কাব্যের আত্মা কী? ভারতীয় কাব্যতত্ত্বে এই প্রশ্নটি বিভিন্ন সময়ে মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। তবে এই প্রশ্নের সম্মুখীন হয়ে আলংকারিকগণ আপন মতবাদ পোষণ করতে বিলম্ব করেনি। যেমন অলংকারশাস্ত্রের প্রথম প্রবক্তা হলেন—আচার্য ভরত, তারপর একে একে আচার্য ভামহ, আচার্য দণ্ডী, আচার্য বামন, আচার্য কুণ্ডক, আচার্য মম্মট ভট্ট, আচার্য আনন্দবর্ধন, আচার্য অভিনব গুপ্ত, বিশ্বনাথ চক্রবর্তী প্রভৃতি আলংকারিকগণ নিজ নিজ মতামত পোষণ করেছেন। উক্ত প্রবক্তাগণ যে সকল মতবাদ প্রবর্তন করেছে তাদের মধ্যে প্রধান হল কাব্যং গ্রাহাখলংকারাৎ, রীতিরাত্মা কাব্যস্য, বক্রোক্তি কাব্যজীবিতম, ধ্বনিরাত্মা কাব্যস্য, বাক্যং রসাত্মকং কাব্যম্ ইত্যাদি। এই সকল মতবাদে কোথাও অলংকারকে, কোথাও বাচ্যাতিরিক্ত ব্যঞ্জনাকে, কোথাও রীতিকে, কোথাও ধ্বনিকে আবার কোথাও রসকে কাব্যের ক্ষেত্রে প্রধান রূপে গণ্য করা হয়েছে। তবে এ বিষয়ে ধ্বনিবাদীরা যে বিচার বিশ্লেষণাত্মক মন্তব্য করেছেন, এ বিষয়ে একালের অন্যতম রসজ্ঞ সমালোচক মনীষী অতুল গুপ্ত বলেন—“কাব্য সম্বন্ধে তার চেয়ে খাঁটি কথা কোনো দেশে কোনো কালে আর কেউ বলেনি।”
এটা সর্বজনস্বীকৃত উক্ত মতবাদগুলির কোনোটাই একেবারে বর্জনীয় নয়। কাব্য নির্মাণে এদের প্রত্যেকটির উপযোগিতা স্বীকৃত হয়ে থাকে। যেমন আচার্য সম্মট ভট্ট তাঁর কাব্যালংকার গ্রন্থে বলেছেন—’কাব্যস্য শব্দার্থের শরীরং’, রসাদিশ্চাত্মা…” এখানে রসকে কাব্যের আত্মরূপে স্বীকৃত দান করলেও পশ্চাতে শব্দার্থ, গুণ, দোষ, রীতি বা অলংকার কোনোটাকেই অগ্রাহ্য করা হয় নি। এই কথার প্রতিধ্বনি বেজে উঠেছে আচার্য বিশ্বনাথ কবিরাজের কণ্ঠে, এককথায় বলতে গেলে তিনি তাঁর ‘সাহিত্য দর্পণ’ গ্রন্থে কাব্যতত্ত্ব বিষয়ে চরম কথাটি বলেছেন—’কাব্যং রসাত্মকং কাব্যং’ এখানেও রসকে কাব্যের আত্মারূপে গ্রহণ করা হয়েছে। লক্ষণীয় উক্ত দুটি মতবাদে কোথাও ধ্বনির কথা উল্লেখ করা হয়নি। বস্তুত ধ্বনির সঙ্গে রসের এমন অঙ্গাঙ্গী সম্পর্ক এদের একটিকে অপরটির সঙ্গে পৃথক করে দেখা নিষ্প্রয়োজন। কারণ এখানে রস বলতে রসধ্বনিকেই বোঝানো হয়েছে। আর ধ্বনি হল—শব্দ ও অর্থ যখন নিজ প্রাধান্য ত্যাগ করে বাচ্যাতিরিক্ত এক প্রতীয়মান অর্থ প্রকাশ করে, তাকে বলা হয় ধ্বনি।
