মার্কসবাদ (Marxism) থেকে সাম্যবাদ (Communism)-এর পতন ও তার তাৎপর্য প্রসঙ্গে ব্যাপক বিতর্ক বর্তমান। এ প্রসঙ্গে একাধিক মতামত বা বক্তব্যের অস্তিত্ব অনস্বীকার্য। একদল রাজনীতিক সমাজবিজ্ঞানীর অভিমত অনুযায়ী ধ্রুপদী মার্কসবাদের রাজনীতিক অভিব্যক্তি হল বিংশ শতাব্দীর সাম্যবাদ। সুতরাং সাম্যবাদ যদি বাতিল হয়ে যায়, তা হলে মার্কসবাদও অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়বে। মার্কসবাদ এক সময় মানব সভ্যতার ইতিহাসের গতিপ্রকৃতির এক নির্ধারক শক্তি হিসাবে পরিগণিত হয়েছে। সাম্যবাদের পতন এই মার্কসবাদের অবসানের সুনিশ্চিত সাক্ষ্য। বিংশ শতাব্দীর পঞ্চাশের ও ষাটের দশকে উদারনীতিক ও রক্ষণশীল মতাদর্শের বিশেষ বিকাশ ঘটে। তারই ভিত্তিতে সাম্যবাদ ও মার্কসবাদের অবসান সম্পর্কিত উপরিউক্ত মতবাদের উদ্ভব ও বিকাশ ঘটে। ঠাণ্ডাযুদ্ধের পরিপ্রেক্ষিতে মার্কসবাদের সামগ্রিকতাবাদী তাৎপর্য তুলে ধরা হয়। অভিযোগ করা হয় যে, লেনিনবাদ ও স্তালিনবাদের মধ্যে মার্কসবাদের এই সর্বাত্মক চেহারা চরিত্রের অভিব্যক্তি ঘটেছে। এ রকম মতবাদের পৃষ্ঠপোষক হিসাবে ফ্রানসিস ফুকুয়ামার নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তিনি তাঁর The End of History শীর্ষক গ্রন্থে এ বিষয়ে বিস্তারিতভাবে আলোচনা করেছেন।
কমিউনিস্ট রাষ্ট্রে কমিউনিস্ট পার্টি একচেটিয়াভাবে ক্ষমতার অধিকার ও প্রয়োগে কৃতকার্য হয়। এ ক্ষেত্রে ‘নোমেনক্লেচার’ (nomenklatura) পদ্ধতি হিসাবে বিশেষভাবে সহায়ক প্রতিপন্ন হয়। কমিউনিস্ট পার্টি রাষ্ট্র ও সমাজকে পুরোপুরি কুক্ষিগত করে নেয়। পরিবার ব্যবস্থা এবং কর্মক্ষেত্রও পাটির কর্তৃত্বাধীনে চলে আসে। ক্ষমতার এই একচেটিয়া ও সর্বগ্রাসী বিস্তার কমিউনিস্ট পার্টির পক্ষে বিপজ্জনক হয়ে দাঁড়ায়। এই কারণে কমিউনিজমের পতনও ত্বরান্বিত হয়। বিরোধীদের বিতাড়ন এবং সর্বাত্মক নিয়ন্ত্রণ কায়েম করার জন্য কমিউনিস্ট শাসকরা ক্ষমতার সন্ত্রাসমূলক প্রয়োগের পথ ধরে। পূর্বতন সোভিয়েত ইউনিয়ন, গণ প্রজাতন্ত্রী চীন এবং পূর্ব ইউরোপে কমিউনিস্ট সন্ত্রাসবাদ কায়েম হয়। হাজার হাজার মানুষের মৃত্যু হয়। বিশেষত স্তালিনের আমলে সোভিয়েত ইউনিয়নে এবং মাও-এর আমলে চীনে অসংখ্য মানুষের জীবনাবসান ঘটে।
সোভিয়েত কমিউনিস্ট পার্টিকে এবং সমগ্র দেশবাসীকে ভীত-সন্ত্রস্ত করে নিয়ন্ত্রণাধীনে নিয়ে আসার জন্য স্তালিন বল্গাহীন সন্ত্রাস কায়েম করেছিলেন। সোভিয়েত কমিউনিস্ট পার্টির বিশোধন কর্মসূচীর নামে তিনি পার্টির অনেক সদস্যকে মনগড়া অভিযোগে অভিযুক্ত করে হত্যা করেছিলেন। ‘দুষ্কৃতি’ ছাপ লাগিয়ে দিয়ে স্তালিন অনেক মানুষের প্রাণহানি ঘটিয়েছিলেন। সমাজবিজ্ঞানী রবার্ট কনকোয়েস্ট (Robert Con quest) তাঁর The Great Terror: A Reassessment শীর্ষক গ্রন্থে এ বিষয়ে বিস্তারিতভাবে আলোচনা করেছেন।
বিংশ শতাব্দীর ষাটের দশকে মাও-এর আমলে গণ-প্রজতন্ত্রী চীনেও অল্পবিস্তর অনুরূপ ঘটনা ঘটে। মাও জেদং সাংস্কৃতিক বিপ্লবের ডাক দেন। কমিউনিস্ট চীনের পূর্ববর্তী আমলের অবশিষ্টাংশের বিরুদ্ধে এবং বিপ্লবী উদ্দীপনারহিত ব্যক্তিবর্গের বিরুদ্ধে সাংস্কৃতিক আন্দোলন সংগঠিত করার ব্যাপারে তিনি জনসাধারণকে, বিশেষত ছাত্র-সম্প্রদায়কে আহ্বান জানান। প্রসঙ্গত উল্লেখ করা আবশ্যক যে মাও এই আন্দোলনের মাধ্যমে সমকালীন চীনের কমিউনিস্ট পার্টি এবং রাষ্ট্রব্যবস্থাকে আঘাত করতে চেয়েছিলেন। কারণ তাঁর ধারণা হয়েছিল যে, পার্টি এবং রাষ্ট্র ইতিমধ্যে অনেকাংশে রক্ষণশীল হয়ে পড়েছে। মাও এমনও আশঙ্কা করছিলেন যে, পার্টি এবং রাষ্ট্র তাঁর ক্ষমতাকে সীমাবদ্ধ করতে চাইছে। এই বৈপ্লবিক আন্দোলনের পরিণামে বিংশ শতাব্দীর সত্তরের দশকে হাজার হাজার মানুষের জীবনহানি ঘটে। ‘প্রতিক্রিয়াশীল’ এই তকমা এঁটে দিয়ে অনেক স্মারক, শিল্পকলা ও গ্রন্থসম্ভারকে ধ্বংস করা হয়।
