ভূমিকা: পরাধীন ভারতবর্ষের সাম্রাজ্যবাদবিরােধী আন্দোলনের শুকতারা’, ভারতীয় জাতীয় মানসে জাতির জনক আখ্যায় ভূষিত ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের অগ্রদূত নির্ভীক কণ্ঠ, সত্যনিষ্ঠ, অদম্য মনােবলসম্পন্ন, ত্যাগ স্বীকারে নিরলস, সত্য, ন্যায় এবং অহিংসার মূর্ত প্রতীক মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী (১৮৬৯-১৯৪৮ খ্রি.) প্লেটো, অ্যারিস্টটল বা হেগেলের মতে রাষ্ট্র দার্শনিক ছিলেন না। গান্ধিজি কোনাে রাজনৈতিক দর্শন বা মতবাদ প্রতিষ্ঠা করতে চাননি।

গান্ধীবাদ: গান্ধিজি নিজেই লিখেছেন, গান্ধীবাদ বলে কিছু নেই। কোনাে মৌলিক দর্শন বা নীতির স্রষ্টা হিসেবে আমি কিছু দাবি করি না। আমি কেবল আমার নিজের মতাে করে দৈনন্দিন জীবন ও সমস্যাবলির ক্ষেত্রে শাশ্বত সত্যকে প্রয়ােগ করার চেষ্টা করেছি মাত্র। ‘The Story of My Experiments with Truth’ শীর্ষক রচনায় তিনি নিজেই লিখেছেন, আমার সমস্ত চিন্তা, দর্শন যা আমি বলেছি, তাকে আর যাই হােক গান্ধীবাদ বলে অভিহিত না করাই ভালাে। হরিজন পত্রিকায় তিনি লিখেছেন, ‘I am not built for academic writings. Action is domain’। যাইহােক পরবর্তীকালে তার অনুগামীগণ তার চিন্তাভাবনাকে সংকলিত করে ‘গান্ধিবাদ নামে রাজনৈতিক দর্শন প্রচার করেন। গান্ধিজি আদর্শ রাষ্ট্র তথা সমাজ প্রতিষ্ঠার যে ধ্যানধারণা প্রচার করেন, তাকে অনেকে গান্ধীবাদ বলে অভিহিত করতে চেয়েছেন। বাস্তবে গান্ধিবাদ হল একটি দৃষ্টিভঙ্গি বা একটি জীবনধারা (a way of Life)

(১) অহিংসা, ন্যায় এবং সত্য: বৈয়ব পরিবারে জন্মগ্রহণ করে আধ্যাত্মিকতার ভাবধারায় ভারতীয় কৃষ্টি, সংস্কৃতি মন্থন করে তিনি যে অমৃতপথের সন্ধান পেয়েছিলেন, তা হল সত্য ও অহিংসার পথ। তাই তিনি রাজনৈতিক ধ্যান ধারণা কেন্দ্রবিন্দুতে অহিংসা, ন্যায় এবং সত্যকে প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছেন। হিংসা ও বলপ্রয়ােগের নীতিতে গান্ধীজীর কোনােরূপ আস্থা ছিল না। তার অহিংসা নীতি হল ক্লোধবশত বা স্বার্থপর উদ্দেশ্যে কাউকে কষ্ট না দেওয়া বা হত্যা না করা। এককথায় তাঁর কাছে অহিংসা ছিল ইতিবাচক ভালােবাসা (Positive Love)‘হিন্দ স্বরাজ’ গ্রন্থে তিনি এই বিষয়ে বিস্তারিত আলােচনা করেছেন। গান্ধিজি বলেছেন, অহিংসা হল আত্মার অঙ্গ এবং ধর্ম, তাই প্রত্যেকের জীবনের প্রতিক্ষেত্রেই অহিংসা পালন করা প্রয়ােজন (Ahimsa is the attribute of the soul and therefore, to be practised by everybody in all the affairs of life”)। দীর্ঘস্থায়ী স্বাধীনতার যুগে গান্ধিজি অহিংসা নীতিকে প্রয়ােগ করেছেন। তাঁর কাছে অহিংসা কোনাে দুর্বলতা নয়, এক নৈতিক শক্তি। বলাবাহুল্য, এই নীতিটি হল এক সদর্থক ধারণা। অহিংসা ছিল তাঁর জীবনের ধর্ম।

