প্রথমেই বলে নেওয়া ভালো, চন্দ্রশেখর কোনো ঐতিহাসিক উপন্যাস নয়, ইতিহাসাশ্রিত সামাজিক ও মনস্তাত্ত্বিক উপন্যাস। ইতিহাস এখানে যতটুকু প্রভাব বিস্তার করেছে তা কাহিনি নির্মাণের প্রয়োজনে, ইতিহাস রস সৃষ্টির জন্য নয়। এর মূল কাহিনি নির্মিত হয়েছে প্রতাপ-শৈবালিনী চন্দ্রশেখর প্রভৃতি সামাজিক চরিত্রকে নিয়ে। যে সকল ঐতিহাসিক চরিত্র স্থান পেয়েছে কার্যকারণসূত্রে তাঁরা উপন্যাস মধ্যে তেমন প্রভাব বিস্তার করতে পারেনি। অদ্ভতঃ উপন্যাস স্রষ্টার, তেমন উদ্দেশ্য বোধ হয় ছিল না– চন্দ্রশেখরকে সার্থকভাবে ঐতিহাসিক উপন্যাস রূপে গড়ে তোলা। মূলতঃ এর মূল কাহিনিকে ইতিহাসের অঙ্গনে প্রতিস্থাপন করা হয়েছে চমৎকারিত্ব সৃষ্টির জন্য, ইতিহাসকে প্রতিপাদনের জন্য নয়। তাই যে সামাজিক কাহিনিতে ইতিহাসের আগমন ঘটে সেখানে আরও প্রবল রূপে সৌন্দর্য ও আকর্ষণ সৃষ্টির জন্য যে কাল্পনিক বিষয়ের অবতারণা হবে সে বিষয়ে কোনো সংশয় থাকতে পারে না। চন্দ্রশেখরে তেমন দৃশ্য দৃষ্ট হয়। ইতিহাসের সঙ্গে অলৌকিক বিষয় মিশ্রিত হয়ে উপন্যাসটি অপরূপ সাজে সজ্জিত করেছে, এবং হয়ে উঠেছে হৃদয়গ্রাহী।

চন্দ্রশেখরে সামাজিক কাহিনি ও ইতিহাসের ঘটনা পাশাপাশি অবস্থান করেছে, এবং সমান্তরাল ধারায় এগিয়ে গেছে। মাঝেমধ্যে চকিতে উভয়ের মিলন ঘটেছে। সামাজিক কাহিনিতে আছে প্রতাপ-শৈবালিনী-চন্দ্রশেখরের প্রেমপ্রণয়ের দ্বন্দ্ব বিক্ষোভ, আর ইতিহাসের ঘটনায় আছে, বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব মীরকাসেমের সঙ্গে ইংরাজদের দ্বন্দ্ব কলহ এবং মীরকাসেমের পরাজয়। দুটি ধারা সম পরিমাণে অলৌকিক কাহিনির সমাবেশ ঘটেছে। প্রতাপ-শৈবালিনী নিশ্চিত যখন জানলেন ইহজীবনে তাঁদের বিবাহ হওয়া সম্ভব নয়, তখন তাঁরা একসাথে আত্মহত্যা জন্যে গঙ্গাবক্ষে ডুবে মরতে গেলেন, প্রতাপ ডুবলেন, শৈবালিনী ফিরে এলেন। প্রতাপ ডুবেও বেঁচে ফিরে এলেন চন্দ্রশেখরের বদান্যতায়। প্রতাপের এই ডুবে যাওয়া এবং বেঁচে ফিরে আসার মধ্যে অলৌকিকতার সুর অনুরণিত হয়েছে।

শৈবালিনী রাতের অন্ধকারে লরেন্স ফষ্টর কর্তৃক অপহূতা হয়েছেন, সে সংবাদ দিকে দিকে রাষ্ট্র হতেই চন্দ্রশেখরের প্রতিবেশী ভগিনী সুন্দরী আর কাল বিলম্ব না করে নদীর তীর ধরে ফষ্টরের নৌকাকে অনুসরণ করতে থাকেন। অবশেষে এক স্থানে ফষ্টর-এর নৌকা নোঙর করলে সুন্দরী নাপিতিনীর ছদ্মবেশে আলতা সিঁদুর বিক্রির জন্য কৌশলে শৈবালিনীর নিকট পৌঁছেছিলেন তাঁকে মুক্ত করার জন্য, এই প্রসঙ্গটি একেবারেই অবাস্তব বলে অনুভূত হয়। অপহ্‌তা শৈবালিনীর সঙ্গে কোনো বিদেশিনীর সাক্ষাৎ এমন সহজভাবে অনুষ্ঠিত হবে তা মনে করা চলে। আবার ব্যর্থ হয়ে সুন্দরী ফিরে এসে শৈবালিনীর কথা প্রতাপকে জানালে প্রতাপ যেভাবে মাত্র জনাকয়েক সঙ্গী নিয়ে শৈবালিনীকে উদ্ধার করলেন তাতে বিস্ময়ের উদ্রেক করে বৈকি। সাম্প্রতিক কালে সচরাচর হিন্দি মিশ্রণমায় নায়কদের মধ্যে এমন বীরত্ব দর্শিত হয়ে থাকে। এগুলিকে একেবারে অলৌকিকতার আবরণে মোড়া তা বলাই বাহুল্য।