স্তালিনীয় সর্বাত্মক রাজনীতিক ব্যবস্থার জনক হিসাবে কার্ল মার্কসকে দায়ী করা হয়। এর পিছনে বিবিধ কারণ দেখানো হয়।
-
(ক) মার্কসবাদকে অন্তর্নিহিতভাবে একত্ববাদী বলে মনে করা হয়। মার্কসবাদী আলোচনায় যাবতীয় বিরোধী ধারণাকে বুর্জোয়া মতাদর্শ হিসাবে সমালোচনা করা হয় এবং বাতিল করে দেওয়া হয়। সামাজিক সংগঠনের ক্ষেত্রে কেবল কমিউনিস্ট মডেলটিকেই স্বীকার ও সমর্থন করা হয়। কমিউনিস্ট রাজনীতিক ব্যবস্থায় মানবসমাজকে সমকেন্দ্রাভিমুখী করা হয়।
-
(খ) বিজ্ঞানসম্মত মতবাদ হিসাবে মার্কসবাদের মাত্রাতিরিক্ত অহঙ্কার অনেকাংশে পীড়নমূলক প্রকৃতির পরিচায়ক হিসাবে প্রতিপন্ন হয়। মার্কসবাদী নেতাদের মতামত বা বক্তব্যকে চূড়ান্তভাবে অভ্রান্ত বলে প্রতিপন্ন করা হয়। স্পর্ধিত ও ধৃষ্টতাপূর্ণ রাজনীতিক ও সামাজিক পুনর্গঠনমূলক কর্মসূচী গ্রহণ করার ব্যাপারে মার্কসবাদী নেতাদের উৎসাহিত করা হয়। এবং এ সব ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট নেতাদের সীমাহীন দুঃসাহস পরিলক্ষিত হয়।
-
(গ) মার্কসবাদ অনুযায়ী ইতিহাসের গতিধারা পূর্বনির্ধারিত। মার্কসীয় এই ধারণায় মানব প্রকৃতির নিয়তিবাদী (determinist) মডেলের কথা বলা হয়। অর্থাৎ মানুষের প্রকৃতি পূর্বনির্ধারিত। সুতরাং মানুষের স্বাধীন ইচ্ছার কোন সুযোগ নেই এবং থাকলেও তা নিতান্তই কম।
আধুনিক মার্কসবাদীরা মার্কসীয় অর্থনীতিবাদের সীমাবদ্ধতার বিরূপ সমালোচনা করেছেন। ঐতিহাসিক ও সামাজিক পরিবর্তনের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে মার্কসবাদীরা আর্থনীতিক বা বস্তুবাদী বিষয়াদির উপর অতিরিক্ত গুরুত্ব আরোপ করেছেন। আধুনিক মার্কসবাদীদের অভিযোগ অনুযায়ী আর্থনীতিক বনিয়াদ যদি রাজনীতিক ও মতাদর্শগত উপরিকাঠামোর নির্ধারক না হয়, তা হবে ভবিষ্যৎ বলার সামর্থ্য মার্কসবাদের আর থাকে না।
মার্কসবাদের অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা অন্যত্র। মার্কস ভবিষ্যৎবাণী করেছিলেন যে, পুঁজিবাদের পতন অনিবার্য এবং পুঁজিবাদের পতনের পর সাম্যবাদের প্রতিষ্ঠাও অনিবার্য। কিন্তু মার্কসের এই ভবিষ্যৎবাণী সত্য প্রমাণিত হয় নি; পুঁজিবাদের অবসান ঘটেনি, বা সাম্যবাদের দেখা মেলে নি। সাম্যবাদের ভূত শিল্পোন্নত দেশগুলিকে তাড়া করতে পারে নি। এই কারণে সমালোচকদের একা অভিযোগ অনুযায়ী ইতিহাস ও সমাজের অনুশীলন সম্পর্কিত মার্কসীয় দৃষ্টিভঙ্গি মৌলিক বিচারে ত্রুটিপূর্ণ এবং অবিশ্বাসযোগ্য। পুঁজিবাদের সাংস্কৃতিক সম্পদসমূহ; ভোগবাদ ও প্রতিযোগিতামূলক ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ প্রভৃতি অতিমাত্রায় শক্তিশালী। এই সমস্ত শক্তি-সামর্থ্যের সাহায্যে পুঁজিবাদ সমাজতন্ত্রবাদের সমর্থনসূচক ভিত্তিকে দুর্বল করে দেয়। মার্কস এই বিষয়টি অনুমান করতে পারেন নি। কার্ল পপার (Karl Popper) মার্কসবাদকে ইতিহাসবাদিতার অভিযোগে অভিযুক্ত করেছেন। মার্কসবাদে মানব ইতিহাসের অসীম জটিলতাকে কতকগুলি ঐতিহাসিক নিয়মকানুনের মধ্যে নামিয়ে নিয়ে আসা হয়েছে। কিন্তু মার্কসবাদী এই উদ্যোগ ত্রুটিপূর্ণ ও ব্যর্থ।
