চৈতন্য-আবির্ভাবের পটভূমি: চৈতন্যদেবের আবির্ভাব গৌড়বঙ্গে এক যুগান্তকারী ঘটনা অনার্য-অধ্যুষিত বঙ্গভূমিতে একদা বৌদ্ধধর্মের প্লাবন দেখা দিয়েছিল। এর পর জগদগুরু শঙ্করাচার্যের আবির্ভাব এবং গৌড়বঙ্গে ব্রাহ্মণ্যধর্মাবলম্বী সেনবংশীয় রাজাদের আধিপত্যে বৌদ্ধধর্মে ভাটা এবং হিন্দুধর্মের পুনরভ্যু্থান সৃচিত হয়। ত্রয়ােদশ শতকের উষালগ্নেই বাঙলায় তুর্কী আক্রমণ আবার এক ক্রান্তিকালের আবাহন জানায়। এই ক্রান্তিকাল প্রকৃতপক্ষে স্থানীয় জনসাধারণের জীবনে এক মেঘের আবরণ বিছিয়ে দেয়। বিদেশি, বিধর্মী এবং বিভাষী শাসক সম্প্রদায়ের অত্যাচার এবং প্রভাব প্রাচীন সমাজ-ব্যবস্থায় ভাঙন ধরিয়ে দিল।

স্বেচ্ছায় এবং অনিচ্ছাসত্ত্বেও বহু বৌদ্ধ, অনার্য আদিবাসী, নিম্নশ্রেণীর হিন্দু ইসলাম ধর্মে আশ্রয় গ্রহণ করবার ফলে সমাজ-জীবনে যে বিপর্যয় দেখা দেয়, সেই সময় আবির্ভাব ঘটে প্রেমের ঠাকুর শ্রীচৈতন্যদেবের। চৈতন্যদেব গৌড়ীয় বৈষ্ণব ধর্ম নামে যে বৈষ্ণব ধর্ম প্রবর্তন করেন তা একটা সাম্প্রদায়িক গােষ্ঠীকে উদ্বুদ্ধ করেছিল, এটা একটা সামান্য কথা। এর একটা বৃহত্তর তাৎপর্য এইতার মহান উদার এবং মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি ধ্বংসােন্মুখ সমাজকে মহতী বিনষ্টির হাত থেকে উদ্ধার করেছিল। বাঙলার সমাজে ও সাহিত্যে, বাঙালীর জীবনে চৈতন্যদেবের আবির্ভাব যে এক নবজাগরণ বা রেনেসাঁসের সৃষ্টি করেছিল নিরপেক্ষ ঐতিহাসিকগণ এই সহজ সত্যকে স্বীকৃতি দান করেছেন। এইজন্যই চৈতন্যদেবের আবির্ভাবকে গৌড়বঙ্গের জীবনে একটা যুগান্তকারী ঘটনা বলেই স্বীকার করে নেওয়া হয়। পাঠান শাসকদের অনুকূলতায় বাঙলা সাহিত্য-তরী ইতঃপূর্বেই গতিলাভ করেছিল, চৈতন্যদেবের আবির্ভাবে সেই তরীর পালে হাওয়া লাগলাে। সমকালের রাজনৈতিক পটভূমিকার পরিচয় দেখা যায়, বাঙলাদেশ মুঘল অধিকারে আসবার ফলে তার স্বাধীনতা ক্ষুদ্র হলেও দেশ একটা বৃহত্তর সমাজ ও পরিবেশের সান্নিধ্য লাভ করেছিল; এই বৃহত্তর পরিবেশের প্রভাব বাঙালীর জীবনবােধ ও দৃষ্টিভঙ্গিতে যথেষ্ট পরিবর্তন এনেছিল। এই পরিবর্তন সমকালীন বাঙালীর জীবন ও সাহিত্যে বিরাট সম্ভাবনার দ্বার উন্মুক্ত করে দেয়।

