উত্তর: চর্যাপদগুলোর মধ্যে পঠিত পদগুলোর আধুনিক গদ্যে রূপান্তর করা হলো এবং নিম্নরেখ শব্দের ব্যুৎপত্তি উল্লেখ করা হলো:

১. কাআ তরুবর পাঞ্চ বি ডাল।
চঞ্চল চীএ পইঠা কালঃ
দিঢ় করিঅ মহাসুহ পরিমাণ।
লুই ভণই গুরু পুচ্ছিঅ জাগঃ (১নং চর্যা)

আধুনিক গদ্যে রূপান্তর: এই শরীর (কায়া), শ্রেষ্ঠ তরু বৃক্ষ) সদৃশ: পাঁচটি তার ডাল। চঞ্চল চিত্তে কাল (মৃত্যু) প্রবেশ করে। (এই চিত্তকে) দৃঢ় করে মহাসুখ পরিমাণ কর। লুই বলেন, (কিভাবে তা করতে হবে) তা গুরুর কাছ থেকে জেনে নাও।

ব্যুৎপত্তি:
চীএ চিত্ত+এ (সপ্তমীর চিহ্ন) > চীঅ + এ
পইঠা = প্রবিষ্ট: পইটঠ পইঠ আ।
দিঢ় = দৃঢ় > দিঢ়
পুছিঅ = পৃচ্ছিত > পুচ্ছিঅ > পুছিঅ।
জাণ = জাণম জাণহ জাণঅ> জাণ।

২. এড়িঅউ ছান্দ বান্ধ করণ কপটের আস।
সূনু পথে ভিড়ি লাবু রে পাস।
ভাই লুই আহে ঝাণে দীঠা।
ধমণ চবণ বেণি পিন্ডী বইঠা। (১নং চর্যা)

আধুনিক বাংলায় রূপান্তর: এড়িয়ে যাও ছন্দ বন্দি (যোগাচারের) এবং (কপট ইন্দ্রিয়ের) করণের আশা। শূন্যতা পক্ষের দিকে এগিয়ে যাও। লুই বলেন, আমি ধমণ (পূরক) চমন (রেচক) নামক দুই পিঁড়িতে উপবিষ্ট হয়ে ধ্যানে (শূন্যতাকে) দেখেছি।

ব্যুৎপত্তি:
আস আশা > আস
লাহু = লভ > লহ > লাহ+ উ (অনুজ্ঞায়), লও

ঝানে = ধ্যায়েণ> ঝাণে

দীঠা = দৃষ্টঃ > দিউঠ > দীঠ + আ = দীঠা > দিঠ

বেণি = দ্বীনি > বেন্নি > বেণিঃ দুই।

বইঠা = উপবিষ্ট > বইঠ + আ।

৩. সঅল সমাহিঅ কাহি করিঅই।
সুখ দুঃখেতে নিচিত মরিঅই।
এড়িঅউ ছান্দ বান্ধ করণ কপটের আস। সুনু পথে ভিড়ি লাহু রে পাস। (১ নং চর্যা)

আধুনিক গদ্যে রূপান্তর: কেন করা হয় সমস্ত সমাধি? সুখে দুঃখে যে নিশ্চিত মারা যায়। এড়িয়ে যাও ছন্দবান্ধ (যোগাচায়ের) এবং করণের (ক্লপট ইন্দ্রিয়ের) আশা। শূন্যতা পক্ষের দিকে এগিয়ে যাও।

ব্যুৎপত্তি:
সঅল সকল > সঅল।
নিচিত= নিশ্চিত> নিচিত
করিঅই = ক্রিয়াত > কর্মতে > করিঅই’

করণ = ইন্দ্রিয়> করণ
পাস = পার্শ্ব > পাস

৪. দুলি দুহি পীড়া ধরণ ন জাই। বুখের তেন্ডলি কুম্ভীরে থাই। আজন ঘরপন সুন ভো বিআতী। কানেট চোরে নিল অধরাতীঃ (২নং চর্যা)

