“লেখক নিছক কলম-পেষা মজুর” (“লেখকের কথা’)–সামাজিক দায়পালনের প্রথম আত্মসচেতনতায় এই অভিনব সিদ্ধান্তের প্রবক্তা মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়। প্রকৃত নাম, প্রবোধকুমার। “জন্ম-পত্রিকায় নাম ছিল অধরচন্দ্র। কিন্তু তার জ্যেষ্ঠ ভ্রাতৃজায়া অমিয়া বন্দ্যোপাধ্যায়ের সূত্রে জানতে পারা যায় গায়ের উজ্জ্বল কালো রং ও সুন্দর মুখশ্রী দেখে আঁতুড়েই তার নামকরণ হয়েছিল ‘কালো মানিক’ এবং সেইসূত্রে তার ডাক নাম হয় মানিক। বন্ধুদের সঙ্গে বাজী রেখে ‘বিচিত্রা’য় প্রথম গল্প পাঠানোর সময় লেখক হিসেবে নিজের ডাকনাম ব্যবহার করেছিলেন তিনি”।

মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের জন্ম-বাল্য-শিক্ষা:

১৯০৮ খ্রীস্টাব্দের ১৯শে মে (বঙ্গাব্দ ১৩১৫, ৬ই জ্যৈষ্ঠ) সাঁওতাল পরগনার দুমকা শহরে মানিকের জন্ম হয়। তিনি চৌদ্দটি ভাই-বোনের মধ্যে সম্ভবতঃ অষ্টম সন্তান। পিতা হরিহর বন্দ্যোপাধ্যায়, সাব-ডেপুটি রেজিস্টার, মা নীরদাসুন্দরী দেবী। মানিক যোল বছর বয়সেই মাতৃহীনা। যৌথ পরিবারের জীবনযাপন হেতু ছোটবেলা থেকেই স্নেহহীন উদাসীনতার শিকার। জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা সুধাংশু কুমার ভারত বিখ্যাত মেট্রোলজিস্ট এবং উচ্চপদস্থ চাকুরে হওয়া সত্ত্বেও পরিবারের প্রতি নির্মমভাবে বিমুখ ছিলেন। তাই ব্যথিত, বিক্ষুব্ধ, বিত্তহীন মানিক পিতার ভরণ-পোষণের দায়িত্ব নিয়ে তার দায়িত্বহীনতায় হয়েছেন সোচ্চার (এ সম্পর্কে ‘মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের সমাজ জিজ্ঞাসা’ গ্রন্থে বিস্তৃত পত্র দ্রষ্টব্য, পৃষ্ঠা ৪১-৫১)।

ছোটবেলা থেকে বেপরোয়া ছন্নছাড়া স্বভাবের বশে জেলে-মালা ইত্যাদি শ্রমজীবী মানুষের মধ্যে ঘোরাফেরা, কুস্তি লড়া, স্কুলে না গিয়ে কখনো শালবনির জঙ্গলে, কখনো বা মহিষাদলে, টাঙ্গাইলে বা ব্রাহ্মণবেড়িয়া অঞ্চলে ঘুরে বেড়ানো, গাঁয়ে আগুন নেভানোর কাজে এগিয়ে যাওয়া, গুণ্ডা শায়েস্তা করা, শরীর থেকে কাচের টুকরো বের করার সময় শৈশবেই অসম্ভব সহ্যশক্তির পরিচয় দেওয়া ইত্যাদি বিচিত্র স্বভাব-বৈশিষ্ট্যে তার জীবন চিহ্নিত।

মানিকের শিক্ষারম্ভ প্রথমে মিত্র ইনস্টিটিউশনে, পরে টাঙ্গাইলে এবং মেদিনীপুর জেলা স্কুলে। ১৯২৬ খ্রীস্টাব্দে আবশ্যিক ও ঐচ্ছিক গণিতে লেটার নিয়ে প্রথম বিভাগে ম্যাট্রিক পাশ করেন। ১৯২৮ খ্রীস্টাব্দে বাঁকুড়ার ওয়েসলিয়ান মিশন কলেজ থেকে প্রথম বিভাগে আই. এস. সি. পাশ করেন। তারপরে অঙ্কে অনার্স নিয়ে প্রেসিডেন্সীতে ভর্তি হন। বি. এস. সি. কোর্স সম্পূর্ণ করার পূর্বে সাহিত্যিক হওয়ার তাড়নায় পরীক্ষা পাশের কাজে গাফিলতি ঘটে। আর এখানেই এ্যাকাডেমিক পড়াশুনায় ইতি হয়।

মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিজ্ঞান ও মার্কসীয় চেতনা:

