অথবা, চণ্ডীদাস ও গোবিন্দদাসের কবি প্রকৃতির তুলনা কর

অথবা, বৈষ্ণব পদকর্তা হিসেবে কবি চণ্ডীদাস ও গোবিন্দদাসের পদের তুলনামূলক আলোচনা লিপিবদ্ধ কর

উত্তর: বাংলাদেশে প্রচলিত পদাবলী গানের ধারায় সুস্পষ্ট দুটি ভাগ দেখা যায়- একটি চৈতন্য পূর্ববর্তী, অপরটি চৈতন্য পরবর্তী। কবি চণ্ডীদাস ও গোবিন্দদাসের কবি প্রতিভার ‘আলোচনা প্রসঙ্গে বলা যায়, চণ্ডীদাস ছিলেন চৈতন্য পূর্ববর্তী যুগের কবি। আর গোবিন্দদাস চৈতন্য পরবর্তী যুগের কবি। চৈতন্যপূর্ব যুগে যেসব কবি বৈষ্ণব কবিতা রচনা করেছেন, তাঁরা কেউ ধর্ম বা দার্শনিক তত্ত্ববোধ ও সাধনার দিক থেকে বৈষ্ণব কবিতা রচনা করেননি। কিন্তু চৈতন্য পরবর্তী বৈষ্ণব কবিরা সবাই গৌড়ীয় বৈষ্ণব গোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। ফলে সুস্পষ্টভাবেই চৈতন্য পূর্ব ও পরবর্তী কবিদের রচনায় পার্থক্য রয়েছে।

কবি চণ্ডীদাস ও গোবিন্দদাসের পদের তুলনামূলক আলোচনায় দেখা যায়, চণ্ডীদাস ছিলেন আবেগপ্রবণ কবি। অনুভূতির রসাপ্লুত তাঁর কবিতার প্রাণ। বুদ্ধির দীপ্তি অপেক্ষা তিনি রাখেন না। যুক্তির ক্রম তাঁর কবিতায় মেলে না। আবেগ প্রবণতা আর অতিমাত্রায় কোমল স্পর্শকাতরতা তাঁর কবিতার বৈশিষ্ট্য।

অন্যদিকে, গোবিন্দদাস সৌন্দর্যের কবি। মধ্যযুগের কবিদের মধ্যে ‘রূপসিদ্ধ কবি’ হিসেবে তাঁর খ্যাতি আছে। ভক্তির আকুলতাকে রচনার সৌকর্যের সাথে দ্বিধাহীন সম্বন্ধে আবদ্ধ না করলে কবিতার সার্থক রসাবেদনের রাজ্যে তার স্থান হয় না- এ. বোধ গোবিন্দদাসের ছিল। তাছাড়া বৈষ্ণব ধর্মে দীক্ষা ও বৈষ্ণব শাস্ত্রের গভীরে প্রবেশের ফলে তাঁর কবি প্রতিভা স্ফুরিত হয়েছে।

চণ্ডীদাস ছিলেন গভীর অনুভূতির অতি সরল ও অনলঙ্কৃত মাহাত্ম্যের কবি। তাঁর কবিতার রূপ নির্মিতিকে পৃথক করে চেনা যায় না। ভাষা এত সরল, ছন্দ এত সাধারণ, অলঙ্করণ এত স্বল্পতা যে মনে হয় কবি আদৌ রূপ সচেতন নন। কিন্তু কবির অন্তরানুভূতির বিশিষ্ট সারল্য ও গভীরতার রাজ্য থেকেই এই ভাষা ছন্দ-শব্দের জন্ম তাতে সন্দেহ থাকে না। চণ্ডীদাসের ‘কাব্য দেহের মার্জনা বিশ্ব সৃষ্টির কৌশলের মতো’। রবীন্দ্রনাথের অনুসরণে বলা যায়, “বিশ্বলক্ষ্মীর মতোই এরও রান্নাঘর ও ভাঁড়ার দৃষ্টির অন্তরালেই থাকে।”

গোবিন্দদাস ছিলেন বিদগ্ধ কবি। তিনি ‘হাটের মাঠের কবি’ নহেন। তাঁর কাব্যে ‘রূপরসের সার্থক সঙ্গমলীলা’ ঘটেছে। তাঁর কবিতায় রূপ-রচনার দিকে সচেতন প্রবণতা ও অলঙ্করণের অতন্দ্র নিষ্ঠা দেখা যায়। চণ্ডীদাসের অতি গভীর অনুভূতির সরলতা এবং অনলঙ্কৃত মাহাত্ম্য হৃদয়ঙ্গম করার মানসিকতা গোবিন্দদাসের ছিল না। পূর্বসূরি হিসেবে তিনি প্রধানত চণ্ডীদাসকে অনুসরণ করেছেন। তাছাড়া চণ্ডীদাসের গভীর অনুভূতি গোবিন্দদাসের অনায়ও ছিল এবং চণ্ডীদাসকে তিনি যথেষ্ট রূপদক্ষ মনে করতেন না।

