বঙ্কিমচন্দ্রের ‘কমলাকান্তের দপ্তর’-এর প্রবন্ধগুলির বিচিত্র অভিনব আঙ্গিকে মানব জীবনের গভীর সত্যের উপলব্ধি ও তার পটভূমিতে সমাজ-সমালোচনার কল্পনা, হাস্যরস ও আবেগ প্রভৃতির সমন্বয়ে যে বাণীবন্ধনে উপস্থাপিত হয়েছে, তা সত্যই অপূর্ব ও অনন্য সাধারণ। ‘কমলাকান্তের দপ্তর’-এর ‘আমার মন’ প্রবন্ধটি বিশ্লেষণ ও পরীক্ষা করে দেখলে এই বিষয়টি আমাদের কাছে পরিস্ফুট হয়ে ওঠে।
‘আমার মন’-এর মূল বক্তব্য বিষয় এই : পরের জন্য আত্মবিসর্জন ছাড়া পৃথিবীতে মানুষের স্থায়ী সুখের অন্য কোনও উৎস বা ভিত্তি নেই। ঐশ্বর্য, খ্যাতি ইত্যাদি ইন্দ্ৰিয়াদিলব্ধ সুখ স্থায়ী নয়। এই সমস্ত বস্তু প্রথমবারে যে পরিমাণে সুখদায়ক হয়, দ্বিতীয়বারে তা হয় না, তৃতীয়বারে তার পরিমাণ আরও হ্রাস পায়, ক্রমে অভ্যাসে সুখানুভূতি একেবারে লোপ পায়। সুখ থাকে না, কিন্তু দুটি কারণে অতৃপ্তি দেখা দেয়: প্রথমত, অভ্যস্ত বস্তুর ভাবে মুখ না হোক, অভাবে গুরুতর অসুখ বা অতৃপ্তি হয়; এবং তৃপ্তিহীন আকাঙ্ক্ষার বৃদ্ধিতে যন্ত্রণা হয়। সুতরাং পৃথিবীতে যে সমস্ত বিষয় কাম্যবস্তু বলে চিরপরিচিত, তা সমস্তই অতৃপ্তিকর ও দুঃখের মূল। খ্যাতির সঙ্গে নিন্দা, ইন্দ্রিয়সুখের সঙ্গে ব্যাধি, ঐশ্বর্যের সঙ্গে ক্ষতি ও মনোকষ্ট অচ্ছেদ্যভাবেই জড়িত। সুন্দর দেহ জরাগ্রস্ত বা ব্যাধিতে জীর্ণ হয়, সুনামের অধিকারী ব্যক্তির নামেও মিথ্যা কলঙ্ক রটে, মানসম্ভ্রম নিতান্ত ক্ষণস্থায়ী। ধনমানাদি লাভে সুখী রয়েছে একথা কারো মুখে কখনও শোনা যায় না। ধনমান প্রভৃতি কাম্যবস্তুর নিষ্ফলতার এমন অকাট্য প্রমাণ সত্ত্বেও প্রতিটি মানুষ কুশিক্ষার প্রভাবে তার জন্য প্রাণপাত করে। পরসুখবর্ধন ছাড়া মানুষের স্থায়ী সুখের অন্য কোনো ভিত্তি নেই, এই প্রাচীন কথাটি বুদ্ধদেব আড়াই হাজার বছর আগে কতভাবে বলে গেছেন, তারপর শত সহস্র লোকশিক্ষক শত সহস্রবার এই শিক্ষা দিয়েছেন। কিন্তু কিছুতেই লোক শেখে না, আত্মপ্রিয়তার মোহজাল কাটিয়ে উঠতে পারে না। তার ওপর ভারতবর্ষে ইংরেজ শাসন প্রতিষ্ঠিত হবার পর থেকে বাহাসম্পদপ্রিয় ইংরেজ শাসকদের বাণিজ্য, রেলওয়ে, টেলিগ্রাফ ইত্যাদি বাহাসম্পদসাধনে ইংরেজি সভ্যতার প্রধান চিহ্ন লক্ষ্য করে এদেশের ইংরেজি-শিক্ষিত সম্প্রদায় মোহমুগ্ধ হয়ে বাহাসম্পদের আরাধনাকেই জীবনের মূলমন্ত্ররূপে গ্রহণ করেছে। কিন্তু এই বাহ্যসম্পদের পূজায় কারো মনের অশান্তির আগুন নির্বাপিত হয়নি, অভদ্র ভদ্র অশিষ্ট শিষ্ট, অধার্মিক ধার্মিক এবং অপবিত্র পবিত্র হয়নি।
