গ্রীক মনীষী প্লাতো মনে করতেন যে বিশ্ববিধাতার মনের ছায়াপাত ঘটে প্রকৃতিতে এবং প্রকৃতির অনুকরণে সৃষ্ট হয় সাহিত্য অর্থাৎ প্লাতোর মতে সাহিত্য হল অনুকরণের অনুকরণ। কিন্তু প্লাতোর শিষ্য আরিস্তোতল গুরুর মতের অনুবর্তী ছিলেন না। তিনি মনে করতেন যে কবির অলৌকিক প্রতিভার স্পর্শে বাস্তব সত্য রূপান্তরিত হয় কাব্য-সত্যে, অতএর কাব্য, সাহিত্য কিংবা অপর কোন কলাকৃতিকেই বাস্তবের অনুকরণ বলা চলে না। ‘সাহিত্যের বিচারক’ প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথও মোটামুটিভাবে এ জাতীয় অভিমতই পোষণ করেছেন। তিনি মনে করেন যে, প্রত্যক্ষদৃষ্ট প্রাকৃত-জগৎকে কবি-সাহিত্যিক তাঁর মনের মধ্যে গ্রহণ করে তাকে আপন মনের জারক-রসে জারিত করে একটা নোতুন জগৎ সৃষ্টি করেন এবং কাব্যে-সাহিত্যে বা যে কোন কলাকৃতিতে তারই রূপায়ণ ঘটে। কবির দৃষ্ট প্রত্যক্ষ জগৎ যখন সাহিত্যে রূপায়িত হয়, তখন পাঠকের নিকট তা অপ্রত্যক্ষ জগতের চিত্র, অতএব দূরবর্তী বলে মনে হয়। এ ছাড়াও বাস্তব জগতে যে সকল অপূর্ণতা, খণ্ডতা কিংবা শূন্যতা থাকে, তা পাঠকের নিকট পীড়াদায়ক হতে পারে মনে করে কবি প্রাকৃত জগতের চিত্রকে আরও অতিশায়িত করে, অবান্তর বর্জন করে এবং তার পূর্ণতা সাধন করে পাঠকের সম্মুখে অর্থাৎ সাহিত্যে উপস্থাপিত করেন। অতএব প্রকৃতির সঙ্গে সাহিত্যের একটা নিকট সম্বন্ধ থাকলেও মধ্যবর্তী পর্যায়ে কবি-সাহিত্যিকের মন তাতে একটা বিরাট ভূমিকা গ্রহণ করে। প্রকৃতিকে গ্রহণ করে মন এবং সেই মনই সৃষ্টি করে সাহিত্য, কিন্তু মনও প্রকৃতির আর্শি নয়, আবার সাহিত্যও নয় প্রকৃতির আর্শি। এদের পারস্পরিক সম্পর্কটিকে রবীন্দ্রনাথ এভাবে বুঝিয়েছেন, “মন প্রাকৃতিক জিনিসকে মানসিক করিয়া লয়, সাহিত্য সেই মানসিক জিনিসকে সাহিত্যিক করিয়া তোলে।”
যে প্রক্রিয়ায় মন প্রকৃতিকে গ্রহণ করে এবং সাহিত্য সৃষ্টি করে, তার মধ্যে ঐক্য থাকলেও পার্থক্য এই যে, মন প্রকৃতিকে গ্রহণ করে নিজের প্রয়োজনে এবং সাহিত্য যা গড়ে তোলে তা সকলকে আনন্দ দানের জন্য। নিজের জন্য যা করা হয়, তা যেমন তেমন হলেও চলে, কিন্তু অপর সকলের জন্য যা করা প্রয়োজন তাকে সম্পূর্ণ হতে হবে—এমন, যা সকলের দৃষ্টিতে আসে। প্রকৃতি থেকে মন সংগ্রহ করে, সাহিত্য মন থেকে সঞ্চয় করে। এখন মনের জিনিসকে যদি বাইরে প্রকাশ করতে হয়, তখন তাকে এমন রূপ দিতে হয়, যাতে তা অপরের নিকট গ্রহণযোগ্য হয়। প্রকৃতপক্ষে সাহিত্য কবি-মানসের নবসৃষ্টি এবং এর জন্য প্রয়োজন