রাজনীতিক ক্ষমতার বণ্টন সম্পর্কিত আলোচনা গুরুত্বপূর্ণ: অ্যালান বল তাঁর Modern Politics and Government শীর্ষক গ্রন্থের দ্বিতীয় অধ্যায়ের শেষে ক্ষমতা ও কর্তৃত্বের বণ্টন সম্পর্কে আলোচনা করেছেন। রাজনীতিক ক্ষমতা ও রাজনীতিক কর্তৃত্ব সম্পর্কে সম্যকভাবে ধারণা লাভের জন্য এদের বণ্টন সম্পর্কেও অবহিত হওয়া আবশ্যক। কারণ রাজনীতিক ক্ষমতা ও কর্তৃত্বের বণ্টন সম্পর্কিত আলোচনা আধুনিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের অনুধাবনের উপর আলোকপাত করে। বিদ্যমান রাজনীতিক ব্যবস্থা সম্পর্কে দেশবাসীর ধারণা ও মতামত রাজনীতিক ক্ষমতার বণ্টনের প্রকৃতির পরিপ্রেক্ষিতে নির্ধারিত ও নিয়ন্ত্রিত হয়ে থাকে। আবার দেশের রাজনীতিক কাজকর্ম দেশবাসীর অংশগ্রহণের প্রকৃতি ও পরিধি রাজনীতিক ক্ষমতার বণ্টনের উপর বহুলাংশে নির্ভরশীল। সর্বোপরি বিদ্যমান রাজনীতিক ব্যবস্থার বৈধতা এবং স্থায়িত্ব নির্ধারণের ক্ষেত্রে রাজনীতিক ক্ষমতা ও কর্তৃত্বের বন্টনের গুরুত্ব বিরোধ-বিতর্কের ঊর্ধ্বে। প্রচলিত রাজনীতিক ব্যবস্থার মধ্যে রাজনীতিক ক্ষমতার বণ্টন যদি সুষম হয়, তা হলে অধিক সংখ্যক মানুষ রাজনীতিক বিষয়ে অংশগ্রহণের সুযোগ পায়। এবং বিদ্যমান রাজনীতিক ব্যবস্থার প্রতি দেশের মানুষের মধ্যে অনুকূল মনোভাবের সৃষ্টি হয়। তার ফলে সংশ্লিষ্ট রাজনীতিক ব্যবস্থা দৃঢ়ভিত্তিক ও দীর্ঘস্থায়ী হয়। বিপরীতক্রমে বিপরীত অবস্থার সৃষ্টি হয়। অর্থাৎ রাজনীতিক ক্ষমতার বণ্টন যদি বৈষম্যমূলক হয়, সেক্ষেত্রে রাজনীতিক কাজকর্মে অংশগ্রহণের সুযোগ মুষ্টিমেয় মানুষের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে। সংখ্যাগরিষ্ঠ বঞ্চিত ব্যক্তিবর্গের মধ্যে বিদ্যমান রাজনীতিক ব্যবস্থা সম্পর্কে প্রতিকূল মনোভাবের সৃষ্টি হয়। তাঁরা প্রতিরোধমূলক ও প্রতিবাদী আন্দোলনের সামিল হয়। এবং এই সবের ফলে সংশ্লিষ্ট রাজনীতিক ব্যবস্থা দুর্বল হয়ে পড়ে ও তার স্থায়িত্ব বিপন্ন হয়।
রাজনীতিক ক্ষমতার অসম বণ্টন: রাজনীতিক ক্ষমতার সুষম বণ্টন হল একটি তাত্ত্বিক বিষয়। বাস্তবে কোথাও রাজনীতিক ক্ষমতার সুষম বণ্টন বড় একটা দেখা যায় না। সকল রাজনীতিক ব্যবস্থাতেই রাজনীতিক ক্ষমতার বণ্টন অল্প-বিস্তর বৈষম্যমূলক। এবং সকল রাজনীতিক ব্যবস্থাতেই দেখা যায় যে, বিত্তহীনদের চেয়ে বিত্তবানেরাই অধিকতর রাজনীতিক ক্ষমতাযুক্ত। বল বলেছেন: “Political power is not distributed evenly in any political system. The rich possess more political resources than the poor.” রাজনীতিক ক্ষমতার বৈষম্যমূলক বণ্টনের কারণ হিসাবে অধ্যাপক বল মূলত দুটি বিষয়ের কথা বলেছেন। এই দুটি বিষয় হল: রাজনীতিক সম্পদ-সামর্থ্যের ক্ষেত্রে বৈষম্য এবং ব্যক্তিগত গুণগত যোগ্যতা ও দক্ষতার ক্ষেত্রে পার্থক্য।