(২) সত্যাগ্রহ: সত্যাগ্রহের সাধারণ অর্থ হল সত্যের প্রতি আগ্রহ। ব্যাপক অর্থে সত্যাগ্রহ হল সৎ উদ্দেশ্যে ন্যায়ের পথে ব্যক্তিগত কষ্ট সহ্য করে অধিকার অর্জন। সহজ কথায় বলা যায়, সত্য, ন্যায় ও অহিংসার উপর ভিত্তি করে সকল প্রকার কষ্ট ও ত্যাগ স্বীকার করে সর্বশক্তি দিয়ে অন্যায়কে প্রতিরােধ করা। কিন্তু এই প্রতিরােধ সংগ্রামে ঘৃণা, ক্রোধ, হিংসার কোনাে স্থান নেই। তাঁর মতে, হৃদয়ের শক্তি ও অন্তরের শক্তিরূপ সত্যাগ্রহে কাপুরুষতার কোনাে স্থান নেই। সত্যাগ্রহের মধ্যে কোনাে নিষ্ক্রিয় প্রতিরােধ নেই, শুধুমাত্র আছে প্রেম ও ভালোবাসা যে প্রতিপক্ষের হৃদয়কে জয় করতে সমর্থ। সত্যাগ্রহের বিভিন্ন পদ্ধতিগুলি হল আমরণ অনশন, অসহযোগ আন্দোলন, আইন অমান্য আন্দোলন, সরকারি অনুষ্ঠান বয়কট, পিকেটিং প্রভৃতি।

(৩) সর্বোদয়: গান্ধিজি সর্বোদয় মূলসূত্র পেয়েছিলেন জন রাস্কিনের ‘Unto This Last’ গ্রন্থে। সর্ব এবং উদয় এই শব্দদুটি নিয়ে তৈরি হয় সর্বোদয়। সর্বোদয় এর মধ্য দিয়ে গান্ধীজীর জীবনের আদর্শ ও সমাজ দর্শন প্রতিফলিত হয়েছে। সর্বোদয় এর ব্যুৎপত্তিগত অর্থ হল সবার কল্যাণ। সর্বোদয়ের প্রকৃতি ব্যাখ্যা করতে গিয়ে তিনি মূলত তিনটি নীতির কথা বলেন সেগুলি হলㅡ

  • সকলের ভালােতে নিজের ভালাে বা কল্যাণ নিহিত,
  • উকিল ও নাপিতের কাজের মূল্য সমান,
  • শ্রমিকের জীবন আদর্শ জীবন।

আসলে গান্ধিজি এক সর্বোদয় সমাজ গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন। গান্ধিজি প্রবর্তিত সর্বোদয়ের মূল বা মুখ্য উদ্দেশ্য হল সমাজে এমন এক নৈতিক পরিবেশ গড়ে তুলতে হবে যেখানে কোনা ধনিক শ্রেণির হাতে পুঁজি কেন্দ্রীভূত হবে না, যেখানে ব্যক্তি, গােষ্ঠী কিংবা শ্রেণি নির্বিশেষে সকলের কল্যাণই সাধিত হবে। গান্ধিজি ভারতের দারিদ্র মোচনে উপযুক্ত পথ হিসেবে যন্ত্রভিত্তিক শিল্পের পরিবর্তে কৃষি ও কৃষিভিত্তিক শিল্প এমনকি কুটিরশিল্পের উপর বিশেষভাবে গুরুত্ব দিয়েছেন। এককথায় সর্বোদয়ের মূল কথা হল আত্মত্যাগ (Self-sacrifice)।

(৪) গ্রাম পুনর্গঠনের উপর জোর: গান্ধী কৃষি প্রধান ভারতের উন্নয়নের স্বার্থে গ্রামকে নতুনভাবে গঠন করার উপর জোর দিয়েছিলেন। বলা যায় যে, গ্রামীণ উন্নয়ন তথা গ্রামীণ ভারতের উন্নয়নের জন্য গান্ধিজি গ্রামীণ জমিদারি প্রথার সংস্কার, গ্রাম-স্বরাজ, স্বাবলম্বন, গ্রামীণ শিল্পের বিকাশ, সমবায় প্রথার প্রচলন প্রভৃতি বিষয় গুলোর উপর বিশেষভাবে গুরুত্ব আরােপ করেছিলেন। গান্ধীজীর আদর্শ গ্রামগুলি হবে স্বয়ংসম্পূর্ণ। গ্রামীণ প্রশাসন নিয়ন্ত্রণ করবে পঞ্চায়েত, যা হবে একাধারে আইনসভা, বিচার ও শাসন পরিষদ।

