ইংরেজি ‘lyrical poetry’ শব্দ থেকে বাংলায় গীতি-কবিতাটির সৃষ্টি হয়েছে। অর্থাৎ lyric শব্দের মূলে আছে লায়ার নামক বীণাজাতীয় বাদ্যযন্ত্র, এই যন্ত্র সহযোগে যে গান গাওয়া হত তাকে lyric বা গীতি-কবিতা বলে। এরই নিরিখে সমগ্র বিভিন্ন ইউরোপের আখ্যানকাব্য ও ইলিয়াড ওডিসিকে এই অবিধায় ভূষিত করা হত কারণ এগুলি বাদ্যযন্ত্র সহযোগে গান করা হত। অনুরূপ বাংলা সাহিত্যের মধ্যযুগে লেখা আখ্যান কাব্য, খণ্ড কাব্য প্রায় প্রতিটি ধারাকেই গীতি-কবিতা রূপে চিহ্নিত করা হয়। যেমন বৈষ্ণবপদাবলী, শাক্তপদাবলী, অনুবাদমূলক কাব্য, মঙ্গলকাব্য সমস্তই তো সুর করে পাঠ করা হয়। তবে আশ্চর্যের বিষয়, গীতিকবিতা বলতে মূলত যা বোঝানো হয় তার সঙ্গে সংগীতের কোনো সম্পর্ক নেই। এ সম্পর্কে সাহিত্য সম্রাট বঙ্কিমচন্দ্রই স্পষ্ট বলেছেন: “গীতের পারিপাট্য জন্য আবশ্যক দুইটি—স্বরচাতুর্য ও শব্দচাতুর্য। দুইটি ক্ষমতাই সচরাচর একজনের ঘটে না। যিনি সু কবি, তিনিই সু গায়ক। ইহা অতি বিরল।” এ থেকে প্রমাণিত হয়—একজন গীত রচনা করেন আরেকজন গান করেন। যদিও গীত হওয়াই গীতিকাব্যের আদিম উদ্দেশ্য, তবুও ছন্দোবিশিষ্ট আনন্দদায়ক পদ অনেক সময় চিত্তাকর্ষক হওয়ায় গীতিকাব্য রূপে পরিগণিত হতে থাকল।
অবশ্য গীতিকবিতার আলোচনায় বঙ্কিমচন্দ্রের সর্বশেষ মন্তব্যটি অত্যন্ত মূল্যবানঃ “গীতের যে উদ্দেশ্য যে কাব্যের সেই উদ্দেশ্য তাহাই গীতিকাব্য। বক্তার ভাবোচ্ছ্বাসের পরিস্ফুটতামাত্র যাহার উদ্দেশ্য, সেই কাব্যই গীতিকাব্য।” অর্থাৎ বক্তার ভাবোচ্ছ্বাসের পরিস্ফুটন গীতিকাব্যের প্রধান বৈশিষ্ট্য, সেদিক থেকে দেখতে গেলে মন্ময় কবিতা মাত্রই গীতি-কবিতা। এক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথ কবিতার যে দুটি স্থূল বিভাগ দেখিয়েছেন : “কোনো কাব্য বা একলা কবির কথা, কোনো কাব্য বা বৃহৎ সম্প্রদায়ের কথা। মূলত গীতি-কবিতা একলা কবির কথা, কবির নিজের কথা বলে বলেই অনুভূতির তীব্রতা এই কবিতার প্রাণ। তবে কবির ব্যক্তিগত অনুভূতি যে-কোনো বিষয় আশ্রয় করেই গড়ে উঠতে পারে। সুতরাং গীতি-কবিতার বিষয়ের ব্যাপ্তি অত্যন্ত বেশি। তবে মনে রাখা দরকার ব্যক্তিগত উচ্ছ্বাস কেবলই ব্যক্তিগত স্বার্থে সীমিত থাকলে তা কবিতার মর্যাদা লাভ করতে পারে না তার আবেদন সর্বজনীন হতে হবে, সেই কারণেই কোনো ধর্মীয় বিষয় এখানে প্রাধান্য লাভ করতে পারে না।