চণ্ডীদাসের রাধা কামাসক্তিবিহীন, প্রেমব্যাকুলতায়, ভাবগভীরতায় আত্মার গভীরতম প্রদেশে অবতারণ করেছে। রাধার প্রেম ইন্দ্রিয় বোধের ঊর্ধ্বচারী। কৃষ্ণই তার ধ্যানজ্ঞান। সব প্রসাধন প্রেমাকুল ভাব-বিগলনে একাকার হয়েছে। রসতন্ময়তায় রাধিকা কৃষ্ণপ্রেমে আত্মবিস্মৃত হারিয়েছে। কবি চণ্ডীদাসও রাধার ভাবতন্ময়তায় একাত্ম হয়েছেন। কবি তাঁর সৃষ্ট রাধাকে আপনার আত্মার প্রতিফলন হিসেবে গড়েছেন। রাধানুভূতিকে দূরে দাঁড়িয়ে নিরাসক্ত আর্টিস্টের দৃষ্টিতে দেখা ও রূপবদ্ধ করা তাঁর পক্ষে সম্ভব হয়নি। কারণ তিনি আপনার কবিসত্তাকে রাধার মধ্যে হারিয়ে ফেলেছেন। রাধার ক্রন্দনে চণ্ডীদাসের ব্যক্তি অনুভূতি ও প্রেমজিজ্ঞাসার আর্তি ঝংকার তুলেছে।

‘সই, কেবা শুনাইল শ্যাম-নাম।

কানের ভিতর দিয়া মরমে পশিল গো

আকুল করিল মোর প্রাণ। (পদ-৫৭)

কৃষ্ণ প্রেমাকুলতায় সর্ব দেহমন পরিপূর্ণ হয়ে উঠল। সামান্য নাম শুনেই রাধার তন্ময়তা প্রাপ্তি- তাহলে অঙ্গের স্পর্শ ঘটলে কি হবে। ভক্ত কবির লেখনীও আর অগ্রসর হয়নি-

‘নাম- পরতাপে যার ঐছন করল গো

অঙ্গের পরশে কিবা হয়।’ (পদ-৫৭)

এই তন্ময় প্রেমাকুলতায় রস-বিগলনে চণ্ডীদাস বিগলিত হয়েছে।

অন্যদিকে, গোবিন্দদাসের রাধা একেবারেই অলৌকিক, অথচ অপূর্ব সুন্দর। বিশ্ব সৌন্দর্যের অধিষ্ঠাত্রী যেন রাধিকা। তাঁর দেহরূপ বর্ণনায় গোবিন্দদাস যে শব্দানুপ্রাসের ধ্বনি সৌকর্যের পরিচয় তুলে ধরেছেন তা অপূর্ব,

‘যাঁহা যাঁহা নিকসয়ে তনু তনু জ্যোতি।

তাঁহা তাঁহা বিজুরি চমকময় হোতি ৷৷ (পদ-৫২)

রাধার দেহ জ্যোতি যেখানে পড়ছে সেখানেই যেন বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে, যেখানে সে ফেলেছে পদযুগল সেখানেই ফুটে উঠেছে স্থলকমল- চিত্রটির সৌন্দর্য করির কল্পনার বৈচিত্র্যে অনন্য। তবে গোবিন্দদাস ভক্ত কবি হলেও কৃষ্ণলীলার সাথে নিজেকে মিশিয়ে ফেলতে পারেননি। রাধার বেদনার মধ্যে নিজ বেদনা ঢেলে দিতে পারেননি। তাঁর ভক্তি- যত বেড়েছে সাধন স্তরে উন্নীত হয়েছে- ততই ঐ রূপমুগ্ধতা এবং কৃষ্ণেন্দ্রিয় প্রীতি ইচ্ছা প্রবল হয়ে তাঁর রূপ সাধনাকে সম্পূর্ণতার দিকে এগিয়ে দিয়েছে।