ছাত্রজীবন থেকেই তাঁর বিজ্ঞানের প্রতি ছিল অপরিসীম অনুরাগ। এই অনুরাগের বশে বিজ্ঞানের বিভিন্ন গ্রন্থ পড়ে বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গী অর্জনের শিক্ষালাভ করেন। ‘জাত বৈজ্ঞানিকের কেন-ধর্মী জীবন-জিজ্ঞাসা’র জাগরণ হয়, উপন্যাসে সমাজ-বাস্তবতার অনুসন্ধানে তার প্রয়োগ-রূপায়ণ ঘটে। বিজ্ঞান পড়ার প্রয়োজন তাঁর মতে, “সরাসরি বিজ্ঞানের কিছু শিক্ষা পাওয়া নয় উপন্যাস লেখার জন্য দরকার খানিকটা বৈজ্ঞানিক বিচারবোধ। প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে বিজ্ঞান প্রভাবিত মন উপন্যাস লেখার জন্য অপরিহার্য রূপে প্রয়োজন।” (“উপন্যাসের ধারা’)। অভিজ্ঞতালব্ধ ঘটনার চুলচেরা বিশ্লেষণে বা কার্যকারণ আবিষ্কারে যুক্তি নির্ভর মানসিকতার মধ্যে প্রতিফলিত হয় এই বিজ্ঞানচেতনা।

অন্যদিকে এই বিজ্ঞানচেতনার প্রতিফলনেই আসে অন্তর্মনের জটিলতা অনুসন্ধান। সিগমুন্ড ফ্রয়েডের গ্রন্থ সমূহের নিষ্ঠাশীল পাঠকরূপে নরনারীর সম্বন্ধ-নির্ণয়ে লক্ষ্য করেন চেতন-অবচেতনের প্রভাব। প্রথম পর্যায়ের গল্প-উপন্যাসে দেখা যায় তার প্রকাশ। শোনা যায়, ফ্রয়েড জীবনের শেষ পর্যায়ে নাকি অবৈজ্ঞানিক অলৌকিকতায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়ায় ইয়ুঙ প্রমুখ তাঁর অনুগামীরা ভিন্নতর ভাবনার সন্ধান করেন। খুব সম্ভবতঃ মানিকও পরবর্তী কালে এই কারণে ফ্রয়েডে শেষ আস্থা খুঁজে না পেয়ে মার্কসীয় ভাবনার সন্ধান করেন। মার্কস-এঙ্গেলস্-লেনিন-কডওয়েল-সিডনি ফিনকাইস্টাইন প্রমুখ লেখকদের লেখা সযত্নে পড়েন, লেনিনের উক্তি ডায়েরির পাতায় নোট করেন, “Learn from the masses, try to comprehend their action; carefully study the practical experience of the struggle of the masses”. আবার পার্টির নিষ্ঠাবান কর্মী হয়ে মহম্মদ আলি পার্কের মিছিলের অভিজ্ঞতা থেকে লেখেন ‘চিহ্ন’ ইত্যাদি উপন্যাস বা তেভাগা আন্দোলনের পটভূমিতে একাধিক গল্প।

বস্তুত, মার্কসবাদের সঙ্গে পরিচয়ের পর বিজ্ঞান-সংক্রান্ত গ্রন্থপাঠ, প্রগতি সংঘের সাপ্তাহিক বৈঠকে নিয়মিত উপস্থিতি সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা এবং হিন্দু-মুসলমানের মিলিত ঐক্যবদ্ধ তেভাগা সংগ্রাম, সাজানো রাজনীতির নোংরা চক্রান্ত, শোষক-জোতদারের বিরুদ্ধে সংগ্রামী কৃষকশ্রেণীর প্রতিবাদপ্রবণ মনোভাব ইত্যাদি ঘটনাসমূহ মানিকের মনোজগতে ছায়া ফেলে। তাই পরে নিজে অকপটে স্বীকার করেন “লিখতে আরম্ভ করার পর জীবন ও সাহিত্য সম্পর্কে আমার দৃষ্টিভঙ্গীর পরিবর্তন আগেও ঘটেছে, মার্কসবাদের সঙ্গে পরিচয় হবার পর আরও ব্যাপক ও গভীরভাবে সে পরিবর্তন ঘটাবার প্রয়োজন উপলব্ধি করি। মার্কসবাদ যেটুকু বুঝেছি তাতেই আমার কাছে ধরা পড়ে গিয়েছে যে, আমার সৃষ্টিতে কত মিথ্যা, বিভ্রান্তি আর আবর্জনা আমি আমদানী করেছি জীবন ও সাহিত্যকে একান্ত নিষ্ঠার সঙ্গে ভালোবেসেও, জীবন ও সাহিত্যকে এগিয়ে নেবার উদ্দেশ্য থাকা সত্ত্বেও। মার্কসবাদই আবার আমাকে এটাও শিখিয়েছে যে, এজন্য আপশোষ করলেও নিজেকে ধিক্কার দেবার প্রয়োজন নেই” (“সাহিত্য করার আগে’’, ‘লেখকের কথা’)। ১৯৪৪ খ্রীস্টাব্দের জানুয়ারী (চিন্মোহন সেহানবীশের মতে, ১৯৪৩ খ্রীস্টাব্দের প্রথম দিকে) ‘ফ্যাসিস্ট বিরোধী লেখক ও শিল্পীসংঘে যোগদান এবং কম্যুনিস্ট পার্টির সদস্যপদ লাভ করেন। এরপরে ১৯৪৯ খ্রীস্টাব্দের এপ্রিল মাসে সংঘের চতুর্থ সন্মেলনে এবং ১৯৫৩ খ্রীস্টাব্দের এপ্রিলের দ্বিতীয় সপ্তাহে মানিকের সভাপতিত্বে পঞ্চম এবং শেষ বার্ষিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়।

মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের সাহিত্যসূচনা:

ছাত্রাবস্থায় কলেজের বন্ধুদের সঙ্গে বাজী রেখে লেখা ছাত্রাবস্থায় ‘বিচিত্রা’ পত্রিকায় ১৯২৮ খ্রীস্টাব্দে প্রকাশিত হয় মানিকের প্রথম গল্প ‘অতসীমামী’। এরপর ১৯২৮ থেকে ১৯৩৫ খ্রীস্টাব্দের মধ্যে ‘বিচিত্রা’, ‘বঙ্গশ্রী’, এবং ‘ভারতবর্ষ’ পত্রিকায় তাঁর স্মরণীয় রচনাগুলির আত্মপ্রকাশ। ১৯৪৬-এ আনন্দবাজার পত্রিকার শারদীয়া সংখ্যায় লেখা হয় ‘সহরবাসের ইতিকথা’। গ্রন্থাকারে প্রকাশিত তাঁর রচনাসমূহ প্রকাশ মাত্রই পাঠক-সমালোচক মহলে স্বীকৃতি পায়। তাঁর বিশ বছরের সাহিত্য জীবনে ৩৫টি উপন্যাস ও ১৮টি গল্পগ্রন্থ এবং মৃত্যুর পর ৪টি উপন্যাস, ২টি গল্পগ্রন্থ ও একাধিক গ্রন্থাবলী প্রকাশিত হয়।

মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের রচনাসমূহ:

(ক) মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপন্যাস : ‘জননী’ (১৯৩৫), ‘দিবারাত্রির কাব্য’ (১৯৩৫), ‘পুতুলনাচের ইতিকথা’ (১৯৩৬), ‘পদ্মানদীর মাঝি’ (১৯৩৬), ‘জীবনের জটিলতা’ (১৯৩৬), ‘অমৃতস্য পুত্ৰাঃ’ (১৯৩৮), ‘সহরতলী’ (১ম পর্ব-১৯৪০, ২য় পর্ব-১৯৪১), ‘অহিংসা’ (১৯৪১), ‘ধরা বাঁধা জীবন’ (১৯৪১), ‘প্রতিবিম্ব’ (১৯৪৩), ‘দর্পণ’ (১৯৪৫), ‘সহরবাসের ইতিকথা’ (১৯৪৬), ‘চিত্তামণি’ (১৯৪৬), ‘চিহ্ন’ (১৯৪৭), ‘আদায়ের ইতিহাস’ (১৯৪৭), ‘চতুষ্কোণ’ (১৯৪৮), ‘জীয়ন্ত’ (১৯৫০), ‘পেশা’ (১৯৫১), ‘স্বাধীনতার স্বাদ’ (১৯৫১), ‘সোনার চেয়ে দামী’ (১ম খণ্ড-বেকার ১৯৫১, ২য় খণ্ড আপোষ ১৯৫২), ‘ছন্দপতন’ (১৯৫১), ‘ইতিকথার পরের কথা’ (১৯৫২), ‘পাশাপাশি’ (১৯৫২), সার্বজনীন (১৯৫২), ‘আরোগ্য’ (১৯৫৩), ‘তেইশ বছর আগে পরে’ (১৯৫৩), ‘নাগপাশ’ (১৯৫৩), ‘চালচলন’ (১৯৫৩), ‘শুভাশুভ’ (১৯৫৪), ‘হরফ’ (১৯৫৪), ‘পরাধীন প্রেম’ (১৯৫৫), ‘হলুদ নদী সবুজ বন’ (১৯৫৬), ‘প্রাণেশ্বরের উপাখ্যান’ (১৯৫৬), ‘মাটি ঘেঁষা মানুষ’, ‘চাষীর মেয়ে ও কুলির বৌ’ (১৯৫৭), ‘শান্তিলতা’ (১৯৬০), ‘মাঝির ছেলে’ (১৯৬০)।

