃথিবী উদ্ভিদের আবরণে ঢেকে যায়। ফলে উদ্ভিদ দ্বারা অতিরিক্ত কার্বন ডাইঅক্সাইড শােষিত হওয়ায় পৃথিবীর উয়তা বহুগুণে হ্রাস পায় এবং পৃথিবীর জলবায়ুতে পরিবর্তন সূচিত হয়।
(খ) মহাদেশসমূহের স্থান পরিবর্তন ও ভূ-সংক্ষোভ
-
ভূ-আন্দোলনের ফলে অভিসারী পাত সীমানায় পলিরাশি সংকুচিত ও উত্থিত হলে বায়ু চলাচলে বিঘ্ন ঘটে এবং উচ্চতার কারণে স্থানটি শীতল হয়ে পরে। হিমালয় ও তিবৃত মালভূমির উত্থানের ফলে পশ্চিম চিন ও মধ্য এশিয়ায় মরুভূমির সৃষ্টি হয়েছে।
-
মহাদেশীয় চলনের ফলে জলবায়ুর আঞ্চলিক পরিবর্তন ঘটে। মেরু অঞ্চলের নিরক্ষরেখামুখী চলনের ফলে মেরু সংলগ্ন অঞ্চলের বরফ গলে গেলে হৈমিক জলবায়ুর পরিবর্তে উয় জলবায়ুর আবির্ভাব ঘটে। মহাদেশের মেরুমুখী সঞ্চলনের ফলে বিপরীত অবস্থার সৃষ্টি হয়। মহাদেশীয় সঞলনের ফলে মহাদেশ ও মহাসাগরের মধ্যে স্থান বিনিময় ঘটে। ফলে বাস্পীভবনের মাত্রার হেরফের ঘটে যা জলবায়ুর পরিবর্তনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
-
দুটি অভিসারী সামুদ্রিক পাত সীমানায় অগ্ন্যুৎপাতের ফলে সমুদ্রের জল বেশ উয় হয়ে যায়। তখন সমুদ্রপৃষ্ঠ সংলগ্ন বায়ু উত্তপ্ত হলে এল নিনাের অনুরূপ ঘটনা জলবায়ুর পরিবর্তনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
-
স্থলভাগে আগ্নেয় বিস্ফোরণের ফলে বাতাসে যে ধূলিকণা, ধূম, বিভিন্ন গ্যাস নির্গত হয় এবং বাতাসে CO, এর মান ভীষণভাবে বেড়ে গেলে বাতাসের উয়তা বেড়ে যায়। আবার ধূলিকণা, লবণ কণা জল আকর্ষণকারী কেন্দ্রাণু (Hygroscopic Nuclei) রূপে বাতাসে ভেসে বেড়ায়, বাতাসে এদের পরিমাণ বাড়লে স্বাভাবিকভাবে জলীয় বাষ্পের পরিমাণ বেশি হয় এবং বাতাস ভারী হয়ে যায়। এর পরিণতি হিসেবে প্রচুর বৃষ্টিপাত তথা অধঃক্ষেপণ ঘটে এবং পৃথিবী অধিক মাত্রায় শীতল হয়।
Leave a comment