রাজনীতিক সমাজবিজ্ঞানীদের মধ্যে কেউ কেউ বিশ্বাস করেন যে, বিচ্ছিন্নতা (alienation) ও শোষণ সম্পর্কিত মার্কসের ধ্যান-ধারণার প্রসঙ্গিকতা এখনও অব্যাহত। কিন্তু এই শ্রেণীর চিন্তাবিদরাও স্বীকার করেন যে, পুঁজিবাদের স্থিতিস্থাপকতা এবং নিজেকে পুনর্নির্মিত করার উল্লেখযোগ্য শক্তি-সামর্থ্য ধ্রুপদী মার্কসবাদ অনুধাবন করতে অসমর্থ হয়েছে। পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির নিত্যনতুন অভাবনীয় আবিষ্কার সুবিদিত। এ সবের সুবাদে পুঁজিবাদের সংকট ঘনীভূত হয়নি বা সর্বহারাদের বিপ্লবী শ্রেণিচেতনা মাথাচাড়া দিয়ে উঠে নি। বরং বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির অপরিসীম বিকাশ ও বিস্তারের কল্যাণে পুঁজিবাদ তার সংকট অনেকটা কাটিয়ে উঠেছে এবং মানুষের জীবনযাত্রার মানের উৎসাহব্যঞ্জক উন্নতির সুবাদে শ্রেণীচেতনার বিষয়টি গুলিয়ে গেছে। অনেকে এমন কথাও বলেন যে, ১৯৮৯-‘৯১ সালে মার্কসবাদের পতন ঘটে নি পতন ঘটেছে মার্কসবাদ-লেনিনবাদের স্তালিনীয় মডেলের। কিন্তু এই বক্তব্যের মাধ্যমেও প্রমাণ করা মুস্কিল যে, মার্কসবাদের প্রাসঙ্গিকতার অস্তিত্ব আজও অব্যাহত।
ট্রটস্কি (Leon Trotsky)-র অভিযোগ অনুযায়ী স্তালিনের শাসনাধীনে সোভিয়েত ইউনিয়ন আমলাতান্ত্রিক অবক্ষয় (bureaucratic degeneration)-এর শিকার হয়েছে। ট্রটস্কি বলেছিলেন যে, সমাজতান্ত্রিক পথে সোভিয়েত ইউনিয়নকে ফিরিয়ে নিয়ে আসা আবশ্যক। তারজন্য দরকার হল একটি রাজনীতিক বিপ্লব। এই রাজনীতিক বিপ্লবের মাধ্যমে বিশেষ সুবিধাভোগী রাষ্ট্রীয় আমলাদের অপসারিত করা সম্ভব হবে।
সোভিয়েত বলশেভিকবাদের সমালোচক মার্কসবাদীরা লেনিনবাদ ও স্তালিনবাদের কঠোর বিরূপ সমালোচনা করেছেন। এই শ্রেণীর মার্কসবাদী সমালোচকদের অভিমত অনুযায়ী লেনিনবাদ ও স্তালিনবাদ হল ধ্রুপদী মার্কসবাদ থেকে বিচ্যুত ও বিকৃত। এ প্রসঙ্গে রোজা লুক্সেমবার্গ (Rosa Luxemburg) -এর সমালোচনামূলক যুক্তি বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য। এই পোলিশ বিপ্লবী মার্কসবাদীর অভিযোগ অনুসারে রাজনীতিক দল সম্পর্কিত লেনিনের মতবাদ ‘বিকল্পবাদ’ (‘substitutionism)-এর জন্ম দেবে। শাসক কমিউনিস্ট পার্টি প্রলেতারিয়েতের বিকল্প হিসাবে ভূমিকা পালন করবে। বিকল্পবাদী ভূমিকার এই ধারায় কালক্রমে সর্বোচ্চ নেতা নিজেকে কমিউনিস্ট পার্টির বিকল্প হিসাবে প্রতিপন্ন করবেন।
মার্কসবাদের অনুসরণের নামে বিংশ শতাব্দীতে রাশিয়া, চীন এবং অন্যান্য দেশে যে আর্থ-রাজনীতিক কর্মকাণ্ড পরিচালিত হয়েছে, তার সঙ্গে মার্কসবাদের বিস্তর তারতম্য পরিলক্ষিত হয়। এই স্বাতন্ত্র্যসূচক দিকগুলি উল্লেখ করা আবশ্যক।
-
(ক) মার্কসের মার্কসবাদ অনুযায়ী তৃণমূল স্তরের গণতান্ত্রিক ভিত্তিতে সিদ্ধান্তসমূহ গৃহীত হবে। কিন্তু সংশ্লিষ্ট কমিউনিস্ট রাষ্ট্রগুলিতে সর্বশক্তিমান কমিউনিস্ট পার্টি ও রাষ্ট্রযন্ত্রের মাধ্যমে একচেটিয়াভাবে যাবতীয় সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।
-
(খ) মার্কস উৎপাদনের উৎসসমূহের সামাজিক মালিকানা বা সমষ্টিগত মালিকানার কথা বলেছেন। তিনি জাতীয়করণ বা রাষ্ট্রীয় মালিকানার কথা বলেননি।
-
(গ) মার্কসীয় দর্শন অনুযায়ী বস্তুগত পারিতোষিক বা সম্পদসমূহ মানবজাতির সামাজিক ও রাজনীতিক সমতাবাদী নীতির প্রয়োজন অনুযায়ী বণ্টিত হবে; কমিউনিস্ট এলিটদের অধিকতর শক্তিশালী করার জন্য নয়।