(খ) মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের গল্পগ্রন্থ : ‘অতসীমামী ও অন্যান্য গল্প’ (১৯৩৫), ‘প্রাগৈতিহাসিক’ (১৯৩৭), ‘মিহি ও মোটা কাহিনী’ (১৯৩৮), ‘সরীসৃপ’ (১৯৩৯), ‘বৌ’ (১৯৪০), ‘সমুদ্রের স্বাদ’ (১৯৪৩), ‘ভেজাল’ (১৯৪৪), ‘হলুদেপোড়া’ (১৯৪৫), ‘আজ কাল পরশুর গল্প’ (১৯৪৬), ‘পরিস্থিতি’ (১৯৪৬), ‘ছোটবড়’ (১৯৪৮), ‘মাটির মাশুল’ (১৯৪৮), ‘ছোট বকুলপুরের যাত্রী’ (১৯৪৯), ‘মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের শ্রেষ্ঠ গল্প’ (১৯৫০), ‘ফেরিওলা’ (১৯৫৩), ‘লাজুকলতা’ (১৯৫৪), ‘মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের স্বনির্বাচিত গল্প’ (১৯৫৬), ‘গল্প সংগ্রহ’ (১৯৫৭), ‘ছোটদের শ্রেষ্ঠ গল্প’ (১৯৫৮), ‘উত্তরকালের গল্প সংগ্রহ’ (১৯৬৩), ‘কিশোর বিচিত্রা’ (১৯৬৮)।

(গ) মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রবন্ধ-সঙ্কলন : ‘লেখকের কথা’ (১৯৫৭)।

মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের আবির্ভাবকালে বাংলা কথাসাহিত্যের মধ্যে তখনও অনেকেই আসীন। কল্লোল-বিচিত্রা শনিবারের চিঠি-প্রবাসী ইত্যাদি পত্রিকায় আধুনিক লেখকদের লেখাও মানিকের অজানা ছিল না। তার নিজের ভাষায় “তীক্ষ্ণতা, ভঙ্গির নূতনত্ব, নতুন মানুষ ও পরিবেশের আমদানি, নরনারীর রোমান্টিক সম্পর্ককে বাস্তব করে তোলার দুঃসাহসী চেষ্টা আশা ও উল্লাস জাগায় তারই পাশাপাশি হাল্কা নোংরা ন্যাকামি তীব্র বিতৃষ্ণা জাগায়।” এই দৃষ্টিভঙ্গীর প্রথম প্রমাণ ‘জননী’ উপন্যাস। এখানে শ্যামা নামে অতি সাধারণ এক নিম্ন-মধ্যবিত্ত পরিবারের নারীর জননীরূপে আত্মপ্রকাশের চিত্রটি মূর্ত; শ্যামার প্রথম জীবন দায়িত্বজ্ঞানহীন স্বামী, সুস্থ মধুর দাম্পত্যজীবনের বঞ্চনা ও প্রথম সন্তানের মৃত্যুর কারণে বিষণ্ণ ও বিতৃষ্ণার। তারপর সাত বছর সন্তানহীনতার যন্ত্রণা সয়ে বিধানের এবং পরে অন্য ছেলেমেয়ের জন্মদানের অভিজ্ঞতা হয়। স্বভাবতই বিধান হয়ে ওঠে তার নয়নমণি। সেই বিধানকে বড়ো করে বিয়ে দিয়ে দেখা দিল জটিলতা। বৌ সুবর্ণ লজ্জাশীলা কোমলপ্রাণা হওয়া সত্ত্বেও সে হয়ে ওঠে শ্যামার চক্ষুশূল। শ্যামার আশঙ্কা হয়েছিল সে তার সংসারের একচ্ছত্র আধিপত্যের সম্ভাব্য ভাগীদার হয়ে উঠবে। কিন্তু যখন শ্যামা জানল সুবর্ণ সন্তান সম্ভবা, তখন “সুবর্ণকে শ্যামা যেন বুকের মধ্যে লুকাইয়া রাখিয়া একটি দিনের প্রতীক্ষা করিতে লাগিল, কোথায় গেল ক্ষুদ্র বিদ্বেষ, তুচ্ছ শত্রুতা! সুবর্ণের জীবন লইয়া শ্যামা যেন বাঁচিয়া রহিল।”

মানিকের ‘দিবারাত্রির কাব্য’ উপন্যাসটির গঠনশৈলী অভিনব। এখানে ‘দিনের কবিতা’, ‘রাতের কবিতা’ ও ‘দিবারাত্রির কাব্য’ এই তিনটি অধ্যায় নিয়ে উপন্যাসটি সম্পূর্ণ। প্রত্যেকটি অধ্যায়ের সূচনায় আছে একটি করে কবিতা, যা সংশ্লিষ্ট অধ্যায়ের রূপক বিশ্লেষণের প্রয়োজনে উপস্থাপিত। লেখকের নিজের ভাষায় : “এটি গল্পও নয়। একটু চিন্তা করলেই বোঝা যাবে, বাস্তব জগতের সঙ্গে সম্পর্ক দিয়ে সীমাবদ্ধ করে নিলে মানুষের কতগুলি অনুভূতি যা দাঁড়ায়, সেইগুলিকেই মানুষের রূপ দেওয়া হয়েছে। চরিত্রগুলি কেউ মানুষ নয়, মানুষের Projection মানুষের এক-এক টুকরো মানসিক অংশ।” উপন্যাসের নায়ক হেরম্ব, তার জীবনে দেখা দেয় দুই নারী—সুপ্রিয়া আর আনন্দ। পাঁচ বছর প্রতীক্ষার পর রূপাইকুড়ায় এসে হেরম্ব সুপ্রিয়াকে নিরাশ করল, অন্যদিকে পুরীর সমুদ্রতীরে পৌঁছে আনন্দকে পেয়ে তার মনে হয়েছিল, “আনন্দের সহজাত সরলতার চেয়ে সুপ্রিয়ার মনোভিজাত্যের সরলতা অনেক বেশী মূল্যবান। একটা ছেলেমানুষী, তার একটা সুশিক্ষা।” কিন্তু তবু নিজের অপরাধবোধে সে পীড়িত “তার দেহ শোকে অবসন্ন, মৃত্তিকার কীটদংশনে বিপন্ন তার মন।” শেষ পর্যন্ত হেরম্ব আনন্দকেও পেল না, অগ্নিতে আত্মাহুতি দিল আনন্দ।

