গণতন্ত্র সম্পর্কিত ধারণার উৎস হল প্রাচীন গ্রীক রাষ্ট্রনৈতিক চিন্তা। সেই প্রাচীনকাল থেকে আজ পর্যন্ত বহু বিদগ্ধ পন্ডিত ব্যক্তির চিন্তা-ভাবনায় গণতন্ত্র সম্বন্ধে ধারণা বিকশিত হয়েছে। রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের মধ্যে গণতন্ত্রের যেমন অন্ধ সমর্থক আছেন, তেমন ঘোরতর বিরুদ্ধবাদীরও অভাব নেই। গ্রীক পন্ডিত অ্যারিস্টটল থেকে শুরু করে বেন্থাম (Jeremy Bentham), টক্ভিল (A.D. Tocqueville), বার্কার (Ernest Barker), ব্রাইস (J. Bryce), ল্যাস্কি (H. J. Laski) প্রমুখ চিন্তাবিদ গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার পক্ষে বলিষ্ঠ যুক্তির অবতারণা করেছেন। আধুনিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা গণতন্ত্রের প্রশস্তিতে পঞ্চমুখ। আবার কার্লাইল, লেকী, হেনরী মেইন, নীট্সে, ট্রিটস্কে, ব্লুণ্টস্লি প্রমুখ রাষ্ট্রনীতিবিদ্ গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার বিরূপ সমালোচনা করেছেন কঠোরভাবে। মার্কসীয় চিন্তাবিদ্গণ উদারনৈতিক গণতন্ত্রের বিরোধিতা করলেও সমাজতান্ত্রিক গণতন্ত্রকে সমর্থন করেছেন। গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা সম্পর্কে সম্যক ধারণা লাভ করতে হলে এর পক্ষে ও বিপক্ষে প্রদর্শিত যুক্তিগুলি যথাযথভাবে অনুধাবন করা দরকার।
গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার গুণাবলী
(১) স্বাভাবিক অধিকারের তত্ত্বই গণতন্ত্রের ভিত্তি: স্বাভাবিক অধিকারের তত্ত্ব (Theory of Natural Right) অনুসারে বলা হয় যে, প্রত্যেকেই তার নিজের ভাগ্য নির্ধারণের অধিকার নিয়ে জন্মগ্রহণ করেছেন। এই স্বাভাবিক অধিকারের স্বীকৃতির ভিত্তিতেই গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার সৃষ্টি। গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় প্রত্যেক ব্যক্তি তার শুভাশুভ নির্ধারণের সুযোগ পায়। প্রত্যেক ব্যক্তির ইচ্ছা রাষ্ট্র কর্তৃক বিবেচিত হওয়ার ব্যাপারে নিশ্চয়তা থাকে।
লাওয়েল বলেছেন: “In a complete democracy no one can complain that he has not a chance to be heard.” গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় সকলে সমান ও স্বাধীনভাবে সামাজিক ও রাজনৈতিক অধিকার ভোগের সুযোগ পায়। এ ধরনের শাসনব্যবস্থার মূল ভিত্তি হল ‘সাম্য, মৈত্রী ও স্বাধীনতা। সমানাধিকারের নীতিটি এখানে তত্ত্বগতভাবে স্বীকৃত এবং বাস্তবে প্রতিষ্ঠিত হয়। এই ব্যবস্থায় ব্যক্তিমাত্রেই নিজ যোগ্যতা অনুসারে আত্মবিকাশের পথ বেছে নিতে পারে। এখানে জন্মগত বা ধনগত বৈষম্যকে স্বীকার করা হয় না। বলপ্রয়োগের কোনো সুযোগ এখানে নেই। বস্তুত গণতন্ত্র সমুন্নত নৈতিক আদর্শের উপর প্রতিষ্ঠিত।
(২) হিতবাদী তত্ত্বের সমর্থন: বেন্থাম, জেমস্ মিল প্রমুখ হিতবাদী (Utilitarians) রাষ্ট্রবিজ্ঞানি ও গণতন্ত্রের দৃঢ় সমর্থক। হিতবাদী তত্ত্বে বলা হয় যে, সর্বাধিক ব্যক্তির সর্বাধিক মঙ্গল সাধনই (greatest good of the greatest number) রাষ্ট্রের লক্ষ্য। গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায়ও এই মৌলিক উদ্দেশ্যের সন্ধান পাওয়া যায়। গণতন্ত্রে শাসনকার্য পরিচালনার চূড়ান্ত ক্ষমতা জনগণের হাতেই ন্যস্ত থাকে। অর্থাৎ রাষ্ট্রনৈতিক কর্তৃত্ব জনগণের করায়ত্ত থাকে। ফলে সরকারের যাবতীয় সুযোগ-সুবিধা সকলেই ভোগ করার সুযোগ পায়।