-
(ঘ) মার্কসের মার্কসবাদ অনুযায়ী চূড়ান্ত বিচারে রাষ্ট্র উবে যাবে। রাষ্ট্র ক্রমান্বয়ে শক্তিশালী ও আমলাতান্ত্রিক হয়ে উঠবে, এমন কথা মার্কসের মার্কসবাদে নেই।
রাজনীতিক সমাজবিজ্ঞানীদের অনেকে এমন অভিযোগও উত্থাপন করেন যে, নিয়মনিষ্ঠ বা গোঁড়া সাম্যবাদের বেশকিছু কাঠামোগত সীমাবদ্ধতা আছে। সংশ্লিষ্ট ত্রুটিবিচ্যুতির কারণে বিভিন্ন দেশের কমিউনিস্ট শাসনব্যবস্থাকে প্রতিকূল পরিস্থিতির মধ্যে পড়তে হয়েছে। সংশ্লিষ্ট সীমাবদ্ধতাসমূহ উল্লেখ করা আবশ্যক। (১) কমিউনিস্ট শাসনব্যবস্থায় একমাত্র স্বীকৃত রাজনীতিক দল হল কমিউনিস্ট পার্টি। তার ফলে কমিউনিস্ট পার্টিকে কোন রকম দলীয় প্রতিদ্বন্দ্বিতার সম্মুখীন হতে হয় না। তা ছাড়া কমিউনিস্ট শাসনে স্বাধীন চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠী বা নিয়ন্ত্রণমুক্ত গণ-মাধ্যম থাকে না। এ রকম অবস্থায় জনসাধারণের ক্রমবর্দ্ধমান ও পরিবর্তনশীল চাহিদাসমূহ প্রকাশ ও পূরণ করা সম্ভব হয় না। (২) ক্রমবদ্ধমান শহুরে শিক্ষিত ও রাজনীতিক বিচারে জটিল প্রকৃতির আমজনতার রাজনীতিক ও পৌর স্বাধীনতাসমূহের চাহিদাসমূহ প্রদান বা পূরণ করা এক দলীয় পীড়নমূলক কমিউনিস্ট রাষ্ট্রের পক্ষে সম্ভব হয় না। (৩) কমিউনিস্ট রাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় অর্থনীতিক পরিকল্পনা সত্বর শিল্পায়নের পক্ষে বিশেষভাবে সহায়ক। এ বিষয়ে দ্বিমতের অবকাশ নেই। কিন্তু আধুনিক কালের জটিল প্রকৃতির শিল্প সমাজের চাহিদাসমূহ সামাল দেওয়ার ব্যাপারে এই কেন্দ্রীয় পরিকল্পনা ব্যবস্থা তেমন সহায়ক নয়। আবার বিংশ শতাব্দীর পঞ্চাশের দশক থেকে পশ্চিমের পুঁজিবাদী দেশগুলিতে ব্যাপক উন্নতি ও সমৃদ্ধি পরিলক্ষিত হয়। কমিউনিস্ট শাসিত দেশগুলি এ ক্ষেত্রে পিছিয়ে পড়ে।
সোভিয়েত ইউনিয়নে গরবাচেভ (Gorbachev) ১৯৮৫ সালের পরবর্তী কালে আর্থনীতিক সংস্কারের জন্য ‘পেরেস্ত্রোইকা’ (perestroika) ও উন্মুক্ত ব্যবস্থার জন্য ‘গ্লাসনস্ত’ (glasnost)-এর ডাক দেন। স্বভাবতই গোঁড়া সাম্যবাদী ব্যবস্থার কাঠামোগত সীমাবদ্ধতাসমূহ প্রকাশ্যে প্রকট হয়ে পড়ে। এ রকম অবস্থায় বৃহত্তর রাজনীতিক পরিবর্তনের প্রয়োজনীয়তা আর চাপা দেওয়া যায় নি। লেনিনবাদী-স্তালিনবাদী বলশেভিক মডেলের গোঁড়া সাম্যবাদী ব্যবস্থা বা কমিউনিস্ট দুনিয়ায় ব্যাপক আলোড়ন ও পরিবর্তন পরিলক্ষিত হয়। আলোড়ন সৃষ্টিকারী পরিবর্তনগুলি উল্লেখ করা আবশ্যক। রাজনীতিক মতাদর্শগত ইতিহাসে বা আরও নির্দিষ্ট করে বলতে গেলে কমিউনিস্ট শাসন বা কমিউনিজমের ইতিহাসে ১৯৮৯ সালটি যুগসন্ধিক্ষণ হিসাবে পরিচিতি পায়। নাটকীয় পরিবর্তনের সূত্রপাত হিসাবে বেজিং-এর তিয়ানানমেন স্কোয়ারে এপ্রিল মাসে ছাত্রদের নেতৃত্বাধীনে গণতান্ত্রিক আন্দোলনের কথা বলা হয়। এই নাটকীয় পরিবর্তনের সমাপ্তি হিসাবে চিহ্নিত করা হয় নভেম্বর মাসে বার্লিন প্রাচীরের পতনকে। বার্লিন প্রাচীরের পতনের পরিণামে পুঁজিবাদী পাশ্চাত্য এবং কমিউনিস্ট প্রাচ্য-ইউরোপের এই বিভাজনের অবসান ঘটে। এতদিন ধরে গোঁড়া কমিউনিজমের মডেল হিসাবে পৃথিবীতে পরিচিত ছিল সোভিয়েত ইউনিয়ন। গোঁড়া কমিউনিস্ট রাষ্ট্র হিসাবে সুবিদিত সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন ঘটে ১৯৯১ সালের মধ্যেই। ইতিমধ্যে পূর্ব ইউরোপের দেশগুলিতে কমিউনিস্ট শাসনের অবসান ঘটে। গণ-প্রজাতন্ত্রী