অথবা, শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্যের বংশী ও বিরহখণ্ড অবলম্বনে বড়ু চণ্ডীদাসের কবি প্রতিভার বৈশিষ্ট্য নির্দেশ কর

এসব চিত্র পাঠকের মনে কৌতুকরস সঞ্চার করে। এ উৎকৃষ্ট খাদ্যসামগ্রী যাকে পরিপাক করতে হবে তার কথা গ্রন্থের মধ্যে উল্লেখ না করে কবি তা পাঠকের ভাবনার উপর ছেড়ে দিয়ে কৃতিত্বের পরিচয় রেখেছে।

উত্তর: ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’ মধ্যযুগের প্রথম কাব্য এবং এর রচয়িতা কবি বড়ু চণ্ডীদাস মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যের আদি কবি। রাধাকৃষ্ণের প্রেমমূলক গল্প অবলম্বনে রচিত এ কাব্যের বংশী ও বিরহ খণ্ডে কবির কবিত্ব শক্তির বিশিষ্ট প্রকাশ ঘটেছে। রাধাকৃষ্ণের প্রেম কাব্যের পরিণতিতে সার্থকতা লাভ করেছে। এ সার্থকতা মিলনে নয়, বিরহে। কাব্যের বংশীখণ্ড থেকে প্রকৃত রাধা বিরহের সূচনা এ বিরহ মিলনোত্তর।

শ্রীকৃষ্ণকীর্তন মূলত একটি কাহিনি কাব্য। এর রূপ বিশ্লেষণ করতে গিয়ে অনেকেই নানা অভিমত ব্যক্ত করেছেন। অসংখ্য প্রমাণসহ কেউ কেউ এর জটিল ঘটনাবর্তের দ্রুত নাটকীয় প্রকাশভঙ্গি দেখে এ কাব্যকে নাট্যধর্মী কাব্য বলেছেন, কেউ কেউ একে মহাকাব্য বলেছেন, কেউ বা আবার একে গীতিকাব্য বলে কল্পনা করেছেন। শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের আবিষ্কার কর্তা বসন্তরঞ্জন রায় মহাশয় ভূমিকায় লিখেছেন, “শ্রীকৃষ্ণকীর্তন গীত গোবিন্দের অনুকরণে রচিত গীতিনাট্য শ্রেণির গীতিকাব্য।”

ড. সুকুমার সেন এ মতকে সমর্থন করেছেন। বস্তুত এ কাব্যের বংশী ও বিরহখণ্ডের এক একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ নিটোল সংগীত মধুর কবিতা গীতিকাব্যের পর্যায়ভুক্ত। অনেকেই বংশী ও রাধাবিরহ অংশে গীতিকবিতার উচ্চ পর্যায় লক্ষ করেছেন। আধুনিক পাঠকের কাছে শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের সর্বাধিক পরিচিত ও অনেকের মতে শ্রেষ্ঠ,

‘কে না বাঁশী বাএ বড়ায়ি কালিনী নই কুলে’।

-পদটিতে কবি বড়ু চণ্ডীদাসের কালজয়ী কবিত্ব শক্তির পরিচয় ফুটে উঠেছে।

বড়ু চণ্ডীদাস উঁচুমানের কবি ছিলেন। তিনি কাব্যটি সম্ভবত লৌকিক কাহিনি অনুসরণে রচনা করেছেন। কাব্যের সর্বত্র শৃঙ্গার রসের ব্যবহার প্রত্যক্ষ গোচর এবং কামনা বাসনার আর্তিও অনেকবার প্রকাশিত হয়েছে। ফলে অনেক সমালোচক এ কাব্যটিকে অশ্লীল ও অমার্জিত কাব্য বলে মনে করেছেন। এ কাব্যে অশ্লীলতার অভিযোগ এ রকম-

“এ কাব্যে দেহ কামনার উগ্রতায় এবং দেহ মিলনের বর্ণনার পুনরুক্তিতে শ্লীলতার ভারসাম্য নষ্ট হয়েছে।”