শ্রীচৈতন্যের জীবনকাহিনী

১৪৮৬ খ্রীঃ ফাল্গুন পূর্ণিমার দিন নবদ্বীপ ধামে মহাপ্রভু শ্রীচৈতন্যদেব জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম জগন্নাথ মিশ্র এবং মাতা শচী দেবী। চৈতন্যদেবের জ্যেষ্ঠভ্রাতা বিশ্বরূপ অল্প বয়সেই সন্ন্যাস গ্রহণের জন্য গৃহত্যাগ করায় বাল্যে চৈতন্যদেবের শিক্ষার প্রতি কোন যত্ন নেওয়া হয়নি। চৈতন্যদেবের বাল্যনাম ছিল নিমাই ও গৌরাঙ্গ। অসাধারণ প্রতিভার অধিকারী নিমাই কিন্তু অল্প বয়সেই বিভিন্ন শাস্ত্রে পারঙ্গমত্ব লাভ করে ‘নিমাই পণ্ডিত নামে পরিচিত হয়েছিলেন। অল্প বয়সেই লক্ষ্মীপ্রিয়াকে বিবাহ করেন এবং বাড়িতে চতুষ্পাঠী স্থাপন করে ছাত্র পড়াতে আরম্ভ করেন।

এর পর কিছুদিনের জন্য নিমাই পূর্ববঙ্গ পরিভ্রমণ করে ফিরে আসেন। ইতিমধ্যে স্ত্রী লক্ষ্মীপ্রিয়ার মৃত্যু হয়। নিমাই মায়ের আগ্রহাতিশয্যে রাজপণ্ডিত সনাতনের কন্যা বিষ্ণুপ্রিয়াকে বিবাহ করেন। এই সময় নিমাই সঙ্গীদল নিয়ে নামকীর্তনে মত্ত হলে কোন কোন নগরবাসীর অনুরােধে কাজী কীর্তন নিষিদ্ধ করে দিলে নিমাই আইন অমান্য করে বিরাট দল নিয়ে নগর সংকীর্তনে বের হন। প্রসঙ্গত উল্লেখ করা প্রয়ােজন অসংখ্য সাধারণ মানুষকে সঙ্গে নিয়ে মিছিলের আকারে প্রতিবাদ জ্ঞাপনের প্রথম ভারতীয় দৃষ্টান্ত সম্ভবত চৈতন্যদেবই সৃষ্টি করেছিলেন। তাঁর নেতৃত্বে বহু ভক্ত মানুষের প্রবল জনমতের চাপে ভয় পেয়ে কাজী নিষেধাজ্ঞা তুলে নেন।

এরপর পিতৃকৃত্যের উদ্দেশ্যে নিমাই গয়ায় গিয়ে ঈশ্বরপুরীর সাক্ষালাভ করেন এবং তাঁর নিকট দশাক্ষর গােপালমন্ত্রে দীক্ষা লাভ করেন। ঘরে ফিরে এলে তার মনে বিরাট পরিবর্তন দেখা দেয়। তিনি মাত্র ২৪ বৎসর বয়সে কাটোয়ার কেশব ভারতীর নিকট সন্ন্যাস গ্রহণ করেন। এই সময় তার নতুন নামকরণ হয় শ্রীকৃষ্ণচৈতন্য’। অতঃপর গৃহত্যাগে কৃতসঙ্কল্প হয়ে তিনি পুরীধামে উপনীত হন এবং তথায় রাজগুরু কাশী মিশ্র ও পণ্ডিতপ্রবর বাসুদেব সার্বভৌমকে ভক্তরূপে লাভ করেন।

পুরী থেকে চৈতন্য দক্ষিণ, পশ্চিম ও মধ্য ভারত পরিভ্রমণে বের হন। এই সময় রায় রামানন্দ এবং পরমানন্দ পুরীর সঙ্গে তাঁর সাক্ষাৎকার ঘটে। এরপর একবার তিনি বৃন্দাবনধামে গমন করেন এবং ভারতের বিভিন্ন লুপ্ত তীর্থ পুনরুদ্ধারে কৃতসঙ্কল্প হয়ে বিভিন্ন জনকে এই কাজের ভার অপণ করেন। তিনি পুরীধামে ফিরে আসবার পর অবশিষ্ট আঠারাে বছর এখানেই অতিবাহিত করেন। প্রতি বৎসর রথযাত্রার সময় গৌড় থেকে ভক্তদের সম্মেলন হতাে পুরীধামে। জীবনের শেষ কয়েক বৎসর চৈতন্যদেব প্রায় বাহ্যজ্ঞানরহিত হয়ে ভাবােন্মত্ত অবস্থায় কাটিয়েছেন। মাত্র আটচল্লিশ বৎসর বয়সে তিনি লীলা সংবরণ করেন। তার লীলাবসানের কারণ এখনও জানা যায়নি। তবে দেবমূর্তির সঙ্গে তার বিলীন হবার বৃত্তান্ত বাস্তবসম্মত নয়। বরং ভাবােন্মত্ত অবস্থায় সমুদ্রে আত্মবিসর্জন কিংবা পায়ে ক্ষত সৃষ্ট হবার ফলে ধনুষ্টঙ্কার জাতীয় ব্যাধিতে মৃত্যুর বর্ণনা বাস্তবসম্মত।

