চোল শাসনব্যবস্থার স্বরূপ:

আদি-মধ্যযুগে চোল নৃপতিদের নেতৃত্বে দক্ষিণ ভারতে যে সাম্রাজ্য গড়ে ওঠে, তার পশ্চাপটে চোল- রাজাদের সাংগঠনিক প্রতিভার দিকটি গুরুত্বপূর্ণ। চোলরাজা রাজরাজ এবং কুলোতুঙ্গের শাসনের অন্তর্বর্তীকালে চোল প্রশাসনিক কাঠামো একটি সুনির্দিষ্ট রূপ পরিগ্রহ করে। শতাধিক বছরের ঐতিহ্য ও অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে ক্রমরূপান্তরের মধ্যে দিয়ে চোল শাসনকাঠামো সুসংহত রূপ নিতে সক্ষম হয়। এই সাফল্যের ক্ষেত্রে তামিল প্রশাসনিক ঐতিহ্যের কাছে চোল প্রশাসন বিশেষভাবে ঋণী ছিল। তবে চালুক্য, সাতবাহন, পল্লব বা রাষ্ট্রকূটদের শাসনধারার সাথে চোল প্রশাসনের প্রভেদ ছিল লক্ষণীয়। সাতবাহন বা পল্লব রাজারা মূলত উত্তর ভারতে প্রচলিত শাসনরীতি দ্বারা প্রভাবিত ছিলেন। আবার চালুক্য ও রাষ্ট্রকুটদের রাষ্ট্রব্যবস্থায় সামন্ত শাসকদের প্রবল প্রতাপ ওই দুই রাজ্যে কেন্দ্রীভূত রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পথে ছিল বিশেষ অন্তরায়স্বরূপ। সেক্ষেত্রে চোলরাজারা একটি প্রতাপশালী কেন্দ্রীয় রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে সফল হন এবং দক্ষিণ ভারতীয় ঐতিহ্যকে ভিত্তি করে একটি সুবিন্যস্ত ও সুশৃঙ্খল শাসনকাঠামো গড়ে তুলতে সক্ষম হন।

চোল সাম্রাজ্যের শাসনতান্ত্রিক পরিকাঠামো জানার জন্য আমাদের প্রধান উপাদান হল সমকালীন কিছু লেখ। তবে লেখগুলির বক্তব্য সম্পর্কে ঐতিহাসিকদের মতভেদ আছে। চৈনিক পরিব্রাজক চো ওয়া’র বিবরণী এক্ষেত্রে আমাদের কিছু আভাস দেয়। চোলরাজাদের ‘প্রশক্তি’ও ‘সঙ্গম’সাহিত্য থেকে অস্পষ্ট কিছু ধারণা পাওয়া যায়। গুপ্ত-পরবর্তী যুগে মুদ্রার প্রচলন সীমিত হওয়ায় এই পর্বের ইতিহাসের উপাদান সংগ্রহ কিছুটা কষ্টকর।

সপ্তম যুগের মতো চোল আমলে একটি কেন্দ্রীভূত রাজতন্ত্র প্রচলিত ছিল। রোমিলা থাপারের মতে, কেবল চোলদের রাজনৈতিক ব্যবস্থাতেই কৃষকদের সঙ্গে নিয়মিত সম্পর্ক বজায় ছিল এবং কেন্দ্রীয় শাসনের কিছু কিছু লক্ষণ দেখা যেত। প্রবল সামস্ততন্ত্রের উত্থানের যুগে চোলরাজাদের এই নিয়ন্ত্রণকারী দক্ষতা নিঃসন্দেহে প্রশংসার যোগ্য। অসংখ্য রাজপ্রাসাদ, একাধিক রাজধানী, বিশাল কর্মীমণ্ডলী ও জাঁকজমকপূর্ণ অনুষ্ঠান পালনের মাধ্যমে চোলরাজারা এক শক্তিশালী কেন্দ্রের অস্তিত্ব জাহির করতে সক্ষম হন। ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে রাজাদের অভিধাতেও পরিবর্তন সূচিত হয়। প্রথম পর্বের চোলরাজারা উপাধি নিয়ে চিন্তা করতেন না। কিন্তু পরবর্তীকালের রাজারা কর্তৃত্বব্যঞ্জক উপাধি যেমন ‘চক্রবর্তীগল’ অর্থাৎ ‘সম্রাট ‘ইত্যাদি গ্রহণ করতে শুরু করেন। কর্তৃত্ব বৃদ্ধির অনুসঙ্গ হিসেবে রাজধানীর সংখ্যা ও জাঁকজমকে পরিবর্তন ঘটে। বিজয়ালয়ের রাজধানী ছিল ‘তাঞ্জোর’। পরে ‘কাঞ্চিপুরম’ দ্বিতীয় রাজধানী হয়। রাজেন্দ্র চোল ‘গঙ্গই-কোণ্ড চোলপুরমে’ নতুন রাজধানী স্থাপন করেন। তিনি কয়েকটি শহরে নতুন রাজপ্রাসাদও নির্মাণ করেন। রাজপ্রাসাদকে কেন্দ্র করে নতুন নতুন রাজনৈতিক নগরী গড়ে ওঠে।

