সঙ্গীতধর্মিতাই হল গীতিকবিতার প্রধান বৈশিষ্ট্য। গান থেকেই গীতিকবিতার উদ্ভব। ইংরেজি lyric শব্দটি এসেছে গ্রীক বাদ্যযন্ত্র lyre থেকে। lyric বা গীতিকবিতার সঙ্গে বাদ্যযন্ত্র সহযোগে গানের যোগসূত্র শব্দটির এই মূলরূপে লক্ষণীয়। চীনা ভাষায় গীতিকবিতা Shin যার অর্থ শব্দ-সংগীত, বাঙলা গীতিকবিতা নামটির মধ্যেও গীতিকবিতার সেই প্রাথমিক সাংগীতিক কাঠামো বা ভিত্তির ইংগিত সুস্পষ্ট। অবশ্য গীতিকবিতা মাত্রই গান করার জন্য রচিত হয় না। গীতিকবিতার ধ্বনিবিন্যাসে অন্ত্যমিল ও ছন্দের নিয়মিত গতিপ্রবাহে সংগীতের গুণ বা ধর্মকে প্রকাশ করা হয়। গীতিকবিতা বলতে সাধারণত এমন স্বল্পায়তন কবিতাকে বোঝায় যা সংগীতকে বিন্যাসের অনুকরণে কবির নিজস্ব চিন্তা অনুভূতি কল্পনাকে স্তবক বিভাগে ও ছন্দের সুরময়তায় প্রত্যক্ষভাবে প্রকাশ করে। বস্তুত গীতিকবিতা সম্পূর্ণরূপেই কবি-হৃদয়ের প্রতিচ্ছবি।
ওয়ার্ডসওয়ার্থ গীতিকবিতা সম্পর্কে বলেছেন, এই রচনা প্রবল আবেগের প্লাবন। হেগেলের মতে, গীতিকবিতা তীব্রভাবেই মন্ময় ও ব্যক্তিগত প্রকাশ। এই সংজ্ঞা ঊনবিংশ বা বিংশ শতাব্দীর গীতিকবিতা সম্পর্কে প্রযোজ্য সন্দেহ নেই। কিন্তু প্রাচীনকালের ও মধ্যযুগের গীতিকবিতা আধুনিক গীতিকবিতার মত মন্ময় কবির আত্মগত ভাবনা-আবেগ-অনুভূতি প্রধান রচনা নয়, তাদের আবেগ-অনুভূতি অনেকটা পরিমাণেই গোষ্ঠীগত বা সমাজগত-যেমন, বাঙলার মধ্যযুগীয় বৈয়ব গীতিকবিতা। সেইজন্য প্রাচীন ও মধ্যযুগীয় গীতিকবিতা এবং আধুনিক গীতিকবিতা এই শ্রেণীবিভাগ করতে হয়। সাম্প্রতিক কালের সমালোচকদের আলোচনায় সঙ্গীতধর্মিতাই গীতিকবিতার অন্ত-সার, তার সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্যরূপে নির্দেশিত হয়েছে। বিখ্যাত আমেরিকান সমালোচক ব্ল্যাকমিউর বলেছেন, এই কবিতার রচনায় শব্দগুলি সাঙ্গীতিক ধ্বনির বিন্যাসের মধ্য দিয়ে কবিতার অর্থ তৈরি করে। ইংরেজ সমালোচক অ্যাবারকম্বির মতে, একজন কবি ভাষাকে আনন্দদায়ক ও উত্তেজক সঙ্গীতে পরিণত করার জন্য রচনা করেন না, তিনি তাঁর বক্তব্য যাতে আমাদের মনে বিচিত্রভাবে প্রভাব বিস্তার করে, তার জন্যই ভাষায় একটি আনন্দদায়ক ও উত্তেজক সঙ্গীত রচনা করেন। ইংরেজ ঔপন্যাসিক জেমস জয়েসের মতে, গীতিকবিতা এমন এক রূপ যাতে শিল্পী নিজের সঙ্গে প্রত্যক্ষ সম্পর্কে তাঁর প্রতিমূর্তি উপস্থাপিত করেন।
