মাইকেল মধুসূদন দত্তর অনবদ্য সৃষ্টি বীরাঙ্গনা কাব্যের মধ্যে মেঘনাদবধ কাব্য, কৃষ্ণকুমারী নাটক প্রভৃতির মতো নিয়তি বা অদৃষ্টবাদ ও কর্মফলবাদের পরিচর্যা লক্ষিত হয়। এর দ্বারা তিনি চরিত্র, কাহিনী ও তাদের পরিণতিকে অনেকাংশে নিয়ন্ত্রিত করেছেন।

গ্রীক ও রোমান কাব্যে যে নিয়তিবাদ লক্ষিত হয় তা দেবতার ক্রোধ থেকে জাত। সেই জন্যেই নিয়তি রহস্যময় ও নির্মম, নিষ্ঠুর। গ্রীক নাটক ও সাহিত্যে সেই নিয়তিবাদের অমোঘ শক্তির বহু উদাহরণ বা নমুনা প্রদান করা হয়েছে। যেমন রাজা অদিপাউসের করুণ পরিণতির প্রসঙ্গে উত্থিত সম্মেলক সুর—

No man can called be happy 

Until he carries his happiness

Unto the grave.

নিয়তি চরিত্র প্রায়শঃই এখানে এক রহস্যময় শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয়ে অন্যান্য চরিত্রের সুখ দুঃখাদি অদৃষ্টের পরিণতিকে নিয়ন্ত্রিত করেছে। 

শেক্সপীয়রের রচনার মধ্যেও নিয়তিবাদ কাজ করেছে। তাঁর নাটকে চরিত্রদের উচ্চাশা, লোভ ইত্যাদি চরিতার্থ করতে অনেক সময় নিয়তিবাদের অবতারণা করা হয়েছে। ম্যাকবেথের উচ্চাশা, ওথেলোর সন্দেহ, হ্যামলেটের সংশয় ইত্যাদি চরিত্রগুলির দুঃখ দুদর্শার কারণ হয়েছে। তাদের পতন পরিণতি পর্যন্ত এর কারণেই হতে দেখা গেছে। মধুসুদনের মেঘনাদবধ কাব্যে, কৃষ্ণকুমারী নাটক প্রভৃতির মধ্যে একই সঙ্গে গ্রীক ও শেক্সপীয়রিয় নিয়তিবাদ অনুসৃত হয়েছে। ভারতীয় সাহিত্যে দুর্জেয় অদৃষ্টশক্তি দ্বারা নিয়ন্ত্রিত ভাগ্যবিপর্যয়কে কর্মফলবাদ আখ্যা দেওয়া হয়েছে। সেই কর্মফলবাদও মাইকেলের কাব্যে নাটকে উপেক্ষিত হয় নি।

বীরঙ্গনা কাব্যেও দেখা যায় গ্রীক নিয়তিবাদ, ভারতীয় অদৃষ্টবাদ ও কর্মফলবাদের অনুসরণ। চরিত্রের সহনশীলতা, দুঃখ, শোক, উন্নতি অনেকক্ষেত্রেই এর দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়েছে। বস্তুত যে যুগে মাইকেল মধুসূদন তার কাব্য রচনা করেছেন সে যুগে মানুষের ঈশ্বর অ-লৌকিকতা, অদৃষ্ট প্রভৃতির প্রতি যে দৃঢ় বিশ্বাস ছিল তারই কতকটা প্রতিফলনের ফলে কাব্যে নিয়তিবাদ, কর্মফলবাদাদি অনুসৃত হয়েছে এ কথাও বলা যেতে পারে। বীরাঙ্গনা কাব্যের নায়িকারা তাদের জীবনধারা, ব্যক্তিত্ব এবং চিন্তা-চেতনায় এই অদৃষ্ট বা নিয়তিবাদের প্রকাশ নানাভাবে পেয়েছে।

শকুন্তলা দুষ্মন্তকে যে পত্র লিখেছিলেন তার মধ্যে স্বামী বিরহ এবং বিস্মরণের জন্যে তিনি নিজের অদৃষ্টকে ছাড়া আর কাউকেই দায়ী করেন নি। তিনি নিজ জন্ম থেকে তার দুঃখী জীবনের কথা স্মরণ করে রাজাকে লিখেছেন—

“চির অভাগিনী আমি। জনকজননী

ত্যজিলা শৈশবে মোরে, না জানি, কি পাপে? 

পরাত্রে বাঁচিল প্রাণ–পরের পালনে। 

এ নব যৌবনে এবে ত্যজিলা কি তুমি,

প্রাণপতি? কোন্ দোষে, কহ, কাস্ত, শুনি, 

দাসী শকুন্তলা দোষী ও চরণ-যুগে?”

নিজেকে অভাগিনী কল্পনা এবং বিরহ দশার জন্যে অদৃষ্টের দোহাই দেওয়া প্রভৃতি চিন্তা নিয়ন্ত্রিত হয়েছে নিয়তিবাদ থেকে। শকুন্তলা অদৃষ্টের দোষ যেমন দেখেছেন তেমনি সৌভাগ্যের কীর্তনও করেছেন ক্ষেত্র বিশেষে। যেমন—

“ভাগ্যে বৃদ্ধা গৌতমী তাপসী

পিতৃস্বসা,—মনঃ তাঁর রত তপজপে;

তা না হলে, সর্বনাশ অবশ্য হইত

এতদিনে!”