চণ্ডীদাস গীতিধর্ম কবিতার সার্থক রূপকার। গীতিপ্রাণতা তাঁর কবিচিত্তের বৈশিষ্ট্য। বস্তুরূপের অন্তরে সূক্ষ্ম ও গভীর ভাবানুভূতির ব্যঞ্জনা সৃষ্টিতে সার্থক। রাধার সাথে তিনি আত্মিক সম্বন্ধ অনুভব করেন। বস্তু অতীত ভাবলোকের দিকে তাঁর রূপরচনা আমাদের নিয়ে যায়। তাঁর রাধার অন্তরেই শ্যামের বাস। কল্পনায় কামনায় রঙে রসে তার নির্মাণ। তাইতো তার কোনো বস্তু সত্তা নেই। তাকে কেবল চাওয়া যায়, বিশ্বের ইঙ্গিতে ভঙ্গিতে তাকে অনুসন্ধান করা যায়, তাকে একটি মানবরূপে ধরা যায় না। সে সবচেয়ে বেশি আয়ত্তের অতীত। তাই গভীর আলিঙ্গনেও রাধার বিচ্ছেদ বেদনা ঘুচে না-

‘দুহু ক্রোড়ে দুহু কাঁদে বিচ্ছেদ ভাবিয়া

আধ তিল না দেখিলে যায় যে মরিয়া। (পদ-১৮৮)

নিখিলের রূপ থেকে অরূপের দিকে চিরন্তন সৌন্দর্য ও প্রেমকামনার ও বিরহের এই সুতীব্র সুগভীর আর্তি চণ্ডীদাসের কবিতার শ্রেষ্ঠ সম্পদ।

অন্যদিকে, গোবিন্দদাসের কবিতায় যে সংগীতোপকরণটি আছে আধুনিক অর্থে তাকে গীতধর্ম বলা যায় না। অস্পষ্টতার ইন্দ্রিয়াতীত রহস্য রাজ্যের দিকে আদৌ তাঁর প্রবণতা না এবং গীতিপ্রণেতা তাঁর কবিচিত্তের বৈশিষ্ট্য নয়। কাব্যরাজ্যের পাত্রপাত্রীর সাথে আপন চিত্তলোকের অন্বয় সম্বন্ধ তিনি অনুভব। করেন না। তাই কোনো অর্থেই তাঁকে খাঁটি গীতি কবি (আধুনিক রীতির) বলা চলে না। তাঁর কবিতার সংগীতরস স্থির চিত্রকে গতিময় করে তোলার উদ্দেশ্যেই ব্যবহৃত। সংগীত প্রবাহটি তাঁর চিত্রাত্মক শব্দগুচ্ছকে ভাসিয়ে নিয়ে যায় এবং ভাসমান তরঙ্গোদ্বেলতা পাঠক চিত্তে আঘাত করে রসনিষ্পত্তিতে সাহায্য করে। একটি উদাহরণ,

নন্দ নন্দন চন্দ-চন্দন

গন্ধ-নিন্দিত-অঙ্গ।

জলজ-সুন্দর কম্বু-কন্ধর

নিন্দি সিন্ধুর-ভঙ্গ।। (পদ-১৩)

চণ্ডীদাসের কবিতা একেবারে ভিন্ন রাজ্যের সামগ্রী। রচনারীতিতে কোথাও বিদগ্ধ বা বুদ্ধি বিচ্ছুরণ নেই, নেই প্রসাধনের বিচিত্রতা। তাঁর কবিতার ভাষা যেমন সহজ ও সরল, তেমনি হৃদয়স্পর্শী। অলংকারের প্রতি তাঁর আদৌ প্রবণতা নেই। প্রসাধনকথা তাঁর কবিতায় বড়ো নয়। ভাব এত গভীর বলেই যেন ভাষা ও প্রকাশভঙ্গি এত সরল নিরহংকার। দৃষ্টান্ত :

১. সে বঁধু কালিয়া না চাহে ফিরিয়া

এমতি করিল কে।

আমার অন্তর যেমতি করিছে

তেমতি হউক সে।। (পদ-১৯০)

চন্ডীদাসের ভাষার শব্দ সম্পদে বাংলার স্বকীয় স্নেহ অনুযোগ, সৌন্দর্যের ধারা, সুখ-দুঃখ নিঙড়ানো প্রেমের আর্তি লোক চেতনার বিভিন্ন প্রকাশ, পদাবলীর একটি নিজস্ব প্রকাশ রীতির পরিচয় বহন করে। কয়েকটি দৃষ্টান্ত,

  1. কালিয়া বধু,
  2. ঘরে গুরুজন ননদী দারুণ;
  3. কলঙ্কের ডালি মাথায় করিয়া;
  4. সিঁদুরের দাগ আছে সর্ব গায়;
  5. কুলবতী হইয়া,
  6. কে বলে পিরীতি ভাল।

