ভূমিকাঃ প্রাচীন যুগে জন্মগ্রহণ করেও চিন্তা, চেতনায়, মননে ও পাণ্ডিত্যে দার্শনিক এরিস্টটল ছিলেন সহস্র বছর অগ্রগামী এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের দিকনির্দেশক। বস্তুত রাষ্ট্রচিন্তা, রাষ্ট্র ও সরকারের প্রসঙ্গসহ রাষ্ট্রবিজ্ঞান সম্পর্কিত বিভিন্ন বাস্তবভিত্তিক ও যৌক্তিক বিশ্লেষণের জন্য তাকে যথার্থই রাষ্ট্রবিজ্ঞানের জনক বলা হয়ে থাকে।
বাস্তববাদী দার্শনিক/ চিন্তাবিদ এরিস্টটলঃ এরিস্টটলের পদ্ধতিগত ও রাষ্ট্রচিন্তার আলােকে তার রাষ্ট্রদর্শনের মূল্যায়ন ও অবদান নিম্নে আলােচনা করা হলােঃa
(১) বিজ্ঞানের মর্যাদায় রাষ্ট্রবিজ্ঞানঃ এরিস্টটল রাষ্ট্রবিজ্ঞানকে একটি স্বতন্ত্র বিজ্ঞানের মর্যাদায় উন্নীত করেছেন। তার অনেক মূল্যবান তত্ত্ব ও তথ্য আধুনিক রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও রাষ্ট্রতত্ত্বের ভিত্তি রচনা করতে যথেষ্ট সাহায্য করেছে। বিশেষ করে রাষ্ট্রতত্ত্বের গবেষণা কর্মে তিনি যে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি অনুসরণ করেন, তা নিঃসন্দেহে মৌলিকত্বের নিদর্শন। তার এই গবেষণা পদ্ধতি রাষ্ট্রবিজ্ঞানকে বিজ্ঞানের মর্যাদা দান করেছে।
(২) রাজনৈতিক জীব হিসেবে মানুষঃ মানুষ স্বভাবতই রাজনৈতিক জীব এবং যে ব্যক্তি রাষ্ট্রে বসবাস করে না, সে হয় দেবতা না হয় পশু। এরিস্টটল এ ধারণাকে আনুষ্ঠানিক ও জোরালােভাবে প্রকাশ করেছেন। এভাবে তিনি রাষ্ট্রীয় জীবনের সঙ্গে মানবজীবনের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক প্রত্যক্ষ করে রাষ্ট্রকে এক মানবহিতৈষী প্রতিষ্ঠান হিসেবে বর্ণনা করেছেন।
(৩) আইনের সার্বভৌমত্বের গুরুত্বঃ এরিস্টটল মতে আইনই হলাে চূড়ান্ত সার্বভৌম, কোনাে ব্যক্তি নয় বরং বিধিসম্মতভাবে সংগঠিত আইনের প্রতি আনুগত্য প্রদর্শনের মধ্যেই ব্যক্তির যথার্থ স্বাধীনতা ও মুক্তি নিহিত। এভাবে তিনি সমগ্র রাষ্ট্রব্যবস্থাকে সার্বভৌম আইনের ভিত্তিমূলে প্রতিষ্ঠিত করে আইনের গুরুত্ব আশানুরূপ বৃদ্ধি করেন।
(৪) নিয়মতান্ত্রিকতার ধারণাঃ নিয়মতান্ত্রিকতার ধারণা তথা নিয়মতান্ত্রিক সরকারের অন্যতম উদ্যোক্তা হলেন এরিস্টটল। সরকারব্যবস্থা মূলত আইনের ওপর প্রতিষ্ঠিত এবং আইন দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। প্রকৃতপক্ষে এরিস্টটল যে নিয়মতান্ত্রিক সরকারের সূচনা করেন সেটিই বিবর্তিত হয়ে আধুনিককালে পরিণত রূপ পরিগ্রহ করেছে।
(৫) কল্যাণমূলক রাষ্ট্রঃ রাষ্ট্রের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সম্পর্কে এরিস্টটল যে ধারণা পােষণ করেছেন তা সর্বকাল ও সর্বযুগে সত্য বলে প্রমাণিত হয়েছে। রাষ্ট্রের সীমানার প্রসার ঘটানাে আর সম্পদ আহরণ ও তার বৃদ্ধি রাষ্ট্রের উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য হতে পারে না। জনগণের উন্নত ও মহৎ জীবন গঠন করার সুযােগ প্রদান, সদগুণের উৎকর্ষ সাধন, এবং ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের প্রকৃত লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য।
(৬) সংবিধান বা সরকারের শ্রেণীবিভাগঃ এরিস্টটল সংবিধান বা সরকারের যে শ্রেণীবিভাগ করেছেন তা সরকারের আধুনিক শ্রেণীবিভাগের ভিত্তি হিসেবে কাজ করেছে। যদিও বর্তমানে বিভিন্ন রাষ্ট্রবিজ্ঞানী বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে সরকারের শ্রেণীবিভাগ করেছেন।
(৭) রাষ্ট্রের সুশাসনঃ রাষ্ট্রের সুশাসনের জন্য তিনি দক্ষ প্রশাসনের প্রয়ােজনীয়তা উপলব্ধি করেছিলেন যা বাস্তবতার পরিচয় বহন করে। যারা শাসনকার্যের উপযুক্ত নয় তারা যদি শাসনক্ষমতা পায় তাহলে শেষ পর্যন্ত গােটা রাষ্ট্রের ক্ষতি হবে এ ধারণা তার জন্মেছিল বলে তিনি গণতন্ত্রের প্রতি আস্থাবান হতে পারেননি।
পরিশেষঃ এরিস্টটল তার রাজনৈতিক ভাবাদর্শের মাধ্যমে পরবর্তী প্রজন্মের ক্ষেত্রে ব্যাপক প্রভাব রেখে যেতে সক্ষম হয়েছেন। তার চিন্তাধারা এবং মূল্যবান তত্ত্ব ও তথ্য যুগে যুগে দার্শনিকদের অনুপ্রাণিত করেছে এবং আগামীতেও করতে থাকবে। রাজনীতি বিজ্ঞানে তিনিই সুবর্ণময় মধ্যপন্থার উদ্ভাবক যার জন্য তিনি চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন।
Leave a comment