আধুনিক বাংলায় রূপান্তর: কচ্ছপ দোহন করে ভাঁড়ে ধরা যাচ্ছে না। কুমীরে খেয়ে নিচ্ছে গাছের তেতুঁল। শোনো স্ত্রী বাদ্যকরী, ঘরের পানে অর্থাৎ মধ্যে অঙ্গন। অর্ধরাত্রে ‘কানেট’ নিল চোরে।

ব্যুৎপত্তি: দুহি =√ দুহ+ ব্লাচ (> ইঅ> ই)

ধরণ =√ ধূ ধর+ন (অন্তি-জাত)

রুখের = বৃক্ষ > রুকুথ> রখ এর (কেরব-জাত)

তেন্তলী = তিভিড়ী > তেন্ডলী; তেঁতুল

সুণ = শুণ >শৃণু – শোণ
বিআতী = বাদয়ন্তিকা> বাত্রভিআ> বি আতী।

অধরাতী = অন্তরক্তিত্র > অর্থরাত্রৌ > অধরাতী।

৫. সসরা নিদ গেল বহুড়ী জাগই। কানেট চোরে নিল কা গই মাগই। দিবসহি বহুড়ী কাউহি ডর ভাই। রাতি ভইলে কামরু জাইঃ (২নং চর্যা)

আধুনিক বাংলায় রূপান্তর: শ্বশুর ঘুমিয়ে গেল, বধূ জাগে। চোরে নিল ‘কানেট’, কি (আর) খোঁজ করবে গিয়ে। দিনের বেলা বউটি কাকের ভয়ে ভীত হয়। কিন্তু রাত হলে (স) কামরূপ
(অভিসারে) যায়।

ব্যুৎপত্তি: বহুড়ী বধূটিকা > বধুটী > বহুড়ী।

জাগই = জাগতি > জাগ্রতি > জাগই।

কাউহি = কাক > কাঅ, কাউ+ হি (পঞ্চমীর চিহ্ন)

ভাই = ভায়ডি > ভাই ভাই; ভীত হয়।

৬. ভবণই গহণ গম্ভীর বেগে বাহী। দুআস্তে চিখিল মাঝে ন থাহী।
ধামার্থে চাটিল সাঙ্কম গঢ়ই।
পারগামী লোঅ নীভর তরই। (৫নং চর্যা)

আধুনিক বাংলায় রূপান্তর: গহন ও গম্ভীর (এই) ভবনদী
বেগে প্রবাহিত হয়। (তার) দু’ধারে কাদা, মাঝে থই মেলে না। ধর্ম সাধনার্থে চাটিল সাঁকো তৈরি করে দিলেন, পারগামী লোক নির্ভয়ে (এখন) পার হতে পারে।

ব্যুৎপত্তি: বাহী= বাহী> বাহিঅ> বাহিত।

দুআন্তে = দু’ধারে: দ্বৌ> দৌ> দু+আন্ত (<অন্ত+এ)

সাঙ্কম = সাঙ্কম< সংক্রম- সাঁকো।

তরই = উত্তীর্ণ হয়; তরতি> তরই।

৭. সাঙ্কমত চড়িলে দাহিণ বাম মা হোহি। নিয়ড়ি বোহি দূর মা জাহিঃ জই তুমহে লোঅ হে হোইব পারগামী।
পুছহু চাটিল অনুত্তরসামীঃ (৫নং চর্যা)

আধুনিক বাংলায় রূপান্তর: সাঁকোয় চড়ে ডান কিংবা বাম দিকে চেয়োনা। বোধি নিকটেই রয়েছে, দূরে যেওনা। যদি ওগো (লোকেরা) তোমরা পরপারে যেতে চাও তবে অনুত্তর স্বামী চাটিলকে জিজ্ঞাসা কর।

বুৎপত্তি: সাঙ্কমত – সাঙ্কম + ত (অধিকরণ)

নিয়ড়ি – নিকট > নিয়ডড> নিয়ড়+ই (সপ্তমীর চিহ্ন)

হোইব – ভূ> জো+ইন (< তর‍্য)।

পূছহু- পুচ্ছ >পূছ+হু (মধ্যম পুরুষের চিহ্ন)