ইংরাজদের দ্বারা অতর্কিতে আক্রান্ত হয়ে প্রতাপ-দলনী যেভাবে বন্দিত্ব প্রাপ্ত হয়েছিলেন এবং শৈবালিনী তাঁদের উদ্ধারকার্যে যে কৌশলে মীরকাসেমের দ্বারস্থ হয়েছিলেন এবং ব্রাহ্মণকন্যা সেজে প্রতাপের নৌকাতে উঠে তাঁকে মুক্ত করেছিলেন, তারপর সমুদ্রবক্ষে ঝাঁপ দিয়ে দীর্ঘক্ষণ সম্ভরণের পর নিজেদেরকে মুক্ত করেছিলেন সমস্ত বিষয়টির মধ্যে যেন কেমন একটা অসঙ্গতি বিরাজ করছে। কাহিনিগ্রন্থনে আকর্ষণ সৃষ্টির ক্ষেত্রে এর বিশেষ অবদান স্বীকৃত হলেও বাস্তবতার খাতিরে এ সকল ঘটনার অসারতা প্রমাণিত হয়। বিশেষতঃ দলনী বেগম নবাবের মঙ্গলকামনায় যেভাবে অস্তপুর ত্যাগ করে গুরগন খাঁর স্মরণাপন্ন হয়েছিলেন, এবং রাতে দুর্গমধ্যে ফিরতে না পেরে শৈবালিনীর পরিবর্তে ধৃত হয়ে ইংরাজের নৌকাতে বন্দিনী হয়ে এসেছিলেন সমস্তটাই যেন দৈবদুর্ঘটনা মাত্র। একটা অদৃশ্য হাত যেন তাঁকে নিয়ন্ত্রণ করেছেন।

প্রতাপের জন্যই শৈবালিনীর জীবন মরুময় হতে চলেছে। তাই তাঁর সান্নিধ্য ত্যাগ করে নৌকা থেকে অবতরণ করে শৈবালিনী যখন নদীর তীর সংলগ্ন অরণ্যমধ্যে আত্মগোপন করে সেখানকার দৃশ্যপটটি লেখক এমনভাবে উপস্থাপন করেছেন তাতে তা যেন অলৌকিকতায় পর্যবসিত হয়েছে। চন্দ্রশেখরের সাহায্যে পর্বতগুহায় এসে আশ্রয় নেওয়া, দীর্ঘদিন ধরে কঠোর ব্রতধর্ম পালন করা। তারপর চন্দ্রশেখরের সঙ্গে শৈবালিনী বেদগ্রামে ফিরে এসে কমণ্ডুলুর জলের প্রভাবে উন্মাদগ্রস্ততা পরিহার করে তাঁর পূর্বস্মৃতি রোমন্থন প্রভৃতি বিষয়গুলি যেন পাঠকদের আকর্ষণ সৃষ্টির নিমিত্তে সংঘটিত হয়েছে। এইসকল ঘটনার কোনো বাস্তব ভিত্তি নেই৷ তথাপি কাহিনি গ্রন্থনের তাগিদে লেখক সংযোজন ঘটিয়েছেন এইসকল বিষয়। এছাড়া যেভাবে অলক্ষ্য হতে রমানন্দ স্বামী ও চন্দ্রশেখর প্রতাপ-শৈবালিনী-দলনীকে অনুসরণ করেছেন এবং বিপদে তাঁদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন তাতে স্পষ্টতই অলৌকিকত্ব ফুটে উঠেছে।

সর্বোপরি ইতিহাস অংশে, তকি খাঁর প্ররোচনায় দলনীর প্রতি সন্দিহান হয়ে নবাব তাঁর বিষপানে হত্যার দণ্ডাজ্ঞা প্রদান করলে, সতীসাধ্বী রমণীর মতো পতি আজ্ঞা পালন করতে দলনী যেভাবে বিষপানে আত্মহত্যা করলেন তা অলৌকিক ভাবে গ্রন্থিত হয়েছে। প্রথমত, দলনী বেগম অনৈতিহাসিক চরিত্র, দ্বিতীয়ত, তাঁর বিষপানে আত্মহত্যা ইতিহাসের পাতায় এমন কোনো ঘটনা সংঘটিত হয়নি, কার্যত এটি লেখক অলৌকিক রূপে প্রতিপন্ন করেছে। অর্থাৎ, সামগ্রিকভাবে বলা যায়, ইতিহাস ও কাল্পনিক কাহিনির আশ্চর্য সমন্বিত রূপ হল ‘চন্দ্রশেখর’ উপন্যাস।