উৎকৃষ্ট সৃষ্টি প্রতিভার। কবি বা কলাকার কীভাবে সৃষ্টি করবেন এ বিষয়ে বলা হয়েছে যে তিনি “makes his state of mind clear to others, when it carries the thought expressed over the threshold of somebody else’s consciousness. Expression for the artist is communication.” কবি শিল্পীর মনে এই সৃজনীশক্তি থাকে বলেই প্রকৃতি থেকে মনে এবং মন থেকে সাহিত্যে যা প্রতিফলিত হয়, তা অনুকরণ থেকে শত যোজন দূরে।
সাহিত্যিক তার কল্পনাকে, তাঁর সুখদুঃখকে প্রকাশ করেন সাহিত্যে, সেই কল্পনা বা সুখদুঃখ কোনো এক বিশেষ মুহূর্তকে অবলম্বন করে গড়ে উঠলেও সাহিত্যে যখন তা রূপায়িত হয় তখন সাহিত্যিক তাকে শাশ্বত কালের মধ্যে প্রতিষ্ঠিত করেন, তখন আর তা বর্তমান কালে সীমাবদ্ধ থাকে না। কোনো এক বিশেষ মুহূর্ত বা খণ্ডকাল থেকে উপকরণ সংগ্রহ করে তাকে শাশ্বত কালের জন্য গড়ে তুলতে হলে সুবিশাল নিরবধি কালসীমার সঙ্গে সামঞ্জস্য বিধান করে নিতে হয়। ক্ষণকালের কিংবা বর্তমানের মাপকাঠিতে তাই কাজ চলে না। অতএব উৎকৃষ্ট সাহিত্য কখনও দেশে কালে সীমাবদ্ধ নয়, বর্তমান কাল কিংবা সংকীর্ণ সংসারের প্রেক্ষাপটে স্থাপন করলে তা-ই উচ্চ সাহিত্যের সঙ্গে তার পার্থক্য অবশ্যই স্পষ্ট হয়ে ওঠে। এ জাতীয় সীমাবদ্ধতাকে অতিক্রম করে যায় উৎকৃষ্ট সাহিত্য। তাই রবীন্দ্রনাথ সাহিত্যের কাজ সম্বন্ধে বলেন, ‘অন্তরের জিনিসকে বাহিরের, ভাবের জিনিসকে ভাষার, নিজের জিনিসকে বিশ্বমানের এবং ক্ষণকালের জিনিসকে চিরকালের করিয়া তোলা সাহিত্যের কাজ।”
সাহিত্যের কাজ সম্বন্ধে রবীন্দ্রনাথের বক্তব্য বিশদ হলেও তার প্রক্রিয়াটি এখনও সুস্পষ্ট হয়নি। প্রাকৃত জগৎ মনোজগতের মাধ্যমে যথোচিত রূপান্তর প্রাপ্ত হয়ে সাহিত্য জগতে পরিণত হয়। রবীন্দ্রনাথ দেখিয়েছেন যে জগতের সঙ্গে মানবমন যে সম্পর্কবন্ধনে সমৃদ্ধ, সাহিত্যিক প্রতিভাও অনুরূপভাবেই মনের সঙ্গে সম্বন্ধযুক্ত। সাহিত্যিকের এই প্রতিভাকে তিনি বিশ্বমানবমন নামে অভিহিত করেছেন। অতএব প্রকৃতি, মন ও সাহিত্যের সম্বন্ধ-সূত্র এইভাবে নির্ণীত হতে পারে : সাধারণ মানব-মন প্রাকৃত জগৎ থেকে নানা উপাদান সংগ্রহ করে চলছে, আর বিশ্বমানবমন সেই সমস্ত উপাদান থেকে আপন প্রয়োজনীয় সামগ্রী গ্রহণ করে তার সাহায্যে সাহিত্য বা যে কোনো প্রকার শিল্পকৃতি নির্মাণ করে চলছে। অতএব এখানে সাহিত্যিকের মনের মধ্যেই দুটি অংশ যুগপৎ কাজ করে যাচ্ছে। মানব-মনের একটা অংশ তার নিজত্ব—যা একান্তভাবেই তার নিজস্ব, আর