এমনি অসংখ্য শব্দ বিশ্লেষণে চণ্ডীদাস রাধা-কৃষ্ণকে অঙ্কিত করেছেন। পদাবলীতে চণ্ডীদাসের এই শব্দ বিপুলতা ও বৈচিত্র্যের কারণে জনৈক সমালোচক তাকে ‘বাংলা কবি ভাষার জনক’ আখ্যা দিয়েছেন।

চণ্ডীদাস ছন্দের তরঙ্গভঙ্গের দিকে সচেতন ছিলেন না; তবু গভীর ভাবাবেশ যে কোমল ধ্বনিমাধুর্য প্রকাশ করেছেন তাও কম বিস্ময়কর নয়। একাবলী ছন্দের উদাহরণ :

বহু দিন পরে বঁধুয়া এলে।

দেখা না হইতে পরাণ গেলে।। (পদ-২৭৮)

অলঙ্কার সচেতন কবি না হলেও চণ্ডীদাসের পদে অনেকাংশে স্নিগ্ধ প্রচ্ছন্ন অলঙ্করণ সৌন্দর্য লক্ষিত হয়।

উৎপেক্ষা : দুহু ক্রোড়ে দুহু কাঁদে বিচ্ছেদ ভাবিয়া।

আধ তিল না দেখিলে যায় যে মরিয়া। (পদ-১৮৮)

ব্যতিরেক: এমন পিরীতি কভু দেখি নাই শুনি। (পদ-১৮৮)

এভাবে চণ্ডীদাসের ভাষা বাংলার খাঁটি নিজস্ব সম্পদ।

অন্যদিকে গোবিন্দদাস মূলত চিত্ররসের কবি। সংগীত যেমন তাঁর কবিতায় চিত্রের বাহন, তেমনি নাট্যরসও চিত্র সৌন্দর্যের সহায়ক হিসেবেই গুরুত্বপূর্ণ। ভাষা, অলঙ্কার, ছন্দ এবং ধ্বনিময় রূপ নির্মিতির ক্ষেত্রে গোবিন্দদাসের প্রতিভার শ্রেষ্ঠত্ব স্বীকার্য। অলঙ্করণ চমৎকারিত্বের ভিতর দিয়ে কবি রাধার বর্ষাভিসারের চিত্র ও প্রকৃতির যে ছবি এঁকেছেন তা তুলনা রহিত। দৃষ্টান্ত:

১. ‘মন্দির বাহির কঠিন কপাট।

চলইতে শঙ্কিল পঙ্কিল বাট।।

তহি অতি দূরতর বাদর দোল।

বারি কি বারই নীল নিচোল।।

সুন্দরি কৈছে করবি অভিসার। (পদ-১৪৮)

আবার অলঙ্কারের সাহায্য না নিয়ে গোবিন্দদাস যখন ছবি এঁকেছেন, তখনও কম সাফল্য আসেনি।

যেমন – ঢল ঢল কাঁচা অঙ্গের লাবণি

অবনী বহিয়া যায়।

ঈসত হাসির তরঙ্গ-হিলোলে

মদন মূরুছা পায়।। (পদ-২৫)

গোবিন্দদাস বাংলা ও ব্রজবুলি উভয় ভাষাতেই পদরচনা করেছেন। ব্রজবুলি গানে বিদ্যাপতির অনুসরণ করেছেন।

ছন্দ নিদর্শন- নন্দ | নন্দন | চন্দ | চন্দন |

গন্ধ | নিন্দিত | অঙ্গ” ( পদ-১৩)

পরিশেষে বলা যায় যে, কবি চণ্ডীদাস ও গোবিন্দদাসের পদের তুলনামূলক আলোচনা এবং কবিপ্রতিভার বৈশিষ্ট্য আলোচনা করে দেখা গেল চণ্ডীদাস ভাবাবেগাকুল কবি; গোবিলাচনা সৌন্দর্যের কবি। চণ্ডীদাস রাধার প্রেমানুভূতি ও গভীরতার সাথে একাত্ম হয়ে গেছেন। কিন্তু গোবিন্দদাস তা হননি। কোনো বিশিষ্ট প্রেমানুভূতির রূপরচনায় নয়, কতকগুলো চিত্রকে ধরে রাখাই গোবিন্দদাসের কবি-কৃতিত্ব। আর এখানেই পদকর্তা হিসেবে চণ্ডীদাস ও গোবিন্দদাস স্বতন্ত্র।