কবিতার নামকরণের মধ্যে কবিতার ভাব পরিস্ফুট হয়। নামকরণের সার্থকতা নির্ভর করে কবিতার ভাববস্তুর রূপায়ণের ওপর। ‘গানের আড়াল’ কবিতা প্রেমের কবিতা, বলা চলে রোমান্টিক প্রেমের কবিতা। তাই কবিতার মধ্যে প্রেমের রোমান্টিক ভাব এখানে রূপ লাভ করেছে বলেই নামকরণ যথাযথ।
কবি তাঁর প্রেয়সীকে গান শুনিয়েছেন। কবি অনুভব করেছেন যে তাঁর বন্ধু গানের বাণী কণ্ঠে গ্রহণ করেছে। কিন্তু তাঁর পরিচয়কে জানতে চায়নি। কবির অন্তরতলে যে ব্যথার পরিচয় লুকিয়ে আছে, সেই পরিচয়কে কবিবন্ধু বুঝতে পারেনি। গানের মধ্যে থাকে বাণী ও সুর । এই বাণী হয়তো অর্থময়, কিন্তু সুর ব্যখ্যাতীত। তাই গানের বাণী যদিও তার কানে পৌঁছেছে, তাঁর সুর কিন্তু হৃদয়ে স্পর্শ করেনি। সুরের আবেদন গভীরতর স্তরের। গানের বাণীর মধ্যে যে আকুলতা থাকে, আর্তি ফুটে ওঠে, তা কেবলমাত্র বিলাশ নয়। তার ব্যাকুলতাও মিথ্যা নয়। কিন্তু গানের বাণী যদি দুলের শোভা পায়, হৃদয়ে প্রবেশ করতে না পারে তাহলে প্রেমের বন্ধন গভীর হয় না। তাই কবি এই কবিতায় গানের আড়ালকে প্রধান ভাব হিসেবে বর্ণনা করেছেন। গানের মধ্যে গানের বাণী তার বহিরঙ্গ রূপ গানের আড়ালে যে শিল্পীমনের যন্ত্রণা ও আকুলতা বর্তমান সেই শিল্পীমনকে তাঁর বন্ধু বুঝতে পারেনি। তাই গানকে বুঝে লাভ নেই। গানের আড়ালে যে মন সেই মনকে যে বোঝেনি তাকে কবি পরিপূর্ণভাবে গ্রহণ করতে চান না। তাই কবি অভিমান করে বলেন যে তাঁর গান যেন তাঁর বন্ধু ভুলে যায়। গান নশ্বর সৃষ্টি। প্রভাতে যে ফুল ঝরে যাবে সেই ফুলকে সন্ধ্যায় তুলে রাখার কী প্রয়োজন ? কবির এই প্রশ্ন আসলে বেদনাহত কবিমনের প্রশ্ন। যে বন্ধু গানের গভীরতর অর্থ খুঁজে পায়নি, যে বন্ধু গানের আড়ালের তাৎপর্যকে বুঝতে পারেনি, সেই বন্ধু কবির কাছে হতাশার আকর। গানের আড়ালের ভাব-তাৎপর্যকে বোঝার মধ্যেই প্রেমের শ্রেষ্ঠ তাৎপর্য। এই তাৎপর্যকে না প্রণিধান করতে পারলে জীবন হয়ে যায় অর্থহীন। তাই কবি শুধু প্রার্থনা করেন যে তিনি তার হৃদয়ের কাছাকাছি থাকতে চান। তাঁর গান যেন প্রেয়সীর কণ্ঠহার হয়ে থাকে এই তাঁর প্রার্থনা।
এই ভাবটিকে কবি সার্থকভাবে মাত্রাবৃত্ত ছন্দের লয়ে গতিতে প্রকাশ করে তুলেছেন। কবির এই ভাবকে প্রকাশ করার জন্য ‘গানের আড়াল’ নামকরণ যথাযথ। কারণ ‘গানের আড়াল’ এই নামকরণের মধ্যে কবির মূল বক্তব্য ফুটে উঠেছে কবির অভিমান, কবির প্রেমতৃত্থা। এই কবিতায় গান কবির সৃষ্টি। কিন্তু গানকে ছাড়িয়ে যে মানুষ, সেই মানুষই প্রেমের আরাধ্য। তাই প্রেমের ক্ষেত্রে মানুষকে যদি অনুভব করা না যায় তাহলে প্রেম হয় ব্যর্থ। কবির অন্তরের প্রেমতৃষ্ণা তাঁকে প্রেয়সীর হৃদয়ের কাছাকাছি থাকতে প্রেরণা দেয়। তবু ভাবটিকে প্রকাশ করার জন্য কবি যে নামকরণ করেছেন, সেই নামকরণটি সার্থক। কারণ তা ভাবকে পূর্ণভাবে পরিস্ফুট করেছে।
Leave a comment