চীন, ভিয়েতনাম, কিউবা, উত্তর কোরিয়া প্রভৃতি কয়েকটি দেশে কমিউনিস্ট শাসন অব্যাহত আছে। এ কথা ঠিক। কিন্তু এই সমস্ত দেশেও স্তালিনবাদী মডেলকে বাতিল করে দিয়ে অনেকাংশে বাজার অর্থনীতিকে গ্রহণ করা হয়েছে। এ ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য উদাহরণ হিসাবে গণ-প্রজাতন্ত্রী চীনের কথা বলা যায়। তবে উত্তর কোরিয়া এ ক্ষেত্রে ব্যতিক্রমী উদাহরণ হিসাবে বহুলাংশে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে।
কমিউনিজমের পতনের প্রেক্ষিত
প্রেক্ষিত পর্যালোচনার পরিপ্রেক্ষিতে স্পষ্টতঃ প্রতিপন্ন হয় যে, কমিউনিজমের অবসান অনিবার্য হয়ে দাঁড়িয়েছিল। বিংশ শতাব্দীর আশির দশকের মাঝামাঝি সময়ে অনেকে এমনও আশঙ্কা করেছিলেন যে, যে কোন সময়ে কমিউনিজমের পতন ঘটার আশঙ্কাকে অস্বীকার করা যায় না। এ ক্ষেত্রে প্রেক্ষিত হিসাবে দুটি বিষয় বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য – একটি বিষয়
-
(১) আন্তর্জাতিক, অন্য বিষয়টি
-
(২) পূর্বতন সোভিয়েত ইউনিয়নের স্বরাষ্ট্র সম্পর্কিত।
(১) কমিউনিজমের পতনের আন্তর্জাতিক প্রেক্ষিত:
কমিউনিজমের পতনের আন্তর্জাতিক পটভূমি বলতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে ঠাণ্ডাযুদ্ধের সংঘাতের পুনরুত্থানের কথা বলা হয়। বিংশ শতাব্দীর সত্তরের দশকের একেবারে শেষের দিকে আশির দশকের একেবারে গোড়ার দিকে সমকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে থেমে থাকা ঠাণ্ডা যুদ্ধ পুনরায় মাথাচাড়া দিয়ে উঠে।
বিংশ শতাব্দীর পঞ্চাশের ও ষাটের দশকে বিভিন্ন ঘটনাকে কেন্দ্র করে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে ব্যাপক উত্তেজনার সৃষ্টি হয়। সংশ্লিষ্ট ঘটনাসমূহের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে প্রতিযোগিতার প্রসার, অস্ত্র প্রতিযোগিতা বৃদ্ধি, কিউবায় মিসাইল সংকট প্রভৃতি ভয়াবহ ঘটনাবলীর পরিপ্রেক্ষিতে আন্তর্জাতিক সংকটপূর্ণ পরিস্থিতি-পরিমণ্ডলের সৃষ্টি হয়। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে উত্তেজনা প্রশমনের প্রয়োজনীতা অপরিহার্য। হয়ে পড়ে। শুভবুদ্ধির সুবাদে সোভিয়েত ইউনিয়ন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের সমঝোতা হয়। মনকষাকষির অবসান ঘটিয়ে উভয় রাষ্ট্র আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি-পরিমণ্ডলকে উত্তেজনামুক্ত রাখার ব্যাপারে উদ্যোগী হয়। কিন্তু এই উদ্যোগ পুরো একটি দশকও স্থায়ী হয় নি।
১৯৭৯ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন আফগানিস্তান আক্রমণ করে। আফগানিস্তানের নড়বড়ে কমিউনিস্ট শাসনকে ঠেকনা দেওয়ার স্বার্থে সোভিয়েত ইউনিয়ন এই সামরিক অভিযান চালায়। ১৯৮০ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতি পদে নির্বাচিত হন রোনাল্ড রেগন। এই দুটি ঘটনার সামগ্রিক প্রতিক্রিয়া হিসাবে মার্কিন সোভিয়েত সম্পর্ক পুনরায় উত্তেজনাপূর্ণ হয়ে উঠে। রেগন সোভিয়েত ইউনিয়ন সম্পর্কে বিরূপ মনোভাব পোষণ করেন। তিনি সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে সমঝোতার নীতি থেকে সরে আসেন এবং সামরিক শক্তি বৃদ্ধির ব্যাপারে উদ্যোগ-আয়োজন গ্রহণ করেন। সে সময় সোভিয়েত ইউনিয়ন তার বন্ধ্য অর্থনীতির প্রতিকূলতার কারণে বেশ চাপে ছিল। ব্যয়সাধ্য সামরিক চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করার অবস্থায় সোভিয়েত ইউয়িন ছিল না।