বেন্থামের মতানুসারে সুশাসনের প্রধান সমস্যা হল শাসক ও শাসিতের স্বার্থের মধ্যে সামঞ্জস্য বিধান ও সর্বাধিক জনগণের সর্বাধিক কল্যাণ সাধন। শাসিতকে শাসকের পদে প্রতিষ্ঠিত করতে পারলে এই সমস্যার সমাধান ও সুশাসন সম্ভব হয়। কেবল গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থাতেই শাসিতকে শাসকের পদে উন্নীত করা যায়। এজন্যই হিতবাদী জেমস্ মিল-এর মতে গণতন্ত্র হল ‘বর্তমান যুগের সর্বোৎকৃষ্ট’ (grand discovery of modern times) I
(৩) আদর্শবাদের সমর্থন: আদর্শবাদী তত্ত্বে গণতন্ত্রের স্বীকৃতি ও সমর্থন পাওয়া যায়। আদর্শবাদে বলা হয়, গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় এমন এক পরিবেশের সৃষ্টি হয় যেখানে ব্যক্তি আত্মবিকাশের সর্বাধিক সুযোগ পেতে পারে। গণতান্ত্রিক সরকার জনগণের নিজস্ব সরকার। জনগণ নিজেরাই সরকার গঠন করে নিজস্ব মতামত প্রকাশ করে এবং স্বাধীনতা সৃষ্টি ও সংরক্ষণের ব্যবস্থা করে। এইভাবে মানুষ আত্মোপলব্ধির পথে অগ্রসর হয়; ফলে সুন্দর ও সমৃদ্ধ জীবন যাপন করা যায়।
(৪) ন্যায় ও সত্যের প্রতিষ্ঠা: গণতন্ত্র হল ন্যায়নীতি-ভিত্তিক শাসনব্যবস্থার প্রকৃষ্ট দৃষ্টান্ত। গণতন্ত্রে দেশের সকল ব্যক্তি রাষ্ট্রনৈতিক ক্ষেত্রে অংশগ্রহণ করে। আলাপ-আলোচনার ভাব-বিনিময়ের মাধ্যমে সর্বজনগ্রাহ্য সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। বার্কার-এর মতানুসারে ‘গণতন্ত্র হল আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে পরিচালিত শাসনব্যবস্থা’ (Democracy….is a system of government by discussion.”)। এইভাবে সকলের সঙ্গে মতামতের আদান-প্রদানের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় বলে সত্য ও ন্যায়ের প্রতিষ্ঠা সম্ভব হয়; সাম্য ও স্বাধীনতা সংরক্ষিত হয়। এজন্য রাষ্ট্রবিজ্ঞানী মেয়ো (Henry B. Mayo)-র অভিমত হল: ‘গণতন্ত্র হল ন্যায় প্রতিষ্ঠার উপযোগী সর্বোৎকৃষ্ট ব্যবস্থা’ [(democracy) is the system best able to produce justice.]।
(৫) সর্বসাধারণের কল্যাণ: ল্যাস্কি (H. Laski)-র মতে জনকল্যাণ সাধন যদি সরকারের লক্ষ্য হয়, তবে রাষ্ট্রনৈতিক কর্তৃত্ব জনগণের হাতেই থাকা আবশ্যক। কারণ নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা যে শ্রেণীর হাতে থাকে, সেই শ্রেণীর স্বার্থেই সরকার পরিচালিত হয়। গণতন্ত্রেই কেবল রাষ্ট্রনৈতিক কর্তৃত্ব জনগণের হাতে ন্যস্ত থাকে। তাই গণতারে সর্বসাধারণের সর্বাঙ্গীণ মঙ্গলবিধানের জন্য সরকারী ক্ষমতা ব্যবহৃত। রাষ্ট্রনৈতিক ক্ষেত্রে কোনো রকম পক্ষপাতিত্ব বা বৈষম্যমূলক আচরণের আশঙ্কা থাকে না। এই হল রাষ্ট্রনৈতিক ন্যায়। এই কারণে গণতন্ত্র সকলের সমর্থন ও আনুগত্যের উপর প্রতিষ্ঠিত।
(৬) স্বায়ত্তশাসনের সুবিধা: জন স্টুয়ার্ট মিলের মতানুসারে সুশাসনই সরকারের একমাত্র উদ্দেশ্য নয়। স্বায়ত্তশাসনের মাধ্যমে জনগণের মানসিক উন্নতি সাধন করা দরকার। এ প্রসঙ্গে একটি বিখ্যাত উক্তি হল: “The best of all governments is which teaches us to govern ourselves.” একজন স্বৈরাচারী রাজা ব্যক্তিগত প্রশাসনিক দক্ষতার ভিত্তিতে সুষ্ঠু শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত করতে পারেন। কিন্তু এতে জনগণের অংশগ্রহণের কোনো সুযোগ থাকে না। ফলে সাধারণ মানুষের বুদ্ধিবৃত্তি ও দায়িত্ববোধ জাগ্রত হয় না এবং আত্মপ্রত্যয় ও দেশপ্রেম সৃষ্টি হয় না। কিন্তু গণতন্ত্রে স্বায়ত্তশাসনের অবাধ সুযোগ রয়েছে। জনগণ শাসনকার্যে অংশগ্রহণের সুযোগ পায়। এর ফলে সাধারণ মানুষ প্রশাসনিক অভিজ্ঞতা অর্জন করে, তাদের বুদ্ধিবৃত্তির বিকাশ ঘটে, প্রত্যেক ব্যক্তি প্রকৃত মর্যাদার অধিকারী হয়। লাওয়েল বলেছেন: “The best government in the long run is one that nurtures a people strong in moral fibre, integrity, industry, self reliance and courage.”