‘পুতুল নাচের ইতিকথা’ গাওদিয়ার গ্রাম্য পরিবেশে আবদ্ধ, চিত্তের দ্বিবিধ বা বহুবিধ দ্বন্দ্বের টানাপোড়েনে বোনা শশী ডাক্তার-কুমু-কুসুম-গোপাল ইত্যাদি বিভিন্ন মানুষের মনোরূপের প্রতিফলন এখানে ঘটেছে।

পদ্মার নিকটবর্তী অঞ্চলসমূহের পটে মাঝিদের দারিদ্র্য লাঞ্ছিত গোষ্ঠীবদ্ধ জীবনচিত্র দেখা যায় ‘পদ্মানদীর মাঝি’তে (বিস্তৃত আলোচনার জন্য টীকা-অংশ দ্রষ্টব্য)। এখানে ভীরু, দরিদ্র কুবের মাঝির কপিলার প্রেমে ও হোসেন মিঞার প্রভাবে ব্যক্তিরূপে আত্মপ্রকাশই সব চাইতে দর্শনীয় দিক।

মধ্যবিত্ত এক বেকার যুবকের যন্ত্রণাময় চিত্র জীবনের জটিলতা’। বস্তুবাদী সাহিত্যিক বিমলের পরস্ত্রী শাস্তার প্রতি আকর্ষণ, স্বামী অধরের সঙ্গে শাস্তার আমৃত্যু প্রেমের অভিনয়ের চেষ্টা, প্রমীলার নগেনের প্রতি যুক্তি-সংস্কারবিহীন তীব্র দুর্বলতা ইত্যাদির মধ্য দিয়ে মানুষের সত্তার গভীরে পারস্পরিক দ্বন্দ্ব এবং তৎপ্রসূত জটিলতার পরিচয় উপস্থাপিত হয়েছে।

সমাজের উচ্চবিত্ত শ্রেণীর লোভ, স্বার্থ ও আদর্শচ্যুতির নিষ্ঠুর ব্যঙ্গাত্মক চিত্র ‘অমৃতস্য পুত্ৰাঃ’। বীরেশ্বরের দুই পৌত্রের একজন ধনী আর একজন দরিদ্র—যথাক্রমে শঙ্কর আর অনুপমকে কেন্দ্র করে রচিত। এই উপন্যাসে লেখকের বিশ্লেষণ বিদ্রূপে শাণিত, স্বাদ তিক্ত, দৃষ্টিভঙ্গী তির্যক।

নৈরাশ্যময় নেতিবাচক মনোভঙ্গী থেকে উত্তরণ দেখা যায় ‘সহরতলী’ উপন্যাসে পুঁজিপতি ও মেহনতী মানুষের দ্বন্দ্ব-রূপায়ণে। এখানে সত্যপ্রিয় মিলস্ ও আরো কয়েকটি কারখানার মালিক সত্যপ্রিয় চক্রবর্তী এবং তার বিপরীতে শ্রমিক প্রতিনিধি যশোদা চরিত্রের উপস্থিতিতে দ্বন্দ্ব-রূপটি পূর্ণ হয়।

‘অহিংসা’ উপন্যাসে সদানন্দ-মহেশ চৌধুরী বিপিন বিভূতির মধ্যে বিরোধের কারণ আপাতদৃষ্টিতে মাধবীলতা, কিন্তু মূল লক্ষ সাধুবাবাদের আশ্রম জীবনের ভণ্ডামি ও প্রতারণা ব্যবসার স্বরূপ উদঘাটন।

‘ধরা বাঁধা জীবনে’ আছে বৌ-ছেলের দুঘণ্টা আগে পরে মৃত্যুর পর নিঃসঙ্গ ভূপেনের আট বছর আগের প্রণয়িনী ডাক্তার প্রভাকে নিয়ে ঘর বাঁধার নিষ্ফল চেষ্টা। বাস্তব কঠিন অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে ভূপেন বোঝে : “স্বাদগন্ধ যখন উপিয়া যায়, প্রত্যাশা আর বিস্ময়ের দিন হয় শেষ, তখন মানুষের খেয়াল হয় জীবন তার অধিকারের বাহিরে, নিজের জীবনে নিজে সে কিছুই নয়।”