চৈতন্যদেবের প্রত্যক্ষ কীর্তি-গৌড়ীয় বৈষ্ণব ধর্মের প্রবর্তন। চৈতন্য-প্রবর্তিত এই বিশেষ মতবাদের পিছনে রয়েছে এক বিরাট যুগসত্যযুগের এবং জাতির প্রয়ােজনেই তিনি এই বিশেষ সত্যদৃষ্টি লাভ করেছিলেন। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন সমাজের বৃহত্তর অংশে যে ভাঙ্গন দেখা দিয়েছে, তাকে রােধ করতে হলে এমন এক মতবাদ প্রচার করতে হবে, যা সর্বজনের পক্ষেই গ্রহণযােগ্য ও আচরণীয় হয়ে উঠতে পারে। তাই হৃদয়ধর্ম থেকে উদ্ভূত এক প্রেমধর্মের প্রচারই ছিল চৈতন্যদেবের জীবনের লক্ষ্য ও ব্রত। সামাজিক বৈষম্য, ধর্মীয় মতবাদের গােড়ামি, মানুষে মানুষে ভেদজ্ঞান-আদি প্রেমধর্মে স্পষ্টতঃ না হলেও বাস্তবতঃ অস্বীকৃত ছিল। বরং তৎকালীন সমাজে নৈষ্ঠিক ব্রাহ্মণ ও বৈষ্ণবগণ হৃদয়ধর্মের ও ভক্তির পরিবর্তে শাস্ত্রবচন ও আচারধর্মকেই অধিক গুরুত্ব দিতেন। চৈতন্যদেব শাস্ত্রাচারের বদলে নিঃস্বার্থ ভক্তিকেই আচরণীয় বলে স্বীকৃতি দিলেন। চৈতন্যদেবের দৃষ্টিতে চণ্ডালােহপি দ্বিজ শ্রেষ্ঠ হরিভক্তিপরায়ণঃ’, তিনি ‘আচণ্ডালে ধরে দেয় কোল’। তার সাদর আহ্বান নিপীড়িত লাঞ্ছিত মানুষের নিকট মন্ত্ররূপে ধ্বনিত হয়েছিল। শুধু চণ্ডাল নয়, যবনও চৈতন্যদেবের প্রেমধর্মে আপনার অধিকার অর্জন করলাে। ফলে সমগ্র দেশেই দেখা দিল এক অপূর্ব ভাব বিপ্লব, যার মহানায়ক হলেন যুগন্ধর পুরুষ মহাপ্রভু চৈতন্যদেব।

চৈতন্য প্রভাব সমাজে

সাধারণ দৃষ্টিতে মহাপ্রভু চৈতন্যদেবকে একজন বৈষ্ণবধর্মপ্রচারক এবং বড় জোর, সমাজ-সংস্কারক বলে অনেকেই মনে করে থাকেন। কিন্তু দেশের একটা ক্রান্তিকালে তিনি গােটা সমাজকে মহতী বিনষ্টির হাত থেকে রক্ষা করে জাতির জীবনে যে প্রবাহ সঞ্চার করেছিলেন, পরবর্তীকালে জাতি তার ফল ভােগ করলেও যথাযথ বিশ্লেষণের অভাবে সমাজজীবনে চৈতন্যপ্রভাবের প্রকৃত মূল্যায়ন বড় একটা হয়নি বললেই চলে। চৈতন্যদেবের আবির্ভাব বাঙালীর সমাজজীবনে যে কী বিপুল প্রভাব বিস্তার করেছিল, তার পরিচয় বাইরের দিকে যতটা দৃশ্যমান, ততােধিক বর্তমান ছিল বাঙালীর অন্তর্জীবনে। অন্তঃসলিলা ফল্গুধারার মতাে এই প্রভাব ভিতরে ভিতরে কাজ করে গেছে, তরঙ্গোচ্ছাসের মধ্য দিয়ে তার বহিঃপ্রকাশ ততােটা ঘটেনি।