কোকার বলেছেন: “Participation in the control of public affairs removes the individual from narrow egotism and enlarges the range of his interest and imagination.” এককথায় জনগণের মানসিক উন্নতি সাধিত হয়। বস্তুত গণতন্ত্র ব্যক্তিজীবনে এক নতুন মূল্যবোধের সঞ্চার করে। তার ফলে ব্যক্তিজীবনে মর্যাদা ও সম্ভ্রমের সৃষ্টি হয়। এইভাবে ব্যক্তিগত জীবনে পূর্ণতা আসে এবং জাতীয় চরিত্র উন্নততর হয়। জন স্টুয়ার্ট মিল মন্তব্য করেছেন: “It promotes a better and higher form of national character than any other polity whatever.” বার্নস (C. D. Burns) মন্তব্য করেছেন: “All government is a method of education but best education is self-education which is democracy.”
(৭) রাজনৈতিক শিক্ষার বিস্তার: স্বতন্ত্র একটি যুক্তির পরিপ্রেক্ষিতে বলা হয় যে, গণতন্ত্রে জনগণের রাজনৈতিক চেতনা ও শিক্ষার বিস্তার ঘটে। গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় প্রত্যেকে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে অংশ গ্রহণের সুযোগ পায়। তার ফলে শাসনব্যবস্থা সম্পর্কে সাধারণ মানুষের মধ্যে আগ্রহ ও উৎসাহ দেখা যায়। এতে রাজনৈতিক শিক্ষার ব্যাপক সুযোগ ঘটে। তা ছাড়া সুষ্ঠুভাবে নির্বাচন সম্পন্ন করার জন্য গণতন্ত্রে রাজনৈতিক দলের অস্তিত্বকে অপরিহার্য মনে করা হয়। এই রাজনৈতিক দলগুলি দেশের বিভিন্ন সমস্যা এবং তার সমাধান সম্পর্কে জনগণের সন্মুখে নিজ নিজ নীতি ও পরিকল্পনা পেশ ও বিশ্লেষণ করে। তাছাড়া বিরোধী দলগুলি সরকারী দলের কার্যাবলী সম্পর্কে জনগণকে অবহিত রাখে। এর ফলে দেশের সাধারণ মানুষও সকল বিষয়ে ওয়াকিবহাল থাকে। এইভাবে জনগণ রাষ্ট্রনৈতিক শিক্ষায় শিক্ষিত হয়। এর – সুদূরপ্রসারী ফল হিসাবে জনকল্যাণধর্মী দায়িত্বশীল শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়।
(৮) সংঘর্ষ ও বিপ্লবের আশঙ্কা থেকে মুক্ত: গণতন্ত্রের সপক্ষে আরও একটি দাবি হল: এটি সংঘর্ষ বা বিপ্লবের আশঙ্কা থেকে মুক্ত। এটি শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের নীতিতে বিশ্বাসী এবং আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে সম্প্রীতি ও সৌভ্রাতৃত্ব সৃষ্টির আদর্শে অনুপ্রাণিত। গণতন্ত্রে ক্ষমতার উৎস হল ব্যালট এবং শাসনের ভিত্তি হল শাসিতের সম্মতি। সকল সরকারী সিদ্ধান্ত ও কার্যকলাপের পিছনে জনগণের নৈতিক অনুমোদন থাকে। তাই জনমনে ক্ষোভ সঞ্চারিত হতে পারে না। জনমতের চাপে সরকারী কার্যক্রম প্রভাবিত হয়। আবার প্রয়োজনবোধে জনগণ শান্তিপূর্ণভাবে নির্বাচনের মাধ্যমে সরকারের পরিবর্তনও করতে পারে। এজন্য জনগণকে রক্তক্ষয়ী বৈপ্লবিক পন্থা অবলম্বন করতে হয় না। গণতন্ত্রে পারস্পরিক বোঝাপড়ার মাধ্যমে শান্তিপূর্ণ উপায়ে সকল সমস্যার সমাধান করা যায়।
(৯) দেশপ্রেমের সৃষ্টি হয়: গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় শাসনকার্যে প্রত্যেকের অংশগ্রহণের সমান সুযোগ থাকে। তা ছাড়া, গণতন্ত্রে সকলের স্বার্থ সংরক্ষণের সুযোগ থাকে। তাই সরকারকে তাদের নিজেদের সরকার হিসাবে ভাবতে শেখে। তার ফলে জনসাধারণের মধ্যে স্বদেশ প্রীতির সৃষ্টি হয় এবং দায়িত্ববোধ বৃদ্ধি পায়। এই দেশপ্রেম কালক্রমে আন্তর্জাতিকতার মহান আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়।