‘প্রতিবিম্ব’ উপন্যাসে তারকের পার্টিকর্মী হওয়া সদিচ্ছা সত্ত্বেও গ্রামের কৃষক-মজুর এবং পার্টির কর্মকর্তাদের সঙ্গে অনৈক্যের পরিচয় প্রতিফলিত। ‘দর্পণ’ (উপন্যাসের কিছু অংশ প্রথমে পাটনার ‘প্রভাবতী’ পত্রিকায় ‘জাগো জাগো’ নামে প্রকাশিত হয়) গ্রন্থে বেশী বিভক্ত সমাজের পরিচয় মূর্ত। লোকনাথ, উমাপদ, হেরম্ব, হীরেন, শশাঙ্ক, দিগম্বরী প্রমুখ চরিত্রেরা তারই প্রতিনিধি। “অত্যাচারী ধনী হেরম্বের বিরুদ্ধে অত্যাচারিত ঝুমুরিয়া গ্রামবাসীর বিক্ষোভের দর্পণ।” “এককালে আদর্শবাদী, হতাশায় ম্রিয়মাণ, ঘুষখোর দারোগা শৈলেন দাসের দর্পণ, বস্তী জীবনের, বাগদীপাড়ার, দেহ-বেচা রূপজীবী অশিক্ষিত নিম্নস্তরের মানুষের দর্পণে” (ড. সরোজমোহন মিত্র)।

‘সহরবাসের ইতিকথা’য় সহর সম্পর্কিত বিভিন্ন সমস্যা, সহর ও গ্রামের পারস্পরিক সুবিধা অসুবিধা কখনও জগদানন্দের জবানীতে কখনও বা সন্ধ্যা ও অসীমের আলাপচারিতায় বিশ্লেষিত হয়।

“চিন্তামণি’ (গ্রন্থরূপ পাবার পূর্বে ‘পূর্বাশা’ পত্রিকায় প্রকাশের সময় নাম ছিল ‘রাঙামাটির চাষী’) দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় লেখা গ্রামবাংলার বিধ্বস্ত অর্থনীতির পটভূমিতে এক কৃষক পরিবারের করুণ কাহিনী। হরমণির দাসী হওয়া, শ্বশুরবাড়ি থেকে চাপাবালাকে তাড়িয়ে দেওয়া, হৈমীর বিবাহ এবং মায়ের অসন্তোষ ইত্যাদি ঘটনাসমূহ ও আচরণ-বিকৃতি সবই দারিদ্র্যের পরিণাম রূপে চিহ্নিত। ১৯৪৬ খ্রীস্টাব্দে কলকাতায় রসিদ আলি দিবস উপলক্ষ্যে ওয়েলিংটন স্কোয়ারে ছাত্র যুবকদের বিক্ষোভ ও মিছিলের ঘটনা নিয়ে লেখা হয় ‘চিহ্ন’। অনুরূপাকে বোঝাতে গিয়ে সতীর কথা উপন্যাসে এইভাবে ব্যক্ত হয় “মুক্তি সংগ্রামে ছাত্রদেরও যে একটা অংশ আছে। সাধারণ অবস্থায় সে অংশগ্রহণ করা যে পড়াশোনার এতটুকু বিরুদ্ধে যায় না, বরং চরিত্রগঠনে আর মানসিক শক্তির বিকাশে সাহায্য করে, এই সহজ কথাটা মাথায় আসে না কেন আপনাদের মাসীমা?” এই মনোভাব বৃদ্ধির ফলে সামাজিক অবস্থার পরিবর্তনে হেমন্ত-জয়ন্ত প্রভৃতি চরিত্রে বৈপ্লবিক রূপান্তর ঘটে। ছাব্বিশ বছর বয়সের পঁচাত্তর টাকা মাইনের কেরাণী ত্রিষ্টুপ নামে এক অস্থিরমতি যুবকের কুণ্ডলাকে জোর করে বিবাহের কাহিনী ‘আদায়ের ইতিহাস’।

মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের গল্পে উপন্যাসে ফ্রয়েডীয় মনোবিকলন নানা রূপে আত্মপ্রকাশ করে। ‘প্রাগৈতিহাসিক’, ‘সরীসৃপ’ ইত্যাদি গল্পে আর ‘চতুষ্কোণ’ উপন্যাসে তার সর্বোত্তম প্রকাশ ঘটে। নরনারীর দেহজ কামনা এর মূল বিষয়বস্তু। গিরি-মালতী-সরসী-রিনির সঙ্গে নায়ক রাজকুমারের সম্পর্ক চতুস্কোণিক প্রেমের বভ্রুকুটিল পথে রূপায়িত হয়। কিন্তু সস্তা দেহানুভূতিতে নয়, মননের সুগভীর সংযমে এই উপন্যাস আঙ্গিক ও বক্তব্যে হয়ে ওঠে শাণিত ও মননদীপ্ত।