সম্পদশালীরাই অধিকতর রাজনীতিক সম্পদযুক্ত: সমাজের সম্পদশালীদের হাতে রাজনীতিক সম্পদের প্রাচুর্য পরিলক্ষিত হয়। এবং এই প্রাচুর্যের পরিপ্রেক্ষিতে তাঁরা সহজেই জনসাধারণের রাজনীতিক জীবনকে প্রভাবিত করতে পারেন। নির্বাচনী প্রচারের বিষয়টি অত্যন্ত ব্যয়বহুল। কেবলমাত্র বিত্তবান ব্যক্তিদের পক্ষেই তা বহন করা সম্ভব। সম্পদশালীরা অর্থব্যয়ের মাধ্যমে সমর্থক সংগ্রহ করতে পারেন, বিরোধীদের বশীভূত করতে পারেন এবং অন্যান্য রাজনীতিক সুযোগ-সুবিধা ক্রয় করতে পারেন। সর্বোপরি রাজনীতিক ক্ষেত্রেও সাফল্যের স্বার্থে শিক্ষা-দীক্ষার প্রয়োজন অনস্বীকার্য। এবং এ ক্ষেত্রেও অর্থবানরা অনুকূল অবস্থায় অবস্থিত অধ্যাপক বল এ ক্ষেত্রে বিত্তবান বলতে সম্পদশালী ব্যক্তিদের মত সম্পদশালী সংঘ-সমিতির কথাও বলেছেন। উদাহরণ হিসাবে তিনি বণিক সংঘের কথা বলেছেন।
ব্যক্তিগত যোগ্যতা ও বিচক্ষণতা: ব্যক্তিগত যোগ্যতা ও বিচক্ষণতার ক্ষেত্রে তারতম্যও এ ক্ষেত্রে তাৎপর্যপূর্ণ। কারও রাজনীতিক বিচক্ষণতা অন্যান্যদের তুলনায় অনেক বেশী। রাজনীতিক নেতাদের মধ্যে কেউ কেউ বিশেষভাবে বিচক্ষণ ও বাগ্মী। আবার কেউ-বা সম্মোহনী ব্যক্তিত্বের অধিকারী। এই শ্রেণীর রাজনীতিক নেতারা সহজেই জনসাধারণকে বশীভূত করতে পারেন। বল এ ক্ষেত্রে হিটলারের উদাহরণ দিয়েছেন। এঁদের মধ্যে অনেকে আবার ধূর্ত প্রকৃতির এবং রাজনীতিক দূরদর্শিতাসম্পন্ন। এই যোগ্যতার সাহায্যে সহজেই তাঁরা বিরোধীদের টপকে যান। এ ক্ষেত্রে উদাহরণ হিসাবে অধ্যাপক বল লয়েড জর্জ (Lloyd George)-এর কথা বলেছেন। যাইহোক এই সমস্ত গুণাবলীর অধিকারী ব্যক্তিবর্গের পক্ষে নির্বাচকমণ্ডলীকে প্রভাবিত করতে এবং রাজনীতিক প্রতিপক্ষকে প্রতিরোধ করতে অসুবিধা হয় না।
অ-রাজনৈতিক ক্ষেত্রে যোগ্যতা: অধ্যাপক বলের অভিমত অনুসারে অ-রাজনীতিক ক্ষেত্রে বিভিন্ন ভূমিকায় বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ যে খ্যাতি ও মর্যাদা অর্জন করেন, তাও রাজনীতিক ক্ষমতায় রূপান্তরিত হতে পারে। সফল কোন সেনানায়ক বা পরমশ্রদ্ধেয় কোন ধর্মগুরু ইচ্ছা করলে রাজনীতিক ক্ষমতার অধিকারী হতে পারেন। আবার এমনও হতে পারে যে রাজনীতিক বিচক্ষণতা ও রাজনীতিক সম্পদ-সামর্থ্যের অধিকারী হয়েও কোন ব্যক্তি রাজনীতিক ক্ষমতা অর্জনের ব্যাপারে অনীহা পোষণ করতে পারেন। আবার ক্ষেত্র বিশেষে এই অনীহাই বিশেষ রাজনীতিক সম্পদে পরিণত হতে পারে।
