“ও সে ক্ষণেক থাকে শূন্যে উপর আবার ক্ষণেক ভাসে নীরে।

পড়শী যদি আমায় ছুঁতো আমার সব-যাতনা যেতো দূরে।”

উত্তর : বাউল মত ও সাধনার শ্রেষ্ঠ ভাষ্যকার লালন শাহ মরমি এ সাধককে বাউলগানের মহত্তর জনক বললেও অত্যুক্তি হয় না। অতুলনীয় সংগীত প্রতিভা ও তত্ত্বজ্ঞানের সমন্বয়ে বাউলগানের একটি স্বতন্ত্র ঘরানা নির্মাণ করতে হয়েছিলেন। লালন ফকির মনে করতেন হাতের কাছেই মানুষরূপী পরমাত্মা বিরাজ করেন। তিনি আরো মনে করেন মনের মানুষরূপী পড়শী বিমূর্ত। তাঁর দেহ অবয়ব নেই- নিরাকার, শূন্যের মধ্যে বিরাজ করেন- কেবল তাকে সাধন ভজন দ্বারা স্পর্শ করা যায়। আবার নিরাকার পড়শী যদি কারণে তাঁর ভক্তকে স্পর্শ করেন- তবেই সমস্ত ভব-যন্ত্রণা থেকে মুক্তি লাভ করা সম্ভব হয়।

মধ্যযুগে বাউলদের রচিত গানগুলো বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ। বাউল মতাদর্শে হিন্দু-মুসলিম ধর্মমতের সমন্বয়সাধিত হয়েছে। এ প্রসঙ্গে উপেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য বলেন “বাউল মতাদর্শের প্রবর্তক মুসলিম আউল চাঁদ ও মাধববিবি। আর মাধববিবির শিষ্য নিত্যানন্দের পুত্র বীরভদ্র এই বাউল মতবাদকে জনপ্রিয় করে তুলেছিলেন।”

উত্তরবঙ্গে তথা রাঢ় অঞ্চলে ‘বাউল’কে ‘ক্ষেপা’ বলা হয়। অনেকে মনে করেন ‘বাউল’ শব্দটি এসেছে ‘বাউর’ থেকে যার অর্থ-এলোমেলো, বিশৃঙ্খল, পাগল ইত্যাদি। তাছাড়া উত্তর ভারতে প্রচলিত ‘বাউর’ শব্দটির প্রায়োগিক অর্থের সাথে ‘বাউল’ শব্দের যথেষ্ট সাদৃশ্য খুঁজে পাওয়া যায়। এছাড়াও ধারণা করা হয়, ‘আকুল’ শব্দ থেকে যেমন ‘আউল’ তেমনি ‘ব্যাকুল’ শব্দ থেকে ‘বাউল’ শব্দের উৎপত্তি হয়ে থাকতে পারে। আবার কেউ কেউ মনে করেন বাউল মতবাদের সূচনালগ্নে দীনদুঃখী সংসার বিবাগী একতারা বাজিয়েদের সাধারণ জনগণ ‘বাতুল’ বলে উপহাস করতো। অনেকে মনে করেন এই ‘বাতুল’ শব্দ থেকেই ‘বাউল’ শব্দের উদ্ভব ঘটেছে।

সংসার বিবাগী, ঈশ্বরপ্রেমে মত্ত এবং বাহ্য বিষয়াদিতে উদাস -এক ধরনের মানুষ বাউল নামে পরিচিত। কৃষ্ণদাস কবিরাজ ‘শ্রীচৈতন্যচরিতমৃতে’ এই অর্থে বাউল শব্দের উল্লেখ করেছেন। এই মতানুযায়ী স্বয়ং চৈতন্যদেবও নিজেকে বাউল হিসেবে পরিচয় দিয়েছেন। ‘বাউল শব্দটির উৎপত্তি নিয়ে পণ্ডিতগণের মতপার্থক্য রয়েছে। বাউল মতাদর্শ প্রাচীন ভারতীয় তত্ত্বের উপর প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। তবে এর উদ্ভবের সাথে নিবিড় সংযোগসূত্র রয়েছে সুফি মতবাদের ওপর। ভারতবর্ষে মুসলমান আগমনের পর হিন্দু-মুসলমান বিপরীত ধর্ম ও সংস্কৃতির সংঘর্ষের প্রথম দিকে দক্ষিণ ভারতে, পরে উত্তর ভারতে এবং শেষে বাংলাদেশের হিন্দুসমাজের মধ্যে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করে। এর মূল প্রবণতা ছিল ধর্ম ও সংস্কৃতির সমন্বয়সাধন। পরমাত্মার অংশ হচ্ছে জীবাত্মা। পরমাত্মার স্থিতি হচ্ছে জীবাত্মার মাঝে কাজেই আপনার আত্মার পরিশুদ্ধি ও পরিচয়ই খোদাপ্রাপ্তির উপায়, তাই আত্মার স্বরূপ উপলব্ধির সাধনাই বাউলদের ব্রত। বাউল সম্প্রদায়ের মতাদর্শ হচ্ছে- Know thyself. নিজেকে চেন। যা কুরআনের পরিভাষায় বলা যায় মান আরাফা নাফসাহু ফাকাদ আরাফা রাব্বাহু অর্থাৎ, নিজকে চেনার মাধ্যমেই সবকে চেনা যায়। এটিই বাউল সম্প্রদায়ের মূল কথা।