বাহ্যতঃ মনে হয়, চৈতন্যদেব ছিলেন বৈষ্ণবধর্মের একজন রূপকার। কিন্তু তৎপ্রচারিত বৈষ্ণবধর্ম ছিল স্বরূপে পৃথক— ‘গৌড়ীয় বৈষ্ণবধর্ম’ নামে এর একটা বিশিষ্ট সত্তা ছিল। গৌড়ীয় বৈষ্ণব ধর্মে বৈদিক যাগ-যজ্ঞ সমন্বিত কর্মবাদ এবং শঙ্করাচার্য-প্রবর্তিত মায়াবাদকে প্রাধান্য না দিয়ে ভক্তির আশ্রয় গ্রহণ করা হয়েছে। ‘বিশ্বাসে মিলায় কৃষ্ণ তর্কে বহুদূরচৈতন্যদেব নিজের জীবনব্যাপী সাধনা দ্বারা এই সত্যই প্রচার করে গেছেন। চৈতন্যদেবের প্রবর্তিত এই মতবাদের পশ্চাতে নিহিত আছে এক বিরাট যুগসত্যযুগের প্রয়ােজনে এবং জাতির প্রয়ােজনেই এই সত্যদৃষ্টির উদ্ভব ঘটেছিল—এই সত্যকে অস্বীকার করবার উপায় নেই। বৈদিক যাগযজ্ঞাদি অনুষ্ঠানে যে কঠোর নিয়মনিষ্ঠার প্রয়ােজন। হতাে, তা সমাজের মুষ্টিমেয় কয়েকজনেরই মাত্র সাধ্য ছিল। বস্তুতঃ পরবর্তী যুগে বঙ্গদেশে একমাত্র ব্রাহ্মণরাই ছিলেন যজ্ঞাদি কর্মবাদের একমাত্র অধিকারী। শঙ্করাচার্য-প্রবর্তিত জ্ঞানবাদও সমাজের উচ্চ কোটিতে সীমাবদ্ধ। শিক্ষা-শাস্ত্র-আদির চর্চায় সমাজের নিম্নস্তরের লােকদের কোনই অধিকার ছিল না অতএব কর্ম আর জ্ঞানের ধারা থেকে সমাজের বৃহত্তর অংশই ছিল বঞ্চিত।

চৈতন্যদেব যুগসত্যকে উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন বলেই বুঝতে পেরেছিলেন যে সমাজের বৃহত্তর অংশে যে ভাঙ্গন দেখা দিয়েছিল, তাকে রােধ করতে হলে এমন এক মতবাদ প্রচার করতে হবে, যা সর্বজনের পক্ষে গ্রহণযােগ্য আচরণীয় হয়ে উঠতে পারে। অতএব নিছক হৃদয়বৃত্তি থেকে উদ্ভূত প্রেমধর্মের প্রচারই চৈতন্যজীবনের লক্ষ্য হয়ে উঠলাে। ভক্তিবাদের ভিত্তিতে গঠিত এই প্রেমধর্মে সর্ব জীব আশ্রয় লাভ করতে পারে। সামাজিক বৈষম্য, ধর্মীয় মতবাদের গোঁড়ামি, মানুষে মানুষে ভেদজ্ঞান-আদি প্রেমধর্মে স্পষ্টতঃ অস্বীকৃত হলাে। ব্রাহ্মণদের শূন্যগর্ভ অহংকারকে তিনি ধিক্কার জানিয়ে বিনয় ও সহিষ্ণুতার বাণী প্রচার করলেন। এর ফলে বৃহৎ জনসমাজ থেকে দর্পের কারণে বিচ্ছিন্ন ব্রাহ্মাণদের সামাজিক গ্রহণশীলতা অনেক বৃদ্ধি পেল। এরপর চৈতন্যদেব স্বয়ং যখন ‘আচণ্ডালে ধরে দেয়। কোল’, তখন সমাজের সর্বনাশা ভাঙ্গনের পথ আপনা থেকেই বন্ধ হয়ে এলাে। যখন চৈতন্যদেবের মতে ‘চণ্ডালােহপি দ্বিজশ্রেষ্ঠঃ হরিভক্তিপরায়ণঃ’, তখন চিরকালের নিপীড়িত লাঞ্ছিত মানুষ মুক্তির আহ্বান শুনতে পেলাে। বস্তুতঃ এর আগে আর বাঙলাদেশে এমনভাবে মানবমুক্তির উদার আহ্বান কখনও ধ্বনিত হয়নি। এই আহ্বান অনতিবিলম্বেই সাড়া জাগালাে সমস্ত ভারতে, সমস্ত জাতির মধ্যে শুধু চণ্ডালই নয়, যবনও পেল প্রেমধর্মে আপনার অধিকার। ফলে সমগ্র দেশেই দেখা দিল এক অপূর্ব ভাববিপ্লব, যার সহায়ক হলেন শ্রীকৃষ্ণচৈতন্য মহাপ্রভু। এই ভাববিপ্লবের প্রত্যক্ষ ফল সমাজজীবনে অনুভূত হলাে নিম্নোক্ত ক্ষেত্রগুলােতে ও ব্যাপক হারে নিম্নবর্ণের হিন্দুর মুসলিম ধর্ম গ্রহণ বন্ধ হলাে, নিম্নবর্ণের হিন্দুরাও বহু ক্ষেত্রে উচ্চবর্ণের সঙ্গে সমান অধিকার লাভ করায় হিন্দুধর্মের সঙ্কীর্ণতা অনেকাংশে দূরীভূত হলাে; সন্কীর্তনে উচ্চনীচ কোন ভেদাভেদ ছিল না; নিম্নবর্ণের হিন্দু বা মুসলমানও বৈষ্ণবধর্ম গ্রহণ করলে সমান অধিকার ভােগ করতাে; গুরুগিরিতে ব্রাহ্মণের যে একচেটিয়া অধিকার ছিল, বৈষ্ণব সম্প্রদায়ে তা’ অপরদের মধ্যেও সম্প্রসারিত হলাে।