সনেট গীতিকবিতার একটি বিশিষ্ট রূপ। চোদ্দ অক্ষর, কখনও বা আঠারো অক্ষর সংবলিত চোদ্দটি পংক্তিতে যখন বিশেষ ছন্দরীতিতে একটি অখন্ড ভাবকল্পনা বা অনুভূতি রূপায়িত হয়, তখনই আমরা সনেটের উদাহরণ পাই। ইটালিয়ান কবি পেত্রার্কা সনেটের প্রবর্তক। সনেটের রূপবন্ধ অত্যন্ত গাঢ় ও সংবৃত। তার আটপংক্তি যুক্ত ভাবের সূত্রপাত ও প্রবাহ সংবলিত প্রথম অংশকে বলা হয় অষ্টক (Octave), পরবর্তী অংশের নাম ষটক (Sestet), এই ছয়পংক্তিবিশিষ্ট অংশটি কবিতার উপসংহার। কোনও কোনও কবি অবশ্য এই দুটি বিভাগকে না মেনে সনেটকে একটি অখন্ড রূপদান করেন। অষ্টকের আর্ট পংক্তি দুটি ভাগে বিভক্ত, চার পংক্তি সংবলিত প্রতিটি ভাগের নাম চতুষ্ক (Quantrain) ঘটকের তিন পংক্তি সংবলিত দুটি ভাগের প্রত্যেক ভাগের নাম ত্রিপদিকা (Tercet)।
অন্ত্যমিলের বিশেষ বিশেষ বিন্যাস অনুযায়ী সনেটের সর্বজনস্বীকৃত প্রধান তিনটি রূপ হল, ইটালিয়ান বা পেত্রার্কান সনেট, স্পেন্সারিয়ান ও শেক্সপীয়রিয়ান। ইংরেজি ভাষায় ওয়াট, সারে, স্পেন্সার, সিডনি, শেক্সপীয়র, ডান, মিল্টন, ওয়ার্ডসওয়ার্থ, কীট্স, রসেটি, ব্রাউনিং, ইয়েট্স, অডেন, ডিলান টমাস প্রভৃতি সনেটের বিশিষ্ট রূপশিল্পী। ১৮৬৬ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত মধুসূদনের ‘চতুর্দশপদী কবিতাবলী’ বাঙলা কাব্যভাষায় প্রথম সনেটের আঙ্গিক গঠনে চমকপ্রদ কৃতিত্বের নিদর্শন। গীতিকবিতার তরল স্বচ্ছন্দ প্রবাহিত ভাবোচ্ছ্বাসকে যে চতুর্দশ পংক্তির গাঢ়বন্ধ রূপে সংহতভাবে প্রকাশ করা যায়, মধুসূদনের সনেট রচনার পূর্বে বাঙলা কাব্যসাহিত্যে তার কোনও উদাহরণ দেখা যায় না। রবীন্দ্রনাথের সনেট বা চতুর্দশপদী কবিতার গাঢ়বন্ধ ভাব পরিমিতি সৃষ্টির নৈপুণ্যের পরিচয় মেলে তাঁর ‘কড়ি ও কোমল’-এর কয়েকটি সনেটে। সনেট রচনায় দেবেন্দ্রনাথ সেনের সহজাত নৈপুণ্য ছিল, তাঁর সনেটের ভাষায় মধুসূদনের এবং নির্মাণে রবীন্দ্রনাথের প্রভাব সত্ত্বেও মৌলিকতা সুস্পষ্ট। মোহিতলাল মজুমদারও সনেট রচনায় তাঁর দক্ষতার পরিচয় রেখে গেছেন। শব্দচয়নের শ্রমনিষ্ঠ নৈপুণ্যে, ভাষা ও ভঙ্গির কঠিন দীপ্তিতে, রচনার সংহতিতে ও পদ্যবন্ধে গদ্যের ভারবহতা সৃষ্টিতে প্রমথ চৌধুরীর সনেটের সংকলন ‘সনেট পঞ্চাশৎ’ ও ‘পদচারণ’ বাঙলা ভাষায় সনেট রচনার বিশিষ্ট ও উল্লেখযোগ্য প্রয়াস।