কিন্তু এটি থাকা সত্ত্বেও ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’ কাব্যে চরিত্র চিত্রণে, অনুভূতির গভীরতায় এবং আখ্যান গ্রন্থনে একটি সার্থক নিপুণতা চোখে পড়ে। এ কাব্যে বড়ু চণ্ডীদাসের সবচেয়ে বড়ো কৃতিত্ব চরিত্র চিত্রণ ও কাহিনি বিন্যাসের ক্ষেত্র। রাধা, কৃষ্ণ ও বড়ায়ি- এই তিনটি চরিত্র অবলম্বনে শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের কাহিনি রূপায়িত হয়েছে। কাব্যের শ্রেষ্ঠ ও প্রধান চরিত্র রাধার মতো পূর্ণাঙ্গ নারী চরিত্র অঙ্কনে ও তাঁর প্রেম চেতনার পরিণতির প্রত্যেকটি স্তরের নিপুণ আলোক সম্পাদনে বড়ু চণ্ডীদাস যে কৃতিত্বের পরিচয় দিয়েছেন তা বিস্ময়কর। নামশ্রবণ বা রূপ দর্শনজনিত প্রথাসিদ্ধ পূর্বরূপ ব্যতীত নিতান্ত দেহ মিলনের দ্বারা পুরুষের প্রতি নারীর প্রেম কিভাবে অঙ্কুরিত, পল্লবিত ও বিকশিত হয়ে উঠতে পারে তারই পুঙ্খানুপুঙ্খ চিত্র অঙ্কন করেছেন বড়ু চণ্ডীদাস।

‘বংশীখণ্ডে’ কৃষ্ণের প্রতি রাধার প্রেমের পরিণতি ঘটেছে। এখানেই প্রথম রাধার মধ্যে বিরহজনিত ব্যাকুলতা দেখা দিয়েছে এবং তার সাথে সংযোজিত হয়েছে চোখের জল। কৃষ্ণের মোহন বাঁশির সুরে রাধার চিত্ত উন্মনা হয়ে উঠেছে। বিরহিণী রাধার সেই চিত্র চরিত্র কবি অপূর্ব কবিত্বের সাথে বর্ণনা করেছেন-

‘কে না বাঁশী বাএ বড়ায়ি কালিনী নই কুলে।

কে না বাঁশী বাএ বড়ায়ি এ গোষ্ঠ গোকুলে।

আকুল শরীর মোর বেআকুল মন।

বাঁশীর শবদে মো আউলাইলো রান্ধন। (বংশী-২)

‘রাধাবিরহ’ অংশে কবি বিশিষ্ট ভাবরূপকের অলঙ্কারে রাধার চরিত্রকে জীবন্ত করে তুলেছেন। কবি রাধার ব্যাকুলতা তার বিরহবোধ যেভাবে ব্যক্ত করেছেন তাতে রাধা হয়ে উঠেছে এক জীবন্ত নারী প্রেমকাতর প্রেমিকা। বিরহ অংশে রাধার বিরহ ব্যাকুলতা পদাবলীর বিরহিণী রাধিকাকে স্মরণ করিয়ে দেয়। কৃষ্ণ বিরহে ব্যাকুলা রাধার স্বরূপ কবি বিশেষ নৈপুণ্যের সাথে অঙ্কন করেছেন-

‘এ ধন যৌবন বড়ায়ি সবঈ আসার।

ছিন্তিআঁ পেলাইবোঁ গজমুকুতার হার। (বিরহ-৫)

রাধার এ বেদনা নিতান্ত ব্যক্তিগত নয়। সে বেদনার সুর ব্যক্তিকে অতিক্রম করে সর্বকালের সব দেশের বিরহ বেদনার সুরের সাথে মিলিত হয়েছে।

কৃষ্ণ চরিত্র অঙ্কনে কবি পৌরাণিক ও লৌকিক ভাবের সম্মিলন ঘটিয়েছেন। কৃষ্ণ কবির চোখে ভগবানের অবতার হলেও গ্রাম্য একটি প্রাণবন্ত কিশোররূপে চিত্রিত হয়েছে। তার সরলতা, উদ্বিগ্ন যৌবন, কিশোর সুলভ রতি মিলনাকাঙ্ক্ষা, বাঁশির প্রতি অনুরাগ, প্রেমিকার প্রতি অভিমান, প্রতিশোধ স্পৃহা- সব মিলিয়ে অমার্জিত দূরন্ত একটি গ্রাম্য যুবকের ছবিই ফুটে উঠেছে। সুদক্ষ রূপকার বড়ু চণ্ডীদাস মানব হৃদয় নিংড়ানো অনুভূতি দিয়ে কৃষ্ণ চরিত্র অঙ্কিত করেছেন।

বড়ায়ি গ্রাম্য কুট্টনী জাতীয় একটি সুন্দর চরিত্র। কবি প্রথমে তাকে কুটিলরূপে শুরু করেছিলেন, কিন্তু পরিণতিতে বড়ায়ি মানবীয় গুণ সমৃদ্ধ নারী হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে। তৎকালীন সমাজজীবনের সে একটি জীবন্ত চরিত্র। কবি যথাসম্ভব নিপুণ হাতে তাঁকে এঁকেছেন।

শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের কাহিনিটিতে ভাগবত, বিষ্ণু পুরাণ, ব্রহ্ম- বৈবর্তপুরাণ ইত্যাদির সহায়তা নিলেও, মূল আখ্যায়িকার ভিত্তি লোকগাথা। বড়ু চণ্ডীদাসের সার্থকতা হলো এ কাব্যে রাধাকৃষ্ণের যে প্রেমলীলা তিনি অঙ্কন করেছেন তা লৌকিক ও জীবন্ত। স্বর্গীয় প্রেমকে ছাড়িয়ে মানব মানবীর প্রেম কাহিনি যেন এখানে মূর্ত হয়ে উঠেছে। এ কারণে সমালোচক বলেছেন,

“শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের মানবতা ও বাস্তবতা আমাদের প্রাচীন কাব্য সাহিত্যের একটি সম্পদ। ……………….বড়ু চণ্ডীদাস লৌকিক উপমা, উৎপ্রেক্ষা এবং গ্রাম্য কথ্য বুলিকে পরিমার্জিত করিয়া এমনভাবে কাব্যে নিবেশিত করিয়াছেন যে, ঐ কাব্যের বাস্তব রস আমাদের প্রত্যক্ষে বিদ্ধ করে।” (শ্রীকৃষ্ণকীর্তন: শঙ্করী প্রসাদ বসু)

শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্যে কবির বলিষ্ঠ কবিত্ব শক্তির পরিচয় আরো রয়েছে নাট্যরসাশ্রয়ী ঘটনা ও সংলাপ রচনার মধ্যে। কোথাও কবি নিজে কাহিনির মধ্যে উপস্থিত থেকে সংলাপের সাথে বর্ণনা যোগ করেছেন, আবার কোথাও সংস্কৃত শ্লোকের সাহায্যে সংযোগ স্থাপন করেছেন। বিভিন্ন খণ্ডে রাধা, কৃষ্ণ ও বড়ায়ির উক্তি প্রত্যুক্তির মাধ্যমে কাহিনির ক্ষিপ্রগতিশীলতা ও সার্থক পরিণতি লক্ষণীয়। ফলে সমগ্র কাব্যখানি অপূর্ব নাটকীয় গুণ সম্পন্ন হয়ে উঠেছে।

বড়ু চণ্ডীদাস সংস্কৃত অলঙ্কার শাস্ত্রে সুপণ্ডিত ছিলেন। কবি জয়দেব ও বিদ্যাপতির মতো তিনি উপমা, রূপক ও উৎপ্রেক্ষায় সুনিপুণ প্রয়োগ দ্বারা তাঁর কাব্যের সৌন্দর্য বৃদ্ধি করেছেন। কবি উপমা উৎপ্রেক্ষার সার্থক প্রয়োগে নায়ক-নায়িকার উজ্জ্বলভাবে চিত্রিত করেছেন।

দৃষ্টান্ত: শ্রীকৃষ্ণের রূপ বর্ণনা প্রসঙ্গে বলেছেন-

‘দেহ নীল মেখ ছটা গন্ধ চন্দনের ফোটা

যেন উয়ে গগনে চান্দ গোটা। (বিরহ-১৫)

বিরহিণী রাধার অবস্থা বর্ণনা প্রসঙ্গে-

‘ক্ষেপে সজল নয়নে

দশ দিশে খনে খনে

নালহীন কৈল যে নীল নলিনে’। (বিরহ-৪৮)

শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্যের মধ্যে কবি বড়ু চণ্ডীদাস অনেক অলঙ্কার ব্যবহার করেছেন। কিন্তু সেখানে অলঙ্কার অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ কাব্যোচিত ধ্বনিই প্রাধান্য লাভ করেছে। যেমন-

‘কে বোলে চন্দন চাঁদ অতি সুশীতল।

আহ্মার মনত ভাএ যেহেন গরল। (বংশী-৫)

এখানে প্রিয় বিরহে বিরহিণীর দগ্ধ হৃদয় যে কিরূপ ব্যথিত হয় কবি তা নিপুণ কৌশলে ব্যক্ত করেছেন। উপমা প্রয়োগে কোথাও কবি মৌলিকতা ও কবিকৃতিত্ব দেখিয়েছেন। যেমন নিম্নোক্ত পদটি-