রাজনীতিক ক্ষমতা মুষ্টিমেয় মানুষের হাতে কেন্দ্রীভূত থাকে: উপরিউক্ত বিভিন্ন কারণের জন্য সকল রাজনীতিক ব্যবস্থাতেই মুষ্টিমেয় মানুষের হাতে রাজনীতিক ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত থাকে। এই মুষ্টিমেয় মানুষকে বা সংখ্যালঘু ব্যক্তিবর্গকে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন নামে অভিহিত করা হয়। এঁদের শাসকশ্রেণী, বাছাই করা রাজনীতিক ব্যক্তি, ক্ষমতাপ্রয়োগকারী বাছাইকরা ব্যক্তি প্রভৃতি নামে আখ্যায়িত করা হয়। বল বলেছেন: “… political power in political system is concentrated in the hands of the few. This minority is often variously described as the ruling class, the political elite, the power elite or the political establishment.” রাজনীতিক ক্ষেত্রে ক্ষমতার অধিকারী সংখ্যালঘু এই ব্যক্তিবর্গের গঠন-প্রকৃতি এবং রাজনীতিক ক্ষমতার প্রয়োগ-পদ্ধতি নানা রকমের হওয়া সম্ভব। এ বিষয়ে বিভিন্ন ও জটিল প্রকৃতির বহুবিধ তাত্ত্বিক মতামত বর্তমান। তবে সাধারণভাবে এ কথা সত্য যে মুষ্টিমেয় কিছু ব্যক্তির হাতেই রাজনীতিক বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত থাকে। এবং সকল রাজনীতিক ব্যবস্থা সম্পর্কে এ কথা সাধারণভাবে স্বীকার্য। বল বলেছেন: “… there is general agreement that political decisions are made by the few….” তত্ত্বগতভাবে বলা হয় যে উদারনীতিক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় এবং সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থায় রাজনীতিক ক্ষমতা বহুমানুষের মধ্যে বণ্টিত অবস্থায় থাকে। কিন্তু এ ধরনের বক্তব্য রাজনীতিক অবস্থার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। কারণ বাস্তবে সকল রাজনীতিক ব্যবস্থাতেই রাজনীতিক ক্ষমতা মুষ্টিমেয় মানুষের হাতেই কেন্দ্রীভূত থাকে এবং তাঁরাই হলেন রাজনীতিক বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণের অধিকারী। তবে সরকারের বৈধতা এবং রাজনীতিক ব্যবস্থার স্থায়িত্বের স্বার্থে রাজনীতিক ক্ষমতার ব্যাপক বণ্টন বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। বল বলেছেন: “The belief that power is more widely distributed may be very important, of course, for the legitimacy of the gov ernment and the stability of the political system.”
