ছোটোগল্প বর্ণনা প্রধান, আখ্যানধর্মী বা চরিত্র প্রধান এবং বক্তব্য কেন্দ্রিক বা ভাব প্রধান হতে পারে। শ্রেণিবিন্যাসে ‘একরাত্রি’ ছোটোগল্পটি অবশ্যই ভাবকেন্দ্রিক ছোটোগল্প বলে গণ্য হবে। সমালোচক বুদ্ধদেব বসু একরাত্রি গল্পকে ‘গুঞ্জনময় গল্প’ বলেছিলেন। আর একজন সমালোচক শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় এক রাত্রির গল্পের পর্যালোচনায় বলেছিলেন ‘একরাত্রি’ গল্পে চরিত্রাঙ্কণের চেষ্টা নিতান্ত স্বাভাবিক। ইহা কেবল প্রলয় দুর্যোগ-রাত্রির অন্ধকারে নীরব স্থির প্রেমের ধ্রুবতারাটি ফুটাইয়া তুলিয়াছে।” সেকেন্ড মাস্টার ওরফে উত্তম পুরুষের বর্ণিত কথকের জীবন কাহিনির সামান্য দু-একটি ইঙ্গিত আভাস থাকা সত্ত্বেও গল্পের রস পরিণামে চরিত্রের স্বভাব বৈশিষ্ট্যের পরিবর্তে একটা অন্তলীন বেদনা ও আনন্দময় অনুভূতির ভাবনাই প্রবলভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। সমাপ্তি অংশে বর্ষণমুখর একরাত্রির দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ায় গল্পের রস পরিণাম নির্দিষ্ট হয়ে গিয়েছে। গল্পের রস পরিণাম-এ পৌঁছেছে প্রাকৃতিক দুর্যোগের অভিনব বর্ণনায়। প্রায় সমস্ত বাহ্য চেতনাকে লুপ্ত করে দিয়ে, সামাজিক ও নৈতিক বন্ধনকে অস্বীকার করে দুর্নিবার আকর্ষণে ঝড় বৃষ্টি বানে, উন্মত্ততার মতো সেকেন্ড মাস্টার সুরবালার গৃহের দিকে ধাবিত হয়েছে। যে প্রেম অবজ্ঞার সুরে পরিত্যাগ করেছিল পরবর্তীকালে তাকে পেতে ধাবিত হয়েছে। বাক্য বা বাচ্যের সহায়তায় গড়ে ওঠা গল্পের অন্তিম কথাবস্তু যে ধ্বনি তোলে সেই ধ্বনি ছোটোগল্পের রস পরিণাম এনে দেয়। ‘একরাত্রি’ গল্প এই দৃষ্টিভঙ্গির ব্যতিক্রম নয়।

সমালোচক মনে করেছেন নিতান্তই অনাদরে যে মূল্যবান প্রেমময় জীবনকে বর্জন করেছিলেন গল্পের কথক সেকেন্ড মাস্টার, উত্তরকালে অনুভূতিতে না পাওয়ার বেদনায় ও বিষণ্ণতায় সেই জীবনকে ধরে রাখতে চেয়েছিলেন। সুরবালাকে পাবার আকাঙ্ক্ষায় নায়কের জীবনকে দুঃসহ পরিণতির দিকে টেনে নিয়ে গিয়েছে যা উত্তরপর্বে ট্র্যাজেডির নিঃসীম বেদনায় আবৃত করেছে। সুরবালাকে যখন চোখের সামনে রেখেও নায়ক কিন্তু বলতে পারছে না তখন দুজনের বিপরীত উপাদানের শিল্পিত সমন্বয় গল্পটিকে এক অনন্য রস এনে দিয়েছে। আর এর মধ্যে ট্র্যাজেডির সার্থকতা খুঁজে পাওয়া গিয়েছে।

