প্রখ্যাত ভারত তত্ত্ববিদ ম্যাক্সমুলার একদা কালিদাস সম্পর্কে মন্তব্য করেছিলেন : ‘ভারতবর্ষে লৌকিক সংস্কৃতি সাহিত্যের প্রকৃত প্রবর্তকের মর্যাদা প্রাপ্ত মহাকবি কালিদাসেরই।” অর্থাৎ বৈদিক যুগের সুদীর্ঘকাল ছিল সাহিত্যের ‘বন্ধ্যাযুগ’ (কালিদাসের কাল থেকেই দেখা দেয় ‘পুনর্জাগরণ’ এবং কালিদাসের সাহিত্য-রচনা দ্বারা ‘লৌকিক সংস্কৃতি সাহিত্যের সমৃদ্ধি যুগের সূচনা হয়। আর তা প্রমাণিত হয় কালিদাস বিরচিত মহাকাব্য ও গীতি কাব্যের দ্বারা। কালিদাস রচনা করেন দুইখানি মহাকাব্য রঘুবংশ ও কুমারসম্ভব এবং দুইখানি গীতিকাব্য—মেঘদূত ও ঋতুসংহার। কাব্য রচনায় কালিদাস কীরূপ দক্ষতা দেখিয়েছেন তা পর্যালোচনা সাপেক্ষ :
মহাকাব্য :
কুমারসম্ভব- কুমার দেব সেনাপতি কার্ত্তিকেয়, তারকাসুরকে নিধন করে দেবতাদের রক্ষা করার জন্য তার শিবপুত্র রূপে জন্মের পৌরাণিক কাহিনিই এ কাব্যের উপজীব্য। কাব্যটি মূলত সতেরোটি সর্গ বিশিষ্ট। প্রথম থেকে অষ্টম সর্গে শিব-পার্বতীর কাহিনি রক্ষিত হয়েছে, দক্ষতা সতীর পতি অপমানে দেহত্যাগ ও হিমালয় সুতা পার্বতী তথা উমারূপে জন্মগ্রহণ, হিমালয়ে শিবের তপস্যা, উমার শিব পরিচর্যা, মদন কর্তৃক শিবের তপোভঙ্গের প্রচেষ্টা পরিণামে মদনভস্ম, রতিবিলাপ, শিবপার্বতী বিবাহ ও কার্ত্তিকেয়ের জন্ম সম্ভাবনা, পার্বতী নয় থেকে সতেরো সর্গে দেবসেনাপতি কাৰ্ত্তিকেয় কর্তৃক তারকাশুর বধের বিস্তারিত বর্ণনা দেওয়া হয়েছে।
কোনো কোনো পণ্ডিতগণ এ কাব্যের অষ্টম সভাকে কালিদাসের রচনা বলে মানতে রাজি নয়। কারণ এ সর্গের রচনা রীতি কালিদাসের অনুকূল নয়। কিন্তু যত্ন সহকারে দেখলে বোঝায়, সভাটিতে কালিদাসের রচনা নৈপুণ্যের যথেষ্ট পরিচয় বিদ্যমান, তাঁর উপমা চয়নের দক্ষতা এই সর্গের সর্বত্র লক্ষিত হয়। আনন্দবর্ষণ এই সর্গে অর্থাৎ হরপার্বতী কালক্রীড়ায় বর্ণনায় কালিদাসের প্রতিভাশক্তির পরিচয় পেয়েছেন। এ কাব্যের শেষ অংশে লক্ষ করা যায়—কালিদাসদের দেবীর নাম করে আমাদের অতি পরিচিত ঘরের ছবিই আঁকতে চেয়েছেন—উমা-মহেশ্বর-হিমালয়- মেনকা সবাই আমাদের অতি পরিচিত ঘরের মানুষ, উমার জন্ম থেকে বিবাহ এরপর তার মিলন ভীরু মনের অবস্থা, পরে মুগ্ধা নায়িকার ধীরে ধীরে প্রতিকূলতা ত্যাগ করে বাঞ্ছিত নায়কের আত্মসমর্পণ সবই মানবোচিত সন্দেহ নেই। একদিকে প্রাকৃতি সৌন্দর্যের সুনিপুণ বর্ণনা, অন্যদিকে মানব স্বভাবের সুক্ষতি-সূক্ষ্ম বিশ্লেষণ-কালিদাস উভয় ক্ষেত্রেই মুনশিয়ানার পরিচয় দিয়েছেন, এযুগে জন্মালে কালিদাস হয়তো কবি না হয়ে ঔপন্যাসিক হতেন।