‘আমার মন’-এর এই বক্তব্য বিষয় বিষয়বস্তু প্রধান প্রবন্ধের গতানুগতিক প্রকাশভঙ্গিতে উপস্থাপিত হয়নি, কমলাকান্তের আবেগ, কল্পনা ও হাস্যরস সৃষ্টির বিচিত্র সমন্বয়ে জীবনের গভীরতম সত্যের বাণীমূর্তিরূপেই আমাদের সামনে উদ্ভাসিত হয়েছে। তার মন কোথায় হারিয়ে গেছে, প্রথমেই এই প্রশ্নের সূত্রে কমলাকান্ত পাকশালায় তার হারানো মনের সন্ধান নিয়ে কৌতুক-পরিহাস করেছে। পৌরাণিক অনুষঙ্গে ও বিচিত্র কল্পনায় তার ঔদারিকতার এই বিবরণগুলি সত্যই অত্যন্ত কৌতুকাবহ : “যেখানে পোলাও, কাবাব, কোফতার সুগন্ধ, যেখানে ডেচী-সমারূঢ়া অন্নপূর্ণার মৃদু মৃদু ফুটফুটবুটবুট টকোবকোধ্বনি, সেইখানে আমার মন পড়িয়া থাকিত” কিংবা “যেখানে ছাগ-নন্দন, দ্বিতীয় দধীচির ন্যায় পরোপকারার্থ আপন অস্থি সমর্পণ করেন, যেখানে মাংসযুক্ত সেই অস্থিতে কোর্মা-রূপ বজ্র নির্মিত হইয়া, ক্ষুধারূপ বৃত্রাসুর বধের জন্য প্রস্তুত থাকে, আমার মন সেইখানেই, ইন্দ্ৰত্ব লাভের জন্য বসিয়া থাকে।” প্রসন্ন গোয়ালিনীর সঙ্গে কমলাকান্তের গব্যরসাত্মক প্রণয়ের বিবরণ কৌতুকরসসিক্ত, প্রসন্নর প্রতি তার অনুরাগের এই কারণ নির্দেশ অত্যন্ত কৌতুকাবহ : “প্রথমতঃ প্রসন্ন যে দুগ্ধ দেয়, তাহা নির্জ্জল, এবং দামে সস্তা; দ্বিতীয়ত, সে কখন কখন ক্ষীর, সর, নবনীত আমাকে বিনামূল্যে দিয়া যায়; তৃতীয়ত, সে একদিন আমাকে কহিয়াছিল; ‘দাদাঠাকুর, তোমার দপ্তরে ও কিসের কাগজ?’ আমি জিজ্ঞাসা করিলাম, ‘শুনবি?’ সে বলিল, ‘শুনিব’। আমি তাহাকে কয়েকটি প্রবন্ধ পড়িয়া শুনাইলাম—সে বসিয়া শুনিল। এতগুণে কোন্ লিপিব্যবসায়ী ব্যক্তি বশীভূত না হয়? প্রসন্নের গুণের কথা আর অধিক কি বলিব—সে আমার অনুরোধে আফিম ধরিয়াছিল।”
পাকশালায়, এমনকি প্রসন্ন গোয়ালিনীর কাছেও নিজের হারানো মনের সন্ধান না পেয়ে কমলাকান্ত পথে বার হয়ে কলসী কাঁখে একজন যুবতীকে দেখে, তার রূপলাবণ্যকে তরঙ্গের মতোই উচ্ছ্বলিত হতে দেখে ভাবে, এই তরুণীই তার মন চুরি করেছে। কমলাকান্ত তার সঙ্গে সঙ্গে চললে যুবতী সে তার পিছু কেন নিয়েছে জানতে চায়। কমলাকান্ত বলে, সে তার মন চুরি করেছে : “যুবতী কটূক্তি করিয়া গালি দিল। বলিল, চুরি করি নাই। তোমার ভগিনী আমাকে যাচাই করিতে দিয়াছিল। দর কষিয়া আমি ফিরিয়া দিয়াছি।” কমলাকান্তের এই হারানো মন সন্ধানের কল্পনাও অত্যন্ত হাস্যোদ্দীপক, এখানেও সংযম ও সুরুচির মাত্রা লঙ্ঘিত হয়নি। কিন্তু এই অংশগুলি নিছক হাস্যোদ্দীপক কল্পনা বিলাসের উদাহরণ মাত্র নয়। এই সংসারে অধিকাংশ মানুষের ধারণা ইন্দ্রিয়-পরিতৃপ্তিতেই সুখ, তাকেই জীবনের চরম লক্ষ্য করে তোলে। কিন্তু নিছক ইন্দ্রিয়-পরিতৃপ্তিতে যে মানব জীবনের প্রকৃত ও স্থায়ী সুখ নিহিত নেই, কমলাকান্ত তার এই সমস্ত হাস্যোদ্দীপক কল্পনা বিলাসে জীবনের চরিতার্থতা সম্পর্কিত সেই চিন্তাকে হৃদয়গ্রাহী সত্যরূপেই প্রকাশ করেছে। এভাবেই কমলাকান্তের মধ্য দিয়ে বঙ্কিমচন্দ্রের জীবনের তীক্ষ্ণ, মৌলিক বিশ্লেষণ জীবন সমালোচনার বিশিষ্ট ভঙ্গি কল্পনায় ও বিশুদ্ধ হাস্যরসের কিরণ-সম্পাতে উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। আমরা তার অন্তরালে গভীর চিন্তাশীলতাকেই লক্ষ্য করি।