রস পরিণামের দিকেই গল্পের উদ্দিষ্ট লক্ষ্য। তারই প্রয়োজনে ইতিপূর্বেকার ইতিবৃত্ত সংক্ষিপ্ত আকারে গল্পের কাহিনিতে বিন্যস্ত হয়েছে। সুরবালার সঙ্গে পাঠশালায় যাওয়া, বউ বউ খেলা, তার পরে শাসন, উপদ্রব ও প্রভুত্ব করা এবং পরিণামে অবহেলা দেখানোর নেপথ্যে যে অস্বীকৃতির ভঙ্গিমা প্রবল হয়েছিল—পিতার আদেশ সত্ত্বেও শিক্ষা ও দেশোদ্ধারের উন্মাদনায় নায়ক সুরবালাকে বিবাহ করতে অস্বীকার হয়েছিল। তাই উত্তরপর্বে একাধিক আঘাত তার জন্য অপেক্ষা করছিল। পিতার মৃত্যু ও সংসারের কঠিন দায়িত্ব যদি প্রথম আঘাত হয় তবে দ্বিতীয় আঘাত এন্ট্রান্স স্কুলের সেকেন্ড মাস্টারের পদ গ্রহণ। তৃতীয় যে আঘাত চূড়ান্ত ও মর্মান্তিকভাবে তাকে বিপর্যস্ত করেছে এবং গল্পকে নির্দিষ্ট সীমায় উত্তীর্ণ করেছে সেটি হল, পল্লিগ্রামের মধ্যে রামলোচনবাবুর স্ত্রীরূপে সুরবালার প্রতি নতুন আকর্ষণ অনুভব। প্রাকৃতিক দুর্যোগের ঘনঘটায় কোনো এক রাত্রিতে বিষণ্ণ হতাশ নায়ককে সুরবালার পাশে নিয়ে গিয়েছে। রাত্রির অবসানে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে থাকা নির্বাক দুই নরনারীর বিচ্ছেদ রচিত হয়েছে নতুন করে। তাই একরাত্রি এক রাত্রিতেই সমাপ্ত নয়—তা অনন্ত রাত্রির প্রতীকি ব্যঞ্জনা নিয়ে নায়কের কাছে উপস্থিত। তাই নায়ক বলেছে—“আমার সমস্তদিন রাত্রির মধ্যে সেই একটিমাত্র রাত্রিই আমার তুচ্ছ জীবনের একমাত্র চরম সার্থকতা।” নায়কের জবানবন্দিতে গল্পের রস পরিমাণ এক অপূর্ব ভাবব্যঞ্জনায় সৃষ্টি করে। নায়কের আকার ইঙ্গিত ভাবভঙ্গিতে অসহ্য যন্ত্রণাকাতর প্রেমবোধের অনুভব গল্পের এই পর্বে ধ্বনিত হয়েছিল। রস পরিণামে সেই একক নিরবচ্ছিন্ন বেদনাবোধ এক আনন্দময় অনুভূতির ভাবমূলক রসাস্বাদনে আত্মতৃপ্ত হয়েছে।

তাই একরাত্রি গল্পের সমগোত্রীয় একাধিক গল্প রবীন্দ্রনাথ সৃষ্টি করলেও এই শ্রেণির গল্পের মধ্যে ‘একরাত্রি’র বিশিষ্টতা আমাদের দৃষ্টি এড়িয়ে যায় না। অন্তিম পর্বে ব্যঞ্জনা পাঠকের অন্তরে একটা স্থায়ী ছাপ ফেলে যায়। একরাত্রির অভিজ্ঞতার অভিঘাত বিষণ্ণ মধুর উপলব্ধিই অন্তরে মুদ্রিত করে এবং রসোত্তীর্ণ শিল্পবোধের সঙ্গে জীবনের বৈচিত্র্যময় রূপের মেলবন্ধন ঘটে যায়। কথকের শাশ্বত উপলব্ধিই এখানে মূখ্য।