৮. তিণ ন ছুবই হরিণা পিবই ন পাণী

হরিণা হরিণির নিলঅ ণ জাণী।

হরিণী বোলই সুণ হরিণা তো। ।

এ বণ ছাড়ী হোবু ভান্তোঃ (৬নং চর্যা)

আধুনিক গদ্যে রূপান্তর: হরিণ তৃণও স্পর্শ করে না, জলও পাণ করে না। হরিণা হরিণির আবাস জানা যায় না। হরিণী বলছে, হরিণ তুমি শোনো, এ বন ছেড়ে চলে যাও।

ব্যুৎপত্তি: তিণ= তৃণ > তিন্ন > তিণ

ছুবই = ক্ষুভ্যন্তি > চ্ছু পই> ছুপই, ছুবই।
হোহু= ভবস: >হোতু > হোহু

৯. অপনা মাংসে হরিণা বৈরী।

খনহ ন ছাড়ই ভুসুকু অহেরী।
তিণ ন ছুবই হরিণা পিবই ন পাণী।

হরিণা হরিণির নিলঅ ণ জাণীঃ (৬নং চর্যা)

আধুনিক বাংলায় রূপান্তর: আপন মাংসের জন্যই হরিণ সকলের শত্রু। এক মুহূর্তের জন্যও শিকারি ভুসুক তাকে ছাড়ে না। হরিণ ঘাসও ছোঁয় না, জলও পান করে না। হরিণ-হরিণীর নিলয় জানা যায় না।

ব্যুৎপত্তি: মাংসে =মাংস + এ (এন)

ছাড়ই = ছাড়ই< ছড্ডই< ছদতি

নিঅল = নিলয় > নিঅল
জানী = জানিত > জানী-জ্ঞাত।

১০. হরিণী বোলই সুণ হরিণা তো।

এ বণ ছাড়ী হোবু ভান্তো।

তরঙ্গতে হরিণার পুর ন দীসই।
ভুসুক ভণই মুঢ়া-হিঅহি ণ পইসইঃ (৬নং চর্যা)

আধুনিক বাংলায় রূপান্তরঃ হরিণী বলছে, হরিণ তুমি শোনো, এ বন ছেড়ে চলে যাও। (দ্রুত) লাফ দেওয়ার জন্য হরিণের খুর দেখা যায় না। ভুসুক বলেন, মূঢ়ের হৃদয়ে (এ তত্ত্ব) প্রবেশ করে না।

ব্যুৎপত্তি: ছাড়- ছাড়িয়া ছিদ্‌> ছাড়+ই (অসমাপিকার চিহ্ন)

দাসই- দৃশ্যতি> দীস যতি > দীসই > দীসঅ।

হিঅহি- হৃদয়ে; হৃদয় হিঅঅ + হি (সপ্তমী)> হিঅহি।

পইসই- প্রবিশতি> পইসই; প্রবেশ করে।

১১. কাহেরে ঘিনি মেলি আছহু কীস। বেঢ়িল হাক পড়ই চৌদীসঃ
আপণা মাংসে হরিণা বৈরী। খনহ ন ছাড়ই ভুসুকু অহেরীঃ (৬নং চর্চা)

আধুনিক বাংলায় রূপান্তর: কাকে নিয়ে (বা কাকে) ছেড়ে কেমন করে আছি। আমাকে ঘিরে চারদিকে হাঁক পড়ে। আপন মাংসের জন্যই হরিণ সকলের শত্রু। ক্ষণ মুহূর্তের জন্যও শিকারি ভুসুক (তাকে) ছাড়ে না।

ব্যুৎপত্তি: ঘিনি = গহ্নাতি> গেণহই> ঘেনি, ঘিনি।

বেঢ়িল = বেষ্টিত > বেঠিঅ + ইল্ল > বেঢ়িল।

চৌদীস = চতুঃ > চৌ+দীস (< দিশ); চারদিকে।

‘হরিণা = হরিণ+ আ (বিশিষ্টার্থে)