একটা মানবত্ব—যা বৃহত্তর মানব-সমাজের সঙ্গে সম্পর্কিত। এ দুটি অংশের পৃথক সত্তা অনুভূত হলেও এবং প্রত্যেকের নিজস্ব ক্ষেত্রে স্বাতন্ত্র্য থাকলেও কিন্তু এদের মধ্যে মুখ দেখাদেখি বন্ধ নয়। এরা একের উপর অপরে নির্ভরশীল এবং একটিকে অপরটির সম্পূরক বলে মনে করা চলে। অন্যথায়, অর্থাৎ এই নিজত্ব এবং মানবত্বের মাঝখানে যদি কোন দুর্ভেদ্য দেওয়াল কল্পনা করা যায়, যদি এদের মধ্যে ভাবের লেনদেন বন্ধ হয়ে যায়, তবে বস্তুত আত্মাকে যেন অন্ধকূপে নির্বাসিত করা হয়। নিজত্ব এবং মানবত্বের সম্পর্কটিকে রবীন্দ্রনাথ এইভাবে বুঝিয়েছেন যে, এদের মাঝখানে যেন রয়েছে কল্পনার কাচের শার্সির স্বচ্ছ ব্যবধান, অতএব উভয়ের মাঝখানে একটা আবরণ থাকলেও এদের একটি অপরের নিকট অদৃশ্য কিংবা অপরিচিত তো নয়ই বরং তাঁর মতে এই কাচ যেন দূরবীক্ষণ এবং অণুবীক্ষণ যন্ত্রের কাচ—যা দূরকে নিকট করে, ছোটোকে করে বড়ো। অর্থাৎ অপ্রত্যক্ষ প্রাকৃত জগৎকে সাহিত্যে কলাকৌশল গ্রহণ করতে হয়, কল্পনার এই স্বচ্ছ কার্য সেই সকল কর্ম সম্পাদন করে থাকে। এই থেকেই প্রমাণিত হচ্ছে যে, সাহিত্যিকের যে প্রতিভাকে বিশ্বমানবমন নামে অভিহিত করা হয়েছে এবং মানব-মনের অংশে যাকে বলা হয়েছে মানবত্ব—এটিই আসলে সৃজনকর্তা। সাহিত্যকে যে প্রকৃতির অনুকরণ না বলে নবসৃষ্টি-রূপে অভিহিত করা হয়, তার মূলে রয়েছে এই মানবত্ব তথা সাহিত্যিকের সৃজনীপ্রতিভা।
মানবমনের যে অংশকে বলা হয় নিজত্ব, যা নিজের জন্য প্রকৃতি-জগৎ থেকে বিভিন্ন উপাদান আহরণ করে, লেখকের মানবত্ব বা সৃজনীপ্রতিভা তাকে আপনার করে নিয়ে, তার খণ্ডতাকে সম্পূর্ণতা দান করে, ক্ষণকালের বস্তুকে চিরন্তনত্ব দান করে। অতএব সাহিত্যের সৃষ্টি প্রক্রিয়া তথা প্রাকৃতজগতের সঙ্গে সাহিত্যজগতের সম্বন্ধ বিচারে দেখা যাচ্ছে যে প্রাকৃত জগতের উপর রয়েছে মনের কারখানা অর্থাৎ প্রকৃতি থেকে বিভিন্ন উপাদান গ্রহণ করছে। সাহিত্যিকের মন যাকে বলা হচ্ছে নিজত্ব তা কেবলই সংগ্রহ করছে। এবার কাজ শুরু বিশ্বমানবমন তথা মানবত্ব অংশের সেখানে চলছে ঝাড়াই বাছাই, গ্রহণ-বর্জন, সংশোধন-সম্পূরণ-আদি বিবিধ প্রক্রিয়া ; এটি হল মানব-মনের সর্বোচ্চ তলা। এবার এখান থেকে উপাদান সংগ্রহ করে সাহিত্যকারের প্রতিভার সাহায্যে রচিত হয় সাহিত্য। শুধু সাহিত্য নয়, সঙ্গীত, ভাস্কর্য আদি যাবতীয় কলাবিদ্যাই এইভাবে প্রাকৃত জগৎ থেকে উপাদান সংগ্রহ করে যথোপযুক্ত প্রতিভার সংস্পর্শে এসে যথার্থ রূপ লাভ করে।
Leave a comment