যাইহোক সোভিয়েত-মার্কিন এই দুই শক্তিধর রাষ্ট্রের মধ্যে নতুন করে ব্যয়বহুল ঠাণ্ডাযুদ্ধের সূত্রপাত হল পুনরায়। এ রকম এক পরিস্থিতিতে সোভিয়েত ইউনিয়নে নতুন দৃষ্টিভঙ্গিসম্পন্ন নতুন প্রজন্মের কিছু রাজনীতিক নেতা ক্ষমতায় এলেন। এঁদের মধ্যে সর্বাগ্রগণ্য হল মিখায়েল গর্বাচেভ (Mikhail Gorbachev)। ১৯৮৫ সালে তিনি সোভিয়েত ইউনিয়নের কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদকের পদে আসীন। বিদ্যমান সোভিয়েত ব্যবস্থার বন্ধ্যা অবস্থা সম্পর্কে তিনি সম্যকভাবে অবহিত ছিলেন। তিনি সহজেই অনুধাবন করেন যে, অস্ত্র প্রতিযোগিতার সামিল হওয়াটা সোভিয়েত ইউনিয়নের পক্ষে আত্মহত্যার নামান্তর হবে। সোভিয়েত অর্থনীতি একেবারে ভেঙ্গে পড়বে।
গরবাচেভ সোভিয়েত ইউনিয়েনের স্বরাষ্ট্র ও পররাষ্ট্র নীতিকে পরিশীলিত ও প্রাসঙ্গিক করে তোলার জন্য বিশেষভাবে উদ্যোগ-আয়োজন গ্রহণ করেন। সমকালীন পরিস্থিতি-পরিমণ্ডলের পরিপ্রেক্ষিতে তিনি সোভিয়েত ইউনিয়ন ও তার কমিউনিস্ট চিন্তাধারাকে সজীব ও উপযোগী করে তোলার চেষ্টা করেন।
সোভিয়েত পররাষ্ট্রনীতিতে গরবাচেভ ব্যাপক কিন্তু সহনীয় সংস্কার সাধনের ব্যাপারে উদ্যোগী হন। পৃথিবীর বিভিন্ন কমিউনিস্ট রাষ্ট্রের উপর বিশেষত পূর্ব ইউরোপের দেশগুলির উপর সোভিয়েত ইউনিয়ন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে তার নিয়ন্ত্রণমূলক কর্তৃত্ব কায়েম রেখেছিল। তার ফলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সমেত পশ্চিম দুনিয়ার সঙ্গে সোভিয়েত ইউনিয়নের সম্পর্কের অবনতি ঘটে, তিক্ততা ও উত্তেজনার সৃষ্টি হয়। তা ছাড়া পৃথিবীর বিভিন্ন কমিউনিস্ট রাষ্ট্রের জন্য সোভিয়েত ইউনিয়নকে বেশ ভাল রকম ব্যয়ভার বহন করতে হত। তার ফলে সোভিয়েত অর্থনীতির উপর প্রতিকূল প্রভাব প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হত। সোভিয়েত ইউনিয়নের সামরিক ও আনুষঙ্গিক ব্যয় হ্রাস করার জন্য এবং সঙ্গে সঙ্গে পশ্চিমী দুনিয়ার সঙ্গে সম্পর্কের উন্নতি সাধনের জন্য গর্বাচভ অন্যান্য কমিউনিস্ট রাষ্ট্রের উপর বিশেষত পূর্ব ইউরোপের কমিউনিস্ট রাষ্ট্রসমূহের উপর সোভিয়েত ইউনিয়নের নিজের সামরিক সহায়তা শিথিল করতে শুরু করেন। গর্বাচেভ আশা করেছিলেন যে সংশ্লিষ্ট অঞ্চলে সীমাবদ্ধভাবে উদারনীতিকরণের নীতি অনুসরণ করলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সমেত ইউরোপের সঙ্গে বিদ্যমান উত্তেজনা প্রশমিত হবে এবং সম্পর্ক স্বাভাবিক হবে। সে ক্ষেত্রে পশ্চিম দুনিয়ার সঙ্গে সোভিয়েত ইউনিয়নের আর্থনীতিক ও ব্যবসায়িক বাণিজ্যিক সম্পর্কের বিকাশ ও বিস্তার ঘটবে।
(২) পূর্বতন সোভিয়েত ইউনিয়নের স্বরাষ্ট্র সম্পর্কিত প্রেক্ষিত:
স্বরাষ্ট্র নীতির ক্ষেত্রে গর্বাচেভ সীমাবদ্ধ ও সহনীয় সংস্কার সাধনের পক্ষপাতী ছিলেন। তিনি সোভিয়েত ইউনিয়নের বা কমিউনিজমের মৌলিক বা সামগ্রিক পরিবর্তন সাধনের কথা বলেন নি। আভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে তিনি দুটি মূল নীতি অনুসরণের উপর জোর দেন। নীতি দুটি হল ‘গ্লাসনস্ত’ (glasnost) এবং ‘পেরেস্ত্রোইকা’ (perestroika)। ‘গ্লাসনস্ত’ কথার অর্থ হল খোলামেলা। ‘পেরেস্লোইকা’ কথাটির মানে হল পুনর্গঠন। এই দুটি নীতির মাধ্যমে গর্বাচেভ কমিউনিজমের উদারিকরণ ও সংস্কার সাধনে উদ্যোগী হয়েছিলেন। গর্বাচেভ বিশ্বাস করেছিলেন