ছাড়ই = ছাড়ই < ছডডই< ছর্দর্তি – ছাড়ে।

অহেরী = অহেরী < আহেড়িঅ < আথেটিক < আহেরি: শিকারী।

১২. অলিএ কালিএ বাট রুজেলা।

তা দেখি কাহ্ন বিমনা ভইলা।

কাহ্ন কহি গই করিম নিবাস।

জো মন গোঅর সো উআস।

আধুনিক বাংলায় রূপান্তর: লোকজ্ঞান ও লোকভাস দ্বারা পথ রুদ্ধ হলো। তা দেখে কাহ্ন বিমর্ষ হলো। কাহ্ন কোথায় গিয়ে বসবাস করবে। সে মন গোচর, সেই উদাস।

ব্যুৎপত্তি: বাট= বর্জ্য > বত্ত> বাট।

গোঅর = গোচর > গোঅর।

উআস = উদাস > উআস।

১৩. তে তীনি তে তীনি তীনি হো ভিন্না।

ডনই কাহ্ন ভব পরিচ্ছিন্না

জে জে আইলা তে তে গেলা।

অবনাগবনে কাহ্ন নিঅড়ি বিমনা ভইলা। (চর্যা-৭)

আধুনিক বাংলায় রূপান্তর: তারা তিন (কায়, বাক, চিত্ত) তিনে আছে তিনই ভিন্ন। কানু বলেন ভব বা পৃথিবী পরিচ্ছন্ন (লীন)। যারা যারা এল তারা তারা গেল। আনাগোনা দেখে কানু দুঃখিত হলো।

ব্যুৎপত্তিঃ আইল = আগত + ইল্লা > আইল্ল > আইল + অ > আইল।

কাহ্ন = কৃষ্ণ > কন্‌হ > কাহ্ন।

গেলা = গত > গত্ম + ইল্ল> গইল্ল> গেল + অ।

১৪. জিম জিম করিআ করিনিরে রিসই। তিম তিম তথতা মঅগল বরিসই। ছড়গই সঅল সহাবে সূধ। ভাবাভাব বলাগ ন ছুধ। (চর্যা-৯)

আধুনিক বাংলায় রূপান্তর: কবি করিনীর যেমন আসক্ত হয় তেমনি তারা বর্ষায় মৃদমত্ত। ছয়গতি সব স্বভাবে পরিশুদ্ধ। ভাবাবেগে তারা কেশাগ্র অপরিশুদ্ধ নয়।

বুৎপত্তি : মঅগল = মদকল > মঅগল।

সঅল = সকল > মঅল।

মহাবে = স্বভাবেন > সভাবে >সহাবে।

১৫. ছড়গই সঅল সহাবে ঘৃধ।

ভাবাভাব বলাগ ন দুধ।

দশবল রঅন হরিঅ দশ দিসে।

বিদ্যা করিকু দম অকিলেসে। (চর্যা – ৯)

আধুনিক বাংলায় রূপান্তর: ছয়গতি স্বভাবে পরিশুদ্ধ। ভাবে ও অভাবে তার কেশাগ্র অপরিশুদ্ধ নয়। দশ রত্ন দশ দিকে বিস্তারিত। বিদ্যারূপ হস্তীকে অক্লেশে দমন কর।

বুৎপত্তি: ছড়গই = ষটগতি > ছড়গই।

সূধ = শুদ্ধ > সুদ্ধ > সূধ।

দুধ = ক্ষুব্ধ > ছুদ্ধ > ছূধ > ছুধ

হরিঅ = হৃত > হরিত > হরিঅ।

অকিলেষে = অক্লেশেন > অক্লেসে > অকিলেসে।

১৬. নগর বাহিরি রে ডোম্বি তোহোরি কুড়িআ।

ছোই ছোই জাসি বাম্‌হণ নাড়িআ

আলো ডোম্বি তোএ সম করিব মই সাঙ্গ।

নিঘিণ কাহ কাপালি জোই লাঙ্গ। (১০নং চর্যা)