গীতি-কবিতার লক্ষণ ও বৈশিষ্ট্য :
(১) গীতি-কবিতা কবির একান্ত ব্যক্তিগত কথা, তাঁর এই নিজস্ব উপলব্ধির সঙ্গে সাধারণভাবে ধর্ম বা তত্ত্ব দর্শনের বিশেষ কোনো সম্পর্ক থাকবে না, এটাই স্বাভাবিক।
(২) কবির ব্যক্তিগত অনুভূতির তীব্রতার জন্যই এতে এমন এক নিবিড় আত্মময়তা থাকে যা অনুভূতিশীল চিত্তকে প্রবলভাবে স্পর্শ করে। কবি ও পাঠকের এই রসসংযোগেই গীতি-কবিতার সৌন্দর্য ফুটে ওঠে।
(৩) কবির অনুভূতি ও উপলব্ধি ব্যক্তিগত হওয়া সত্ত্বেও গীতি-কবিতার এক শাশ্বত ও সর্বজনীন আবেদন থাকে—সম্ভবত এই কারণে যে, আন্তরিক অনুভূতির মধ্যে এমন এক নিত্যতা এবং আবেদন আছে যে অনুভূতিশীল সকল মানুষকেই তা আন্দোলিত করতে পারে।
(৪) আবেগ সংযত ও সংহত হয়ে যখন গাঢ়ত্ব লাভ করে, সেই অবস্থাতেই গীতি-কবিতা লেখা হয়। সুতরাং এর প্রকাশ হয় সাবলীল, ব্যঞ্জনাময় ও সংহত—নিটোল মুক্তা সম্ভব এক একটি শুক্তির মতো। আকারে সংক্ষিপ্ত অথচ অনুভূতিতে প্রগাঢ়—এটাই গীতি-কবিতার প্রকৃত বৈশিষ্ট্য।
উদাহরণ : বৈষ্ণব পদাবলী হল—প্রাচীন গীতি-কবিতার প্রাণ। এই পদের মূল উপজীব্য বিষয় রাধা ও কৃষ্ণের প্রেম। যখন রাধা কৃষ্ণের দর্শন বা স্পর্শসুখে আনন্দিতা তখন দেখা হয়েছে রূপোল্লাস, পূর্বরাগ, অভিসার, প্রকৃত পর্যায়ের পদ। আবার যখন কৃষ্ণের বিরহে রাধা কাতর কৃপিত তখন লেখা হয়েছে মায়, মাথুর, আক্ষেপানুরাগ পর্যায়ের পদ। কিন্তু রাধা কৃষ্মকে অবলম্বন করে এ পদ রচিত হলেও, যে আর্তি এবং আন্তরিকতা ফুটে উঠেছে, তাতে মনে হয় কবি নিজের জীবন দিয়ে এই আনন্দ ও বেদনা অনুভব না করলে কেবল ধর্মীয় সংবেদন সৃষ্টির জন্য এমন পদ রচনা করতে পারতেন না। প্রসঙ্গক্রমে মাথুর পর্যায়ে বিদ্যাপতির এই পদখানি বিশ্লেষণ করলে বক্তব্যের সারবত্তা খুঁজে পাওয়া যাবে—
এ সখি হামারি দুখের নাহি ওর।
এ ভরা বাদর মাহ ভাদর
শূন্য মন্দির মোর।…….