পরমাত্মা তথা ঈশ্বরের সান্নিধ্য লাভই বাউলতত্ত্বের মূল কথা। কাজেই আপনার আত্মার পরিশুদ্ধি ও পরিচয়ই খোদাপ্রাপ্তির উপায়। তাই আত্মার স্বরূপ উপলব্ধির সাধনাই বাউলদের ব্রত। জীবনের পরম ও চরম সাধনা হচ্ছে খোদাকে চেনা। বাউলের রূপক অভিব্যক্তিতে সে পরমাত্মা হচ্ছেন-মনের মানুষ, অটল মানুষ, অধর মানুষ, মানুষ রতন, পড়শী, মনমনুরা, অচিন পাখি, অলখসাঁই প্রভৃতি। বাউল রচনা সাধারণত রূপকের আবরণে আচ্ছাদিত। সে রূপক দেহাধার, বাহ্যবস্তু ও ব্যবহারিক জীবনের নানাকর্ম ও কর্মপ্রচেষ্টা থেকে গৃহীত। দেহের আধারে যে চৈতন্য, সে-ই তো আত্মা। এ নিরাকার আত্মার স্বরূপ জিজ্ঞাসা শারীরতত্ত্বে মানুষকে ফরেছে কৌতূহলী। বাউলগানে জগৎ ও জীবনের সৃষ্টি ও স্রষ্টার গভীরতর রহস্য ও তত্ত্ব সহজভাবে উদঘাটিত হয়েছে।

‘যে পড়শী বহুকাল থেকে বাস করে দেহে, এত কাছে থাকার পরও সেই পড়শীর সন্ধান মানুষ পায় না। সেই পড়শীকে একদিনও দেখা গেল না। আত্মারূপে পরমাত্মা বিরাজ করে। কাছে থাকে, দেখা যায় না, ধরা যায় না, তাই ক্ষোভ:

“আমার বাড়ির কাছে আরশী নগর

সেথা এক পড়শী বসত করে।

আমি একদিনও না দেখিলাম তারে।”

বাউলদের গানের ভাষা সহজসরল হলেও তাঁদের সাধনতত্ত্ব অত্যন্ত রহস্যময় ও জটিল। সাধারণ মানুষ সহজে তাদের এই সাধনতত্ত্বের অভ্যন্তরে প্রবেশ করতে পারে না। যারা আপনাকে চিনতে পারে, স্বীয় সত্তার স্বরূপ উপলব্ধি করতে পারে তাদের কাছে পরম আকাঙ্ক্ষার মনের মানুষ এসে ধরা দেয়। ‘একবার আপনারে চিনলে পরে যায় অচেনারে চেনা।’ কারণ:

‘আপনাকে চিনলে পরে চেনা যায় পরওয়ার দিগারে।

সাঁই নিরাকারে নিরন্তর খেলছে খেলা এই আকারে ॥”

দেহের আধারে যে চৈতন্য, সে-ই তো আত্মা। এ নিরূপ- নিরাকার আত্মার স্বরূপ জিজ্ঞাসা মানুষকে দেহতত্ত্ব বিষয়ে অনুপ্রাণিত করেছে। এ থেকে মানুষ বুঝতে চেয়েছে দেহযন্ত্র নিরপেক্ষ আত্মার অনুভূতি যখন সম্ভব নয়, তখন আত্মার রহস্য ও স্বরূপ জানতে হবে দেহযন্ত্র বিশ্লেষণ করেই। এভাবেই সাধনতত্ত্বে যৌগিক প্রক্রিয়ার অসামান্য গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। কামাচার বা যোগ-সাধনাই বাউল পদ্ধতি। এ তত্ত্ব অত্যন্ত জটিল। বাউলেরা জীবন সমাজ ও পরিবেশ সচেতন। ভেদবুদ্ধিহীন মানবতার উদার পরিসরে সাম্য ও প্রীতির সুউচ্চ মিনারে বসেই বাউলেরা সাধনা করে। তারা পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সাধক ও দার্শনিকদের কণ্ঠের সঙ্গে কণ্ঠ মিলিয়ে সাম্য ও প্রেমের বাণী শোনায়। তাই বাউলগানে মানুষের দেহমন বিশ্লেষণ করে জীবন ও জগতের, সৃষ্টি ও স্রষ্টার রহস্য উদ্‌ঘাটিত হয়েছে:

“এই মানুষ আছে রে মন

যারে বলে মানুষ রতন

ডুবে দেখ দেখি মন তারে

কিরূপ লীলাময়।

যাঁরে আকাশ পাতাল খোঁজ

এই দেহে তিনি রয়।”

আত্মারূপে মানবদেহে পরমাত্মা বিরাজ করে। এই পরমাত্মা এত কাছে থাকার পরও মানুষ তার সন্ধান পায় না। তাই তার বেদনা ও ক্ষোভ-

“আমার ঘরখানায় কে বিরাজ করে

তারে জনমভর একবার দেখলাম না রে।

কথা কয় রে দেখা দেয় না।

নড়ে চড়ে হাতের কাছে

খুঁজলে জনমভর মেলে না।”

তাছাড়া পৃথিবীতে যত সৃষ্টি আছে তার মধ্যে মানুষ শ্রেষ্ঠ। তাই বাউলদের ধারণা সৃষ্টি জগতের সকল প্রাণীসহ ফেরেশতারা বা দেবদেবীরা পর্যন্ত মানবভজনা করে। বাউলরা তাই ধর্মের নীতিকথা তুলে মানুষে মানুষে বিভেদের বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছেন। বাউলদের গানে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির কথা নানাভাবে ব্যক্ত হয়েছে। ধর্ম-বর্ণ-গোষ্ঠী প্রভৃতি বিভাজনের পরিবর্তে বাউলদের নিকট মানবধর্ম বড়ো ধর্ম। লালন শাহ ছিলেন এই মানবধর্মের পূজারি।

বাউলসাধক লালন শাহ্ তাঁর মতাদর্শ সংগীতের মাধ্যমে প্রকাশ করেছেন। সাধনার গূঢ়তত্ত্ব প্রকাশে তিনি যুগপৎ হিন্দু সম্প্রদায় এবং মুসলিম সম্প্রদায়ের শব্দাদি ব্যবহার করেছেন। তাঁর প্রচারিত মতাদর্শে হিন্দু-মুসলিম উভয় ধর্মের কথা রূপক আকারে স্থান লাভ করেছে। এছাড়াও তিনি দেহতত্ত্বের নানা বিষয়াদি প্রকাশে তান্ত্রিক ও যোগসাধনের কথাও উল্লেখ করেছেন। বাউল লালন শাহের সাধনার মূলসুর দেহতত্ত্বমূলক এবং তিনিও আত্মার যথার্থ উপলব্ধির মাধ্যমে পরম জ্ঞান লাভের কথা বলেছেন। এজন্য তিনি তাঁর গানে উল্লেখ করেছেন:

“আজব কারখানা বোঝা সাধ্য কার,

সাঁই করে লীলা ভবের পার।

এই মানুষে রঙ্গ রসে বিরাজ করে সাঁই আমার ।।”

রবীন্দ্রনাথ বাউলসাধকদের গানগুলোর প্রভাব এড়াতে পারেননি। বিশেষকরে লালন শাহের দর্শন ও ঈশ্বর সাধনার। গানগুলো তাঁকে দারুণভাবে আলোড়িত করেছিল। রবীন্দ্রনাথের নিম্নোক্ত গানে যেন লালন শাহেরই দর্শন অভিব্যক্ত :

“আমার হিয়ার মাঝে লুকিয়ে ছিলে

দেখতে তোমায় পাইনি,

বাহির পানে চোখ মেলেছি

হৃদয় পানে চাইনি।”

যে পড়শী বহুকাল থেকে বাস করে মানবদেহে, এত কাছে থাকার পরও সেই পড়শীর সন্ধান মানুষ পায় না। সেই পড়শীকে একদিনও দেখা গেল না। পড়শীকে কাছে পেতে হলে দরকার সাধনা। কিন্তু সে পড়শী বহুরূপী। সে একস্থানে বাস করে না। তার অবস্থান কখনো শূন্যের ওপরে, আবার কখনো ভাসে পানিতে। বাউলতত্ত্বের আজীবন সাধনা পড়শীকে একান্ত আপন করে পাবার সাধনা। তাকে একবার পেলে সমস্ত যাতনা মুছে যেত। জীবন পরিপূর্ণ হয়ে যেত। তাই বাউল কবির উচ্চারণ:

“ও সে ক্ষণেক থাকে শূন্যের উপর

আবার ক্ষণেক ভাসে নীরে।।

পড়শী যদি আমায় ছুঁতো

আমার সব-যাতনা যেতো দূরে।”

বাউলদের অধ্যাত্ম সাধনার পথ রবীন্দ্রনাথকেও প্রভাবিত করেছিল। যার কারণে গীতাঞ্জলির মতো বিখ্যাত কাব্য রচনা করা সম্ভব হয়েছিল রবীন্দ্রনাথের পক্ষে। বাউল দর্শনের অমিত বাণী মানবহৃদয়ে প্রবেশ করলে অসাম্প্রদায়িক চেতনা সমৃদ্ধ হবে। সমৃদ্ধ হবে মানবজীবন।