কমিউনিজম হল এক গুচ্ছ ধারণার সমাহারে সৃষ্ট এক মৌলিক মতাদর্শ। সামাজিক, রাজনীতিক ও আর্থনীতিক বিষয়াদি সম্পর্কে কমিউনিস্ট দৃষ্টিভঙ্গি সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র প্রকৃতির। একেবারে বুনিয়াদি বিচারে কমিউনিজম হল এমন এক মতাদর্শ যার মূল উদ্দেশ্য হল মানুষের মধ্যে সাম্য সৃষ্টি করা। এই উদ্দেশ্যে উপনীত হওয়ার জন্য কমিউনিজমে মূলত ব্যক্তিগত সম্পত্তি ও বাজারি শক্তিসমূহের অবসানের কথা বলা হয়।

মানবজাতির ইতিহাসে সকলের জন্য সুযোগ-সুবিধা ও সাম্য প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে উপযুক্ত উপায়-পদ্ধতির অনুসন্ধান সুদীর্ঘ কালের। কমিউনিজমের তত্ত্ব ও প্রয়োগের কেন্দ্রবিন্দুতে এই উদ্যোগ বা সংগ্রামের কথাই আছে। মানুষের মধ্যে সম্পদের সম বণ্টনের স্বার্থে কমিউনিজমে এমন এক ব্যবস্থা গড়ে তোলার কথা বলা হয় যেখানে ব্যক্তির স্বাধীনতাসমূহ সীমাবদ্ধ থাকবে। আর্থনীতিক বৈষম্যবিযুক্ত এই বিশ্ব দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বিশ্বব্যাপী কমিউনিস্ট শাসনব্যবস্থা গড়ে তোলার কথা বলা হয়। কমিউনিস্ট চিন্তাধারার মতাদর্শ উচ্চমার্গীয়। এ বিষয়ে দ্বিমতের অবকাশ নেই। বিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে কমিউনিস্ট শাসনের নাটকীয় অভ্যুত্থান ঘটেছে। এ বিষয়েও বিতর্ক নেই। এতদসত্ত্বেও পুরো একটি দশক অতিক্রান্ত হতে না হতেই পৃথিবীর অধিকাংশ কমিউনিস্ট শাসনের অবক্ষয় শুরু হয়। কমিউনিজম কীভাবে স্বাধীনতা ও সাম্যের মধ্যে সামঞ্জস্য সাধনের পরিকল্পনা করেছে এবং কেনই বা কমিউনিস্ট ব্যবস্থা এ ক্ষেত্রে সামগ্রিক সাফল্য অর্জন করতে পারেনি সে বিষয়ে আলোচনা করা আবশ্যক।

মার্কস সুনির্দিষ্টভাবে বলেছেন যে, মানুষের ইতিহাস এবং সম্পর্কসমূহ ভিত্তি এবং উপরিসৌধের উপর প্রতিষ্ঠিত। বনিয়াদ হল আর্থনীতিক উৎপাদন ব্যবস্থা বা উৎপাদনের উপায়সমূহের ব্যবস্থা এবং ফলশ্রুতি সম্ভৃত শ্রেণী সম্পর্কসমূহের প্রকৃতি বা উৎপাদন সম্পর্ক। এই বনিয়াদের উপরই উপরিকাঠামো গড়ে উঠে। মানুষের সকল প্রতিষ্ঠানই উপরিকাঠামোর অন্তর্ভুক্ত। এ ক্ষেত্রে উদাহরণ হিসাবে উল্লেখযোগ্য হল: রাজনীতি, রাষ্ট্র, ধর্ম, সংস্কৃতি, জাতীয় সত্তা, সরকারের কাঠামো প্রভৃতি সব কিছুই। মার্কসের মতানুসারে উপরিকাঠামো হল প্রতিষ্ঠানসমূহের এক ব্যবস্থা। বিদ্যমান ব্যবস্থাকে সমর্থন ও স্থায়ী করাই হল এর উদ্দেশ্য। আর্থনীতিক প্রেক্ষিত অনুসারেই মার্কস বিশ্বকে সম্যকভাবে অনুধাবনের কথা বলেছেন। বিত্তবান ও বিত্তহীনদের মধ্যে সম্পর্কের প্রকৃতি অনুসারেই মানুষের যাবতীয় কাজকর্ম সম্পাদিত হয়। মার্কসের মতানুসারে কাঠামো সমূহই ইতিহাস সৃষ্টি করে, জনগণ বা ধারণাসমূহ নয়।

স্বভাবতই মার্কস উদারনীতিক গণতন্ত্রকে বাতিল করে দিয়েছেন। শোষিত মানবগোষ্ঠীকে প্রতারিত করারই এক ব্যবস্থা হল এই উদারনীতিক গণতন্ত্র। শোষিত শ্রমজীবী জনগোষ্ঠীকে প্রবঞ্চিত করার জন্যই উদারনীতিক গণতন্ত্রে বলা হয় যে, তারা তাদের রাজনীতিক ভাগ্য নির্ধারণ করতে পারে। অথচ বাস্তবে বিত্তবানেরাই রাজনীতিকে নিয়ন্ত্রণ করে। মানুষ ভ্রান্ত চেতনার শিকার হয়। মানুষ মনে করে যে তারা তাদের চারপাশের দুনিয়ার প্রকৃত প্রকৃতিকে জানে। কিন্তু বাস্তবে তারা উপরিকাঠামোর দ্বারা প্রতারিত হয়। এই উপরিকাঠামো পুঁজিবাদের চাপিয়ে দেওয়া ব্যবস্থা।