(১০) সরকার স্বৈরাচারী হতে পারে না: গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় সরকারের স্বৈরাচারী হওয়ার আশঙ্কা থাকে না। কারণ এ ধরনের শাসনব্যবস্থা হল জনমত-পরিচালিত শাসনব্যবস্থা। জনমতের ভয়ে সরকার সাধারণত স্বৈরাচারী হতে পারে না। জনমতকে উপেক্ষা করলে ক্ষমতাসীন গোষ্ঠীর পরবর্তী নির্বাচনে ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। তা ছাড়া প্রত্যক্ষ গণতান্ত্রিক নিয়ন্ত্রণও সরকারকে সংযত রাখে। প্রকৃত প্রস্তাবে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় শাসিতের প্রতি শাসকের দায়িত্বশীলতা সুনিশ্চিত হয়।
(১১) স্থায়িত্ব: গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা দেশবাসীর অকুণ্ঠ সমর্থন ও সক্রিয় সহযোগিতার উপর প্রতিষ্ঠিত। এই সরকারের পিছনে জনসাধারণের ব্যাপক সম্মতি বর্তমান থাকে। সেজন্য গণতান্ত্রিক সরকার স্থায়ী হয়।
(১২) আইনের অনুশাসন: গণতন্ত্রে আইনের অনুশাসন প্রতিষ্ঠিত হয়। সকল রকম বৈষম্যমূলক আচরণের পথ রুদ্ধ হয়। শাসক এবং বিচারকদেরও বৈষম্যমূলক ও অন্যায় কাজকর্মের জন্য জবাবদিহি করতে হয়। গণতন্ত্রে সকল ক্ষেত্রে জনগণই হল চূড়ান্ত বিচারক। ড. ফাইনার বলেছেন: “We have the assurance that the sphere of our private life will not be invaded except by due process of law in which we have an equal say with any.”
(১৩) রাজনৈতিক সার্বভৌমত্বের স্বীকৃতি: গণতন্ত্রে রাজনৈতিক সার্বভৌমত্ব বাস্তবে কার্যকর হয়। গণতন্ত্রে জনগণই হল সকল ক্ষমতার উৎস। কেবল গণতন্ত্রেই জনগণ তাদের ইচ্ছানুসারে সরকার গঠন ও রদবদল করতে পারে। গণতন্ত্রে সরকার তার সকল কাজের জন্য জনগণের কাছে দায়িত্বশীল থাকে।
(১৪) দায়িত্বশীলতা: গণতন্ত্রে শাসিতের কাছে শাসক দায়িত্বশীল থাকে। সংসদীয় গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় মন্ত্রিপরিষদ জনগণের কাছে দায়িত্বশীল থাকে। আবার রাষ্ট্রপতি-শাসিত শাসনব্যবস্থায় রাষ্ট্রপতি সরাসরি জনসাধারণের কাছে দায়িত্বশীল থাকেন।
গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার ত্রুটি
বিভিন্ন গুণাবলীর অস্তিত্ব সত্ত্বেও গণতন্ত্রের বিরুদ্ধে বিরূপ সমালোচনার অভাব নেই। গ্রীক দার্শনিক প্লেটোর সময় থেকেই গণতন্ত্রের বিরুদ্ধে বহু অভিযোগ উত্থাপিত হয়েছে। বিরুদ্ধবাদীদের মতে, গণতন্ত্র অপেক্ষা নিকৃষ্ট শাসনব্যবস্থা বিরল। তাঁরা বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে গণতন্ত্রের বিরুদ্ধে তীব্রভাবে সমালোচনা করেছেন।