পরিচয় পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে প্রকাশের সময় ‘জীয়ন্ত’ উপন্যাসের প্রথম কিস্তিতে নাম ছিল ‘কলমপেষার ইতিকথা’। এখানে কোন সুনির্দিষ্ট কাহিনী বিরল, আটুলিগার মানুষের সামাজিক চেতনা অর্জন এবং কতকগুলি বিভিন্ন মানসিকতার প্রকাশ লক্ষ্য করা যায়; যেমন বড়লোকের ছেলে রায়বাহাদুরের ভাগ্নে পাকা বা প্রকাশ রায়ের অভিজাত জীবন সম্পর্কে বিতৃষ্ণা অথচ সুস্থির কোনো আদর্শের প্রতি বিশ্বাসহীন মনোভাব, তার বন্ধু পাঁচুর গ্রামের জন সংগ্রামের সাথে সংযোগ, পুরনো বিপ্লবী শ্যামল জানার স্মৃতিচারণ, জ্ঞানদাসের অভিজ্ঞতা সত্ত্বেও অসহায়তা ইত্যাদি। প্রকৃত স্বাধীনতা অর্জন যে ইংরেজ বিতাড়নে নয়, জমিদার-জোতদার শ্রেণীর নাগপাশ থেকে অর্থনৈতিক মুক্তিলাভে সম্ভব, এই উপন্যাসে এটাই হল লেখকের বক্তব্য।

‘পেশা’ (পূর্বে নাম ছিল ‘নবীন চিকিৎসক’) উপন্যাসে কেদার ডাক্তারের সাহায্যে দেখানো হয় “যে মধ্যবিত্ত ঘরের অনেকগুলি দামী টাকা আর কতগুলি বছরের দামী সময় খরচ করে ডাক্তার হয়ে এ দেশের গরীব জনসাধারণের সঙ্গে সম্পর্ক রাখা সম্ভব হয় না ডাক্তারের পক্ষে”। তাই “ডাক্তার ব্যক্তিগতভাবে দায়ী নয়, ওটাও দেশের লোককে অন্ন-বস্ত্র ইত্যাদির সঙ্গে চিকিৎসা থেকে বঞ্চিত রাখার ব্যবস্থার ফল।” এখানে লেখক শ্রেণী-শোষণের ব্যাপকতর অভিজ্ঞতার আলোকে সমস্যাটির অনুধাবনে সচেষ্ট হন।

১৯৪৬-এ কলকাতায় সংঘটিত ভয়াবহ দাঙ্গার পটভূমিতে লেখা হয় তাঁর রাজনৈতিক উপন্যাস ‘স্বাধীনতার স্বাদ’। এখানে সাধারণ মধ্যবিত্ত শ্রেণী থেকে মজুর শ্রেণী পর্যন্ত সকলের দাঙ্গাবিরোধী মনোভাব এবং তার বিপরীতে শাসক ও প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠীর মনোভাব নিপুণভাবে বিশ্লেষণ করা হয়। যেমন ঘুঁটেকুড়ানী এক মুসলিম বুড়ীর দৃষ্টিতে, “দাঙ্গা হানাহানি কর্তাদের লীলা, চাকররা মোড়ে মোড়ে দাঁড়িয়ে ট্রাকে চেপে টহল দিয়ে তা থামাবে। হায়রে তামাসা!”

এই চেতনা অর্জনের আর এক চিত্র—’সোনার চেয়ে দামী’। সাধারণ একটি পুরনো হারকে কেন্দ্র করে রাখাল আর সাধনার মধ্যে সম্পর্কের তিক্ততায় কাহিনীর সূচনা হয়। কিন্তু শেষপর্যন্ত সামাজিক ও আর্থ-রাজনীতির চেতনা অর্জনের কথা বড়ো হয়ে ওঠে। এই চেতনা অর্জনের ফলে স্বামী-স্ত্রীর তথা নারী-পুরুষের মধ্যে নতুন সম্পর্ক, স্ত্রী স্বাধীনতা ইত্যাদি বিষয়গুলিকে শ্রেণীচেতনার আলোকে ব্যাখ্যা করা হয়“পুরুষেরা মেয়েদের দাসী করে রেখেছে, এই বলে মেয়েদের সরিয়ে নিয়ে গিয়ে স্বাধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলন করার মানেই হচ্ছে হিন্দুস্তান পাকিস্তানের মত রাষ্ট্র চাওয়া। পুরুষদের বিরুদ্ধে মেয়েদের কোন লড়াই নেই। সব লড়াই অবস্থা আর ব্যবস্থার বিরুদ্ধে। সকলের ভাতকাপড় পাওয়া আর মেয়েদের স্বাধীন হওয়া হলে দুটোই একসাথে হবে, নইলে কোনটাই হবে না।” বলা বাহুল্য, এই বোধ ও দৃষ্টিভঙ্গী লেখকের মার্কসীয় শিক্ষার ফলশ্রুতি।

