ওড হল গীতি-কবিতার প্রাচীনতম ও অন্যতম শাখা। বাংলায় যাকে স্তুতিমূলক কবি রূপে আখ্যাত করা হয়। প্রাচীন গ্রিসে ওড ছিল প্রধানত একধরনের সম্মেলক গান বা কোরাস, তবে একক কণ্ঠের ওডও তখন একেবারে অপ্রচলিত ছিল না। পুরনো ওড়-এ পর পর তিনটি স্তবক থাকত। সম্মেলক গায়কগণ প্রথমে মঞ্চের বাঁদিকে ঘুরে প্রথম স্তবক গাইতেন, একে বলা হত স্ট্রোফি (Strophe) তারপর দ্বিতীয় স্তবকটি গাইতেন ডানদিকে ঘুরে একে বলা হত অ্যান্টিস্ট্রোফি (Antistrophe) এরপর তৃতীয় স্তবকটি গাইতেন সবাই একজায়গায় দাঁড়িয়ে, একে বলা হত ইপোড় (Epode)। কবিতা দীর্ঘ হলে স্তবকের সংখ্যা বেড়ে যেত, কিন্তু পুরনো ওডে তিনটি বিভাগ সর্বদাই মেনে চলা হত। প্রাচীন গ্রিক ভাষায় যেসব কবি সার্থক ওড় রচনা করেছেন, তাঁদের মধ্যে ম্যাফো, অ্যানাক্রেওন, পিন্ডার প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। অবশ্য এসকল কবিদের রচিত ওড়ের বিষয় ছিল এতই ভিন্ন যে গীতি-কবিতার এই বিভাগটিকেই সমালোচক হাডসন খুব বিস্তৃত ও অস্পষ্ট বলে মনে করেন।
পরবর্তীকালে ওড কবিতায় প্রচুর বিবর্তন হলেও এ ধারাটি এখনও সজীব। প্রাচীন গ্রিক রীতির তিনটি বিভাগ এখনো মানা হয়, তবে জনমন তাদের নতুন নামকরণ করেছেন—turn, counter-turn, এবং stand, প্রাচীন গ্রিক কবিদের মধ্যে ওড় রচনায় সবচেয়ে খ্যাতিমান ছিলেন ‘পিডার’। তাঁর মতো কঠিন নিয়মনিষ্ঠা দেখাতে না পারলেও মোটামুটি পিন্ডরীয় রীতিতেই রোমান কবি জোরেস ওড রচনা করেছেন, ইংরেজি কবিতায় কবি মিলটনের সময় থেকেই ওড জাতীয় কবিতা লেখা শুরু হয়েছে, বস্তুত ইংরেজি সাহিত্যে রচিত ওডের মারফতই আমরা এই ধরনের কবিতার সঙ্গে পরিচিত হয়েছি। নতুবা বাংলা সাহিত্যে ঠিক এইরকম স্তুতি কবিতার লেখার রেওয়াজ ছিল না, অতি সমৃদ্ধ ইংরেজি সাহিত্যে যাঁরা মোটামুটিভাবে পিন্ডরীয় রীতি মেনে কবিতা রচনা করেছেন তাঁদের মধ্যে পুরনো কবি বলতে জন মিল্টন ও আব্রাহাম কলির নাম করতে হয়। পরবর্তীকালে এই ধারা অনুসরণ করে যারা নিয়ম মেনে ওড রচনা করেছেন তাঁদের মধ্যে বিখ্যাত কবিতা—স্পন্সরের এপিথালামিয়ন/ শেলীর ওয়েস্ট উইন্ড/ কীসের টু এ নাইটেঙ্গল/গ্রীসিয়ান আর্ন প্রভৃতি। যাঁরা কঠিন নিয়ম না মেনে কিছু স্বাধীনতা নিয়েছিলেন তাঁদের মধ্যে ওয়ার্ডসওয়ার্থ/টেনিসন বিশেষ উল্লেখযোগ্য।
বাংলা কবিতার ওড মূলত আধুনিককালের সৃষ্টি। মধুসূদনের ‘চতুর্দশপদী কবিতাবলীতে কিছু ওড়ের সন্ধান পাওয়া যায়। যেমন—কপোতাক্ষ নদ, বসন্তে একটি পাখির প্রতি, শ্যামাপক্ষী প্রভৃতি। হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা মন্ত্র কবিতাতে ওডধর্মী রচনা কিছু আছে, বিশেষত ইংরেজি কবিতার অনুবাদে। বিহারীলাল চক্রবর্তীর বঙ্গসুন্দরী, নিসর্গ সন্দর্শন, দীর্ঘ রচনা হলেও তাতে ওড়ের ধর্ম রক্ষিত হয়েছে। বাংলা সাহিত্যে সর্বশ্রেষ্ঠ ওড় রচনা করেছেন— রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর । ছোটো কবিতার মধ্যে তাঁর ‘মহুয়া’ কাব্যে ‘নাম্নী’ শীর্ষক কবিতাগুলিকে এই ধরনের কবিতার পর্যায়ে ফেলা হয়। দীর্ঘ কবিতার মধ্যে ‘বসুন্ধরা’, ‘সমুদ্রের প্রতি’, ‘ক্যামেলিয়া’, ‘পৃথিবী’ প্রভৃতি কবিতার উল্লেখ করা যায়। এছাড়া বাংলায় পরবর্তীকালের অন্যান্য ওডের মধ্যে উল্লেখযোগ্য যতীন্দ্রনাথ সেনগুপ্তের ‘পরপন্থা’, সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের ‘বুদ্ধপূর্ণিমা’, মোহিতলাল মজুমদারের ‘পান্থ’, জীবনানন্দ দাশের ‘সুচেতনা’, সঞ্জয় ভট্টাচার্যের ‘নীলিমাকে’, বিনয় মজুমদারের ‘আমার ঈশ্বরীকে’ প্রভৃতি আলোচনার দাবি রাখে।
Leave a comment