ভক্তিমূলক বা ভক্তিরসাশ্রিত গীতিকবিতার উপজীব্য ধর্ম বা ভক্তিভাব। ধর্মবোধাশ্রিত আধ্যাত্মিক চেতনা, ঈশ্বরভুক্তি কবিহৃদয়ে যে আবেগ উদ্দীপিত করে তোলে, তা উৎকৃষ্ট গীতিকবিতার রস ও রূপে পরিণত হতে পারে। বিদ্যাপতির প্রার্থনা পদ, গোবিন্দদাস কবিরাজ ও অন্যান্য চৈতন্য বন্দনাপদ, রামপ্রসাদ, কমলাকান্ত প্রভৃতি কবিদের শাক্তপদাবলী, অক্ষয়কুমার বড়ালের ‘কোথা তুমি’, রবীন্দ্রনাথের ‘গীতাঞ্জলি’র অন্তর্ভুক্ত কবিতাগুচ্ছ ভক্তিমূলক গীতিকবিতার উদাহরণ। যে গীতিকবিতায় কবির স্বদেশপ্রেম প্রকাশিত হয়, তাকে স্বদেশপ্রেমমূলক গীতিকবিতা বলা হয়ে থাকে। এই জাতীয় কবিতায় দেশের প্রাচীন ঐতিহ্যের প্রতি অনুরাগ, দেশাত্মবোধের পরিপোষক অতীতকালের বীরদের কীর্তিকলাপের শ্রদ্ধা ও মমতাপূর্ণ স্মৃতিচারণ, কিংবা দেশের দুর্গতি বা পরাধীন অবস্থা সম্পর্কে ক্ষোভবেদনা প্রভৃতি প্রকাশ করে কবিরা স্বদেশবাসীদের হৃদয়কে স্বাজাত্যবোধে অনুপ্রাণিত করে তুলতে চেষ্টা করেন। মূলের Glories of Brien the Brave ও From Life Without Freedom অনুসরণে রচিত রঙ্গলাল বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘পদ্মিনী উপাখ্যানে’র ‘ক্ষত্রিয়দিগের প্রতি রাজার উৎসাহবাক্য’ অংশে আমরা প্রথম দেশাত্মবোধের উদ্দীপনার গীতিকবিতাসুলভ প্রকাশ পাই। হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘ভারত সঙ্গীত’-এর মত দেশপ্রেমের এমন উচ্চাশাপূর্ণ ও আবেগের উত্তেজনাময় প্রকাশ খুব কম কবিতায়ই পাওয়া যায়। স্বদেশবাসীদের দাস মনোভাবের প্রতি কবির ধিক্কারের পেছনে পরাধীনতার জন্য তাঁর হৃদয়ের ক্ষোভ জ্বালা আমাদের অনুভব না করে উপায় থাকে না। ‘ভারতসঙ্গীত’ বাঙলার জাতীয় আন্দোলনকে অনুপ্রাণিত করেছিল। অক্ষয়কুমার বড়ালের ‘বঙ্গভূমি’, দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের ‘ভারতবর্ষ, বঙ্কিমচন্দ্রের ‘আনন্দমঠ’-এর অন্তর্ভুক্ত ‘বন্দেমাতরম’ সঙ্গীত, রবীন্দ্রনাথের ‘ভারততীর্থ’ ইত্যাদি রচনাও স্বদেশপ্রেমমূলক গীতিকবিতার উদাহরণ।
ইংরেজিতে যা ওড (Ode) নামে পরিচিত, তা-ই বাঙলার স্তোত্র কবিতারূপে অভিহিত হয়ে থাকে। Ode শব্দটি এসেছে গ্রীক aci dein থেকে, যার অর্থ গান করা, মন্ত্রোচ্চারণ। আধুনিককালে স্তোত্র কবিতা বলতে বোঝায় অত্যন্ত আনুষ্ঠানিক, কোনও উপলক্ষ্যে রচিত, অপেক্ষাকৃত দীর্ঘ কবিতার এক সুসঙ্গত রূপ। কোনও শাসকের জন্মদিন, অভিষেক, কোনও স্মারকবস্তু বা জনসেবামূলক কাজের প্রতিষ্ঠা বা উৎসর্গ ইত্যাদি উপলক্ষ্যে সাধারণের উদ্দেশ্যে ভাষণের মাধ্যম হিসেবে কবিতার এই রূপটি ব্যবহৃত হয়। আধুনিক স্তোত্র কবিতায় গ্রীক হেরোশিয়ান ওডের চিন্তাশীলতা বা দার্শনিকতার বৈশিষ্ট্যের সঙ্গে পিণ্ডারিক ওডের উপলক্ষ্য ও প্রাধান্যের মিশ্রণ লক্ষ্য করা যায়। বাঙলা ভাষায় স্তোত্র কবিতার উদাহরণ অক্ষয়কুমার বড়ালের নারীস্মৃতিমূলক কয়েকটি