কেন্দ্রীয় প্রশাসনের সর্বোচ্চ ছিলেন রাজা। রাজনৈতিক কর্তৃত্বের পাশাপাশি রাজাদের ওপর দেবত্ব আরোপ করা হয়। মৃত রাজাদের স্মরণে মন্দির নির্মাণ করা হয়। রাজপদ ছিল বংশানুক্রমিক। আইন, বিচার, প্রশাসন সব কিছুর ঊর্ধ্বে ছিল রাজার স্থান। তিনিই ছিলেন প্রধান বিচারপতি ও প্রধান সেনাপতি। রাজসভায়, ‘রাজগুরু’ বিশেষ মর্যাদা পেতেন। রাজগুরু পার্থিব ও আধ্যাত্মিক বিষয়ে রাজাকে পরামর্শ দেবার পাশাপাশি গুরুত্বপূর্ণ ও জটিল রাজনৈতিক বিষয়েও পরামর্শ দিতেন। যুবরাজ রাজকার্যে রাজাকে সহায়তা করতেন। রাজা পরবর্তী উত্তরাধিকারী মনোনীত করে যেতেন। তাই গৃহযুদ্ধের সম্ভাবনা শিথিল হয়। রাজার অনুপস্থিতিতে যুবরাজ শাসনকার্য চালাতেন। অনেক সময় রাজা উপশাসক হিসেবে যুবরাজের হাতে কিছু প্রশাসনিক ক্ষমতা হস্তান্তর করে দিতেন। যুগ্ম-শাসন ছিল চোল প্রশাসনের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। অধ্যাপক নীলকণ্ঠ শাস্ত্রী চোলদের অধীনে ‘উদান কুট্টম’ (Udan Kuttam) নামক মন্ত্রীদের অস্তিত্ব উল্লেখ করেছেন। এঁরা বিভিন্ন বিভাগের ভারপ্রাপ্ত ছিলেন। তবে রোমিলা থাপার মনে করেন, চোলদের কোনো স্থায়ী মন্ত্রীসভা ছিল না। সম্ভবত, ‘উদান কুট্টম’ শ্রেণির কর্মচারীরা রাজার অনুগত হিসেবে শাসন-দায়িত্ব পালন করতেন এবং রাজাকে পরামর্শ দিতেন। পরামর্শ গ্রহণ করা বা না করা ছিল সম্পূর্ণভাবে রাজার ইচ্ছাধীন।