আধুনিক গদ্যে রূপান্তর: ওগো ডোম্বি, তোমার কুড়েঘর খানি নগরের বাইরে। তুমি ব্রাহ্মণ নেড়েকে ছুঁয়ে ছুঁয়ে যাও। ওগো ডোম্বি, আমি তোমাকে বিবাহ করব। আমি কানু কাপালিক, নিঘূর্ণ এবং উলঙ্গ যোগী।

ব্যুৎপত্তি: তোহারি = তব > তোহ+হ (< ইহ < ইধ)+র (কারক জাত) > তোহার+ই (স্ত্রীপ্রত্যয়)।

কুড়িআ = কড়িআ < কুটী + ইকা -কুড়ে ঘর

ছোই = √ ছুপ + ইঅ > ছোইঅ > ছোই।

বামহণ = বামহ্ণ > ব্রাহ্মণ।

তোএ = তব > তো+এ (< এণ, তৃতীয়ার চিহ্ন)

মই = মই < ময়া- আমি।

১৭. তুলো ডোম্বি হউ কাপালী।

তোহার অন্তরে মোএ ঘালিলি হাড়েরি মালী।

সরবর ভাঞ্জিঅ ডোম্বি খাহ মোলাণ।

মারমি ডোম্বি লেমি পরাণ। (১০ নং চর্যা)

আধুনিক বাংলায় রূপান্তর: তুমি ডোম্বী, আমি কাপালিকা তোমার জন্যই হাড়ের মালা গ্রহণ করেছি। ডোম্বি, সরোবর ভেঙে মৃণাল খাও। ডোম্বি, তোমাকে মারব, প্রাণ নেব।

ব্যুৎপত্তি: ঘালিলি = ঘল্ল > ঘাল+ইল (কর্মবাচ্য); গৃহীত হল।

মোলাণ = মৃণাল > মুনাল > মোলাণ (বর্ণ বিপর্যয়)

লেমি = লভ > লহ > (লে + মি (উত্তম পুরুষের চিহ্ন)

১৮. উষ্ণা উষ্ণা পাবত তহি বসই সবরী বালী।

মোরাঙ্গ পীচ্ছ পরিহাণ সবরী গীবত গুঞ্জরী মালী।

* উমত সবরো পাগল সবরো মা কর গুলীগুহারী।

তোহেরী ণিঅ ঘরিণী ণামে সহজ সুন্দরী। (২৮ নং চর্যা)

আধুনিক বাংলায় রূপান্তর: উঁচু উঁচু পাহাড়, যেখানে শবরী বালিকা বাস করে। ময়ূরের পুচ্ছ পরিধান করে শবরী, গলায় গুঞ্জার মালা। উন্মত্ত শবর, পাগল শবর, গোলমাল কিংবা অভিযোগ করো না। সহজ সুন্দরী নামে শবরী তোমার নিজ গৃহিণী।

ব্যুৎপত্তি: পাবত = পর্বত > পব্বত > পাবত।

বসই = বসতি > বসই = বাস করে।

গীবত = গ্রীবা > গীব+ত (৭মী)

উমত = উম্মত > উমত।

১৯. জো সো বুধী সোহি নিরুধী।

জো সো চোর সোহি সাধী।

নিতি নিতি সিআলা সিহে সম জুঝই।

ঢেণঢণ পাত্রর গীত বিরলে বুঝই। (৩৩ নং চর্যা)

আধুনিক বাংলায় রূপান্তর: যে বুদ্ধিমান, সেই নির্বোধ, যে চোর সেই সাধু। নিত্য শৃগাল যুদ্ধ করে সিংহের সঙ্গে। ঢেণঢণপাদের গীত অল্প লোকেই বুঝে।

ব্যুৎপত্তি: বুধী = বুদ্ধি > বুধী

নিবুধী = নির্বুদ্ধিক > নিবুধী

সিআলা = শৃগাল > সিআল + আ (বিশিষ্টার্থে)

বিরলে = বিরল + এঁ (<এন)

বুঝই = বুধ্যতে > বুঝই

২০. টালত মোর ঘব নাহি পড়বেসী।

হাড়ীত ভাত নাহি নিতি আবেশী।

বেঙ্গস সাপ চঢ়িল জাই।

দুহিল দুধু কি বেন্টে সামাই। (৩৩ নং চর্যা)

আধুনিক গদ্যে রূপান্তর: বস্তিতে আমার ঘর, প্রতিবেশী নেই। হাড়িতে ভাত নেই, অথচ প্রেমিক ভিড় করে। ব্যাঙ কর্তৃক সাপ আক্রান্ত হয়। দোয়ানো দুধ কি বাঁটে প্রবেশ করে?