এখানে বর্ষার যেন বিরহের একটা নিবিড় সম্বন্ধ স্থাপিত হয়েছে। রাধা আক্ষেপ করে বলছে, তার দুঃখের সীমা নেই, কারণ ভাদ্র মাসের এই ভরা বাদলেও কিনা তার গৃহ শূন্য। এ ধারণা ও বক্তব্য শাশ্বত ও চিরন্তন। কারণ সে যুগের কবি যেমন বলেছিলেন–বর্ষা এলেই প্রবাসী কান্তের জন্য মন উচাটন করে ওঠে। এ যুগের শ্রেষ্ঠ কবিও বলেই—“এমন দিনে তারে বলা যায়/এমন ঘনঘোর পরিধায়।” সেই বলবার মানুষটি ঘরে না থাকলে রবীন্দ্রনাথের নায়িকারও মনে হয়—
ঝরো ঝরো ঝরো ভাদর বাদর বিরহ কাতর শর্বরী,
ফিরিছে এ কোন অসীম রোদন কানন কানন মমরী॥
যাইহোক গীতি-কবিতার লক্ষণগুলি বিদ্যাপতির পদের মধ্যে কীরূপ বর্তমান তা এমনভাবে নির্দেশ করা যেতে পারে।
(১) মূলত বিদ্যাপতির এ পদটি ব্যক্তিগত আবেগে মহিত। আসলে এ আবেগ রাধার হলেও কবির মনের কথা সেখানে গোপন থাকেনি। বিদ্যাপতি ব্যক্তিগতভাবে রাধার অনুভূতি কখনো কখনো প্রকাশ করেছেন, তা সত্ত্বেও পদটির মধ্য দিয়ে রাধার যে কাতরোক্তি প্রকাশ পেয়েছে তা গীতিকবিতার ব্যক্তিগত লক্ষণের বহিঃপ্রকাশ মাত্র।
(২) আত্মতন্ময়তা গীতিকবিতার যে দ্বিতীয় বৈশিষ্ট্য—তা এই পদের মধ্যে রাধার অহং প্রকাশের মধ্য দিয়ে ব্যক্ত হয়েছে। একার্থে এখানে রাধা ও কবি একাত্মতা অর্জন করেছেন সেই কারণে এ কবিতায় পরোক্ষে যে আত্মময়তা ফুটে উঠেছে তা গীতি-কবিতার ক্ষেত্রেই সুপ্রযুক্ত।
(৩) শাশ্বত ও সার্বজনীনতা—‘এ সখী হামারি’ কবিতার আবেদনের মধ্যেই প্রমাণিত এমন একটি অনুভূতি যুক্ত কবিতা শাশ্বত চিরন্তন না হয়ে পারে না। আজকের পাঠক হয় বৈশ্ববমন, অথবা ধন তার কাছে সাহিত্যরস আস্বাদনের কোনো শর্তই নয়, অথচ এই পদের আস্বাদন তিনি সহজেই করতে পারেন। অর্থাৎ কালের বিচারে প্রমাণিত হয়ে গিয়েছে এ পদের আবেদন কালোত্তীর্ণ এবং ধন নিরপেক্ষ।
(৪) সংহত প্রকাশভঙ্গির জন্যই বিদ্যাপতি খ্যাতিমান ছিলেন। তাছাড়া বৈষ্ণুব পদাবলী অতি স্বল্প পরিসরে বক্তব্য বিশদ করা সম্ভব ছিল না। অনুভূতির যে রসঘন প্রকাশ এখানে ঘটেছে তা আদর্শ স্বরূপ।
পরিশেষে, বলতে হয় কেবলমাত্র প্রাচীন বৈষ্ণুবপদ বা শক্তিপদ গীতিকবিতা পদমর্যাদায় বিভূষিত নয়। সময়ের বিশাল দূরত্ব অতিক্রম করে সাম্প্রতিককালে স্বীকৃত কবির কলম থেকে গীতিকবিতার ফল্গু স্রোত নিত্য বহমান যার অবয়ব নির্মিত—গীতিকবিতার প্রচার চারটি শর্ত সহযোগে ব্যক্তিগত লক্ষণ, আত্মময়তা, শাশ্বত ও সর্বজনীন আবেদন এবং ব্যঞ্জনাময় সংহতি। সময়, কাল, যুগ, পরিবেশ, প্রতিবেশ অতিক্রম করে গীতিকবিতা যে এমনভাবে নব সৃষ্টির উন্মাদনায় এগিয়ে চলেছে এখানেই তার বিশেষত্ব।
Leave a comment