যে, ‘গ্লাসনস্ত’ এর অনাবৃত আবহাওয়ায় মানুষের অধিগম্যতা বৃদ্ধি পাবে। উন্মুক্ত আলোচনা হবে। বিদ্যমান ব্যবস্থার সীমাবদ্ধতাসমূহ নিয়ে জনসাধারণের মধ্যে বিতর্ক হবে। এই আলোচনা ও বিতর্ক প্রয়োজনীয় পরিবর্তনের পথ উন্মুক্ত করবে। কমিউনিস্ট শাসনের বৈধতা বৃদ্ধি করবে। পেরেস্রোইকার মাধ্যমে আর্থনীতিক ও রাজনীতিক ব্যবস্থায় প্রকৃত প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার সাধনের পরিকল্পনা করা হয়েছিল। আশা করা হয়েছিল যে, সংশ্লিষ্ট। সংস্কারের মাধ্যমে রাজনীতিক ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধভাবে গণতান্ত্রিক অংশগ্রহণ এবং আর্থনীতিক ক্ষেত্রে বাজার ভিত্তিক উৎসাহ-উদ্দীপনার সৃষ্টি হবে।
‘গ্লাসনস্ত’ প্রক্রিয়ার সুবাদে আলোচনা ও সমালোচনা দুর্নীতি বা ভোগ্য পণ্যসামগ্রীর গুণমানের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে নি। জনসাধারণের মধ্যে রাজনীতিক ও আর্থনীতিক বিষয়াদিকে কেন্দ্র করে ব্যাপক বিতর্ক বিস্তার লাভ করে। সোভিয়েত ইউনিয়নের অন্তর্ভুক্ত বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর মানুষ এবং পূর্ব ইউরোপের রাষ্ট্রসমূহের নাগরিকরা গ্রাসনস্তকে ব্যবহার করে রুশ প্রাধান্যের বিরুদ্ধে অধিকতর স্বাধীনতার জন্য সংগ্রামী আন্দোলন সংগঠিত করে। বিদ্যমান রাজনীতিক ব্যবস্থার প্রকৃতিকেই জনসাধারণ চ্যালেঞ্জ জানায়। গ্লাসনস্ত সঞ্জাত সংস্কার প্রক্রিয়ার সুবাদে গর্বাচেভ ও সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে কঠোর সমালোচনামূলক আক্রমণ আরম্ভ হয়। গ্লাসনস্তের মত পেরেস্ত্রোইকার ফলাফলও গর্বাচেভের আশা ও বিশ্বাসের বিরুদ্ধে যায়। পেরেস্ত্রোইকার পরিণামে কমিউনিজমের গতি-প্রকৃতি কী দাঁড়াবে যে বিষয়ে কমিউনিস্ট পার্টি, রাষ্ট্র ও সমাজের মধ্যে ব্যাপক বিভ্রান্তির সৃষ্টি হয়। সমস্যা সংকটের দিকে এগোয় গরবাচেভের উৎসাহহীন উদ্যোগ-আয়োজনের জন্য। সোভিয়েত কমিউনিস্ট পার্টির মধ্যে ‘নোমেনক্লেচার’ (nomenklatura)-এর সুবাদে রাজনীতিক নেতৃবৃন্দ, প্রশাসক গোষ্ঠী, কলকারখানার উচ্চ পদাধিকারী এবং অনুরূপ অন্যান্যদের নিয়ে একটি বিশেষ সুবিধাভোগী গোষ্ঠীর সৃষ্টি হয়েছিল দীর্ঘদিন ধরে। গরবাচেভের ‘গ্লাসনস্ত-পেরেস্ত্রোইকা’ এই গোষ্ঠীর কায়েমি স্বার্থে আঘাত হানে। স্বভাবতই তারা সাধ্যমত সংস্কারের বিরোধিতা করে। তার ফলে পার্টির মধ্যে অন্তর্কলহ দেখা দেয়। অব্যবস্থা ও অস্থিরতা বাড়তে থাকে।
সোভিয়েত ইউনিয়নের উপর নির্ভরশীল কমিউনিস্ট রাষ্ট্রসমূহে গ্লাসনস্ত-পেরেস্রোইকার প্রতিক্রিয়া স্বরূপ পরিবর্তন দ্রুত গতিতে ঘটতে লাগল। এতদিন বিশ্বের বিভিন্ন কমিউনিস্ট রাষ্ট্রের আপদে-বিপদে সোভিয়েত ইউনিয়ন বিভিন্ন বিশেষত সামরিক সাহায্য-সহযোগিতা নিয়ে পাশে দাঁড়িয়েছে। গরবাচেভ এই নীতি থেকে সরে আসেন। তার ফলে পূর্ব ইউরোপের বিভিন্ন কমিউনিস্ট রাষ্ট্রের কমিউনিস্ট পার্টি বিপদাপন্ন হয়ে পড়ে। বিরোধী শক্তিসমূহ ১৯৮৯ সালে কমিউনিস্ট শাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলনের সামিল হয়। বিরোধীরা একদলীয় কমিউনিস্ট ব্যবস্থার অবসান দাবি করে এবং খোলামেলা নির্বাচন ব্যবস্থারও দাবি করে। পূর্ব ইউরোপের কমিউনিস্ট শাসিত রাষ্ট্রসমূহের কমিউনিস্ট পার্টিগুলির অনুধাবন করতে অসুবিধা হয়নি যে, কমিউনিস্ট বিরোধী এই আন্দোলনকে দমিয়ে দেওয়া যাবে না। কারণ সোভিয়েত ইউনিয়নের সামরিক সাহায্য আর পাওয়া যাবে না। এরকম এক পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে পূর্ব ইউরোপীয় কমিউনিস্ট পার্টিগুলির নেতারা নীরবে বিরোধীদের দাবি-দাওয়া মেনে নিতে বাধ্য হয়। তার ফলে ১৯৯০ সালের মধ্যেই পূর্ব ইউরোপের দেশগুলিতে মোটামুটি শান্তিপূর্ণভাবেই কমিউনিস্ট শাসনের অবসান ঘটে। এইভাবে প্রথম পূর্ব ইউরোপে কমিউনিস্ট শাসনের অবসান ঘটিয়ে পশ্চিমী গণতান্ত্রিক শাসন প্রতিষ্ঠার পথ প্রশস্ত হয়েছে।