কমিউনিজম হল একটি সামগ্রিক বিশ্ববীক্ষা। কমিউনিজম মানব ইতিহাসের গতিধারা ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করে। আর্থনীতিক মিথস্ক্রিয়ার পরিণামে মানব ইতিহাসের এক কাল্পনিক স্তরে উত্তরণের অপরিহার্যতার কথাও কমিউনিজমে বলা হয়। এই মতাদর্শ অসংখ্য মানুষকে মুগ্ধ, প্রভাবিত ও পরিচালিত করেছে। মার্কসবাদকে প্রয়োগের ক্ষেত্রে যাঁরা অগ্রণী ও নেতৃত্বমূলক ভূমিকা গ্রহণ করেছেন তাঁদের উপর এই মতাদর্শের প্রভাব অপরিসীম বা সামগ্রিক। এ ক্ষেত্রে দুটি নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য: লেনিন (Vladimir Ulyanov Lenin) এবং মাও জেদং (Mao Zedong)। ১৯১৭ সালে রুশ কমিউনিস্ট বিপ্লবে নেতৃত্ব দিয়েছেন লেনিন এবং ১৯৪৯ সালে চীনের কমিউনিস্ট বিপ্লবে নেতৃত্ব দিয়েছেন মাও। লেনিন এবং মাও দুজনেই প্রথম সারির মার্কসবাদী। দুজনেই কিন্তু দুটি পৃথক দেশে কমিউনিস্ট আন্দোলন সংগঠিত করার ক্ষেত্রে অনেকাংশে ধ্রুপদী মার্কসবাদী ধারণা থেকে সরে এসেছেন। লেনিনের রাশিয়া বা মাও-এর চীন মোটেই শিল্পোন্নত পুঁজিবাদী রাষ্ট্র ছিল না। সমকালীন রাশিয়া ও চীন ছিল কৃষিপ্রধান সামন্ততান্ত্রিক রাষ্ট্র। মার্কস কিন্তু ভবিষ্যৎবাণী করেছিলেন এবং যুক্তি দিয়ে ব্যাখ্যা করেছিলেন যে, যেখানে এবং যখন পুঁজিবাদ বিকাশের চূড়ান্ত পর্যায়ে উপনীত হবে, সেখানে এবং তখন সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব সংঘটিত হবে। কারণ সেখানে এবং তখন পুঁজিবাদের পতনের প্রবণতার সৃষ্টি হবে। লেনিন এবং মাও বিশ্বাস করতেন যে, কম উন্নত দেশে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব সংঘটিত হওয়া সম্ভব। তবে সে ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট কমিউনিস্ট নেতৃবর্গকে প্রোলেতারিয়েতদের একটি অগ্রগামী বাহিনী গড়ে তুলতে হবে। সুতরাং এ বিষয়ে মার্কসের মূল অবস্থানকে ভ্রান্ত প্রতিপন্ন করে বাস্তবে কমিউনিজমের বিকাশ ও বিস্তার ঘটেছে সেই সমস্ত দেশে, যেখানে আর্থনীতিক উন্নয়নের মান বা স্তর অপেক্ষাকৃত নিম্ন। শিল্পোন্নত দেশগুলিতে কমিউনিজম বিকশিত হওয়ার পথ করতে পারেনি। সেভিয়েত ইউনিয়ন ও গণ প্রজাতন্ত্রী চীনের সাহায্য-সহযোগিতায় অধিকাংশ কম উন্নত দেশসমূহে কমিউনিজমের বিকাশ ও বিস্তার ঘটেছে। বিংশ শতাব্দীর আশির দশকের মধ্যেই বিশ্বের মোট জনসংখ্যার প্রায় এক-তৃতীয়াংশ কমিউনিস্ট শাসনাধীনে চলে আসে। কিন্তু জীবনের শেষের দিকে এসে এ বিষয়ে মার্কস তাঁর পুবর্তন অবস্থান থেকে অনেকাংশে সরে এসেছেন এবং বলেছেন যে, কম উন্নত রাশিয়াতেও সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব সংঘটিত হওয়ার সম্ভাবনা আছে।

কমিউনিজমের প্রয়োগ প্রসঙ্গে বা কীভাবে কমিউনিজম গড়ে তুলতে হবে, সে বিষয়ে ধ্রুপদী মার্কসবাদে কোন রকম পরিপূর্ণ পরিকল্পনা প্রদান করা হয় নি। স্বভাবতই কমিউনিস্ট দুনিয়ার বিভিন্ন দেশে গড়ে উঠা আর্থ-রাজনীতিক ব্যবস্থাসমূহের উল্লেখযোগ্য পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়। এই পার্থক্যের পিছনে বিবিধ কারণের ক্রিয়া বর্তমান। সংশ্লিষ্ট কারণগুলি হল: ঐতিহাসিক পটভূমি; অভ্যন্তরীণ আর্থনীতিক ও রাজনীতিক পরিস্থিতি পরিমণ্ডল; জীবনধারাগত উপাদানসমূহ; ক্ষমতাসীন শাসকগোষ্ঠীর ধ্যান-ধারণা ও কর্তৃত্ব প্রভৃতি। সংশ্লিষ্ট পার্থক্যসমূহের অস্তিত্ব সত্ত্বেও কমিউনিস্ট দুনিয়ার অধিকাংশ দেশ কতকগুলি বুনিয়াদি সমাজতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানকে গ্রহণ করেছে। প্রসঙ্গত উল্লেখ করা আবশ্যক যে, সংশ্লিষ্ট সমাজতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানসমূহ প্রথম গড়ে উঠেছে বিপ্লবোত্তর সোভিয়েত ইউনিয়নে।