কবিতা ও ‘মানববন্দনা’, সুরেন্দ্রনাথ মজুমদারের ‘মাতৃস্তুতি সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের ‘নমস্কার’, রবীন্দ্রনাথের ‘বর্ষশেষ’, মোহিতলাল মজুমদারের নারীস্তোত্র প্রভৃতি। গৃহাগতপ্রাণ বাঙালির জীবনে ও মানসে স্বাভাবিকভাবেই নারীর প্রভাব ও গুরুত্ব সর্বাধিক, সেইজন্যই বাঙালী কবিদের স্তোত্র-কবিতার প্রধান বিষয় নারীবন্দনা, দেবেন্দ্রনাথ সেনের কবিতা, সুরেন্দ্রনাথ মজুমদারের ‘মহিলা কাব্য’, অক্ষয়কুমার বড়ালের কবিতা, মোহিতলাল মজুমদারের ‘নারীস্তোত্র’ কবিতাটি তারই উদাহরণ।
শোকগীতির ধ্যানধারণা আমরা পেয়েছি Elegy থেকে, শব্দটির উৎস গ্রীক elegeia যার অর্থ শোক করা। কোনও ব্যক্তির মৃত্যু অথবা জীবনের করুণ ট্র্যাজিক দিক সম্পর্কে কবির চিন্তাকে কেন্দ্র করে শোকগীতি রচিত হয় এবং কবি তাঁর শোকাবেগ প্রকাশ করতে গিয়ে কোনও শাশ্বত নীতির অনুধ্যানে সান্ত্বনা খুঁজে পান। গ্রীক সাহিত্যে অবশ্য শোক, যুদ্ধ, প্রেম, রাজনৈতিক বিদ্রূপ ইত্যাদি যে কোনও বিষয় নিয়ে রচিত বিশেষ রীতিবদ্ধ কবিতাকে Elegy বলা হত। পরবর্তীকালে Elegy শোকগীতিতে পরিণত হয়। ব্যক্তির মৃত্যুজনিত শোক ছাড়াও কোনও শহরের পতন, জাতীয় বিপর্যয়, অতীতে খ্যাতনামা ব্যক্তিদের স্মৃতিচারণ প্রভৃতি বিষয় নিয়েও শোকগীতি রচিত হয়েছে। শোকানুভূতির আন্তরিকতা এই জাতীয় কবিতার উৎকর্ষের মানদন্ড, এই শ্রেণীর কোনও কোনও রচনায় কবির ব্যক্তিগত বেদনা সর্বমানবের বেদনার রূপ নেয়। সেই রচনা সর্বজনীনতার মর্যাদা লাভ করে। বাঙলা ভাষায় শোকগীতি কবিতার উদাহরণ বিহারীলালের বন্ধুবিয়োগ, অক্ষয়কুমার বড়ালের স্ত্রী-বিয়োগ উপলক্ষ্যে রচিত এবং রবীন্দ্রনাথের স্ত্রীর মৃত্যুর পর রচিত স্মরণ, নজরুল ইসলামের দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জনের মৃত্যু উপলক্ষ্যে রচিত ‘চিত্তনামা’, রবীন্দ্রনাথের কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের অকাল বিয়োগে রচিত ও ‘পূরবী’ কাব্য গ্রন্থে সংকলিত ‘সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত’ শীর্ষক কবিতা। কোনও কোনও কবি তাঁর বন্ধু বা আত্মীয়ের বিয়োগ-উপলক্ষে রাখালের উক্তির মাধ্যমে নিজের শোকানুভূতিকে প্রকাশ করেন এবং তার জন্য উপযুক্ত রাখালিয়া পরিবেশও গড়ে তোলেন, এই জাতীয় শোকগীতিকে রাখালিয়া শোকগীতি (Pastoral Elegy) বলা হয়। বাঙলার কালিদাস রায়ের ‘কৃষাণীর ব্যথা’, যতীন্দ্রনাথ সেনগুপ্তের ‘চাষার ঘরে’ এই জাতীয় শোকগীতির উদাহরণ।
Leave a comment