প্রশ্নঃ “জনশ্রুতি কোন সাক্ষ্য নয়” সংক্ষেপে এই নীতির ব্যতিক্রমসমূহ আলোচনা ও ব্যাখ্যা কর।

জনশ্রুতিমূলক সাক্ষ্যঃ সাক্ষী যা নিজে সংঘটিত হতে দেখেন নি বা নিজ কানে শুনেন নি বা নিজ ইন্দ্রিয় দ্বারা অনুভব করেননি, কিন্তু অপর ব্যক্তির নিকট হতে শুনেছেন এরূপ কোন ঘটনা সম্পর্কে সাক্ষ্য দিলে তাকে জনশ্রুতিমূলক সাক্ষ্য বলে।

স্টিফেনের মতে, শ্রুতিমূলক শব্দটি বিভিন্ন অর্থে ব্যবহৃত হতে পারে। যেমন, সাক্ষী অন্য ব্যক্তির নিকট হতে যা শুনেছেন তা বুঝাতে কিংবা অপর ব্যক্তির নিকট হতে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে সাক্ষী কোনকিছু ঘোষণা করলে তা বুঝাতে কিংবা অপ্রাসঙ্গিক সাক্ষ্যের তুল্য হিসেবে বুঝাতে ব্যবহৃত হতে পারে।

বিচারপতি বেস্টের মতানুসারে জনশ্রুতিমূলক সাক্ষ্য বলতে এমন সাক্ষ্যকে বুঝায় যা সাক্ষী নিজ চোখে দেখে নি বা নিজ কানে শুনে নি বা ঐ ঘটনার সাথে সে কোন প্রকারে সংশ্লিষ্ট ছিল না। অথবা তা নিজের কাছে ধরা পড়ে নি, তবে ঘটনাটি যে সংঘটিত হয়েছে তা তৃতীয় কোন ব্যক্তির কাছে থেকে শুনেছে ।

উদাহরণ : ক এর বিরুদ্ধে খ এর মালামাল চুরি অভিযোগের বিচার হচ্ছে। গ এ সম্পর্কে সাক্ষ্য দিচ্ছে। গ নিজে চুরির ঘটনাটি দেখে নি। সে শুনেছে ঘ এর নিকট হতে কিন্তু ঘ আদালতে অনুপস্থিত। এমতাবস্থায় ক এর সাক্ষ্য হবে জনশ্রুতিমূলক সাক্ষ্য ।

কি কি কারণে এটি সাক্ষ্য হিসেবে বর্জন করা হয় জনশ্রুতি সাক্ষ্য হচ্ছে এমন ধরনের সাক্ষ্য যা সাক্ষী নিজে সংঘটিত হতে দেখে নি, অপর কোন ব্যক্তির নিকট হতে শুনেছে। এ ধরনের সাক্ষ্য সাধারণত গ্রহণযোগ্য নয়। এর কারণসমূহ নিম্নরূপ-

(১) ইহা প্রত্যক্ষ সাক্ষ্য নয় হেতু উৎকৃষ্ট সাক্ষ্য মতবাদের ইহা পরিপন্থী।

(২) জনশ্রুতি সাক্ষ্য আদালতের বাইরে প্রদত্ত বিবৃতির উপর নির্ভরশীল। শপথপূর্বক যে বিবৃতি দেয়া হয় নি তা নির্ভরযোগ্য নয়।

(৩) মূল বিবৃতিদানকারী ব্যক্তি আদালতে হাজির না থাকার কারণে তাকে জেরা করার সুযোগ থাকে না। ফলে সত্যতা নিরূপণের আর কোন উপায় থাকে না।

(৪) মিথ্যা সাক্ষ্য দেয়ার জন্য সাক্ষীকে যে শাস্তি পেতে হয় সেরূপ আশংকা এক্ষেত্রে থাকে না।

(৫) শোনা কথা একজন হতে আরেকজনের নিকট প্রচারিত হতে থাকলে প্রকৃত সত্য বিকৃতির সম্ভাবনা থাকে। এছাড়া স্মৃতিশক্তির উপর নির্ভর করতে হয় হেতু সত্য বিকৃতি হতে পারে। তাই এক্ষেত্রে মিথ্যা ও প্রতারণার সুযোগ উন্মুক্ত থাকে।

(৬) জনশ্রুতি সাক্ষ্য গৃহীত হলে সাক্ষীর সংখ্যা অসংখ্য হতে পারে। ফলে মামলা নিষ্পত্তি হতে অনেক সময় লেগে যায়।

মূলতঃ এ সকল কারণে জনশ্রুতি সাক্ষ্য সাধারণত আদালতে গ্রহণযোগ্য হয় না ।

কোন কোন ব্যতিক্রমধর্মী অবস্থায় এটা সাক্ষ্য হিসেবে গ্রহণযোগ্য হয়ঃ জনশ্রুতি সাক্ষ্য সাধারণত গ্রহণযোগ্য নয়। তবে সাক্ষ্যের প্রয়োজনীয়তা এবং পারিপার্শ্বিক অবস্থার কারণে এর বিশ্বাসযোগ্যতা-এ দুটো ব্যতিক্রম রয়েছে যার জন্য কতিপয় ক্ষেত্রে এরূপ সাক্ষ্য গৃহীত হতে পারে। সাক্ষ্য আইনের ৩২ ও ৩৩ ধারায় এ ব্যতিক্রমগুলি বর্ণিত রয়েছে।