রঘুবংশ- কালিদাসের সর্বশ্রেষ্ঠ মহাকাব্য হল রঘুবংশ। বিদ্যাসাগর বলেছিলেন : ‘সংস্কৃত ভাষায় যত মহাকাব্য আছে, তন্মধ্যে কালিদাস প্রণীত রঘুবংশ সর্বাংশে উৎকৃষ্ট। আচার্য দন্ডী মহাকাব্যের যে সংজ্ঞা নির্দেশ করেছেন তদানুসারে কালিদাসের রঘুবংশ শ্রেষ্ঠ মহাকাব্য। উনিশটি সর্গে রচিত এই কাব্যের উপজীব্য দিলীপ থেকে শুরু করে ইক্ষাকু বংশের তথা রঘুবংশের নরপতিগণের কাহিনি। দিলীপ পুত্র রঘু দিগ্বীজয়ী সম্রাট ছিলেন তাই তাঁর নামেই এই বংশের পরিচয় এবং তাঁর পরবর্তী সাতাশজন রাজা অর্থাৎ দিলীপ থেকে অগ্নিবর্ণ পর্যন্ত মোট আটাশজনই রাজার কাহিনি কালিদাসের রসিতব্য। কিন্তু সকলকে তিনি সমান গুরুত্ব দেননি। দিলীপ, রঘু, অজ, দশরথ ও রাম তাঁর কাব্যে যতটা স্থান জুড়ে আছেন অন্যেরা তার চেয়ে কম। তাঁরা অধিকাংশই এমন নামমাত্র রাজা ছিলেন যে কালিদাস তাদের কথা বিশদভাবে বলার প্রয়োজনীয়তা বোধ করেনেনি।
রঘুবংশ কাব্যের সঙ্গে শেষ ঊনবিংশ সর্গে অগ্নিবর্ণের প্রমোদ বিলাসের চিত্র বর্ণিত হয়েছে। প্রজার প্রতি উদাসীন এই অপদার্থ নারীবিলাসী রাজা কীভাবে নিজের পুত্র জন্মাবার আগেই অকাল মৃত্যুবরণ করলেন কবি তাঁর কথাই বলেছেন। তাঁর প্রথমা পত্নী তাঁর মৃত্যুকালে গর্ভবতী ছিলেন—মন্ত্রীরাই সেই গর্ভস্থ সন্তানকে রাজা বলে কল্পনা করে নিয়ে রাজমাতাকে রাজ্যাভিষিক্ত করলেন। রাজার অবর্তমান অজাত পুত্রের প্রতিনিধি হয়ে রাজ্যশাসন করতে লাগলেন। এখানেই রঘুবংশ কাব্যের সমাপ্তি। ড. সুকুমার সেন কাব্যটি সম্পর্কে বললেন : “বীজ হইতে শস্য এবং শস্য হইতে বীজ—এই হইল পৃথিবীতে জীবনচক্রের আবর্ত গতি। রঘুবংশে কালিদাস ভারতবর্ষের ঐতিহ্যগত এক রাজবংশের ইতিহাসচক্র সেই আবর্ত গতিতেই সম্পূর্ণ করিয়া দেখাইয়াছেন।”
গীতিকাব্য :
মেঘদূত- আগাগোড়া মান্দাক্রান্ত ছন্দে ১৭ অক্ষরবিশিষ্ট ৪ চরণের শ্লোকে লেখা এই কাব্যটির কাহিনি এমনটি— কুবেরের শাপে তার এক অনুগত যক্ষ কাজে অবহেলার অপরাধে প্রিয়তমা পত্নীর কাছ থেকে দূরে রামগিরি পর্বতে এক বৎসরের জন্য নির্বাসিত হন। প্রেমিক যক্ষ কোনো প্রকারে আট মাস কাটিয়ে আষাঢ়ের প্রথম দিনে পাহাড়ের গায়ে একখণ্ড মেঘ দেখে উন্মনা হয়ে উঠলেন। কারণ কালিদাসের মতে—“মেঘ দেখলে সুখী ব্যক্তির চিত্তও ব্যাকুল হয়, যার কণ্ঠলগ্ন হওয়ার জন্য উন্মুখ প্রিয়জন দূরে থাকে তার তো কথাই নেই।” বিরহে ব্যাকুল যক্ষ চেতন অচেতন ভেদজ্ঞান হারিয়ে মেঘকে দ্যুত করে অলকা নিবাসী তাঁর প্রিয়ার উদ্দেশ্যে বার্তা পাঠাবার জন্য উন্মুখ হয়ে উঠলেন।