কমিউনিস্ট রাষ্ট্রসমূহ মানবিক সম্পর্কসমূহকে মৌলিকভাবে নতুন রূপে পুনর্গঠিত করতে চায়। স্বভাবতই কমিউনিস্ট রাষ্ট্রগুলি উচ্চস্তরের স্বাতন্ত্র্য ও সামর্থ্যসম্পন্ন হয়ে দাঁড়ায়। কমিউনিস্ট রাষ্ট্রগুলি মানুষের কর্মক্ষেত্রের, আধ্যাত্মিক ক্ষেত্রের, নারী-পুরুষ ও পারিবারিক সম্পর্কসমূহের, শিল্প-সাহিত্যের — সংক্ষেপে জনজীবনের সকল ক্ষেত্রের বুনিয়াদি মানবিক প্রতিষ্ঠানসমূহের রূপান্তর সাধনে সক্রিয় হয়। তার ফলে কর্তৃত্ববাদী (authoritarian) কমিউনিস্ট শাসন অনেক সময় সর্বাত্মক (Totalitarian) শাসনে পরিণত হয়। কমিউনিস্ট শাসনের এই রূপান্তর সাধনের দায়িত্ব কমিউনিস্ট এলিটদের উপর বর্তায়। কমিউনিস্ট এলিটরাই রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার উচ্চপদে আসীন হন এবং রাষ্ট্র পরিচালনার লাগাম হাতে রাখেন। চূড়ান্ত রাজনীতিক ক্ষমতা কমিউনিস্ট পার্টির হাতেই ন্যস্ত। কমিউনিস্ট পার্টি হল অপেক্ষাকৃত ছোট আকারের এক অগ্রগামী সংগঠন। প্রাপ্ত এক পরিসংখ্যান অনুযায়ী সাধারণত দেশের মোট জনসংখ্যার দশ শতাংশের কম মানুষকে নিয়ে এই সংগঠনটি গড়ে উঠে। কমিউনিস্ট পার্টির ক্ষমতা ও কার্যাবলীর বিস্তৃত পরিধি এবং ভূমিকার কর্তৃত্ব দেশের সংবিধানে লিখিতভাবে স্বীকৃত ও সংরক্ষিত থাকে। মানব ইতিহাস ও ভবিষ্যৎ সম্পর্কসমূহের ব্যাপারে কমিউনিস্ট পার্টির ভাষ্যই হল সংবিধান স্বীকৃত সঠিক ভাষ্য। নাগরিক সমাজের অন্য সকল বিকল্প সংগঠন মতাদর্শকে কমিউনিজমের বিরোধী বলে মনে করা হয় এবং দমন করা হয়। কমিউনিস্ট পার্টি ব্যতিরেকে অন্য কোন রাজনীতিক সংগঠনের অস্তিত্বকে সাংবিধানিকভাবে স্বীকার করা হয় না। সুতরাং কমিউনিস্ট পার্টিকে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা থেকে অপসারণ করার সংবিধান স্বীকৃত কোন সুযোগ থাকে না।

কমিউনিস্ট পার্টি কেবল বলপ্রয়োগের মাধ্যমে তার কর্তৃত্ব কায়েম রাখে, এমন নয়। কারণ কর্তৃত্ববাদী কোন শাসনই নিছক ক্ষমতার ভীতি প্রদর্শনের মাধ্যমে ক্ষমতাসীন থাকতে পারে না। কমিউনিস্ট পার্টি সমগ্র সমাজের উপর প্রশ্নাতীত নিয়ন্ত্রণ কায়েম রাখার জন্য শুধুমাত্র পীড়নমূলক প্রক্রিয়ার উপর নির্ভর করে না। দেশব্যাপী বিভিন্ন স্তরের রাজনীতিক, আর্থনীতিক ও সামাজিক-সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানসমূহের হাতে সতর্কতার সঙ্গে ক্ষমতাকে ছড়িয়ে রাখা হয়। সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান বা সংগঠনসমূহের সদস্যদের নিযুক্ত বা নির্বাচিত করা হয় কমিউনিস্ট পার্টির অনুগত সদস্যদের ভিতর থেকে। রাষ্ট্রীয়, সামাজিক ও আর্থনীতিক ক্ষেত্রে সংবেদনশীল এবং প্রভাব-প্রতিপত্তিশালী পদসমূহে নিয়োগের ক্ষেত্রে বাছাই ও নিয়োগের বিষয়টি কমিউনিস্ট পার্টির অনুমোদন সাপেক্ষ।