‘দুখ সুখ পাঁচ কথা কহিতে না-পাইল।

ঝালিআর জল যেন তখনে পালাইল।’ (বিরহ-৬৫)

এখানে রাধার বেদনা দগ্ধ চিত্তের ক্ষোভ প্রকাশমান। কৃষ্ণের কাছে সুখদুঃখের কথা বলা হলো না। জাদুকরের তৈরি গাছের ডাল যেমন অকস্মাৎ দেখা দিয়ে মুহূর্তে অন্তর্হিত হয়, কৃষ্ণ তেমনি অন্তর্ধান করল। জাদুকরের সৃষ্ট ডালের সাথে কৃষ্ণের অন্ত ধানের সাদৃশ্য আবিষ্কার বড়ু চণ্ডীদাসের মৌলিকতার পরিচয়বাহী।

লোক সাহিত্যে প্রচলিত কতকগুলো কাব্য শ্রীকৃষ্ণকীর্তনে পাওয়া যায়। বড়ু চণ্ডীদাস লৌকিক সাহিত্য হতে প্রবাদ প্রবচন আহরণ করে একদিকে যেমন তাঁর কাব্যের সৌন্দর্য বর্ধন করেছেন, তেমনি কবিত্ব শক্তির স্বাক্ষর রেখেছেন। কয়েকটি উদাহরণ:

১. পাখী জাতী নহোঁ বড়ায়ি উড়ী জাঁও তথা।

মোর প্রাণনাথ কাহ্নাঞি বসে যথাঁ। (বিরহ-৬৪)

২. পোটলী বান্ধিঞাঁ রাখ নহুলী যৌবন, (বিরহ-২৭)

৩. সোনা ভাঙ্গিলে আছে উপাএ

জুড়িএ আগুনতাপে।

পুরুষ নেহা ভাঙ্গিলে

জুড়িএ কাহার বাপে। (বিরহ, ৩৭)

শুন কলসী লই সখী আগে জাএ।

বাওঁর শিআল মোর ডাহিনে জাএ॥ (বংশী, ২৮)

এ প্রবচনগুলো তৎকালীন গ্রাম্য শ্রোতাদের সুপরিচিত। আর এর সার্থক ব্যবহারে কবির কৃতিত্ব প্রকাশমান।

শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্যে হাস্যরস সৃষ্টির ক্ষেত্রেও আমরা কবি বড় চণ্ডীদাসের কবিত্ব শক্তির পরিচয় পাই। বংশীখণ্ডে দেখা যাচ্ছে কৃষ্ণের বংশীধ্বনি শুনে রাধার মন ব্যাকুল হয়েছে। তাই রন্ধনকর্মে আজ তার কোনো শৃঙ্খলা নেই-

‘ছোলঙ্গ চিপিআঁ নিমঝোলে খেপিলোঁ।

বিণি জলে চড়াইলোঁ চাউল। (বংশী, ১৫)

শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্যের আরম্ভ এবং কাহিনি বিস্তার নাটকীয় ঢঙে ঘটেছে। বড়ু চণ্ডীদাসের কবিত্ব অশ্লীলতার দোষে দুষ্ট- একথা স্বীকার করেও বলা যায় যে বংশী ও বিরহ খণ্ডে কবির কাব্য ভাবনা এক নতুন মোড় নিয়েছে। এখানে আত্মগত ভাবোচ্ছ্বাস সহজেই বিচরণশীল। পদাবলীর রসমাধুর্যের সাথে বড় চণ্ডীদাসের বিরহের পদগুলো তুলনীয়। রাধার বিরহ ও করুণ আর্তির চিত্র কবি বেশ নিপুণ হাতে এঁকেছেন। কয়েকটি উদাহরণ-

১. মেঘ আন্ধারী অতি ভয়ঙ্কর নিশী।

একসরী ঝুরোঁ মো কদমতলে বসী।

চতুর্দিশ চাহোঁ কৃষ্ণ দেখিতে না পাওঁ।

মেদনী বিদায় দেউ পসিআঁ লুকাও। (বিহর, ১৯)

পরিশেষে বলা যায় যে, এখানে কবি যে মন্ময় সুরের আবেগ জাগানিয়া আর্তি প্রকাশ করেছেন তাতে তাঁর অনন্য কবি প্রতিভার আশ্চর্য পরিচয় মেলে। বংশী ও বিরহ খণ্ড কবি বড়ু চণ্ডীদাসের কবিত্বের উৎকর্ষে অনুপম একথা স্বীকার করতেই হবে।