অধ্যাপক অসিত বন্দ্যোপাধ্যায় সমাজজীবনে চৈতন্যদেবের প্রভাব সম্বন্ধে আলােচনা করতে গিয়ে লিখেছেন, “..এখন আমরা চৈতন্যের জীবনে নব্যমানবতা (neo-humanism) সমাজ সংস্কার, নীচ জাতিকে উচ্চ শ্রেণীতে গ্রহণ করা, অস্পৃশ্যতা দূরীকরণ, পতিত-পতিতাকে পংক্তিতে স্থান দান ইত্যাদি আধুনিক সমাজ-মানসিকতার প্রভাব আবিষ্কারের চেষ্টা করিতেছি।” চৈতন্যদেব মানবিক সম্পর্কের নব নব মূল্যায়ন ঘটালেন তার ফলে মধ্যযুগের সাহিত্যে দেবতার স্থানে মানুষের অধিকার লাভ কতকাংশে সম্ভব হয়েছে। অস্ত্যমধ্যযুগের সাহিত্যে এই মানবতাবোেধ তথা নয়া মতবাদ স্পষ্টতঃই চৈতন্যের প্রভাবজাত।

আমাদের বাঙালী সমাজের বাইরেও চৈতন্যপ্রভাব লক্ষ্য করা যায়। পাঠান শাসনকালে বাঙলাদেশ আপনাতে আপনি সম্পূর্ণ ছিল, বাইরের সঙ্গে বিশেষ কোন যােগাযােগ ছিল না। চৈতন্যদেবই প্রথম সমগ্র দক্ষিণ ভারত, মধ্য ভারত ও উত্তর ভারত পরিভ্রমণ করে তথাকার সাধকদের সঙ্গে যােগাযােগ সাধন করে ভাবধারার বিনিময় ঘটান। এরই প্রত্যক্ষ ফল, আজও পর্যন্ত পুরী, বৃন্দাবন, মথুরা-আদি অঞ্চলের সঙ্গে বাঙালীদের হৃদয়ের যােগ বর্তমান রয়েছে। চৈতন্যদেবের প্রচেষ্টাতেই মথুরা-বৃন্দাবনের লুপ্ত তীর্থসমূহ উদ্ধার পেলাে। এক সময় বৃন্দাবনই হয়ে উঠেছিল গৌড়ীয় বৈষ্ণবধর্মের মূলকেন্দ্র।

চৈতন্যদেবের প্রচেষ্টাতে এই যে বাইরের দরজা খুলে গেল, তার ফলে বাইরের জগতের সঙ্গে আমাদের প্রত্যক্ষ যােগাযােগ স্থাপিত হলাে। এর পরই বাঙলাদেশে মুঘল কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হওয়ায় বৃহত্তর সমাজ ও পরিবেশের প্রভাব বাঙালীর জীবনবােধ ও দৃষ্টিভঙ্গিতেও অনেকটা পরিবর্তন এনেছিল। আবার মুঘল প্রভাব যখন জাতিদৃষ্টিকে অনেকটা বহির্মুখী করেছিল, তখন বাংলাদেশে চৈতন্যপ্রভাবই তাকে সংযত সংহত রেখেছিল।