(ক) অজ্ঞ ও অশিক্ষিতদের শাসন: গণতন্ত্রের বিরুদ্ধে প্রথম ও প্রধান অভিযোগ হল এটি অশিক্ষিত, অজ্ঞ ও অক্ষম ব্যক্তির শাসন। কারণ গণতন্ত্র হল জনগণের শাসন এবং জনগণের অধিকাংশই অশিক্ষিত ও অজ্ঞ। অতএব যে শাসনব্যবস্থায় জনগণের ভূমিকাই মুখ্য, তা গুণগত বিচারে নিম্নমানের হওয়াই স্বাভাবিক। লেকি তাই উপহাস করে বলেছেন: গণতন্ত্র হল ‘সর্বাপেক্ষা দরিদ্র, সর্বাপেক্ষা অজ্ঞ এবং সর্বাপেক্ষা অযোগ্য ব্যক্তির শাসনব্যবস্থা, কারণ তারাই হল সংখ্যায় সর্বাধিক’ (Democracy is a Government “by the poorest, the most ignorant, the most incapable, who are necessarily the most numer ous.”)। একই ভাবে কার্লাইল তীব্র কটাক্ষ করে বলেছেন: ‘গণতন্ত্র হল মূর্খদের, মূর্খদের জন্য এবং মূর্খদের দ্বারা পরিচালিত শাসনব্যবস্থা’ (“Democracy is a Government of the fools, for the fools and by the fools.”)। অজ্ঞ ও অশিক্ষিত জনগণের দ্বারা নির্বাচিত প্রতিনিধিরাও অনুরূপ প্রকৃতির হন। তাঁদের দ্বারা দক্ষ শাসন আশা করা যায় না।
(খ) সততা ও যোগ্যতার কদর নেই: একথা বলাই বাহুল্য যে, যে-কোনো শাসনব্যবস্থার সাফল্য শাসকবর্গদের বুদ্ধিমত্তা ও গুণগত যোগ্যতার উপর নির্ভরশীল। বর্তমান কালের সমস্যাসঙ্কুল ও জটিল শাসনব্যবস্থায় এ ব্যাপারটি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। কিন্তু গণতন্ত্রে সততা ও যোগ্যতার যোগ্য মর্যাদা দেওয়া হয় না। এখানে শিক্ষিত-অশিক্ষিত, যোগ্য-অযোগ্য, দক্ষ-অকর্মণ্য, সৎ-অসৎ নির্বিশেষে সকলকে সমান গুরুত্ব দেওয়া হয়। বরং অধিকাংশ সাধারণ মানুষ অশিক্ষিত ও অজ্ঞ বলে যোগ্য ও দক্ষ প্রতিনিধি বাছাই করতে পারেন না। তাঁরা ধূর্ত ও চতুর ব্যক্তিদের ভাঁওতায় বিভ্রাপ্ত হয়ে অযোগ্য ব্যক্তিদেরই মনোনীত করেন। এর ফলে যোগ্য ও বিজ্ঞ ব্যক্তিগণ সরকার পরিচালনার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হন। এতে দেশে সুশাসনের সম্ভাবনা কমে যায়।
জার্মান দার্শনিক নীৎসে (Nietzsche) বলেছেন: গণতন্ত্র বলতে সাধারণ ব্যক্তির প্রতি শ্রদ্ধা এবং জ্ঞানীগুণী ব্যক্তির প্রতি অবজ্ঞা বোঝায়’ (Democracy means ‘Worship of the mediocrity and hatred of excellence,” here “imitation is horizontal instead of vertical-not the superior man but mojority men becomes the ideal and the model.”)। গণতন্ত্রে গুণগত যোগ্যতার পরিবর্তে সংখ্যাগরিষ্ঠতার উপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়। অথচ জনগণের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশই হল অশিক্ষিত ও অজ্ঞ। লেবঁ (Le Bon) গণতন্ত্রকে বলেছেন ‘Government by crowds.’ বার্নস (C. D. Burns)-এর মতানুসারে, “Civilisation which Democracy produces is banal, mediocre or dull.”
(গ) রক্ষণশীল: গণতন্ত্র শিক্ষিত ও অক্ষম ব্যক্তির শাসন। তাই এই শাসনব্যবস্থা প্রকৃতিগতভাবে প্রগতিবিরোধী ও রক্ষণশীল। শিক্ষিত ও বিজ্ঞ ব্যক্তির মনেই প্রগতিশীল চিন্তার উন্মেষ ঘটে। অপরদিকে অশিক্ষিত ও অজ্ঞ জনগণ নতুন চিন্তা-ভাবনা, আবিষ্কার, উদ্ভাবনের ব্যাপারে নিস্পৃহ এবং ঘোরতর বিরোধী। তারা প্রগতিমূলক পরিবর্তনের পরিপন্থী। স্থিতাবস্থা বজায় রাখার জন্য তাদের উৎসাহ লক্ষ করা যায়। এর ফলে গণতন্ত্রে বিভিন্ন ক্ষেত্রে বাঞ্ছিত সংস্কার ব্যাহত হয়; প্রগতির বিরুদ্ধে রক্ষণশীলতাই জয়ী হয়। কোকার (F. W. Coker) মন্তব্য করেছেন: “Democracies are…the most conservative of all forms of state.”