সংশ্লিষ্ট নিয়োগের ব্যাপারে বাছাই করা ব্যক্তিদের নামের তালিকা প্রস্তুতকরণের প্রক্রিয়াটি কমিউনিস্ট রাষ্ট্রসমূহে ‘nomenklatura’ হিসাবে সুপরিচিত। নামের তালিকা প্রস্তুতকরণের এই প্রক্রিয়ার এক্তিয়ারভুক্ত থাকে বহু ও বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদাধিকারীর পদ। এ ক্ষেত্রে উদাহরণ হিসাবে উল্লেখযোগ্য হল: শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহের প্রধান, সামরিক বাহিনীর আধিকারিক, সংবাদ পত্রের সম্পাদক প্রভৃতি তাৎপর্যপূর্ণ পদসমূহ। এই সমস্ত পদে নিযুক্ত হওয়ার জন্য কমিউনিস্ট পার্টির অনুমোদন লাগে। এই অনুমোদন পাওয়ার জন্য পার্টির সদস্যপদ আবশ্যক। বাহ্যিক কাঠামোগত বিচারে পৃথিবীর অন্যান্য দেশের রাজনীতিক ব্যবস্থার সঙ্গে কমিউনিস্ট দেশসমূহের রাজনীতিক ব্যবস্থার সাদৃশ্য পরিলক্ষিত হয়। রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, পার্লামেন্ট, আদালত, স্থানীয় শাসন প্রভৃতি গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার সবকিছুই কমিউনিস্ট শাসনব্যবস্থায় বর্তমান থাকে। কিন্তু সকল সরকারি প্রতিষ্ঠানের পদাধিকারিদের পদ ‘নোমেনক্লাচারা’ (nomenklatura) প্রক্রিয়ার এক্তিয়ারভুক্ত স্বভাবতই কমিউনিস্ট পার্টির সদস্যরাই সকল সরকারী পদে নিযুক্ত হওয়ার সুযোগ পান। প্রকৃত প্রস্তাবে কমিউনিস্ট রাষ্ট্রসমূহে ব্যক্তিগত কর্মজীবনে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠার জন্য পার্টির সদস্যপদ এবং পার্টির প্রতি প্রশ্নাতীত আনুগত্য আবশ্যক। কেবল কেরিয়ারের উন্নতির বিষয় নয়, জাগতিক ও বিবিধ সুখ-সমৃদ্ধি সুনিশ্চিতকরণের ক্ষেত্রেও পার্টির সদস্যপদ সূত্রে পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধা পাওয়া যায়। স্বভাবতই মতাদর্শগত আনুগত্যের পরিবর্তে বৈষয়িক লাভালাভের বিচার-বিবেচনার দ্বারা পরিচালিত হয়ে অসংখ্য সুযোগ সন্ধানী মানুষ কমিউনিস্ট পার্টির সদস্যপদ পাওয়ার জন্য সর্বপ্রকারে উদ্যোগী হয়। এ বিষয়ে মিখায়েল বসলেনস্কি (Michael Voslensky) তার Nomenklatura: Anatomy of the Soviet Ruling Class শীর্ষক গ্রন্থে বিস্তারিতভাবে আলোচনা করেছেন।

বিভিন্ন ধরনের রাজনীতিক ব্যবস্থায় ক্ষমতা-সম্পর্ক (power relationship) বিভিন্ন রকমের হয়। গণতান্ত্রিক এবং অন্যান্য অনেক রকমের কর্তৃত্ববাদী রাজনীতিক ব্যবস্থায় ক্ষমতা-সম্পর্ক ভিন্ন ভিন্ন ধরনের হয়। কমিউনিস্ট শাসনব্যবস্থায় কমিউনিস্ট পার্টি ও নোমেনক্লাচারা (nomenklatura)-এর প্রাধান্যমূলক ভূমিকার কারণে কমিউনিস্ট শাসনব্যবস্থায় পৃথক প্রকারের ক্ষমতা সম্পর্ক পরিলক্ষিত হয়। এ ক্ষেত্রে প্রকৃত ক্ষমতা রাষ্ট্র বা সরকারের হাতে থাকে না; থাকে কমিউনিস্ট পার্টির হাতে। সংসদীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার মতই কমিউনিস্ট শাসনব্যবস্থাতেও নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের নিয়ে আইনসভা গঠিত হয়। নিয়ম-মাফিক নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় বটে, কিন্তু সাধারণত অধিকাংশ ক্ষেত্রেই নির্বাচনের সামিল সকল প্রার্থীই হল একমাত্র কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য। তার ফলে সঠিক বিচারে কোন রকম নির্বাচনী প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয় না। তাছাড়া আইনসভা ও ক্ষমতার অন্যান্য অঙ্গসমূহ অনেকাংশে রাবার স্টাম্পের মত প্রতিষ্ঠান হিসাবে ভূমিকা পালন করে। ক্রমোচ্চ স্তরবিন্যস্ত কমিউনিস্ট পার্টির বিভিন্ন স্তরে পার্টি সংগঠনের কাছ থেকে পাওয়া সিদ্ধান্তসমূহকে সরকারী প্রতিষ্ঠানগুলি বাস্তবে বলবৎ করে। পার্টির শীর্ষস্থানীয় কোন নেতা সাধারণত গুরুত্বপূর্ণ কোন রাষ্ট্রীয় পদে আসীন থাকেন না। কিন্তু পার্টির এবং সরকারের উপর কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদকের একচ্ছত্র আধিপত্য প্রশ্নাতীত।