(৫) রাষ্ট্রচিন্তা: গান্ধীজীর রাষ্ট্রচিন্তার উপর টলস্টয় এবং ডেভিড থােরাে প্রমুখের চিন্তা দর্শনের প্রভাব ছিল অপরিসীম। The Kingdom of God is within you এবং Essay on civil Disobedience গ্রন্থ দ্বারা প্রভাবিত হয়ে তিনি রাষ্ট্রের প্রকৃতি সম্পর্কে তার মতামত ব্যক্ত করেছেন। The Story of My Experiments with truth নামক আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থ, বিভিন্ন প্রবন্ধ, পুস্তক-পুস্তিকায় রাষ্ট্রের উৎপত্তি ও প্রকৃতি সম্পর্কে আলােচনা করেছেন। গান্ধীজীর মতে, রাষ্ট্র হল কেন্দ্রীভূত শক্তি বা হিংসার বহিঃপ্রকাশ (“The State represents violence in a concentrated and organised form”) রাষ্ট্রকে তিনি ভয়ের চোখে দেখতেন, তিনি মনে করতেন রাষ্ট্র মানুষের সার্বিক বিকাশের পরিপন্থী। তার মতে, সেই সরকারই ভালাে যে সরকার সবচেয়ে কম শাসন করে (…that government is best, which govern the least) গান্ধিজি রাষ্ট্রকে নিজেই নিজের লক্ষ্য (an end in itself) বলে মনে করতেন।

গান্ধিজি সরাসরি বলতে বাধ্য হয়েছেন সেবা ও আত্মত্যাগের আদর্শ, নৈতিক মূল্যবোধ, মানুষের মানবিক সচেতনতা এসব রাষ্ট্রীয় যন্ত্র ধ্বংস হয়ে যায়। তাই তিনি রাষ্ট্রের বিরােধিতা করেছেন। গান্ধিজি রাষ্ট্রকে সর্বদাই সন্দেহের চোখে দেখতেন। রাষ্ট্রের কার্যাবলিকে খুবই সীমিত রাখার পক্ষপাতী ছিলেন তিনি।

(৬) রামরাজ্য: গান্ধিজি শ্রেণিহীন, শােষণহীন সাম্যভিত্তিক অহিংস সমাজ প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন। এই সমাজ ব্যবস্থায় কোনাে রাষ্ট্র থাকবে না এবং রাজনৈতিক ক্ষমতা হবে বিকেন্দ্রীভূত এবং স্বনিয়ন্ত্রিত গান্ধী কল্পিত এই অহিংস গণতান্ত্রিক সমাজই হল রামরাজ্য।

(৭) রাষ্ট্রহীন গণতন্ত্র: সমাজ জীবনের বৃহত্তর কল্যাণের পটভূমিতে গান্ধিজি গণতন্ত্রের প্রকৃতিকে বিচারবিশ্লেষণ করেছেন। তিনি মনে-প্রাণে বিশ্বাস করতেন যে, অহিংস পথেই নির্ভেজাল গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব। তিনি পশ্চিমি ধাঁচের গণতন্ত্রকে অপছন্দ করতেন। রাষ্ট্রবিজ্ঞানী কার্লাইলের মতে গান্ধীজি পার্লামেন্টকে (Talking Shop of the world) পরিহাস বলে মনে করেছেন। তাঁর মতে, পার্লামেন্ট হল একটি ধারা (Hoax)। গান্ধিজি ব্যক্তি স্বাধীনতাকে প্রকৃত গণতন্ত্রের ভিত্তি বলে মনে করতেন। তাঁর মতে, আদর্শ সমাজ ব্যবস্থার ভিত্তি হল অহিংস নীতির উপর প্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্রহীন গণতন্ত্র। গান্ধিজি গণতন্ত্রের সংখ্যা থেকে তার গুণকে বেশি গুরুত্ব দেওয়ার পক্ষপাতী ছিলেন। গান্ধিজি রাষ্ট্রহীন গণতন্ত্র গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন। পঞ্চায়েতিরাজ ব্যবস্থা থেকে গান্ধিজি ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শ ও পারস্পরিক সহনশীলতাকে গণতন্ত্রের ভিত্তি মনে করতেন।

(৮) রাষ্ট্রের পরিবর্তে ব্যক্তিসত্তার উপর গুরুত্ব: গান্ধিজি একদিকে যেমন মানবিক ব্যক্তিসত্তার উপর যথেষ্ট গুরুত্ব আরােপ করেছেন তেমনই অপরদিকে রাষ্ট্র সংক্রান্ত চরম ও চূড়ান্ত শক্তির ধারণাকে পক্ষপাতিত্ব করেননি। গান্ধিজি ব্যক্তিকেই কর্তৃত্ব ও মূল্যবােধের কেন্দ্রবিন্দুতে স্থান দিয়েছিলেন, তাই তিনি জনগণের সার্বভৌমিকতা বিশ্বাসী ছিলেন। তিনি মনে-প্রাণে এই মতের বিশ্বাসী ছিলেন যে, জনগণই মূল, রাষ্ট্র ফল মাত্র। মূলটি যদি মধুর হয়, ফলটিও সুমিষ্ট হবে।