(ঘ) দলপ্রথার কুফল: গণতন্ত্রে রাজনৈতিক দলের অস্তিত্বকে অপরিহার্য বিবেচনা করা হয়। দলীয় ভিত্তিতেই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। যে দল সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে, সেই দলই সরকার গঠন করে। ফলে কার্যত দলীয় শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়। সরকারী দল প্রায় ক্ষেত্রেই বৃহত্তর জাতীয় স্বার্থের পরিবর্তে সংকীর্ণ দলীয় স্বার্থকেই প্রাধান্য দেয়। দলীয় স্বার্থ সাধনের উদ্দেশ্যে জন-সাধারণের অর্থের ব্যাপক অপচয় হয়। অভিযোগ করা হয় যে, নির্বাচনের প্রাক্কালে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত সরকারী দল জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি ও ভোট সংগ্রহের জন্য সরকারী প্রশাসন ও অর্থকে অবাধে ব্যবহার করে। সরকারী অর্থের অপরিমিত অপচয়ের জন্য জনস্বার্থ অবহেলিত হয়, জনগণের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য ব্যাহত হয়। রাজনৈতিক দলগুলি ক্ষমতার লোভে দ্বন্দ্ব-সংঘাতে লিপ্ত হয় এবং জনগণের মধ্যে বিশৃঙ্খলা ও বিভ্রান্তির সৃষ্টি করে। দলীয় শাসনের যাবতীয় কুফল গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় সংকট সৃষ্টি করে। দলীয় আমলাতন্ত্র গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় প্রশ্রয় পায়। ব্রাইস একে বলেছেন: “Under power of party organisation.”
(ঙ) স্বল্পস্থায়ী ও ক্ষণভঙ্গুর: স্থায়িত্বের ব্যাপারেও গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার বিরূপ সমালোচনা করা হয়। হেনরী মেইন প্রমুখ রাষ্ট্রবিজ্ঞানীর মতে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা ক্ষণভঙ্গুর ও স্বল্পস্থায়ী। গণতন্ত্রে বহু পরস্পর-বিরোধী মত ও ধারণা দেখা যায়। এতে বিভিন্ন ক্ষেত্রে মতপার্থক্য ও সংঘর্ষের সৃষ্টি হয়। এর ফলে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে কোন স্থায়ী সরকার গঠন করা যায় না। অনেক সময় বহু-দলীয় কোয়ালিশন সরকার গঠিত হয়। এতে সরকার বিশেষভাবে দুর্বল ও স্বল্পস্থায়ী হয়। প্রায়ই একটি সরকারের পতন, আবার নির্বাচন এবং নতুন সরকার গঠিত হয়ে থাকে। ফলে কোনো সরকারই জনকল্যাণ সাধনের উদ্দেশ্যে দীর্ঘমেয়াদী কোনো পরিকল্পনা গ্রহণ বা বাস্তবে রূপায়িত করতে পারে না।
(চ) শিল্প-সাহিত্য ও জ্ঞান-বিজ্ঞানের চর্চার বিরোধী: গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার বিরুদ্ধে অন্যতম অভিযোগ হল যে, এই শাসনব্যবস্থা সভ্যতা, সংস্কৃতি ও জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিকাশে আনুকুল্য প্রদর্শন করে না। গণতন্ত্র হল সাধারণ মানুষের সরকার। কারণ তারাই সংখ্যাগরিষ্ঠ। এতে প্রতিভার কদর বা মর্যাদা নেই। গণতন্ত্র বিজ্ঞ-অজ্ঞ সবাইকে সমপর্যায়ভুক্ত করে। বুদ্ধিবৃত্তির ক্ষেত্রেও হাস্যকর সাম্য সৃষ্টির চেষ্টা করে। তাতে সভ্যতা, সংস্কৃতি ও জ্ঞানবুদ্ধির অপমৃত্যু ঘটে। ইতিহাসের পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে, পৃথিবীর উৎকৃষ্ট শিল্পস্থাপত্য এবং জ্ঞান-বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে উন্নত সৃষ্টিসমূহ কোনো-না-কোনো রাজার বিশেষ আনুকূল্যের ফলে সম্ভব হয়েছে।
মেইন (Henry Maine), লে ব (Le Bon), প্রভৃতি চিন্তাবিদের মতানুসারে গণতন্ত্র শিল্প, সাহিত্য, বিজ্ঞান, চারুকলা প্রভৃতি মানুষের সুকুমার বৃত্তিসমূহের বিরোধী। লে. বঁ মন্তব্য করেছেন: “It is fortune for the progress of civilization that the power of crowds only began to exist when the great discoveries of science and industry had already been effected.”