কমিউনিস্ট শাসিত রাষ্ট্রে কমিউনিস্ট পার্টি পরিকল্পিতভাবে নানা পথে রাষ্ট্রব্যবস্থাকে প্রতিপন্ন করার চেষ্টা করে। পার্টির সাধারণ সম্পাদক প্রশাসনিক প্রধান হিসাবে ভূমিকা পালন করেন। পার্টির ‘পলিটব্যুরো’ (Politburo) ক্যাবিনেট হিসাবে এবং ‘কেন্দ্রীয় কমিটি’ (Central Committee) আইনসভার ন্যায় জাতীয় নীতি নির্ধারণ এবং পার্টির নেতাদের সিদ্ধান্তসমূহকে পাকাপাকিভাবে স্বীকৃতি প্রদানের ব্যবস্থা করে। কেন্দ্রীয় কমিটির নিচে থাকে বিভিন্ন স্তরের পার্টি সংগঠনসমূহ। প্রতিটি কর্মক্ষেত্র এবং আবাসনক্ষেত্র অবধি পার্টির সংগঠন ছড়িয়ে থাকে। বুনিয়াদি পর্যায়ের পার্টি সংগঠনকে ‘সেল’ (Cell) বলা হয়। প্রাথমিক পর্যায়ে সেলের মধ্যে পার্টির সদস্যরা সংগঠিত হয়। প্রচলিত প্রথা অনুযায়ী নির্দিষ্ট সময় অন্তর পার্টি কংগ্রেস অনুষ্ঠিত হয়। পার্টি সেলসমূহ থেকে আসা প্রতিনিধিরাই পার্টি কংগ্রেসে পার্টির শীর্ষস্থানীয় নেতাদের নির্বাচিত করেন। তবে সাধারণত পার্টির বিভিন্ন পদাধিকারীদেরই পুনরায় অনুমোদন করা হয়। এইভাবে কমিউনিস্ট পার্টিতে অনন্যসাধারণ মহিমান্বিত নেতার আবির্ভাব ঘটে। এঁদের মধ্যে কেউ কেউ কমিউনিজমের ভবিষ্যদ্বক্তা হিসাবে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করেন। এ ক্ষেত্রে উদাহরণ হিসাবে লেনিন, মাও, স্তালিন ও কাস্ত্রোর নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। আবার ব্যক্তিপূজার প্রক্রিয়ার মাধ্যমে কোন কোন কমিউনিস্ট নেতা নিজেদের মহিমান্বিত করেছেন।

কমিউনিজম মূলত মার্কসের মতাদর্শের উপর প্রতিষ্ঠিত এবং লেনিন কর্তৃক গৃহীত ও বিকশিত হয়েছে। কমিউনিস্ট মতাদর্শ প্রধানত অসাম্যের অবসান ও আর্থনীতিক উন্নয়নের উপর সর্বাধিক গুরুত্ব আরোপ করে। কমিউনিস্ট পার্টি এবং পার্টির নোমেনক্লেচার’ (nomenklatura) গুরুত্বপূর্ণ সংগঠনসমূহকে নিয়ন্ত্রণ করে। অপরদিকে কমিউনিস্ট মতাদর্শ নীতি নির্ধারণ করে এবং কর্তৃত্ববাদী নিয়ন্ত্রণকে বৈধ প্রতিপন্ন করে।

কমিউনিস্ট রাজনীতিক অর্থনীতি

কমিউনিস্ট রাজনীতিক অর্থনীতিতে যে সমস্ত প্রতিষ্ঠান ও নিয়ম নীতির কথা বলা হয়, তা উদারনীতিক, বাণিজ্যিক বা সামাজিক গণতান্ত্রিক বিকল্প ব্যবস্থাসমূহের আর্থনীতিক প্রতিষ্ঠান ও নিয়ম-নীতির থেকে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র। কারণ কমিউনিস্ট রাজনীতিক অর্থনীতিতে বাজার এবং সম্পত্তিকে রাষ্ট্র অনিবার্যভাবে পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণাধীনে রাখে। কমিউনিস্ট ব্যবস্থায় ব্যক্তিগত সম্পত্তির অবসানের সঙ্গে সঙ্গে বাজার ব্যবস্থাকেও বাদ দেওয়া হয়। কারণ মনে করা হয় যে, বাজার ব্যবস্থার মাধ্যমে সম্পদের সমবণ্টন সুনিশ্চিত করা সম্ভব নয়। কমিউনিস্ট ব্যবস্থায় ব্যক্তিবর্গ সম্পত্তিকে নিয়ন্ত্রণ করার অধিকার হারায়। নিজেদের শ্রমকেও নিয়ন্ত্রণ করার অধিকার মানুষের হাতে থাকে না। কীভাবে শ্রম ও সম্পদ ব্যবহৃত হবে, সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে কমিউনিস্ট পার্টি ও রাষ্ট্র। উৎপাদনের উৎসসমূহ রাষ্ট্রের হাতে থাকে। তার ফলে পুঁজিবাদের বেশ কিছু বিষয় অপসারিত হয়। এ ক্ষেত্রে উদাহরণ হিসাবে ব্যক্তিগত মুনাফা, বেকারত্ব, উৎপাদক প্রতিষ্ঠানসমূহের মধ্যে প্রতিযোগিতা প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য।

কমিউনিস্ট রাজনীতিক অর্থনীতিতে কমিউনিস্ট নেতারা জাতীয় সম্পদকে সমষ্টিগত সাম্যের লক্ষ্যে পরিচালিত করেন। এ ক্ষেত্রে উপায় হিসাবে শিল্পায়ন ও সামাজিক ব্যয়সমূহের পথ অবলম্বন করা হয়। কমিউনিস্ট রাষ্ট্রসমূহ সাধারণত বাজার ব্যবস্থাকে বাতিল করে দিয়ে রাষ্ট্রীয় আমলাতান্ত্রিক ব্যবস্থা অবলম্বন। করে। রাষ্ট্রীয় আমলাতান্ত্রিক সুনিয়ন্ত্রিত পরিকল্পনার মাধ্যমে সম্পদসমূহের বিনিয়োগ ও বণ্টনের ব্যবস্থা করা হয়। এই পরিকল্পনাকে বলা হয় কেন্দ্রীয় পরিকল্পনা (Central Planning)। রাষ্ট্রীয় আমলাতান্ত্রিক ব্যবস্থার মাধ্যমে নির্ধারিত হয় কী উৎপাদন করা হবে। উৎপাদনের পরিমাণ কী হবে? উৎপাদিত দ্রব্যসামগ্রীর দাম কী হবে? এবং কোথায় সংশ্লিষ্ট দ্রব্যসামগ্রী বিক্রয় করা হবে?