চতুর্থ সর্গে, দশরথের প্রতি কেকয়ীর পত্রে, দশরথ ভরতকে বঞ্চিত করে রামকে যৌবরাজ্যে অভিষেক করলে, কেকয়ী দশরথকে অধর্মাচারী রাজা বলে যথেষ্ট তিরস্কার করেছেন। তবু তারও মধ্যে বিগত যৌবনা কেকয়ীর অভিমান ও প্রতিবাদের সঙ্গে অদৃষ্টবাদের দোহাই শোনা যায়। প্রতিজ্ঞা রক্ষায় ব্যর্থ দশরথকে তিনি কর্মফলবাদের দোহাই দিয়ে বলেছেন—

“যদি থাকে ধর্ম তুমি অবশ্য ভুঞ্জিবে

এ কর্মের প্রতিফল! দিয়া আশা মোরে,

নিরাশ করিলে আজি; দেখিব নয়নে

তব আশা-বৃক্ষে ফলে কি ফল, নৃমণি?”

এমনকি ভরতকে দশরথ রাজগৃহে অন্নগ্রহণ করতে নিষেধ করতে কেকয়ী দিব্যি পর্যন্ত দেবেন বলে জানিয়েছেন—অদৃষ্টবাদের যা মেয়েলি আধুনিক রূপ—

“দিব্য দিয়া মানা তারে করিব খাইতে

তব অন্ন, প্রবেশিতে তর পাপ পুরে।”

ষষ্ঠ সর্গে অর্জুনের প্রতি দ্রৌপদীর পত্রে দেখি পাঞ্চালী অদৃষ্টের দৈববাণী শুনেছেন—

“শুনিনু সুবানী

(স্বপ্নে যেন!) এই তোর পতি লো পাঞ্চালী।

ফুল-মালা দিয়ে গলে, বর নরবরে।”

এর পরের অংশে নিজের ভাগ্যদোষের কথা লিখেছেন দ্রৌপদী—

“চাহিনু বরিতে, নাথ, নিবারিলা তুমি

অভাগীর ভাগ্য-দোষে। তা হলে কি তবে 

এ বিষম তাপে, হায়, মরিত এ দাসী?”

বীরাঙ্গনা কাব্যের আধুনিকতার ছোঁয়া যে অদৃষ্টবাদের মধ্যেও লেগেছে তার নমুনা কিছু পূর্বে কেকয়ী পত্র মাধ্যমে প্রদান করা গেছে। মধুসূদনের মানবিকতাবাদেরই এ এক ভিন্ন রূপ প্রতিফলন। মানুষের প্রতি সহমর্মিতা তার চিন্তা চেতনায় রসনিষ্পত্তিকর কাব্য রচনায় প্রেরণা সঞ্চার করেছে। তার ফলে পুত্র হারা জনার শোক, বিলাপে বাস্তবতার ছোঁয়া লেগেছে—অদৃষ্টের দোহাই দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে—

“রে দারুণ বিধি

এ কি লীলাখেলা তোর, বুঝিব কেমনে? 

একমাত্র পুত্র দিয়া নিলি পুনঃ তারে

অকালে?”

কোথাও কোথাও আবার ধ্বনিত হয়েছে ভারতীয় জন্মান্তরবাদ, কর্মফলবাদ ও নিয়তিবাদের সম্মেলক সুর—

“কোন জন্মে, কোন পাপে পাপী

তোর কাছে অভাগিনী, তাই দিলি বাছা,

এ তাপ? আশার লতা তাই-রে ছিঁড়িলি?

হা পুত্র! শোধিলি কিরে তুই এইরূপে 

মাতৃধার? এই কিরে ছিল তোর মনে?”

এমন কি মন্দভাগ্যের জন্যে অবসাদগ্রস্থ কোন কোন নায়িকা তাদের প্রাণ ত্যাগ করার বাসনাও জানিয়েছেন তাদের প্রেমাস্পদকে। জনা তো স্পষ্ট ভাবেই বলেছেন, “ছাড়িব এ পোড়া প্রাণ জাহ্নবীর জলে।” তারা অসংকোচে চন্দ্রকে জানিয়েছেন, “জীবন মরণ মম আজি তব হাতে।” তার মধ্যে আশ্রমকন্যা শকুন্তলা লিখেছেন— “জীবনের আশা, হায়, কে তাজে সহজে।”

এইভাবে পুঙ্খানুপুঙ্খ বিচার করে দেখলে দেখা যায় গ্রীক ও ভারতীয় পুরাণের মতো বীরাঙ্গনার নায়িকারাও কমবেশি নিয়তিবাদ, অদৃষ্টবাদ, কর্মফলবাদ ও জন্মান্তরবাদের শিকার হয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে এগুলিই কাব্যের চরিত্র ও কাহিনীকে নিয়ন্ত্রিত করেছে।