৩২ ধারায় বিধান রয়েছে যে, যে ব্যক্তি সাক্ষ্য দেয়ার অযোগ্য, মৃত বা নিখোঁজ কিংবা যাকে আদালতে হাজির করতে প্রচুর সময় ও অর্থ ব্যয় হবে তার মৌখিক বা লিখিত বিবৃতি নিম্নোক্ত ক্ষেত্রে প্রাসঙ্গিক হিসেবে বিবেচিত হবে।

(১) যদি কোন নিহত ব্যক্তির মৃত্যুর কারণ বা পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করে কোন মৃত্যুকালীন বিবৃতি প্রদান করে থাকে, তবে তা লিখিত হোক বা মৌখিক হোক সাক্ষ্য হিসেবে গ্রহণীয় হবে।

(২) যদি কোন ব্যক্তি তার স্বাভাবিক কাজকর্মের নিয়ম অনুযায়ী কোন বিবৃতি দিয়ে থাকে অথবা পেশাগত স্বাভাবিক কাজকর্মের নিয়ম অনুযায়ী কোন বিবৃতি কোন খাতায় বা দলিলে লিখে রাখে, তবে তার অনুপস্থিতে সাক্ষ্য হিসেবে গ্রহণীয় হবে।

(৩) যদি কোন বিবৃতি বিবৃতিদাতার আর্থিক বা মালিকানা স্বার্থের পরিপন্থী হয় অথবা বিবৃতিটি যদি এমন হয় যে তা সত্য হলে বিবৃতিদাতার বিরুদ্ধে ফৌজদারী অথবা ক্ষতিপূরণের দেওয়ানী মামলা হতে পারে, তবে তাও সাক্ষ্য হিসেবে গ্রহণীয় হবে।

(৪) যদি কোন বিবৃতিতে সর্বসাধারণের অধিকার, প্রথা বা স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয়ে অভিমত প্রকাশ করা হয় এবং এই অভিমত বিরোধ সৃষ্টির পূর্বে দেয়া হয়ে থাকে, তবে তা সাক্ষ্য হিসেবে গ্রহণীয় হবে।

(৫) যদি কোন বিবৃতি আত্মীয়তা (রক্ত, বৈবাহিক বা দত্তক দ্বারা) সম্পর্কিত হয়ে থাকে এবং তা যদি বিরোধ সৃষ্টির পূর্বে দেয়া হয়ে থাকে তবে তা সাক্ষ্য হিসেবে গ্রহণযোগ্য হবে।

(৬) উক্ত বিবৃতি (৫ উপধারা মতে) পারিবারিক বিষয় সম্পর্কিত কোন দলিলে লিপিবদ্ধ থাকলে তাও সাক্ষ্য হিসেবে গ্রহণযোগ্য হবে।

(৭) দলিলে বা উইলের বিবৃতি যার দ্বারা অধিকার বা প্রথা সৃষ্ট বা নষ্ট বা সংশোধিত হয় তা সাক্ষ্যে গ্রহণীয় হবে।

(৮) কতিপয় ব্যক্তি যদি কোন বিবৃতি দ্বারা বিচার্য বিষয়ের সঙ্গে প্রাসঙ্গিক কোন ধারণা প্রকাশ করে তাহলে তাও সাক্ষ্য হিসেবে গৃহীত হবে।

প্রদত্ত কোন সাক্ষীর প্রদত্ত বিবৃতি পরবর্তী মামলায় গ্রহণযোগ্য ও প্রাসঙ্গিক করা হয়েছে। যখন কোন সাক্ষী মৃত অথবা নিখোঁজ বা সাক্ষ্য দিতে অক্ষম বা বিরুদ্ধপক্ষ কর্তৃক প্রতিরুদ্ধ, তখন মামলার বিচার্য বিষয় প্রমাণের জন্য আলোচ্য ধারা মতে শর্তসাপেক্ষ গ্রহণীয়। এই শর্তগুলি হচ্ছে নিম্নরূপ-

(ক) পূর্ববর্তী মামলাটি বর্তমান মামলার পক্ষদ্বয়ের মধ্যেই বা তাদের প্রতিনিধিদের মধ্যে হয়েছিল। (খ) পূর্ববর্তী মামলার সাক্ষীকে জেরা করার সুযোগ বিরুদ্ধ পক্ষের ছিল। (গ) পূর্ববর্তী মামলার বিচার্য বিষয় পরবর্তী মামলার বিচার্য বিষয়ের অনুরূপ ছিল।

সাক্ষীকে হাজির করতে অযৌক্তিক দেরী ও অর্থ ব্যয় হবে বলে আদালতের নিকট প্রতীয়মান হলেও উপরি-উক্ত শর্ত সাপেক্ষ পূর্ববর্তী মামলার সাক্ষী প্রদত্ত সাক্ষ্য পরবর্তী মামলায় গ্রহণীয় হবে।

এভাবে মৃত বা নিখোঁজ ব্যক্তি বিবৃতি বা সাক্ষ্য দিতে অসমর্থ ব্যক্তির বা আদালতে হাজির করতে অনেক অর্থ ব্যয় ও সময় ব্যয় হতে পারে-এরূপ অবস্থায় তার সাক্ষ্য শ্রুতিমূলক হলেও গ্রহণ করা যেতে পারে।