কেন্দ্রীয় পরিকল্পনা ব্যবস্থার মাধ্যমে কমিউনিস্ট রাষ্ট্রে আর্থনীতিক ক্ষমতার অতিরিক্ত কেন্দ্রীকরণ বিবিধ সমস্যার সৃষ্টি করে। মার্কসীয় মতবাদে সংশ্লিষ্ট সমস্যাদি সম্পর্কে আগাম কোন আশঙ্কা করা হয় নি। প্রসঙ্গত উল্লেখ করা আবশ্যক যে, স্তালিনের আমলে সোভিয়েত ইউনিয়নে এবং মাও-এর আমলে গণ-প্রজাতন্ত্রী চীনে ক্ষমতার মাত্রাতিরিক্ত কেন্দ্রীভবনের জন্য কমিউনিস্ট পার্টিকে একমুখী পথে পরিচালিত করা হয়েছিল। তার ফলে পার্টির ক্ষমতার ব্যাপক অপব্যবহারের ঘটনা ঘটেছিল। কেন্দ্রীয় পরিকল্পনার মাধ্যমে কমিউনিস্ট রাজনীতিক অর্থনীতির ফলশ্রুতি হিসাবে অনুরূপভাবে বিবিধ প্রতিকূল প্রভাব-প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়। ১৯৫৯ ‘৬১ সালে গণ-প্রজাতন্ত্রী চীনে ‘Great Leap Forward’ নামে চিহ্নিত কর্মসূচীর মাধ্যমে সত্বর শিল্পায়ন ও কৃষিতে যৌথ মালিকানা ব্যবস্থা প্রবর্তনের পরিকল্পনা কার্যকর করার ব্যবস্থা করা হয়। প্রাপ্ত এক পরিসংখ্যান অনুযায়ী, তার ফলে দুর্ভিক্ষে প্রায় তিন কোটি মানুষের মৃত্যু হয়। সমাজবিজ্ঞানী দালি ইয়াং (Dali Yang) তার Calamity and Reform in China: Rural Society and Institutional Change Since the Great Leap Famine-শীর্ষক রচনায় এ বিষয়ে বিস্তারিতভাবে আলোচনা করেছেন।

কমিউনিস্ট রাজনীতিক অর্থনীতি এবং বাজার অর্থনীতির মধ্যে বিস্তর ব্যবধান বর্তমান। বাজার অর্থনীতি চাহিদা-যোগানের পারস্পরিক সম্পর্কের পরিপ্রেক্ষিতে পরিচালিত। বাজার অর্থনীতির গতিবিধি স্বতঃস্ফূর্ত ও বিকেন্দ্রীভূত। তদনুসারে কোন একটি দ্রব্যসমাগ্রীর যদি বাজার থাকে, তা হলে মুনাফা লাভের আশায় উৎপাদকরা সংশ্লিষ্ট দ্রব্যসমাগ্রী উৎপাদনে বিনিয়োগ করবে। কিন্তু কমিউনিস্ট রাজনীতিক অর্থনীতি হল কেন্দ্রীয়ভাবে পরিকল্পিত অর্থনীতি। এ ধরনের আর্থনীতিক ব্যবস্থায় রাষ্ট্রীয় আমলারাই সকল পণ্যসামগ্রীর উৎপাদন, উৎপাদনের পরিমাণ, মান প্রভৃতি সব কিছুই নির্ধারণ করেন। কিন্তু একটা দেশের সমগ্র অর্থনীতির সম্পূর্ণ পরিকল্পনা করা দুরূহ ব্যাপার, অসম্ভব বললেও অত্যুক্তি হয় না। তারজন্য আবশ্যক বিভিন্ন ক্ষেত্রে অসংখ্য তথ্য ও পরিসংখ্যান।

কমিউনিস্ট রাজনীতিক অর্থনীতিতে কেন্দ্রীয় পরিকল্পনার সীমাবদ্ধতা কালক্রমে প্রকট হয়ে পড়ে। একটি দেশের সম্পূর্ণ অর্থনীতির সমগ্র উৎপাদন ব্যবস্থার উপকরণ-উপপাদ (inputs-outputs) -এর মধ্যে প্রয়োজনীয় সামঞ্জস্য সাধন পরিকল্পনাকারীদের পক্ষে কার্যত অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়। বহু ও বিভিন্ন ধরনের হাজার হাজার দ্রব্য সমাগ্রীর উৎপাদন অপরিহার্য প্রতিপন্ন হয়। বেশ কিছু দ্রব্যসামগ্রীর উৎপাদন পরস্পরের উপর নির্ভরশীল। একটির উৎপাদন বিঘ্নিত হলে বা একটির উৎপাদনের পরিমাণ প্রয়োজনমাফিক না হলে, সংশ্লিষ্ট উৎপাদনের উপর নির্ভরশীল অন্যান্য পণ্যসামগ্রীর উৎপাদনও ব্যাহত হতে বাধ্য। তার ফলে সামগ্রিক বিচারে দেশের আর্থনীতিক ব্যবস্থায় ভারসাম্যহীনতা দেখা দিতে বাধ্য। এ ক্ষেত্রে উদাহরণ হিসাবে বুনিয়াদি উৎপাদন স্টিলের কথা বলা যায়। আবার স্টিলকে কাঁচামাল হিসাবে ব্যবহার করে এমন সব উৎপাদনের সামগ্রী অন্য একটি সম্পূর্ণ পণ্যের আংশিক উপাদান হিসাবে ব্যবহৃত হতে পারে। প্রকৃত প্রস্তাবে প্রয়োজনীয় বিভিন্ন পণ্যসামগ্রীর সমগ্র উৎপাদন প্রক্রিয়া হল একটি অতিমাত্রায় জটিল ব্যবস্থা। কেন্দ্রীয়ভাবে এর সম্যক পরিকল্পনা এক দুরূহ ব্যাপার। তাছাড়া উৎপাদন ব্যবস্থায় বিবিধ অজানা প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি হওয়ার আশঙ্কা থাকেই। বিভিন্ন কারণে কোন একটি পণ্যের অতি উৎপাদন বা অতি কম উৎপাদন হতে পারে; কোন একটি পণ্যের চাহিদার পরিমাণে বা প্রকৃতিতে রবর্তন হতে পারে; কোন একটি দ্রব্যের উৎপ কারী কলকারখানা হঠাৎ করে বন্ধ হয়ে যেতে পারে—এবংবিধ অসংখ্য প্রতিবন্ধকতার আশঙ্কাকে অস্বীকার করা যায় না।