চোল শাসনব্যবস্থার অন্যতম বৈশিষ্ট্য ছিল এক বিশাল ও জটিল আমলাতন্ত্র। নীলকন্ঠ শাস্ত্রী লিখেছেন, “The chola administrative machinary was an elaborate and complicated bureau cracy comprising officials of various grades.” অর্থাৎ চোল কর্মচারীদের মধ্যে শ্রেণিবিভাগ ছিল স্পষ্ট। পদ অনুসারে ভিন্ন ভিন্ন অভিধা দ্বারা কর্মচারীদের পার্থক্য বোঝানো হত। সাধারণভাবে উচ্চপদস্থ কর্মচারীরা পেরুদনম (Perudanam) এবং নিম্নপদস্থরা সিরুদনম (Sirudanam) নামে অভিহিত হতেন। ড. রমেশচন্দ্র মজুমদার এদের যথাক্রমে ‘পেরুদনম’ ও ‘সিরুতনম’ নামে অভিহিত করেছেন। এদের মধ্যবর্তী কর্মচারীদের বলা হত সিরুদনত্তুপ-পেরুন্দনম। সামরিক ও বেসামরিক উভয় শ্রেণির কর্মচারীর ক্ষেত্রেই অভিধাগুলি প্রযুক্ত হত। কর্মচারীর পদগুলি বংশানুক্রমিক ধারায় পূরণ করা হত। তবে কেন্দ্রীয় কর্মচারীদের নিয়োগ পদ্ধতি, পদোন্নতি ইত্যাদি সম্পর্কে তথ্যাবলি খুব স্পষ্ট নয়। রোমিলা থাপারের মতে, সম্ভবত উত্তর ভারতীয় নিয়োগ-পদ্ধতির সাথে চোলদের নিয়োগ-ব্যবস্থার বিশেষ পার্থক্য ছিল না। এক্ষেত্রে বর্ণ, বংশপরিচয়, যোগাযোগ ও অন্যান্য গুণাবলি বিবেচনা করা হত। প্রথমে রাজা মৌখিক নির্দেশ দিয়ে কাজে নিয়োগ করতেন। পরে ওই নিয়োগ লিপিবদ্ধ করা হত। কোনো কোনো ক্ষেত্রে নিয়োগের আদেশপত্রে সংশ্লিষ্ট কর্মচারীকেও স্বাক্ষর করতে হত। পদোন্নতির ক্ষেত্রে কর্মচারীর দক্ষতা, সততা, রাজানুগত্য ইত্যাদি গুণাবলি বিবেচনা করা হত। কর্মচারীরা নগদ অর্থে বেতন পেতেন না। বেতনের পরিবর্তে তাদের ভূমিদান করা হত। এই দান ‘জীবিত’ নামে পরিচিত ছিল। ভূমির মালিকানাস্বত্ব রাজার হাতেই থাকত। কর্মজীবনে সংশ্লিষ্ট কর্মী উল্লিখিত জমির রাজস্ব নগদ অর্থে কিংবা দ্রব্যের মাধ্যমে আদায় করতেন। সরকার ভূমি-সংক্রান্ত নির্দেশনামাগুলি কঠোরভাবে সংরক্ষণ করত।

সমগ্র চোল সাম্রাজ্য কয়েকটি ‘প্রদেশ’ বা ‘মণ্ডলম’-এ বিভক্ত ছিল। প্রদেশের সংখ্যা ছিল আট বা নয়। প্রতিটি প্রদেশ ‘জেলা’ বা ‘বলনাড়ু তে বিভক্ত ছিল। কয়েকটি করে গ্রামের সমষ্টি নিয়ে গঠিত হত নাড়ু’বা ‘কোট্রম’বা কুররম’। ‘বলনাডু’ ছিল কয়েকটি ‘নাডু’ বা ‘কোট্রম’-এর সমষ্টি। শাসনব্যবস্থার সর্বনিম্ন একক ছিল ‘গ্রাম’। অনেক সময় এক একটি বড়ো গ্রাম এককভাবে ‘কুররম’ নামে চিহ্নিত হত। এমন গ্রামকে বলা হত ‘তানিয়ুর’। গ্রামগুলির স্বায়ত্তশাসন অধিকার ছিল। বড়ো বড়ো নগরের স্বতন্ত্র পৌরশাসন কায়েম ছিল। সাধারণভাবে যুবরাজ বা অনুগত সামন্ত প্রদেশগুলির শাসক নিযুক্ত হত। প্রাদেশিক শাসকদের নিজস্ব কর্মীমণ্ডলী ছিল। প্রাদেশিক শাসকরা রাজার ইচ্ছানুসারে শাসন পরিচালনা করতেন এবং সমস্ত ঘটনাবলি সম্পর্কে রাজাকে অবহিত রাখতেন।