এ সকল প্রবল প্রভাব ছাড়া চৈতন্যদেবের জীবন যে কতদিকে তাৎকালিক জনজীবনে উদ্দীপনা সঞ্চার করেছিল, তার কিছু কিছু কাহিনী তার চরিতকারগণ লিখে রেখে গেছেন। চৈতন্যদেব প্রেম-ভক্তিধর্ম প্রচারের জন্য প্রতি সন্ধ্যায় সমবেতভাবে নামকীর্তন করতেন। অল্পকালের মধ্যেই এই নামকীর্তন ঘরে ঘরে অনুষ্ঠিত হতে লাগলাে। কিছু উদ্দেশ্যপরায়ণ লােক এর বিরুদ্ধে কাজীর দরবারে নালিশ জানালে কাজী নামকীর্তন নিষিদ্ধ করেন। ধর্মাচরণের অধিকার ক্ষুন্ন হওয়াতে কাজীর আইনের বিরুদ্ধে জেহাদ ঘােষণা করলেন স্বয়ং চৈতন্যদেব। যে সঙ্কীর্তন ঘরে আবদ্ধ ছিল, তাকে তিনি নগর-সন্কীর্তনে রূপায়িত করলেন। চৈতন্যদেবের নায়কত্বে সঙ্কীর্তন দল কাজীর বাড়ি গিয়ে উপস্থিত হলে ভয় পেয়ে কাজী নিষেধাজ্ঞা তুলে নিলেন। আচার্য সুকুমার সেন লিখেছেন, “চৈতন্যের এই উদ্যম ভারতবর্ষে শাসক-শক্তির বিরুদ্ধে প্রথম চালেঞ্জও।” চৈতন্যদেবের এই আইন অমান্য আন্দোলন নিপীড়িতের মুখে প্রথম ভাষা যােগালাে।

চৈতন্য প্রভাব সাহিত্যে

বাঙলা সাহিত্যের ইতিহাস-আলােচনা-প্রসঙ্গে স্পষ্টতঃই একটা প্রশ্ন উঠতে পারে বাংলা সাহিত্যে চৈতন্যদেবের দান কী? প্রশ্নের একটি সহজ উত্তর কিছুই নয়, চৈতন্যদেব বাঙলা ভাষার একটি পংক্তিও রচনা করেছেন বলে আমাদের জানা নেই। কেবল তাঁর মুখনিঃসৃত আটটি শ্লোকবন্ধ উপদেশ শিক্ষাষ্টক’ নামে প্রচলিত আছে। কিন্তু প্রত্যক্ষভাবে না হলেও পরােক্ষভাবে তিনি বাঙলা সাহিত্যকে যা দান করে গেছেন, তা স্বর্ণমূল্যে তুলিত হ’বার যােগ্য। চৈতন্যদেবের আবির্ভাবে বাঙলা সাহিত্যে যে নবজাগরণ দেখা দিয়েছিল, তাতে বাঙলা সাহিত্যের গতিপথ সুনিশ্চিতভাবেই একটা পরম পরিণতির দিকে চিহ্নিত হয়েছিল। চৈতন্যোত্তর যুগের সাহিত্যের পার্থক্য থেকেই সদ্য-কথিত উক্তিটির যাথার্থ্য প্রতিপন্ন হতে পারে। চৈতন্য-প্রচারিত মতবাদ তৎকালীন বাঙালীর জীবনে যে ভাবগত পরিবর্তন সাধন করেছিল, তার ফলে বাঙালীর নিকট মানব-জীবনের মূল্য নােতুনভাবে নির্ণীত হয়েছিল। এই পরিবর্তিত দৃষ্টিভঙ্গির প্রভাবে কাহিনীর কাঠামােতে কোন লক্ষণীয় পরিবর্তন দেখা না দিলেও অন্তরে যে অনেক উলটপালট হয়ে গেছে, তার পরিচয় তৎকালীন সাহিত্যের পৃষ্ঠায় এখনও বর্তমান।

