বাল্য ও বয়স্ককালের মধ্যবর্তী সময়কাল হল কৈশাের বা বয়ঃসন্ধিকাল| জীবনবিকাশের এই পর্যায়ে ছেলেমেয়েরা বাল্যাবস্থা থেকে প্রাপ্তবয়স্ক স্তরের দিকে অগ্রসর হয়। এই পর্যায়ে তাদের দৈহিক, মানসিক, সামাজিক, প্রাক্ষোভিক প্রভৃতি বিভিন্ন দিকে উল্লেখযােগ্য পরিবর্তন ঘটে যার সঙ্গে তারা সহজে মানিয়ে নিতে পারে না। যার ফলে তাদের জীবনে যেন ঝড় বয়ে যায়।

মানবজীবনের এই গুরুত্বপূর্ণ স্তরটিকে বিভিন্ন মনােবিজ্ঞানী বিভিন্নভাবে ব্যাখ্যা করেছেন। কোনাে কোনাে মনােবিদ বয়ঃসন্ধির এই সময়কে যৌন পরিপতির স্তর হিসেবে ব্যাখ্যা করেছেন। আবার কোনাে কোনাে মনোবিদ একে ‘বৈপ্লবিক পরিবর্তনের স্তর হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। মনোবিদ থর্নডাইক এবং কিসে বয়ঃসন্ধির এই পর্যায়কে ক্রমবিকাশমূলক স্তর হিসেবে ব্যাখ্যা করেছেন। এই পর্যায়ের দৈহিক, মানসিক ও প্রাক্ষোভিক পরিবর্তনগুলি যেহেতু ছেলেমেয়েদের জীবনে নানান সমস্যা সৃষ্টি করে, তাই মনােবিদ জি. এস. হল কৈশাের বা বয়ঃসন্ধিকালকে ‘ঝড়ঝার ও দুঃখকষ্টের কাল হিসেবে চিহ্নিত করেছেন।

বয়ঃসন্ধিকালে ছেলেমেয়েদের দেহমনে কতকগুলি আকস্মিক এবং গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন আসে। হঠাৎ এই ধরনের পরিবর্তনের ফলে তাদের সামগ্রিক আচরণ বদলে যায়। এই বয়সে ছেলেমেয়েদের মধ্যে যৌন চেতনা দেখা দেয়। এর আকস্মিকতায়। এবং সামাজিক সমর্থনের অভাবে কিশাের-কিশােরীরা তাদের যৌন চেতনাকে অবদমন করতে বাধ্য হয়। ফলে তাদের মধ্যে নানা ধরনের মানসিক পীড়া দেখা দেয়।যৌনতা সম্পর্কে ভ্রান্ত ধারণার ফলে মানসিক দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হয় এবং মনে পাপবােধ জন্ম নেয়। ফলে তারা খানিকটা দিশেহারা হয়ে পড়ে। এই স্তরের আর-এক সমস্যা হল নতুন পরিস্থিতিতে সংগতিবিধানের সমস্যা। এই বয়সের ছেলেমেয়েরা বুদ্ধি, চিন্তা, বিচারবিবেচনাতে বয়স্কদের সমকক্ষ হয়ে ওঠে। তারা বয়স্কদের ভূমিকা পালন করতে চায়। কুসংস্কার, অন্ধবিশ্বাসের প্রতিবাদ করতে চায়। কিন্তু বয়স্করা তা সমর্থন করেন না। তারা কিশােরদের এই আচরণকে ‘জ্যাঠামাে, ‘এঁচোড়ে পাকামাে’ বলে মন্তব্য করেন। আবার কৈশােরকালে বালকের আচরণও তারা সমর্থন করেন না, কিশোরদের কাছ থেকে দায়িত্বপূর্ণ আচরণ প্রত্যাশা করেন। এর ফলে কিশােররা তাদের অবস্থান সঠিকভাবে বুঝতে পারে না।

এইসব কারণে অনেক মনােবিজ্ঞানীরা কৈশোরকে ‘ঝড়- ঝঞ্ঝার কাল’ বা ‘পীড়ন ও কষ্টের কাল’ বলে বর্ণনা করেছেন।

বাল্য এবং বয়স্ককালের মধ্যবর্তী সময়কাল হল বয়ঃসন্ধি বা কৈশােরকাল। এই পর্যায়ে ছেলেমেয়েরা অপরিণত অবস্থা থেকে পরিণত অবস্থার দিকে অগ্রসর হয়। এই পর্যায়ে ছেলেমেয়েদের মধ্যে দৈহিক, মানসিক, প্রাক্ষোভিক ও সামাজিক বিকাশগত বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী নানা ধরনের চাহিদার সৃষ্টি হয়। এই সময়কার দুটি গুরুত্বপূর্ণ চাহিদা হল

(১) যৌন চাহিদা: কৈশােরের গুরুত্বপূর্ণ জৈবিক ঢাহিদাগুলির মধ্যে যৌন চাহিদা অন্যতম। ছেলেমেয়েরা কৈশােরে পোঁছােলে তাদের দেহের বিভিন্ন অন্তঃক্ষরা গ্রন্থিগুলি অত্যন্ত সক্রিয় হয়ে ওঠে। বিভিন্ন ধরনের গােনাডােট্রপিক হরমােন ক্ষরণ শুরু হয়, ফলে যৌন অঙ্গগুলি বিকাশলাভ করে। এই কারণে ওই বয়সে ছেলেমেয়েদের মধ্যে যৌন চাহিদা দেখা দেয়। নিজেদের যৌন কৌতূহল মেটানাের জন্য তারা বিপরীত লিঙ্গের প্রতি আকর্ষণ অনুভব করে। সামাজিক নিয়ন্ত্রণের কারণে তাদের যৌন কৌতুহল ও যৌন চাহিদা তৃপ্ত হয় না, ফলে এই সময়কার জীবন তাদের কাছে একটি সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়।

(২) স্বাধীনতার চাহিদা: কৈশােরে পৌঁছে ছেলেমেয়েরা গণ্ডিবদ্ধ জীবনযাপন পছন্দ করে না। তারা স্বাধীনতা চায়। স্বাধীনভাবে মতামত প্রকাশ করতে চায়। অন্যের নিয়ন্ত্রণ এবং প্রভুত্ব পছন্দ করে না। তাদের মনে আত্মনির্ভর হওয়ার ইচ্ছে জাগে| তারা বিভিন্ন দায়িত্বপূর্ণ সামাজিক কাজে অংশগ্রহণের মাধ্যমে নিজের পায়ে দাঁড়াতে চায়। তাদের স্বাধীন কাজকর্মে বাধার সৃষ্টি হলে তারা বিদ্রোহী হয়ে ওঠে।