ব্যুৎপত্তি: হাড়ীত = হণ্ডী > হাঁড়ী, হাড়ী + ত (৭মী)।

ভাত = ভাত< ভত্ত < ভও

নিতি = নিত্যেন > নিতে > তিনি

চড়িল = চড় + ইল্ল

সামাই = সমায়াতি > সামাই।

২১. জো মণ-গোঅর আলাজালা।

আগম পোখী ইট্‌ঠা মালা।

ভণ কইসে সহজ বোলবা জাই।

কাঅবাক চিঅ জসু ণ সমাই। (৪০ নং চর্যা)

আধুনিক বাংলায় রূপান্তর: যা মনোগোচর, তা ধোকাবাজি- অমনি ধোকাবাজি হচ্ছে আগম পুথি ইষ্টমাল্য। বল, সহজকে বলা যায় কেমন ক’রে- যার মধ্যে কায়-বাক চিত্ত প্রবেশ করে না।

ব্যুৎপত্তি: আলা জালা = আলজাল > আলাজালা।

পোথী = পুস্তিকা > পোথী

ইটঠা = ইষ্ট > ইঠা + আ

জসু = যস্য > জসু

২২. জ়েতই বোলী তেতবি টাল।

গুরু বোব সে সীসা কাল।

ভণই কাহ্ন জিণরঅণবি কইসা।

কাল বোবে সংবোহিঅ জইসা। (৪০ নং চর্যা)

আধুনিক বাংলায় রূপান্তর: যতই বলা হলো ততই চলল টাল-বাহানা। গুরু, বোবা, (আর) সে শিষ্য কালা। কানু বলেন, জিন রত্নটি কেমন, বোবা যেমন কালাকে সংবোধিত করে তেমনি।

ব্যুৎপত্তি: সীসা = শিষ্য > সীস + আ (বহুবচনে)

ৰোবে = বোবে > বোবে, বোবা+এঁ (এন)

সংবোহিঅ = সংবোধিত > সংবোহি অ।

২৩. ভণ কইসে সহজ বোলবা জাই।

কাঅবাক্ চিঅ জসু ণ সমাই।

আলে গুরু উএসই সীস।

বাক্ পথাতীত কহিব কীসা। (৪০নং চর্যা)

আধুনিক বাংলায় রূপান্তর: বল সহজকে বলা যায় কেমন করে- যার মধ্যে কায়বাকচিত্ত প্রবেশ করে না। বৃথাই গুরু শিষ্যকে উপদেশ দেয়, বাক পথের অতীত বস্তু কেমন করে ব্যাখ্যা করা যাবে।

ব্যুৎপত্তি: বোলবা = বোলবা (তব্য-জাত অসমাপিকা)

আলে = অলম > আল+এ (এন)

উএসই = উপদিশতি > উএসই।

২৪. ছীজই = ছেদ্যতি > ছিজ্জতি > চীজজই > ছীজই।

ডহিঅ পাঞ্চ পাটন ইন্দি বিসঅ নঠা।

ণ জানমি চিঅ মোর কহি গই পইঠা

সোণ অ রূঅ মোর কিম্পি ণ থাকিউ।

নিঅ পরিবারে মহাসুহে থাকিউ। (চর্যা – ৪৯)

আধুনিক বাংলায় রূপান্তর: পঞ্চ পাটন গদ হলো, ইন্দ্রিয় বিষয় নষ্ট হলো। জানি চিত্ত আমার কোথায় গিয়ে প্রবিষ্ট হলো। আমার সোনা-রুপা কিছুই থাকল না। নিজ পরিবারে মহাসুখে থাকলাম।