মেঘদূত কাব্যের দুটি খণ্ড—পূর্বমেঘ ও উত্তর মেঘ। রবীন্দ্রনাথ তাঁর নববর্ষ প্রবন্ধে এই দুটি খণ্ডের অপূর্ব তাৎপর্য ব্যাখ্যা করে বলেছেন: “পূর্ব মেঘে বহু বিচিত্রের সহিত সৌন্দর্যের পরিচয় এবং উত্তর মেঘে সেই এদের সহিত আনন্দের সম্মিলন।” শুধু সৌন্দর্যে বা আলংকারিক নৈপুণ্য নয়, এ কাব্যে অনুভূতির গভীরতাও লক্ষণীয়—বিরহী প্রেমিকের ‘চিত্তদীর্ণ তীব্র ব্যাকুলতার’ এমন অপরূপ প্রকাশ বিশ্ব সাহিত্যে বিরল। এছাড়া কাব্যটি নিসর্গ বর্ণনার একটা অনন্য সম্পদ। কাব্যটি পুরোটাই মন্দাক্রান্ত ছন্দে বর্ণিত হওয়ায় বিশেষ সৌন্দর্য সম্পাদিত হয়েছে। প্রেম কাব্য—মানব মানবীর মিলনের আকুতিভরা বিরহ কাব্যরূপে কালিদাসের ‘মেঘদূত’ বিশ্বসাহিত্যে অদ্বিতীয়।
ঋতুসংহার- হয় সর্গে বিভক্ত ১৫৩টি শ্লোকে বিরচিত এ কাব্যে ছয় ঋতুর বর্ণনা দেওয়া হয়েছে। একাব্যে কালিদাস ছয় ঋতুর বর্ণনায় সূক্ষ্ম পর্যবেক্ষণ শক্তির পরিচয় দিয়েছেন। এবং ভারতীয় কবি সুলভ প্রকৃতি প্রীতিরও পরিচয় দিয়েছেন। কিন্তু তাঁর আসল উদ্দেশ্য প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক নির্ণয়। এক একটি ঋতুর আবির্ভাব নিসর্গলোকে এবং সেই সঙ্গে মানুষের মনোরাজ্যে যে বিপুল পরিবর্তন আনে কালিদাস তারই চিত্র এঁকেছেন। একাব্য সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ যথার্থই বলেছেন : “যৌবনাবেশ বিধুর কালিদাস ছয় ঋতুর ছয় তারে নরনারীর প্রেম কী কী সুরে বাজিতে থাকে তাহাই বর্ণনা করিয়াছেন, তিনি বুঝিয়েছেন জগতে ঋতু আবর্তনের সর্বপ্রধান কাজ প্রেম জাগানো, ফুল ফুটানো প্রভৃতি সমস্তই তাহার অনুষঙ্গ।” অর্থাৎ কবি প্রেম ও প্রকৃতির যে সহজ এবং সঠিক বর্ণনা এ কাব্যে দিয়েছেন তা অন্যত্র দুর্লভ। তবে সংস্কৃত কাব্যে ঋতু সংহারের বিশেষ প্রভাব না থাকলেও পরবর্তী মধ্যযুগীয় বাংলা কাব্যে বারমাস্যার মধ্যে এর প্রভাব অনুমান করা চলে।
অতএব স্বীকার করতেই হয়, কিংবদন্তী প্রচলিত কালিদাস ‘মহামূখ’। সরস্বতীর বরে তিনি পরবর্তী জীবনে বিশেষ কবি ও নাট্যকার রূপে স্বীকৃতি পায়, হ্যাঁ, দৈব আশীষ ছাড়া এমন প্রতিভার অধিকারী হওয়া অসম্ভব। মূর্খ কালিদাস থেকে কবি কালিদাসে উত্তীর্ণ হয়ে তিনি যা দিয়ে গেছেন সংস্কৃত সাহিত্য তথা সমগ্র বিশ্ব সাহিত্যে তাঁর নিকট চিরঋণী হয়ে থাকবেন।
Leave a comment