কমিউনিস্ট রাজনীতিক অর্থনীতির কেন্দ্রীয় পরিকল্পনা ব্যবস্থার আরও সীমাবদ্ধতা আছে। অর্থনীতির বিকাশ বা উন্নতির জন্য প্রতিযোগিতা এবং উৎসাহ-উদ্দীপনা আবশ্যক। অন্যথায় দক্ষতা ও আবিষ্কার অমিল হয়ে পড়বে; অর্থনীতি নিরুদ্দম হয়ে নিশ্চল হয়ে পড়বে। কমিউনিস্ট রাজনীতিক অর্থনীতি এ রকমই সীমাবদ্ধতার শিকার হয়ে পড়ে। কমিউনিস্ট দেশগুলি সাধারণত আর্থনীতিক বিচারে পিছিয়ে পড়ে। কমিউনিস্ট রাজনীতিক আর্থনীতিক ব্যবস্থায় কলকারখানা রাষ্ট্রীয় মালিকানায় থাকে এবং শ্রমিকদের চাকরির নিরাপত্তা থাকে। স্বভাবতই কলকারখানাগুলি দেউলিয়া হওয়ার আশঙ্কা থাকে না এবং শ্রমিকদের বেকার হয়ে পড়ার ভয় থাকে না। আবার শ্রমিকদের কোন রকম উৎসাহ-ভাতা থাকে না। উৎপাদন প্রক্রিয়ায় শ্রমিকদের আন্তরিকতার অভাব দেখা দেয়। আবার কলকারখানাগুলি উৎপাদিত পণ্যের গুণগত মান সম্পর্কে মাথা ঘামায় না। কারণ কেন্দ্রীয় পরিকল্পনাকারীরা প্রতিটি ফ্যাকট্রি-ফার্মের মোট উৎপাদনের একটি কোটা নির্ধারণ করে দেয়। সংশ্লিষ্ট কোটা-পরিমাণ পণ্য উৎপাদন করলেই চলে। প্রতিযোগিতাহীন পরিস্থিতিতে উৎপাদিত দ্রব্যসামগ্রীর গুণগত মানের দিকে নজর দেওয়া হয় না।

কমিউনিস্ট শাসনে সামাজিক প্রতিষ্ঠানসমূহ

কমিউনিস্ট রাজনীতিক ব্যবস্থায় কমিউনিস্ট পার্টির মূল লক্ষ্য হল পুঁজিবাদী ব্যবস্থার সঙ্গে সংযুক্ত অসাম্য ও শোষণের বিলোপসাধন। রাজনীতিক ও আর্থনীতিক ব্যবস্থাদির মাধ্যমে কমিউনিস্ট পার্টি সেই লক্ষ্যে অগ্রসর হয়। আবার ভ্রান্ত চেতনা সৃষ্টিকারী পুরাতন উপরিকাঠামো কমিউনিজমের পরিপন্থী। স্বভাবতই পূর্ববর্তী উপরিসৌধকে ধ্বংস করা আবশ্যক হয়ে দাঁড়ায়। এই কারণে আগেকার আমলের উপরিকাঠামোকে অপসারিত করার ব্যাপারে কমিউনিস্ট শাসকরা উদ্যোগ আয়োজন গ্রহণ করে। এই উদ্দেশ্য সাধনের জন্য মানবিক সম্পর্কসমূহকে পুনর্বিন্যস্ত করার ব্যবস্থা করা হয়।

কমিউনিস্ট মতাদর্শ অনুযায়ী নারী-পুরুষের মধ্যে চলে আসা সুদীর্ঘকালের সাবেকি সম্পর্ক পুঁজিবাদী প্রকৃতির। মার্কসবাদী ভাষ্য অনুযায়ী নারী-পুরুষের সম্পর্ক শ্রেণি সম্পর্কেরই সংক্ষিপ্তসার। কারণ পারিবারিক কাঠামোর মধ্যে মহিলারা পুরুষদের দ্বারা শোষিত হয়। মার্কসীয় দর্শনে সব রকম শোষণের বিরোধিতা করা হয়। বুর্জোয়াদের দ্বারা প্রোলেতারিয়েতদের শোষণের বিরোধিতার মত পুরুষের দ্বারা মহিলাদের শোষণেরও বিরোধিতা করা হয়। নারী-পুরুষের সম্পর্ক বিষয়ক সনাতন ব্যবস্থায় যৌন নৈতিকতার কথা বলা হয়। এই নৈতিকতার উদ্দেশ্য হল নারী-পুরুষের সাবেকি সম্পর্কের মধ্যে বিদ্যমান অসাম্যকে অব্যাহত রাখা। কমিউনিজমের আর্থনীতিক, রাজনীতিক ও সামাজিক সকল ক্ষেত্রেই সম্পূর্ণ সাম্যের কথা বলা হয়।