চৈতন্য-পূর্ব যুগের মঙ্গলকাব্য সাহিত্যে যে ভেদবুদ্ধির পরিচয় পাওয়া যায়, চৈতন্যোত্তর যুগের সাহিত্যে তা অনেকটা দূরীভূত; চৈতন্যপ্রভাবের ফলে পরবর্তী মঙ্গলকাব্যেও অনেকটা অসাম্প্রদায়িক সাহিত্যের উপর দিয়া বৈষ্ণব সাহিত্যের কুলপ্লাবিনী বন্যা প্রবাহিত হইয়া গিয়াছে। তাহার ফলে এই সমাজের প্রায় সমগ্র সাম্প্রদায়িক সাহিত্যের বৈষম্যের মূল শিথিল হইয়া গিয়াছে। চণ্ডীমঙ্গল কাহিনীর নায়ক ব্যাধসন্তান কালকেতু। অনার্য ব্যাধসন্তানকে নায়কের পদে অভিষিক্ত করবার মানসিকতা চৈতন্য-পূর্ব যুগে ছিল অপ্রত্যাশিত। চৈতন্যদেবের আবির্ভাব আমাদের সমাজের অনেক নিম্নস্তরের মানুষকেও যে উপরে উঠতে সাহায্য করেছে, তা ঐতিহাসিক সত্য। আমাদের এই সৃজনশীলতা, এই উদার দৃষ্টিভঙ্গি আমরা পেয়েছি চৈতন্যদেবের কাছ থেকেই। আর এরি ফলে আমাদের পক্ষে কালকেতুকে কাব্যের নায়করূপে গ্রহণ করতে কোন অসুবিধে হয়নি।

মঙ্গলকাব্যের মতােই অনুবাদ সাহিত্যেও চৈতন্যপ্রভাব প্রত্যক্ষগােচর। চৈতন্যদেবের ব্যক্তি জীবনের উচ্চ আদর্শই বাঙালী কবিকে অনুরূপ আদর্শ চরিত্রের সন্ধানে নিয়ােজিত করেছিল। এরি ফলে প্রাচীন মহাকাব্য এবং পুরাণ থেকে রামচন্দ্র এবং শ্রীকৃষ্ণকে বিভিন্ন অনুবাদের মাধ্যমে বাঙালীর চোখের সামনে উপস্থিত করা হয়েছিল। চৈতন্যদেবের আদর্শ থেকেই বাঙালী কবিরা এদের নােতুনভাবে গড়ে তুলেছিলেন। বিভিন্ন অনুবাদ সাহিত্যের সাহায্যে ভগবদ্ভক্তি প্রচারের চেষ্টাও চৈতন্যপ্রভাবজাত।

ভগবানের মাধুর্যময় রূপের অভিব্যক্তি কৃষ্ণমূর্তিতে আর শ্রীরাধিকাই কৃষ্ণের হ্লাদিনী শক্তি। পরব্রহ্মের লীলারসকে চৈতন্য আস্বাদ করেছিলেন স্বদেহে যুগপৎ কৃষ্ণ ও রাধার অস্তিত্ব অনুভবের মধ্য দিয়ে। বৈষ্ণব কবিতাগুলিতে চৈতন্য-আস্বাদিত রসেরই পরিবেষণ ঘটেছে। চৈতন্যোত্তর কবিগণ চৈতন্যদেবের অন্তরালে দাঁড়িয়েই রাধাকৃষ্ণ-লীলার আস্বাদন করেছেন। অতএব চৈতন্যদেবের প্রত্যক্ষ প্রভাবেই যে বাঙলাদেশে বিরাট পদাবলী সাহিত্য গড়ে উঠেছিল, তা’ সন্দেহাতীতভাবেই সত্য বলে প্রমাণিত। চৈতন্যদেবের প্রেমসাধনার সঙ্গে ঐক্য অনুভব করে ইসলাম-পন্থী সুফী সাধকরাও রাধাকৃষ্ণের প্রেমলীলার যে চিত্র রচনা করেছেন তার প্রভূত নিদর্শন রয়েছে পদাবলী সাহিত্যে। বাঙলার লােকসাহিত্যে, বাউল গানেও চৈতন্যপ্রভাব সুস্পষ্ট। বাংলার মুসলমান কবিরাও যে রাধা-কৃষ্ণ অবলম্বন করে বৈষ্ণবপদ রচনায় উদ্বুদ্ধ হয়েছিলেন এর জন্যও কৃতিত্বের দাবিদার স্বয়ং মহাপ্রভু।