(৯) স্বরাজ: গান্ধিজি রাষ্ট্রহীন গণতন্ত্র ছাড়াও মানুষকে সকলের শোষণের হাত থেকে মুক্ত করতে চেয়েছিলেন বলা যেতে পারে, তাঁর কাছে এটাই ছিল স্বরাজ। অর্থাৎ তিনি পূর্ণস্বরাজ বা স্বাধীনতার মধ্য দিয়ে জাতপাত ও ধর্ম নির্বিশেষে জনসাধারণের নিজ অধিকার সমভাবে প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন। গান্ধিজি স্বরাজের মধ্য দিয়ে এক আদর্শ সমাজ গঠন করেছিলেন, যার মূল ভিত্তি ছিল পরিপূর্ণ সামাজিক সাম্য, স্বাধীনতা ও ন্যায়বিচার।

(১০) অছি সম্পর্কিত তত্ত্ব: গান্ধিজির রাষ্ট্রচিন্তার অন্যতম একটি বৈশিষ্ট্য হল তার অছি সংক্রান্ত ধারণা বা তত্ত্ব। ঈশােপনিষদের অপরিগ্রহ এবং সমভাবের আদর্শ দ্বারা তিনি প্রভাবিত হয়ে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে মানুষের ন্যূনতম প্রয়ােজন পূরণের জন্য যতটুকু প্রয়ােজন ততটুকুর উপরেই তার অধিকার রয়েছে, তার বেশি আশা করা বা সংগ্রহ করা চুরি করার সমান এবং তা হল শাস্তিযােগ্য অপরাধ। অর্থাৎ গান্ধিজি অছি সংক্রান্ত ধারণা বা তত্ত্বের মাধ্যমে মানুষের নৈতিক পরিবর্তনের (Moral Change) উপর গুরুত্ব দিয়েছেন। গান্ধিজি অছি সম্পর্কিত তত্ত্বের মধ্যে ধর্ম সম্পদকে ব্যক্তিগত ও রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন রাখার বিরােধিতা করেছেন। অনুবাদ বলতে বােঝায় একটি অছি (trustee) ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে রাষ্ট্রের সমস্ত ধনসম্পদ ও মালিকানা ব্যক্তিগত বা রাষ্ট্রীয় মালিকানার পরিবর্তে সামাজিক মালিকানায় আনা। অর্থাৎ, রাষ্ট্রের সমস্ত ধনসম্পদ একটি অছির অধীনে থাকবে। এই অছির মাধ্যমে সভ্য সমাজের সকলেই তা ভােগদখল করবে।

(১১) জাতীয়তাবাদ ও আন্তর্জাতিকতার আদর্শ: গান্ধীজীর রাজনৈতিক চিন্তা দর্শনের বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ দিক হল তিনি জাতীয়তাবাদ এবং আন্তর্জাতিকতাবাদের মাধ্যমে বিশ্ব-রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন। তিনি উগ্র বা বিকৃত জাতীয়তাবাদকে সমর্থন করেননি। গান্ধিজি মনে-প্রাণে বিশ্বাস করতেন যে, সর্বপ্রথম কোনাে একজন মানুষকে ভালাে জাতীয়তাবাদী হতে হবে তারপর সে একজন প্রকৃত আন্তর্জাতিকতাবাদী বা বিশ্বপ্রেমিক আখ্যা পাওয়ার যােগ্যতা অর্জন করবে। গান্ধীজীর চিন্তাধারায় জাতীয়তাবাদের সঙ্গে আন্তর্জাতিকতাবাদের কোনো বিরােধ ছিল না। তাই তিনি মানবসভ্যতার বিকাশের ক্ষেত্রে সুস্থ জাতীয়তাবাদের কথা বলেছেন তথা আন্তর্জাতিকতাবাদের তত্ত্ব প্রচার করেছেন।