চোল আমলে রাজকোষে আয়ের প্রধান উৎস ছিল ভূমিরাজস্ব। চোলরাজা প্রথম রাজরাজ জমি জরিপ করে রাজস্ব আরোপের নীতি প্রবর্তন করেন। পরবর্তী রাজাদের লেখা থেকে জানা যায় যে, জরিপব্যবস্থা পরবর্তীকালেও কার্যকরী ছিল। ভূমিরাজস্বের হার সাধারণভাবে ছিল উৎপাদনের এক-তৃতীয়াংশ। তবে জমির উর্বরতা অনুসারে এই হারের তারতম্য ঘটত। উৎপন্ন ফসলের চরিত্র পরিবর্তন হলেও রাজস্বের হার নতুনভাবে নির্ধারণ করা হত। নগদে অথবা শস্যে রাজস্ব দেওয়া যেত। প্রতি গ্রামে বাসগৃহ, দেবস্থান, জলাশয়, শ্মশান, সেচখাল ইত্যাদির জন্য নিষ্কর জমি নির্দিষ্ট করা থাকত। তবে করযোগ্য জমির কর প্রদানের ক্ষেত্রে সামান্যতম শিথিলতা সহ্য করা হত না। জমির মালিকানা ব্যক্তি, গোষ্ঠী বা গ্রামসভার হাতে ন্যস্ত হত। ভূমিরাজস্ব ছাড়া আমদানি-রপ্তানি শুল্ক, নগর প্রবেশের শুল্ক এবং খনি, অরণ্য ইত্যাদি ক্ষেত্র থেকে কর আদায় করা হত। সব মিলিয়ে করের চাপ ছিল যথেষ্ট। সরকার বা ধনী ব্যক্তিরা সামাজিক দানধ্যানের মাধ্যমে সাধারণ মানুষকে অতিরিক্ত পরিসেবা দেবার চেষ্টা করতেন।

নীলকণ্ঠ শাস্ত্রী চোলদের তিন ধরনের আদালতের নাম উল্লেখ করেছেন—রাজকীয় আদালত, গ্রামীণ আদালত এবং জাতি-পঞ্চায়েত। রাজকীয় আদালতগুলিকে সম্ভবত ‘ধর্মাসন’ বলা হত। ধর্মাসনের বিচার পরিচালনার ক্ষেত্রে শাস্ত্রজ্ঞ-ব্রাহ্মণদের (ধর্মাসন-ভট্ট) মতামতকে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হত। রাজদ্রোহিতার মতো গুরুত্বপূর্ণ অপরাধের বিচার রাজা স্বয়ং করতেন। তবে সাধারণভাবে গ্রামসভাগুলিই স্থানীয় স্তরে অধিকাংশ বিবাদের নিষ্পত্তি করে দিত। গ্রামসভায় বিচারে সন্তুষ্ট না হলে। নাড়ুর ভারপ্রাপ্ত কর্মচারীর কাছে আবেদন করা যেত। দেওয়ানি ও ফৌজদারি মামলার মধ্যে প্রভেদ করা হত না। শাস্তির ক্ষেত্রে কঠোরতা ছিল। রাজদ্রোহিতার অপরাধে সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত, নির্বাসন কিংবা প্রাণদণ্ড দেওয়া হত। সাধারণ অপরাধের ক্ষেত্রে আর্থিক জরিমানা বা কারাদণ্ড দেওয়া হত। দাঙ্গা এবং অগ্নিসংযোগের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ জরিমানা আদায় করা হত। মন্দিরের সম্পত্তি নষ্ট করলে (শিবদ্রোহ) অভিযুক্তের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করে দেবস্থানের ক্ষতিপূরণ করা হত। চুরি, ব্যভিচারিতা, জালিয়াতি ইত্যাদি লঘু অপরাধের ক্ষেত্রে বেত্রাঘাত, অর্থদণ্ড বা কারাদণ্ডের বিধান ছিল। এই সকল অপরাধী গ্রামসভার কাজে যোগ দিতে পারত না।