অধিকাংশ কমিউনিস্ট রাষ্ট্রে মহিলাদের পূর্বাপেক্ষা অধিকতর সুযোগ-সুবিধা প্রদান করা হয়। শিল্পায়নের স্বার্থে কমিউনিস্ট পার্টি নারী শিক্ষার বিকাশের উপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করে এবং শিল্প-কারখানার কাজে মহিলাদের যোগদানের ব্যাপারে উৎসাহিত করে। অনেক দেশে বিবাহ বিচ্ছেদ আইনকে অধিকতর সহজ-সরল করা হয় এবং গর্ভপাত আইন পাস করা হয়। নারীজাতির জন্য সমাজকল্যাণমূলক বিবিধ পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়। ইতিবাচক ও অর্থবহ উদ্যোগ আয়োজন গৃহীত হওয়া সত্ত্বেও কমিউনিস্ট শাসনে নারী-পুরুষের মধ্যে সাবেকি সম্পর্কের পরিবর্তন ঘটেছে নিতান্তই আংশিকভাবে। পার্টি, রাষ্ট্র এবং অর্থনীতির শীর্ষস্থানীয় পদসমূহে মহিলারা আসতে পারে নি; সংশ্লিষ্ট পদসমূহ পুরুষদের অধীনে অব্যাহত। কমিউনিস্ট রাষ্ট্রসমূহে গুরুত্বপূর্ণ অনেক পেশায় মহিলারা যোগ দিয়েছেন। কিন্তু মাত্র হাতে গোনা কয়েকজন তাৎপর্যপূর্ণ রাজনীতিক ও আর্থনীতিক ক্ষমতা ও মর্যাদা অর্জন করতে পেরেছেন। বরং কমিউনিস্ট শাসনে মহিলাদের দায়-দায়িত্ব বিশেষভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। কারণ মহিলাদের সাবেকি গৃহকর্মের দায়দায়িত্বের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে পরিবারের পরিধির বাইরের কাজকর্ম। নতুন সমাজতান্ত্রিক মহিলাদের পরিপূরক হিসাবে নতুন সমাজতান্ত্রিক পুরুষেরা এগিয়ে আসছে না। স্বভাবতই নারী-পুরুষের সাবেকি সম্পর্ক অনেকাংশে অব্যাহত।

কমিউনিস্ট শাসকরা জাতিগত ও জাতপাতের স্বতন্ত্র সত্তাকে পরিবর্তনের ব্যাপারে সক্রিয়ভাবে সচেষ্ট। হয়। কমিউনিজমে জাতিসত্তা, জাতীয়তাবাদ, জাতিগত-ভাগ প্রভৃতিকে উপরিকাঠামোর অংশ হিসাবে বিবেচনা করা হয়। শাসক এলিটরা জাতীয়তাবাদ ও জাতিগত বিভাজনকে হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার করে। এর উদ্দেশ্য হল বিভিন্ন দেশের শ্রমিক শ্রেণীকে পরস্পরের বিরুদ্ধে লড়িয়ে দেওয়া। অর্থাৎ বিভাজন ও শাসনের সেই সাবেকি ব্রিটিশ নীতিকে কার্যকর করাই হল মূল উদ্দেশ্য। কমিউনিজমের ভাষ্য অনুযায়ী বিশ্বব্যাপী কমিউনিস্ট বিপ্লব সংঘটিত হওয়ার পর জাতিসত্তাগত বিভাজনের অবসান ঘটবে এবং দুনিয়াজুড়ে মানবজাতির মধ্যে সম্ভাব, সংহতি ও সাম্যের সৃষ্টি হবে।

কমিউনিস্ট পার্টি জাতীয়তাবাদের প্রকাশ্য প্রচারকে সমর্থন করে না। তবে কমিউনিস্ট রাষ্ট্রেও অপ্রকাশ্যভাবে জাতীয়তাবাদী চেতনার অস্তিত্ব অনস্বীকার্য। এ ক্ষেত্রে উদাহরণ হিসাবে পূর্বতন সেভিয়েত ইউনিয়নের কথা বলা যায়। সমকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নে বহু ও বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর মানুষের বসবাস ছিল। তবে রুশরাই ছিল এককভাবে বৃহত্তম জাতি। সোভিয়েত কমিউনিস্ট পার্টির মধ্যেও প্রাধান্য ও কর্তৃত্ব ছিল রুশদের। রুশদের কর্তৃত্ব ও প্রাধান্যের বিরুদ্ধে অন্যান্য জাতিগোষ্ঠীর অনেক নাগরিকের ধূমায়িত ক্ষোভ ছিল। পূর্ব ইউরোপের কিছু দেশে কমিউনিস্ট শাসনকে রুশ সাম্রাজ্যবাদ হিসাবে গণ্য করা হয়েছে। স্বভাবতই সংশ্লিষ্ট দেশগুলির জনগণের মধ্যে জাতিসত্তার স্বাতন্ত্র্যমূলক চেতনা ক্রমশ ক্ষুরধার হয়েছে। পুর্বতন সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং পূর্ব ইউরোপে কমিউনিজমের পতনের পিছনে অন্যতম কারণ হিসাবে এই ধূমায়িত জাতীয়তাবাদের ভূমিকার কথা বলা যায়।