পরসুখবর্ধন ছাড়া যে মানুষের সুখের অন্য কোনো মূল্য নেই, সেই সম্পর্কে কমলাকান্ত এই গভীর চিন্তাকে মন্ত্রের মতোই উচ্চারণ করে “আমি মরিয়া ছাই হইব, আমার নাম পর্যন্ত লুপ্ত হইবে, কিন্তু আমি মুক্তকণ্ঠে বলিতেছি, একদিন মনুষ্যমাত্রে আমার এই কথা বুঝিবে যে, মনুষ্যের স্থায়ী সুখের অন্য মূল্য নাই। এখন যেমন লোকে উন্মত্ত হইয়া ধন মান ভোগাদির প্রতি ধাবিত হয়, একদিন মনুষ্য জাতি সেইরূপ উন্মত্ত হইয়া পরের সুখের প্রতি ধাবমান হইবে। আমি মরিয়া ছাই হইব, কিন্তু আমার এ আশা একদিন ফলিবে। ফলিবে, কিন্তু কত দিনে! হায়, কে বলিবে, কতদিন।” এখানে কমলাকান্ত তথ্য তার স্রষ্টার আবেগ-কম্পিত কণ্ঠস্বরটিকে মানুষের আত্মকেন্দ্রিকতায় বেদনাহত হৃদয়ের দীর্ঘশ্বাসকে আমরা স্পষ্টই শুনতে পাই। মানব জীবনের চরিতার্থতার এই সত্য কমলাকান্ত তথা তার স্রষ্টার আবেগ স্পন্দনই আমাদের কাছে ধরা দেয় বলেই তা আমাদের হৃদয়কে গভীরভাবে আলোড়িত করে। ভারতবর্ষের ইংরেজি-শিক্ষিত সম্প্রদায় ইংরেজদের বাহাসম্পদ প্রীতি ও বাহাসম্পদসাধনের আয়োজনের লক্ষ্য করে মোহমুগ্ধ ও বিভ্রান্ত হয়ে বুদ্ধদেব ও অন্যান্য ভারতীয় সাধকদের পরের জন্য আত্মবিসর্জনই যে মানব জীবনের স্থায়ী সুখ, সেই শিক্ষাকে জলাঞ্জলি দিয়ে বৈষয়িক সুখ সমৃদ্ধির কামনায় ও তার সন্ধানে মত্ত হয়ে উঠেছিল। তার জন্য আত্ম ও পর-বঞ্চনায় তাদের কোনো দ্বিধা হয়নি। কমলাকান্ত এই অংশে সেই সম্পর্কে গভীর ক্ষোভ ও বেদনাকেই প্রকাশ করেছে : “মন আবার কি? টাকা ছাড়া মন কি? টাকা ছাড়া আমাদের মন নাই; ট্যাকশালে আমাদের মন ভাঙ্গে গড়ে।” আমরা এখানে কমলাকান্তের তথা তার স্রষ্টার আমাদের জাতীয় জীবনের করুণ রিক্ততা ও বঞ্চনার আবেগ স্পন্দিত উপলব্ধির প্রকাশকেই লক্ষ্য করি, প্রথমাংশের নিজের হারানো-মনের সন্ধান সম্পর্কিত হাস্যোদ্দীপক কল্পনা-বিলাসের সঙ্গে এই আবেগকম্পিত উপলব্ধিকে মানব জীবন সম্পর্কিত চিন্তা ও অনুভূতির ঐক্যসূত্রেই সমন্বিত হতে দেখি।
“এই প্রবন্ধগুলিতে জীবনের তীক্ষ্ণ, মৌলিক বিশ্লেষণ, সমালোচনার বিশিষ্ট ভঙ্গী কল্পনা সমৃদ্ধিযোগে অপরূপ ও বিশুদ্ধ হাস্য-কিরণ সম্পাতে ভাস্বর হইয়া উঠিয়াছে; গভীর চিন্তাশীলতা, জীবনের করুণ রিক্ততা ও বঞ্চনার আবেগ-কম্পিত উপলব্ধির সহিত হাস্যোদ্দীপক, লীলায়িত অথচ সূক্ষ্মসংযমবোধ নিয়ন্ত্রিত কল্পনা-বিলাসের অপূর্ব সমন্বয় সাধিত হইয়াছে”—এই উক্তিটি যে ‘আমার মন’ প্রবন্ধটি সম্পর্কে সম্পূর্ণরূপেই প্রযোজ্য, এই বিশ্লেষণের সাহায্যেই বোঝা যায়।
Leave a comment