নিরক্ষরেখার উভয় দিকে কর্কটক্রান্তি ও মকরক্রান্তি রেখার মধ্যবর্তী অঞ্চলে যেসব ঘূর্ণবাত সৃষ্টি হয় তাদের ক্রান্তীয় ঘূর্ণবাত বলে। তীব্রতার মাপকাঠি অনুযায়ী বিশ্ব আবহাওয়া সংস্থা (WMO) ক্রান্তীয় গােলযােগকে তিনটি ভাগে ভাগ করেছে। যথা [1] ক্রান্তীয় ডিপ্রেসন (গতিবেগ ঘণ্টায় 40 কিমির কম), [2] ক্রান্তীয় ঝড় (গতিবেগ ঘণ্টায় 40 থেকে 120 কিমি) এবং [3] ক্রান্তীয় ঘূর্ণবাত বা প্রবল শক্তিশালী ঘূর্ণবাত (ঘণ্টায় গতিবেগ 120 কিমি থেকে 300 কিমি বা 400 কিমি)
লীনতাপের জোগান : ক্রান্তীয় ঘূর্ণবাতের শক্তির উৎস হল লীনতাপ। সমুদ্রপৃষ্ঠের উয়তা 27° সেলসিয়াসের বেশি হলে বাতাসে জলীয় বাষ্পের জোগান বাড়ে, যা ঘনীভূত হয়ে বাতাসে লীনতাপ সরবরাহ করে।
উষ্ণ জলের বিস্তৃতি : সমুদ্রজলের গভীরতা 30 মিটার থেকে 70 মিটার এবং উয়তা 27°C এর বেশি হওয়া প্রয়ােজন। অন্যথায় ঘূর্ণবাত বিলীন হয়ে যায়।
অধিক পরিমাণ কোরিওলিস বল : ক্রান্তীয় ঘূর্ণবাত সৃষ্টিতে বেশি পরিমাণ কোরিওলিস বলের (10-5 ডাইন/সে) প্রয়ােজন। নিরক্ষরেখার উভয় দিকে 5° উত্তর ও দক্ষিণ অক্ষরেখার মধ্যে তা সৃষ্টি হয় না। ওই শক্তি 5° অক্ষরেখার পর বাড়তে থাকে। তাই 15° উত্তর ও দক্ষিণ অক্ষরেখা বরাবর অধিকাংশ ঘূর্ণবাত জন্ম নেয়।
অন্যান্য শর্ত : বায়ুমণ্ডলের নিম্নস্তরে পুবালি বায়ুতরঙ্গের অবস্থান, উর্ধ্ব ট্রপােস্ফিয়ারে নাতিশীতােয় ঘূর্ণবাতের পরিত্যক্ত ট্রাফের উপস্থিতি এবং বাতাসের ন্যূনতম উল্লম্ব উত্থান প্রভৃতি ক্রান্তীয় ঘূর্ণবাত সৃষ্টির অন্যান্য শর্ত।
প্রারম্ভিক পর্যায় : এই পর্যায়ে সমুদ্রের ওপর বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে উয়তার প্রভাবে বায়ুর চাপ ধীরে ধীরে কমে। এলােমেলােভাবে বাতাস বইতে থাকে এবং ক্রমাগত আবর্তিত হয়ে ঘূর্ণির সৃষ্টি হয়।
বিকাশশীল পর্যায় : এই পর্যায়ে বায়ুর চাপ ক্রমাগত কমতে থাকে, বাতাসের গতিবেগ বেড়ে যায় এবং ঝড়ের চক্ষুকে কেন্দ্র করে বাতাস প্রবলবেগে ঘুরতে ঘুরতে এগিয়ে যায়। আকাশ মেঘে ঢাকা থাকে। বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে বৃষ্টিপাত হয়। ঘূর্ণবাত ভেঙে কয়েকটি ছােটো ছােটো ঘূর্ণবাতে পরিণত হয়। এদের মধ্যে একটি ক্রমশ বড়াে হয়ে শক্তিশালী ঘূর্ণবাতে পরিণত হয়।
পরিণত পর্যায় : এই পর্যায়ে ঘুর্ণিঝড় প্রবল আকার ধারণ করে। ঘূর্ণিঝড়ের বিস্তীর্ণ অঞ্চলকে 4টি বৃত্তীয় বলয়ে ভাগ করা যায়। যথা—(i) 10 কিমি 20 কিমি ব্যাসযুক্ত কেন্দ্রবলয়। এই অংশে বাতাসের গতিবেগ খুবই কম, আকাশ পরিষ্কার থাকে। (ii) এর পরবর্তী বলয় 50 কিমি – 150 কিমি পর্যন্ত বিস্তৃত। এই অংশে বায়ুর চাপীয় ঢাল বেশ খাড়া। তাই বাতাসের গতিবেগ প্রবল, বৃষ্টিপাতের পরিমাণও খুব বেশি। (iii) বহিস্থ বলয়টি ঝঞ্চাবিক্ষুপ্ধ। (iv) সবচেয়ে শেষের বলয়ে দুর্বল ঝােড়াে বাতাস প্রবাহিত হয়।
সমাপ্তি পর্যায় : শক্তিশালী ঘূর্ণবাত স্থলভাগে প্রবেশ করার পর ভূপৃষ্ঠের ঘর্ষণজনিত বাধার জন্য এর গতিবেগ কমে যায়। স্থলভাগে সমুদ্র থেকে জলীয় বাম্পের জোগান কমে বলে ঘূর্ণবাতের শক্তি উল্লেখযােগ্যভাবে কমে যায়। ফলে বৃষ্টিপাতের পরিমাণও কমে যায়। নিম্নচাপের কেন্দ্র ক্রমাগত উচ্চচাপে পরিণত হয়। অবশেষে ঘূর্ণবাতের পরিসমাপ্তি ঘটে।
ঘূর্ণবাতের গঠন
(১) ক্রান্তীয় ঘূর্ণবাতের ব্যাস প্রায় 200 কিমি – 700 কিমি, উচ্চতা প্রায় 12 কিমি – 16 কিমি। বাতাসের গতিবেগ ঘণ্টায় প্রায় 120 কিমি – থেকে 400 কিমি।
(২) ক্রান্তীয় ঘূর্ণবাতের 10 কিমি থেকে – 20 কিমি ব্যাসযুক্ত একটি বৃত্তাকার কেন্দ্র থাকে। একে ঝড়ের চক্ষু বলে।
(৩) ক্রান্তীয় ঘূর্ণবাত শত শত কিমি বিস্তৃত, কয়েক কিমি প্রশস্ত নীহারিকার মতাে মেঘের কুণ্ডলী থাকে।
(৪) ঘূর্ণবাতের গােলাকার আকৃতি ডিম্বাকৃতিতে পরিণত হয়।
Leave a comment