(ছ) গণতন্ত্র হল নির্বাচক-মণ্ডলীর সরকার পরিবর্তনের ক্ষমতা: গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা বলতে যে সমুন্নত ও আদর্শ সরকারের কথা বলা হয় তাও বস্তুতপক্ষে অতিপ্রচার মাত্র। গণতন্ত্র সকলের সরকার নয়। আবার সংখ্যাগরিষ্ঠেরও সরকার নয়। কার্যক্ষেত্রে গণতন্ত্র হল নির্বাচকমন্ডলীর সরকার পরিবর্তনের ক্ষমতা মাত্র। অন্যান্য শাসনব্যবস্থায়ও জনসাধারণ এই ক্ষমতা ভোগ করতে পারে। তবে গণতন্ত্রে জনগণের এই ক্ষমতা বৈশিষ্ট্যপূর্ণ।
(জ) জরুরী অবস্থার অনুপযোগী: গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার বিরুদ্ধে আর একটি গুরুত্বপূর্ণ অভিযোগ হল এটি জরুরী অবস্থার উপযোগী নয়। কারণ এ শাসনব্যবস্থা মহর ও শ্লথ গতিসম্পন্ন। বহিরাক্রমণ, আভ্যন্তরীণ গোলযোগ, প্রাকৃতিক বিপর্যয় প্রভৃতি সংকটপূর্ণ মুহূর্তে দেশের স্বার্থ সংরক্ষণের জন্য দ্রুত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হয়। এবং তৎপরতার সঙ্গে সেই সিদ্ধান্তকে কার্যকর করতে হয়। গণতন্ত্রে আলাপ আলোচনার মাধ্যমে সরকার পরিচালিত হয়। তাই তা সম্ভব হয় না। গণতন্ত্রে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে বিলম্ব হয়। তার ফলে ইতিমধ্যে দেশের স্বার্থের প্রভূত ক্ষতি হয়। তাই গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার মাধ্যমে দৃঢ়তার সঙ্গে জরুরী অবস্থার মোকাবিলা করা যায় না। এই ব্যবস্থা জাতীয় সংকটের মোকাবিলার উপযোগী নয়।
(ঝ) নৈতিক অবনতি ঘটে: গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় নৈতিকতার ক্রমশ অধঃগতি ঘটে। গণতন্ত্র হল সংখ্যাগরিষ্ঠের শাসন। সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণই হল অজ্ঞ ও অশিক্ষিত এবং রাজনৈতিক জ্ঞান-রহিত। এই অবস্থায় চতুর, বাকপটু ও স্বার্থপর কিছু নেতা মিথ্যাচারের মাধ্যমে জনগণের মধ্যে বিভ্রান্তির সৃষ্টি করে ক্ষমতাসীন হন। নির্বাচনে ব্যাপক দুর্নীতি, উৎকোচ প্রদান ও গ্রহণ প্রভৃতি অবাধে চলতে থাকে। সাধারণ মানুষ দুর্নীতি ও প্রলোভনের শিকার হয়। অনৈতিক কাজকর্মে সমাজজীবন ছেয়ে যায়। রাজনৈতিক ভাঁড়ামি এবং স্বার্থের রাজনীতিতে দেশ ছেয়ে যায়। আসির বাথম বলেছেন: “Democracy is a process of diseducation. It flatters people. It engenders people a false sence of equality.”
(ঞ) নিম্নস্তরের নেতৃত্ব: উপরিউক্ত কারণের জন্য গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় অযোগ্য ব্যক্তিরা নেতৃত্ব লাভ করেন। নির্বাচনের মাধ্যমে নেতৃত্ব স্থিরীকৃত হয়। তাই অসৎ ও অযোগ্য ব্যক্তিরাই নেতৃত্ব পেয়ে থাকেন। ঐতিহাসিক পর্যালোচনার ভিত্তিতে র্যাল্ফ অ্যাডাম ক্র্যাম প্রতিপন্ন করেছেন যে অতীতের নেতৃত্বের থেকে গণতান্ত্রিক নেতৃত্বের মান নিচু। ফরাসি চিন্তাবিদ ফ্যাগুয়েও সমমত পোষণ করেন। তিনি বলেছেন: “Government is an art and it presupposes knowledge, but the people are governed by men who have neither knowledge nor are and were chosen because they have them not.”
(ট) জীবনবিজ্ঞানের সমালোচনা: জীববিজ্ঞান ও মনোবিজ্ঞানমূলক দৃষ্টিকোণ থেকে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থাকে ‘বন্য, সাধারণ ও স্থূল’ সভ্যতার উপযোগী বলে সমালোচনা করা হয়েছে। আয়ারল্যান্ড (Alleyane Ireland), প্রেস্ফুট হল (Prescott Hall) প্রমুখ জীবনবিজ্ঞানীর মতানুসারে গণতন্ত্রে ব্যক্তির গুণগত পার্থক্যকে স্বীকার করা হয় না। জন্মগতভাবে মানুষে মানুষে পার্থক্য বর্তমান। কিন্তু গণতন্ত্র ‘সব মানুষ সমান’—এই সাম্যনীতির উপর প্রতিষ্ঠিত। এই নীতি অবৈজ্ঞানিক। জাতিগত শ্রেষ্ঠত্ব এবং মননশীলতা ও প্রতিভার পার্থক্য অস্বীকৃত হওয়ায় গণতান্ত্রিক সভ্যতাও নিম্নস্তরের হয়ে থাকে।