ব্যুৎপত্তি: ডহিঅ= দন্ধিত> দহিঅ> ডহিঅ।

বিসঅ = বিষয়া: >বিসা।

রূঅ = রূপক > রূঅ।

থাকিউ = স্থক্কিত: > থাকিউ।

২৫. রাজনাব পাড়ী পউআঁ খালে বাহিউ।

অদঅ বঙ্গাল দেশ লুড়িউ।

আজি ভুনুকু বঙ্গলী ভইলী।

নিঅ ঘরিণী চণ্ডাল লেলী।

আধুনিক বাংলায় রূপান্তর: বজ্র নৌকা বেয়ে’ পদ্মা খাল পাড়ি দেই। অদ্বয় বাংলাদেশ লুণ্ঠিত হলো। আজ ভুসুকু তাই বঙ্গবাসী হলো। নিজের ঘরণীরূপে চণ্ডালকে নিল।

ব্যুৎপত্তি:

বাজ = বজ্র > বজজ > বাজ।

পউআঁ = পদ্মা > পদুমা > পউআঁ।

অদঅ = অদ্বয় > অদঅ।

নিঅ = নিজ / নিঅ

২৬. গঅণত গঅণত তইলা বাড়ী হিএ কুরাড়ী।

কণ্ঠে নইরামণি কালি জাগন্তে উপাড়ী।

ছাড় ছাড় মাআ মোহা বিসমে দুন্দোলী।

মহামুহে বিলসন্তি সবরো লইঅ সূণ মেহেলী। (চর্যা ৫০)

আধুনিক বাংলায় রূপান্তর: গগনে গগনে তৃতীয় বাড়ি, হৃদয় কুঠার। কণ্ঠে নৈরাত্মা বালিকা নিভৃতে জেগে থাকে। ছাড় ছাড় মায়ামোহ বিষম দ্বন্দ্বকারী। শবর মহাসুখে শূন্য মহিলা নিয়ে বিলাস করে।

ব্যুৎপত্তি : তইলা = তৃতীয় > তঈঅ > তইঅ + ল > তইল অ > তইলা।

কুরাড়ী + কুঠারিকা > কুরাড়ী।

বিসমে = বিসম> বিসমে।

২৭. হেরি সো মোরি তইলা বাড়ী খসমে সমতুলা।

সুকল এ মোরে ব্যপাসু ফুটিলা।

তইলা বাড়ীর পাসেঁরে জোহ্নাবাড়ী তাএলা

ফিটেলি অন্ধারি রে আকাস ফুলিলা। (চর্যা-৫০)

আধুনিক বাংলায় রূপান্তর: আমার আকাশ সমতুল্য তৃতীয় বাড়ি দেখে যায়। সুন্দর কাপাস ফুটলো। তৃতীয় বাড়ির পাশে জ্যোৎস্না বাড়ি উদিত হলো। দূর হলো অন্ধকার, আকাশ কুসুমিত হলো।

ব্যুৎপত্তি: জোহ্না = জ্যোৎস্না > জোহ্না

অন্ধারি = অন্ধকার > অন্ধআর+ অন্ধার +ই> অন্ধারি।

২৮. আলো ডোম্বী তো পুহমি সদভাবে।

আইসসি জাসি ডোম্বী কাহেরি নাবে। (১০নং চর্যা)

আধুনিক গদ্যে রূপান্তর: ওগো ডোম্বি, সদ্‌ভাবে তোমাকে আমি শুধাই- তুমি, ডোম্বি, কার নৌকোয় আসা-যাওয়া কর?

ব্যুৎপত্তি: আলো = ওলো > প্রাকৃতি হলো

তো< ত্বা = তোমাকে।

পূছমি < পৃচ্ছামি = জিজ্ঞাসা করি।

সদভাবে = সদ্ভাবে (তৎসম শব্দ)।

আইসিস< আবিশসি = আসিস।

কাহেরি = কস্য > কাহ + র (কেরক-জাত) + ই (স্ত্রীলিঙ্গে)।

নাবে = নৌ > নাব + এ’ (<এন, তৃতীয়ার চিহ্ন)। তান্তি< তন্ত্রী।