কোনো কোনো অলংকারের সুকৌশল ব্যবহারে এক বস্তুর দ্বারা অন্য বস্তুর ব্যঞ্জনা বলে ভ্রম হয়। এ বিষয়ে সতর্ক করে দেবার জন্য ধ্বনি, সমাসক্তি ও সংকবালংকারের দৃষ্টান্ত দিয়ে হাসিয়েছেন যে, এদের মধ্যে বাচ্যাতিরিক্ত কোনো ব্যঞ্জনা না থাকায় এগুলিকে ধ্বনিররূপে গ্রহণ করা চলে না। কারণ, ব্যঞ্জনামাত্রই কাব্য নয়, শব্দের ও অলংকারের ব্যঞ্জনা যদি বাচ্যাতিরিক্ত বিষয়ের ব্যঞ্জনা না হয়, তবে তা কাব্য হতে পারে না। অর্থাৎ যেখানে বাচ্যার্থ এবং ব্যঙ্গার্থের যুগপৎ প্রকাশ ঘটে সেই ধ্বনিই শ্রেষ্ঠ ধ্বনি এবং রসধ্বনিই বস্তুত ধ্বনিবাদীরাও কাব্যের আত্মারূপে স্বীকৃতি দান করেছেন রসকেই এবং ধ্বনিকে বলেছেন রসের প্রকাশ, যাবতীয় ধ্বনি পর্যবেক্ষণ ঘটে রসধ্বনিতে। আচার্য অভিনবগুপ্ত মদন ভট্টের পর তার প্রভাব বিষয়ে দুটি শ্লোক উদ্ধার করেছেন। এক—“সেই এক কুসুম ধন্যা যিনি ত্রিলোক জয় করেছিলেন, শম্ভু তার দেহ হরণ করতে পারেননি।” দুই—যিনি কর্পূরের মতো দগ্ধ হয়েও মনে মনে তাঁর গুণ জানাচ্ছেন, সেই অবামবীর্য পুষ্পবন্ধাকে নমস্কার।”—এই দুটি কবিতার কোথাও বাচ্যাতিরিক্ত কোনা ব্যঞ্জনা না থাকায় আচার্য অভিনবগুপ্ত এদের কাব্য বলে স্বীকার করেনি। আলোচ্য প্রবন্ধের লেখক অতুল গুপ্ত অনুরূপ বিষয়ে রবীঠাকুরের কবিতাংশ উদ্ধার করে মন্তব্য করেছেন যে, একই বিষয় থাকা সত্ত্বেও এ কবিতার কাব্যত্ব হচ্ছে এর “করুণ বিপ্রলম্ভের ধ্বনি।”
পঞ্চ শরে দগ্ধ কবি করেছ একি সন্ন্যাসী
বিশ্বময় দিয়েছো তারে ছড়ায়ে
ব্যাকুল তব বেদনা তার বাতাসে ওঠে নিশ্বাসি
অশ্রু তার আকাশে পড়ে গড়ায়ে।
উক্ত তিনটি উদাহরণ থেকে দেখা গেল যে বাচ্য কিংবা কথা নয়, কাব্যের আত্মা ব্যঞ্জনা বা ধ্বনি, এবং এই ধ্বনি বস্তুধ্বনি বা অলংকার ধ্বনি নয়, রসধ্বনি।
সাহিত্য দর্পণকার বিশ্বনাথ কবিরাজ বলেছেন—“কাব্যং রসাত্মকং কাব্যম” উক্তিটি বহুল প্রচলিত হলেও তার পূর্বে ধ্বনি নদী আনন্দবর্ষণ এবং অভিনবগুপ্ত সবাই রসপ্রাধান্যকে স্বীকার করেছেন। অভিনবগুপ্ত রসকে বলেছেন—নিজের আনন্দময় সম্বিতের আস্বাদস্বরূপ। এই রস একপ্রকার লোকোত্তর আনন্দঘন প্রতীক যা একমাত্র সহৃদয় ব্যক্তির চিত্তেই আস্বাদ্যমান। ধ্বন্যালোকে বলা হয়েছে—“পূর্বপরিচিত অর্থ ও রসের যোগে কাব্যত্ব লাভ করে বসন্তের নবকিশলয় খচিত বৃক্ষের মতো নূতন বলে প্রতীয়মান হয়।” অতএব দেখা যাচ্ছে, ধ্বনিবাদীরা ধ্বনিবাত্মাকাব্যস্ব বলে আরম্ভ করলেও উপসংহারে দেখিয়েছেন—কাব্যং রসাত্মকং কাব্যম্।” এর তাৎপর্য কিন্তু ধ্বনি এবং রসের পৃথক কারণ নয় এবং কাব্য যে রসধ্বনিময়, এর আরম্ভ থেকে সমাপ্তি পর্যন্ত বাচ্যাতিরিক্ত ধ্বনিরই প্রকাশ ঘটে এবং তাতেই হয় রসের উদ্বোধন—এই সত্যই এখানে প্রকটিত।
Leave a comment