চৈতন্যপ্রভাবের প্রত্যক্ষ ও সুপরিণত রূপ জীবনী সাহিত্যের কথা বিশেষভাবেই উল্লেখযােগ্য। বাঙলাদেশে চৈতন্যদেবের জীবনকাহিনীকে অবলম্বন করেই সর্বজীবনীসাহিত্য রচিত হয়। উক্ত সাহিত্যের চৈতন্যদেবের উপর অলৌকিক দেব-মহিমা আরােপ করা হলেও ঐ সাহিত্যেই যে সর্বপ্রথম মানব-জীবনাভিমুখী বাস্তব রূপের প্রতিফলন ঘটেছিল, তার সাক্ষী ইতিহাস। অবশ্য আমাদের দুর্ভাগ্য যে আমরা ‘প্রিয়েরে দেবতা’ করতে গিয়ে খাঁটি মানবিক জীবনী-সাহিত্য সর্বপ্রথম বিশ্বসাহিত্যের দরবারে উপস্থিত করার সুযােগ থেকে বঞ্চিত হয়েছি। যাহােক, পরবর্তী কালের বৈষ্ণবসাধকগণ আরও কিছুটা অগ্রসর হয়ে চৈতন্য-পার্ষদদেরও জীবনী রচনা করেছেন। বস্তুতঃ মধ্যযুগের বাঙলা সাহিত্যে চৈতন্যদেবের প্রভাব যে সর্বতােমুখী রূপ লাভ করেছিল, তাতে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই। চৈতন্যজীবনী ছাড়াও বৈষ্ণব পদাবলী সাহিত্যেও সংযুক্ত হল একটি নতুন পর্যায়। মানব চৈতন্যকে একদেহে রাধাকৃষ্ণের মিলিত বিগ্রহ জেনে পদাবলীকারগণ রচনা করলেন চৈতন্যকে অবলম্বন করে পদাবলী যার পারিভাষিক নাম গৌরচন্দ্রিকা।

চৈতন্যদেবের আবির্ভাবের প্রত্যক্ষ ও পরােক্ষ প্রভাবে বাঙলা সাহিত্যে যে সকল পরিবর্তন সাধিত হয়েছিল, তাদের প্রধানগুলি ইতঃপূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে। এগুলি ছাড়া আরও কিছু লক্ষণের উল্লেখ চলে। চৈতন্যদেব জন্মগ্রহণ করেছিলেন সামন্ততান্ত্রিক যুগে। চৈতন্যদেবের ধর্মমত ছিল সামন্ততন্ত্রের অনুদার মনােভাবের বিরােধী তাই চৈতন্যোত্তর সাহিত্যে সামন্ততান্ত্রিক মনােভাবের বিরােধিতাই লক্ষ্য করা যায়। চৈতন্যদেবের প্রবর্তিত ভক্তিধর্মের আবেগপ্রবণতা একদিকে যেমন গীতিকবিতাকে সার্থকতর করে তুলেছে, তেমনি আখ্যায়িকামূলক কাব্যে গীতিকবিতার স্পন্দন এবং সঙ্গীত-ধর্মিতার উৎসার ঘটিয়েছে। বৈষ্ণব পদাবলীতে ‘গৌরচন্দ্রিকা’র প্রবর্তন এবং বাল্য ও গােষ্ঠলীলা’র পদগুলি চৈতন্যআবির্ভাবের ফলেই সম্ভবপর হয়েছে। গৌড়ীয় বৈষ্ণবধর্মের প্রচারকগণ সংস্কৃত সাহিত্যের অনুশীলন করায় সাধারণ বৈষ্ণব কবিরাও বাঙলা পদগুলিতে সংস্কৃত শব্দের সার্থক ব্যবহার দ্বারা ভাষার সৌকুমার্য সাধন করেন। চৈতন্যদেবের সমুন্নত ও রুচিসম্পন্ন জীবন-যাপনের আদর্শে বৈষ্ণব কবিগণ সাহিত্যেও মার্জিত রুচির পরিচয় দান করেন। মধ্যযুগের চৈতন্যজীবনী গ্রন্থগুলি ছাড়াও পরবর্তীকালে চৈতন্যজীবন-অবলম্বনে নাটক, যাত্রা, কবিগানাদি রচিত হয়েছে ও সমগ্র বাঙলা সাহিত্যেই চৈতন্য জীবনাদর্শ ও ভক্তিভাবের প্রকাশ ঘটেছে।