ঋগবৈদিক যুগে আর্য সমাজে বর্ণপ্রথার অস্তিত্ব ছিল—এবিষয়ে ইতিহাসবিদগণ মােটামুটি একমত। তবে এই সময় ভারতে জাতিভেদপ্রথার অস্তিত্ব ছিল কি না সে বিষয়টি নিয়ে পণ্ডিতমহলে যথেষ্ট বিতর্ক রয়েছে। কেউ কেউ মনে করেন যে, ঋগবৈদিক যুগের সূচনাতেই সমাজে জাতিভেদ প্রথার অস্তিত্ব ছিল। আবার কেউ কেউ মনে করেন যে, জাতিভেদ প্রথার উৎপত্তি ঘটেছিল আরও পরে, বর্ণপ্রথা থেকেই।

[1] ঋগবৈদিক সমাজে জাতিভেদের উপস্থিতির পক্ষে যুক্তি: কোনাে কোনাে ঐতিহাসিক মনে করেন যে, ঋগবৈদিক সমাজে জাতিভেদপ্রথার অস্তিত্ব অবশ্যই ছিল। তারা ঋগবেদের পুরুষসূত্তের একটি স্তোত্র উল্লেখ করে বলেন যে, আদি পুরুষ ব্রয়ার মুখমণ্ডল থেকে ব্রাহ্মণ, বাহুদ্বয় থেকে ক্ষত্রিয়, উরুদেশ থেকে বৈশ্য ও চরণযুগল থেকে শূদ্রের উৎপত্তি হয়েছে। তাদের মতে, বর্ণ বা জাতির অবস্থান নির্ধারিত হয় জন্মসূত্রে, কর্মসূত্রে নয়। সেই অর্থে ঋগবৈদিক সমাজের চারটি বর্ণ বংশানুক্রমিকভাবে চলতে চলতে জাতিতে পরিণত হয়।

[2] ঋগবৈদিক সমাজে জাতিভেদের অনুপস্থিতির পক্ষে যুক্তি: [i] ঋগবেদের যুগে বিভিন্ন শ্রেণি ও পেশার মানুষ থাকলেও এই শ্রেণি ও পেশা বংশানুক্রমিক ছিল না। [ii] বিভিন্ন জাতির একত্রে আহারের ক্ষেত্রে এবং অন্তর্বিবাহে নিষেধাজ্ঞা জাতিভেদপ্রথার এই বিশেষ দুটি বৈশিষ্ট্যের উল্লেখ ঋগবেদে নেই। বরং ঋগবেদে আর্য ও শূদ্রের বিবাহের উল্লেখ আছে। [iii] অধিকাংশ ঐতিহাসিকের মতে, ঋগবৈদিক যুগের পরবর্তীকালে ধীরে ধীরে পূর্বভারতে আর্যদের বসতির প্রসার ঘটলে সমাজজীবনে জটিলতা বাড়ে। সমাজে তখনই অর্থাৎ যজুর্বেদের যুগে জাতিভেদপ্রথার চূড়ান্ত প্রকাশ দেখা দেয়।

ইতিহাসবিদ ড. এ. এল. বাসাম মনে করেন যে, ঋগবৈদিক যুগে বর্ণ বলতে কখনােই জাতিকে বোঝাত না। বর্ণ’ ও ‘জাতি দুটি পৃথক সত্তা। জাতিপ্রথার বাস্তব ভিত্তি ভারতীয় সমাজে সুস্পষ্ট। তবে বর্ণপ্রথার ধারা থেকেই পরবর্তীকালে ভারতীয় সমাজে জাতিপ্রথার উদ্ভব ঘটে।

[1] ড. ডি. ডি. কোশান্ত্রীর মত: ইতিহাসবিদ ড. ডি. ডি. কোশাম্বী মনে করেন যে, ঋগবৈদিক যুগে উপজাতিগুলির মধ্যে জাতিবৈষম্য বা শ্রেণিবৈষম্য ছিল না। পরবর্তীকালে উপজাতিপুলি ভেঙে পড়তে থাকে এবং তখনই জাতিভেদ প্রথার আত্মপ্রকাশ ঘটে।

[2] রিজলের অভিমত: হার্বার্ট রিজলে মনে করেন যে, সমাজে শ্রমভিত্তিক প্রয়ােজন থেকেই পেশাভিত্তিক জাতির উদ্ভব হয়েছিল। তিনি জাতিভেদ প্রথার উদ্ভবের পশ্চাতে পেশা, সম্প্রদায়, ভাষা প্রভৃতি উপাদানের ওপর গুরুত্ব দিয়েছেন।

উপসংহার: ঋগবৈদিক যুগের বর্ণপ্রথা পরে ভারতীয় সমাজ- ব্যবস্থায় জাতিপ্ৰথায় পরিণত হয়। ক্রমে বর্ণপ্রথার বিষয়টি গুরুত্ব হারায় এবং এর জায়গায় জাতিপ্রথাই গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হয়ে দাঁড়ায়।