রাজনীতিক ক্ষমতার বণ্টন সম্পর্কে কতকগুলি প্রশ্নের ব্যাপারে অনুসন্ধান আবশ্যক: বলের অভিমত অনুসারে রাজনীতিক ক্ষমতার বণ্টন প্রসঙ্গে আরও কতকগুলি প্রাসঙ্গিক প্রশ্ন সম্পর্কে অনুসন্ধান করা আবশ্যক। এই অনুসন্ধানের ফলাফল সূত্রে গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন রাজনীতিক বিষয়ে অবহিত হওয়া যাবে। এই সমস্ত বিষয়ের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল: রাজনীতিক ব্যবস্থায় বিরোধের প্রকৃতি, বিভিন্ন রাজনীতিক প্রতিষ্ঠান ও রাজনীতিক প্রক্রিয়ার পরিকাঠামোর মধ্যে বিরোধের নিষ্পত্তি এবং সংশ্লিষ্ট বিরোধ সূত্রে সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়া। বল যে সমস্ত প্রশ্নে অনুসন্ধানের প্রয়োজনীয়তার কথা বলেছেন সেগুলি উল্লেখ করা দরকার। কোন বিশেষ একটি সংখ্যালঘু গোষ্ঠী, নাকি কতকগুলি সংখ্যালঘু গোষ্ঠী রাজনীতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়াকে প্রভাবিত করে। বিভিন্ন ক্ষেত্রে সিদ্ধান্তকে একই সংখ্যালঘু গোষ্ঠী প্রভাবিত করে কিনা? নাকি এই প্রবণতা একটি বিশেষ ক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত গ্রহণের মধ্যেই সীমাবদ্ধ? সংখ্যালঘু সিদ্ধান্ত গ্রহণকারীদের মধ্যে যোগাযোগের বিষয়টিও পর্যালোচনা করা প্রয়োজন। তা হলে বোঝা যাবে যে তারা সকলে বিশেষ কোন সামাজিক শ্রেণী বা জাতিগত গোষ্ঠী থেকে সম্ভৃত কিনা। এবং জানা যাবে যে তারা তাদের এই উদ্ভবগত যোগাযোগ সম্পর্কে সম্যকভাবে সজাগ কিনা। বিভিন্ন রাজনীতিক ব্যবস্থার মধ্যে তারতম্যের কারণ অনুধাবনের জন্য জানতে হবে রাজনীতিক ক্ষমতার জন্য বিভিন্ন সংখ্যালঘু গোষ্ঠী পারস্পরিক প্রতিযোগিতার সামিল হয় কিনা এবং সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ হল এই সংখ্যালঘুর অন্তর্ভুক্ত হওয়ার সুযোগ বাইরের মানুষও পায় কিনা, কিম্বা সংখ্যালঘু গোষ্ঠী রাজনীতিক প্রভাবের পরিধিকে সীমাবদ্ধ রাখতে সক্রিয় কিনা। যদি দেখা যায় যে কোন বিষয়ে একটি সংখ্যালঘু গোষ্ঠী বা কতকগুলি সংখ্যালঘু গোষ্ঠী সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়ার উপর নিয়ন্ত্রণকে কুক্ষিগত করেছে, তা হলে দেখতে হবে যে সমস্ত সাধারণ মানুষের উপর এই সমস্ত সিদ্ধান্ত কার্যকর হয় তারা সিদ্ধান্ত গ্রহণকারী সংখ্যালঘু গোষ্ঠী বা গোষ্ঠীসমূহের উপর কি ধরনের নিয়ন্ত্রণ কার্যকর করে? দেখতে হবে যে, সংশ্লিষ্ট সংখ্যালঘু গোষ্ঠীকে অপসারণ করা যায় কিনা? যদি অপসারণ করা সম্ভব, তা হলে তার উপায় পদ্ধতি কি? তা ছাড়া দেখতে হবে অধঃস্তনদের অভাব-অভিযোগ সম্পর্কে সংশ্লিষ্ট সংখ্যালঘু গোষ্ঠী কতটা সহানুভূতিশীল?
Leave a comment