বাংলা গদ্যের প্রস্তুতি পর্ব শুরু হয়েছিল ১৮০০ খ্রীঃ শ্রীরামপুর মিশন স্থাপন ও মুদ্রণ যন্ত্র প্রতিষ্ঠা এবং কলিকাতায় ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ স্থাপন কাল থেকেই। কিন্তু তথাকথিত বাংলা ভাষা সৃষ্টির সঙ্গে সঙ্গেই বাংলা গদ্যের উদ্ভব ঘটেছিল, তা বললে অত্যুক্তি হয়না। দলিল দস্তাবেজ, চিঠিপত্র ইত্যাদি প্রয়োজনে বাংলা গদের লিখিতরূপ প্রচলিত ছিল। এ ব্যাপারে শ্রীরামপুর মিশনের ভূমিকা অগ্রগণ্য।

উইলিয়াম কেরীর প্রচেষ্টা :

বাংলা গদ্যের সূচনা পর্বেই শ্রীরামপুর মিশন (১৮৬০ খ্রীঃ)। এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করেছিল। মুলত সব মানুষের মধ্যে ধর্ম ব্যাপারে সচেতন করাই ছিল এঁদের মূল প্রচেষ্টা। এঁদের মধ্যে ছিলেন উইলিয়াম কেরী, জনটমাস, ফতেরা মার্শম্যান, উইলিয়াম ওয়ার্ড, রামরাম বসু প্রমুখ ব্যক্তিবর্গ। এদের মধ্যে উইলিয়াম কেরী ছিলেন। বিশেষ উল্লেখযোগ্য। কেরী সাহেব এদেশে নতুন প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে যথেষ্ট উৎসাহী হয়ে। উঠলেন। কিন্তু কোম্পানীর কর্তৃত্বধীন কোন এলাকায় স্থায়ীভাবে কোন প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা তার পক্ষে সম্ভব হয়ে ওঠেনি। কিন্তু এ বিষয়ে তার প্রচেষ্টা থেমে থাকেনি। এই সময়ই তিনি মুদ্রণ যন্ত্র সংগ্রহ করেন ও বাংলা ভাষায় বাইবেল অনুবাদের কাজও অনেকটাই এগিয়ে গিয়েছিল। কিন্তু যেহেতু কোন স্থায়ী প্রতিষ্ঠান ছিলনা তাই একাজ বেশীদূর এগিয়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভবপর হচ্ছিলনা। অবশেষে ইষ্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানির কর্তৃত্বের বাইরে ডেনিশ শাসনাধীন শ্রীরামপুর মিশনকেই নির্বাচন করা হল।

উইলিয়াম কেরীর নেতৃত্বে মুদ্রণ যন্ত্রের প্রতিষ্ঠা

কেরীর প্রধান সহযোগী হিসাবে ওয়ার্ড ও মার্শম্যান এদেশে এসেছিলেন (১৭৯৯ খ্রীষ্টাব্দে)। কেরী সাহেবের নিজস্ব চেষ্টায় এবং অন্যান্য কর্মীদের ১৮০০ খ্রীঃ শ্রীরামপুর ব্যাপটিস্ট মিশন ও প্রেস প্রতিষ্ঠা করেন। ১২ জানুয়ারী থেকে রীতিমত কাজ শুরু হয়। নিজেদের মধ্যে গদ্যভাষা নিয়ে মতান্তর থাকলেও মুদ্রণ যন্ত্রের প্রতিষ্ঠায় জনসাধারণের সহযোগিতা এবং এর ফলে বাংলা গদ্যের যে শ্রীবৃদ্ধি ঘটেছিল, তার জন্য শ্রীরামপুর মিশনের কৃতিত্ব অভাবনীয়। একথা মানতে হবে যে বাংলা সাহিত্যে এক নব যুগ সূচনা করেছিল শ্রীরামপুর মিশন। একথা সর্বজনস্বীকৃত। এটা সম্ভব হয়েছিল উইলিয়াম কেরীর নেতৃত্বে, তাই বাংলা গদ্য সাহিত্যের ইতিহাস তাঁর নাম অবিস্মরণীয় হয়ে আছে।

কেরীর রচনাবলী :

শ্রীরামপুর মিশনের প্রতিষ্ঠার সঙ্গে সঙ্গে উইলিয়াম কেরীর আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হল তাঁর গ্রন্থ রচনা তাঁর রচনাগুলি হল-

১। নিউ টেস্টামেন্টের অনুবাদ : উইলিয়াম কেরী তাঁর ভাষা শিক্ষক রামরাম বসুর মহাশয়ের অনুপ্রেরণীয় বাইবেল অনুবাদ করতে মনোনিবেশ করেন। এই সময় ধর্মপুস্তক নামে এক গ্রন্থ (১৮০১) প্রকাশিত হয়। নিউ টেস্টামেন্টের প্রথম অংশের অনুবাদ এই গ্রন্থে প্রকাশিত হয়।

২। A Grammar of the Bengali Language : এই গ্রন্থের ভূামকাংশে বাঙলা ভাষা সম্পর্কে তার সুচিন্তিত মতামত প্রকাশ পায় এবং বাংলা ভাষার সঙ্গে যে সংস্কৃত ভাষার একটি যথার্থ সম্পর্ক রয়েছে তা তিনি গ্রন্থের মধ্যে দেখিয়েছেন।

৩। কথোপকথন : এই বইটিতে বাঙালী সমাজ ও বাঙালী পরিবারের একটি সুন্দর চিত্র ফুটে উঠেছে। এই সংলাপ গদ্যাংশটি বিভিন্ন শিরোনামে প্রকাশিত হয়েছে। যেমন— ঘটকালি, হাটের বিষয়, কন্দল, মহিয্যা কান্দল প্রভৃতি। উদাহরণ- মজুরের কথাবার্তা : “ফলনা কায়েতের বাড়ী মুই কাজ করিতে গিয়াছিনু। তার বাড়ীতে অনেক কাজ আছে। তুই যাবিনা ভাই। মুই সে বাড়ীতে বাড়ীতে কাজ করিতে যাবনা তার বড় ঠেটা।” —বস্তুত স্বতন্ত্র বাগভঙ্গিমায় এই গ্রন্থটির মধ্যে বাস্তব জীবন রসের স্বাদ মেলে।

৪। ইতিহাস মালা : এই গ্রন্থটির রচনা নিয়ে অনেকের মতানৈক্য আছে। অনেকে বলেন এটি কেরী সাহেবের রচনা নয় এটি তার সম্পাদিত বই। যাইহোক, দেশ বিদেশের বহু ঐতিহাসিক ও অনৈতিহাসিক ঘটনা ও গল্প এই গ্রন্থটিতে প্রকাশিত হয়েছে।