পূর্ব ইউরোপের পরিণতি থেকে সোভিয়েত ইউনিয়নও নিজেকে রক্ষা করতে পারে নি। পূর্ব ইউরোপে কমিউনিজমের পতনের পরিপ্রেক্ষিতে সোভিয়েত ইউনিয়নের কমিউনিস্ট বিরোধী শক্তিসমূহ বিশেষভাবে উৎসাহিত হয়। গর্বাচেভের সীমাবদ্ধ সংস্কার মানুষকে সন্তুষ্ট করতে পারে নি। ব্যাপকতর মৌলিক পরিবর্তনের দাবি উঠে। ১৯৯১ সালের মধ্যেই সোভিয়েত ইউনিয়নে অস্থিরতা ও অব্যবস্থা মাথা চাড়া দিয়ে উঠে। বিভিন্ন গোষ্ঠী রাজনীতিক ক্ষমতার অধিকার দাবি করে আন্দোলন সংগঠিত করে। জাতীয়তাবাদ ও জাতিদাঙ্গা ক্রমশ বাড়তে থাকে। তবে পূর্ব ইউরোপের মত সোভিয়েত ইউনিয়নে শান্তিপূর্ণ পথে কমিউনিস্ট শাসনের অবসান ঘটে নি। সোভিয়েত কমিউনিস্ট পার্টির কট্টরপন্থী গোষ্ঠী সংস্কার প্রক্রিয়াকে প্রতিহত করার জন্য গর্বাচেভের হাত থেকে ক্ষমতা কেড়ে নেওয়ার জন্য এবং গর্বাচেভকে আটক করার জন্য অভ্যুত্থানের আশ্রয় নেয়। কিন্তু অভ্যুত্থানকারীরা সামরিক বাহিনীর সমর্থন-সহযোগিতা পায় নি। রাষ্ট্রের অন্যান্য অংশও তাদের সাহায্য করেনি। জনসাধারণের সমর্থনও তারা পায় নি। তার ফলে কট্টরপন্থীদের এই অভ্যুত্থান ব্যর্থ হয়। অতঃপর সোভিয়েত ইউনিয়নের অন্তর্ভুক্ত প্রদেশ বা রিপাবলিকগুলি জাতিগোষ্ঠীসমূহের স্বাতন্ত্র্য্যমূলক আবেদনের ভিত্তিতে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। রাশিয়া সমতে পনেরটি নতুন স্বাধীন দেশের সৃষ্টি হয়। সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙ্গে যায়।
পূর্ব ইউরোপের দেশগুলিতে কমিউনিস্ট শাসনের অবসান ঘটল। সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙ্গে গেল। এতদসত্ত্বেও এ কথা বলা যায় না যে, সর্বত্র কমিউনিজমের পতন ঘটেছে। ১৯৮৯ সালেই গণ-প্রজাতন্ত্রী চীনেও কমিউনিস্ট সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন সংগঠিত হয়েছে। গর্বাচেভের দৃষ্টান্তমূলক ভূমিকায় উৎসাহিত হয়ে চীনের ছাত্র সমাজ সংঘটিতভাবে প্রতিবাদী আন্দোলনের সামিল হয়। কিন্তু চীনের কমিউনিস্ট নেতারা সংস্কার ও উদারিকরণের ব্যাপারে জনসাধারণের দাবিদাওয়াকে দৃঢ়তার সঙ্গে উপেক্ষা করে। সামরিক বাহিনীকে দিয়ে শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ আন্দোলনকে নির্মম-নিষ্ঠুরভাবে দমন করতে তারা দ্বিধা করে নি। তিয়েনানমেন স্কোয়ারে সমবেত ছাত্রসমাজের উপর চীনের সামরিক বাহিনী নির্বিচারে গুলিবর্ষণ করে। প্রসঙ্গত উল্লেখ করা আবশ্যক যে, বিংশ শতাব্দীর সত্তরের দশকের শেষের দিকে চীনের কমিউনিস্ট পার্টি আর্থনীতিক ক্ষেত্রে ব্যাপকভাবে সংস্কারমূলক কর্মসূচী গ্রহণ করে। কিন্তু আর্থনীতিক ক্ষেত্রে সংস্কার সাধনের সঙ্গে সঙ্গে রাজনীতিক ক্ষেত্রে সংস্কার সাধনের ব্যাপারে কোন রকম উদ্যোগ-আয়োজন গ্রহণ করা হয়নি। প্রকৃত প্রস্তাবে জনসাধারণের অসন্তোষের অবসানের জন্য এবং পার্টির বৈধতা বৃদ্ধির জন্য চীনের কমিউনিস্ট পার্টি আর্থনীতিক সংস্কার সাধনের পথে অগ্রসর হয়।
Leave a comment