(ঠ) পুঁজিবাদের ত্রুটি: অনেকের মতে গণতন্ত্রে পুঁজিবাদ প্রশ্রয় পায়। অভিজ্ঞতা থেকে দেখা যায় যে, যে সকল দেশে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা আছে বলে দাবি করা হয়, সেই সব দেশে রাজনৈতিক সাম্য থাকলেও অর্থনৈতিক সাম্য থাকে না। তার ফলে অর্থনতিক বৈষম্যমূলক সমাজব্যবস্থায় রাজনৈতিক সাম্য মূল্যহীন হয়ে পড়ে। দেশের প্রশাসনিক ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব বিত্তবান পুঁজিপতিদের করায়ত্ত হয় এবং তাদের স্বার্থেই প্রশাসন ব্যবস্থা পরিচালিত হয়।
(ড) আমলাতন্ত্রের ত্রুটি: আবার গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় আমলাতন্ত্রের ত্রুটি দেখা যায়। গণতন্ত্রে জনপ্রতিনিধিদের সুষ্ঠু প্রশাসন কার্যের জন্য প্রয়োজনীয় প্রশাসনিক জ্ঞান বা অভিজ্ঞতা থাকে না। তা ছাড়া, জনসমর্থন অটুট রাখার জন্য প্রতিনিধিরা শাসনকার্যে আত্মনিয়োগ না করে রাজনৈতিক কার্যকলাপে বেশি সময় ব্যয় করেন। ফলে প্রশাসনিক ব্যাপারে তাঁরা আমলাদের উপর অতিমাত্রায় নির্ভরশীল হয়ে পড়েন। আর আমলাদের প্রাধান্য-প্রতিপত্তির জন্য জনসাধারণের স্বার্থ অবহেলিত হয়।
(ঢ) ব্যয়বহুল: অনেকের মতে গণতন্ত্র হল একটি অত্যন্ত ব্যয়বহুল শাসনব্যবস্থা। ঘন ঘন নির্বাচনের ব্যবস্থা, জনমত গঠন, ব্যাপক প্রচারকার্য প্রভৃতিকে কেন্দ্র করে সরকার, রাজনৈতিক দল, প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী প্রভৃতি বিভিন্ন ব্যক্তি ও কর্তৃপক্ষের ব্যাপক অর্থ ব্যয় হয়। আর এই ব্যয় অর্থের অপচয় বই কিছু নয়।
(গ) সংখ্যালঘুদের স্বার্থের অবহেলা: আবার সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের স্বার্থ অবহেলিত হওয়ার অভিযোগও করা হয়। বাস্তবে গণতন্ত্র সংখ্যাগরিষ্ঠের শাসনে পরিণত হয়। সংখ্যালঘুরা সাধারণত আইনসভায় প্রতিনিধি প্রেরণ করতে পারে না। ফলে তাদের অভাব-অভিযোগ সম্পর্কে সরকার উদাসীন থাকে।
(ত) আবেগের তাড়না: গণতন্ত্রে জনগণের আবেগের আধিক্য দেখা যায়। সাধারণ মানুষ রাজনৈতিক চেতনা ও যুক্তির বদলে উচ্ছ্বাস ও ভাবালুতার দ্বারা প্রভাবিত ও পরিচালিত হয়। সমাজবিজ্ঞানী গিডিংস একে বলেছেন, ‘Unbridled emotionalism’। গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় আবেগ উচ্ছ্বাস বিপথগামী হয়।
উপসংহার: বহু বিরূপ সমালোচনা সত্ত্বেও গণতন্ত্রই হল বর্তমানে বিশ্ববন্দিত শাসনব্যবস্থা। গণতন্ত্রের বিরুদ্ধে উল্লিখিত সমালোচনাগুলির কতকগুলি গণতন্ত্র সম্পর্কে ভ্রান্ত ধারণাপ্রসূত। আর বাকিগুলি অধিকাংশ ক্ষেত্রেই অযৌক্তিক। সাধারণ মানুষের অধিকাংশই অশিক্ষিত, একথা ঠিক। কিন্তু তাই বলে অজ্ঞ—একথা বলা যায় না। কারণ স্কুল-কলেজের পাঠক্রমের সঙ্গে রাজনৈতিক সচেতনতার তেমন ঘনিষ্ঠ কোনো সংযোগ নেই। বাস্তবে এমন নজির অসংখ্য। তা ছাড়া জনগণের মধ্যে শিক্ষার ব্যাপক বিস্তারের জন্যও গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থাই বিশেষভাবে উপযোগী। তবে গণতন্ত্রকে একেবারে ত্রুটিমুক্ত শাসনব্যবস্থাও বলা যায় না। কিন্তু গণতন্ত্রের ত্রুটি-বিচ্যুতিগুলি সংশোধনযোগ্য এবং এগুলি দূর করা দরকার। যাইহোক, ত্রুটি-বিচ্যুতি সত্ত্বেও গণতন্ত্র বর্তমান দুনিয়ার সর্বশ্রেষ্ঠ শাসনব্যবস্থা হিসাবে সর্বজনস্বীকৃত। লিপসন মন্তব্য করেছেন। “….of all forms of Government known and tried, democracy is the wisest and the best.” পরিশেষে বার্নস (C. D. Burns )-এর মন্তব্য বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য। তিনি বলেছেন: “No one denies that existing representative assemblies are defective; but even if an automobile does not work well, it is foolish to go back to farm cart, however romantic.”
Leave a comment