(১২) ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ ও স্বাবলম্বন: গান্ধীর রাজনৈতিক চিন্তা দর্শনের আরও দুটি মূলনীতি হল ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ ও স্বাবলম্বন। গান্ধীর রামরাজ্য বিকেন্দ্রীকরণ নীতির উপর প্রতিষ্ঠিত। প্রত্যেকে তার জীবন ও জীবিকার স্বার্থে পরিশ্রম করবে এবং সামর্থ্য অনুসারে সমাজের সেবা করবে। গান্ধিজি যে রাষ্ট্রহীন গণতন্ত্রের ধারণা দিয়েছেন তা সম্পূর্ণ পঞ্চায়েত দ্বারা শাসিত অর্থাৎ পঞ্চায়েতের মাধ্যমে স্বশাসিত এই গ্রামীণ সমাজ হবে স্বনির্ভর বা স্বয়ংসম্পূর্ণ।

(১৩) আদর্শ সমাজ: সত্য ও অহিংসার উপর প্রতিষ্ঠিত গণতন্ত্র হল গান্ধিজির রামরাজ্য। যেখানে সকল প্রকার শোষণের অবসান ঘটবে, ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ হবে এবং প্রত্যেকে পরিচালিত হবে নৈতিক সংযমের স্ব-আরােপিত আইন দ্বারা। এই সমাজই হল আদর্শ সমাজ।

(১৪) ঈশ্বর বিশ্বাসী হয়েও বাস্তববাদী: গান্ধিজি প্রবল ঈশ্বরবিশ্বাসী হয়েও কিন্তু নিয়তিবাদে বিশ্বাসী ছিলেন না, তিনি ছিলেন কর্মযােগী। সর্বশক্তিমান ঈশ্বরের প্রাধান্যের উপর গুরুত্ব আরােপের পাশাপাশি তিনি কর্মযােগের সাধনার কথা বলেছেন। তা বলা হয়, গান্ধিজি ঈশ্বরবিশ্বাসী হলেও প্রকৃতপক্ষে তিনি ছিলেন বাস্তববাদী এবং কর্মযােগী।

সমালােচনা: গান্ধীজীর রাজনৈতিক চিন্তা দর্শন বিভিন্ন দিক থেকে সমালােচিত হয়েছে। অনেকের মতে, তাঁর রাজনীতি সংক্রান্ত চিন্তার দর্শন মূলতㅡ

  • স্ববিরােধী প্রকৃতির,
  • অর্থনৈতিক চিন্তাধারা রক্ষণশীল ভাবধারায় পরিচালিত হয়েছে,
  • রামরাজ্যের প্রতিষ্ঠার ঘটনাটি অলীক কল্পনা ছাড়া কিছুই নয়,
  • গান্ধিজি রাষ্ট্রের শ্রেণিচরিত্রকে উপেক্ষা করে ধর্ম এবং নৈতিকতার প্রতি অধিকতর গুরুত্ব আরােপ করেছেন।

উপসংহার: বহু বিরুদ্ধে সমালােচনা থাকলেও পরিশেষে এ কথা অবশ্যই উল্লেখের দাবি রাখে যে, প্রথম জাতীয় নেতা হিসেবে গান্ধীজিই অসংখ্য দারিদ্র্যপীড়িত ভারতবাসীকে দেশপ্রেমে অনুপ্রাণিত করে জাতীয় মুক্তিসংগ্রামে শামিল করতে সমর্থ হয়েছিলেন। এ কথা অনস্বীকার্য যে, বর্তমান ভারতবর্ষের সমাজনীতি, রাজনীতি এবং অর্থনীতির ক্ষেত্রেও গান্ধিজির রাষ্ট্র সংক্রান্ত বিভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি অনুসরণ করা হয়। এখানেই গান্ধি দর্শনের তাৎপর্য ও গুরুত্ব বিরাজমান। তাই তার প্রতিভায় মুগ্ধ হয়ে আইনস্টাইনের মতাে বিশ্ব বিখ্যাত বিজ্ঞানী ও বলে গেছেন যে, হাজার বছর পরে মানুষ অবাক হয়ে ভাববে যে এমন একটা লােক পৃথিবীর ধূলিতে একদিন বিচরণ করেছিলেন।

মার্কসের রাষ্ট্র সম্পর্কিত তত্ত্ব । রাষ্ট্র সম্পর্কিত মার্কসের তত্ত্বের আলোচনা 

রাষ্ট্রের প্রকৃতি সম্পর্কে উদারনৈতিক ও মার্কসীয় দৃষ্টিভঙ্গির পার্থক্য | রাষ্ট্রের প্রকৃতি সম্পর্কে উদারনৈতিক ও মার্কসীয় দৃষ্টিভঙ্গির তুলনা

বিপ্লব সম্পর্কিত মার্কসীয় তত্ত্বটি আলােচনা করাে।