‘ছন্দপতন’ উপন্যাসে কবি নবনাথ রায় বস্তুবাদী জীবনের সঙ্গে সংযোগ রেখে তৃপ্তি তমাল-অশোক-আলেয়া-নিখিল-মলয়া এবং বিড়ি শ্রমিকবন্ধুদের কাছে কবিতা পরিবেশন করেছে। এই উপন্যাসে আত্মকথন পদ্ধতি ও তাত্ত্বিক সংলাপের প্রাচুর্য দেখা যায় ‘সার্বজনীন’ উপন্যাসে উদ্বাস্তু সমস্যার বিষয়টি সমকালীন সমাজ-বাস্তবতার প্রেক্ষিতে উপস্থাপিত হয়।

ইতিকথার পরের কথা’য় আছে বিজ্ঞানী নায়ক শুভের বিদেশ ফেরৎ শিক্ষা ও অভিজ্ঞতার দেশের লোকের সাহায্য ও সহযোগিতার অভাবে ব্যর্থ হওয়ার বিবরণ। ‘আরোগ্য’ উপন্যাসে কেশব ড্রাইভার নিজের পরিবারে ও অন্যত্র তার মানসিক রোগের কারণ ও চিকিৎসার পথ খুঁজে হয়রান হয়। শেষে কানুর কাছে স্বীকার করে “সবার জীবন শুধরে দেবার লড়াই করব ঠিক করতে রোগ যেন অর্ধেক কমে গেছে। লড়াই আরম্ভ করলে নিশ্চয়ই আরোগ্য”।

‘তেইশ বছর আগে পরে’ উপন্যাসটির প্রথম অংশ ‘ব্যথার পূজা’ নামে প্রথমে ‘বিচিত্রা’য় প্রকাশিত হয়। এখানে ব্যক্ত ধর্মীর পুত্র জগদীশের ও ধনীকন্যা চিত্রার প্রতি আসক্তির মামুলী কাহিনী। পরবর্তী তেইশ বছর পরে তার উপন্যাসে উত্তরণ স্বাভাবিক হয়নি।

‘চালচলন’ উপন্যাসে সুনীল-রেণু, অনাদি মিলনীর আবেগবিহীন সম্পর্কের সঙ্গে প্রচলিত বিবাহরীতির দ্বন্দ্বকে প্রকাশ করা হয়েছে। ‘নাগপাশে’ দেখানো হয় অধ্যাপক মাধবের দৃষ্টিকোণে, “লাখ লাখ পাশ করা আর মূর্খ মানুষদের জন্য চাকরী আর কাজের কোন ব্যবস্থাই নেই—জেনেও খেয়াল হয় না যে চাকরী আর কাজের ব্যবস্থা না হলে পাশের লড়াই চালিয়ে যাওয়া বোকামি।” সেক্ষেত্রে পরে লড়াই মুলতবী রেখে “ছাত্রদের কোমর বেঁধে সব কিছু ঠিক করার কাজে অর্থাৎ রাজনীতি করতে নেমে পড়া অত্যন্ত জরুরী ব্যাপার”।

‘শুভাশুভ’ উপন্যাসে আছে পরিবর্তিত অর্থনীতির প্রেক্ষাপটে সামাজিক মূল্যবোধগুলির নির্মম বিচার-বিশ্লেষণ; যেমন নন্দিতার ধারণা “দেহ দিয়ে প্রেম হয় না, সেটা পাগলের উদ্ভট কল্পনা। শুধু মন দিয়েও প্রেম হয় না—সেটা মানসিক ছ্যাবলামি। প্রেম হল দেহমন মিলেমিশে দৈহিক, আর ওই দেহগত মনটার মানসিক যোগবিয়োগ সৃষ্টি করা।”

‘হলুদ নদী সবুজ বন’, উপন্যাস কতকগুলি খণ্ডচিত্রের সমষ্টি; যেমন ‘বড়দিন’, সশস্ত্র প্রহরী’, ‘বিলাসমন’, ‘প্রাক শারদীয় কাহিনী’ প্রভৃতি। এই উপন্যাসের পটভূমি আদিম অরণ্য ও নদী পরিবেষ্টিত। বাল্যবিধবা লখার মা চরিত্রটি উজ্জ্বল।

‘হরফ’ উপন্যাসে কালাচাদ নামে দরিদ্র জনৈক প্রেস কম্পোজিটার অনন্য অধ্যবসায় ও প্রাণশক্তিতে প্রতিকূল পরিবেশের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে সংশ্লিষ্ট সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। এই উপন্যাসে লেখকের রাজনৈতিক দর্শন ও অভিজ্ঞতা প্রতিফলিত হয়।

‘পরাধীন প্রেম’ (‘বাস্তবিক’ উপন্যাসের ‘অনন্যা’য় প্রকাশিত অংশগুলি কিছু চরিত্র ও ঘটনার অদল-বদল করে উপন্যাসটির প্রথমাংশে ব্যবহৃত হয়) রচনায় অজিত-উমা, বিনয়-বকুল, অনিল-কাস্তা ও সমীর সুমতির প্রেম-ধারণার বৈচিত্র্য প্রদর্শিত হয়। এই প্রেম সামাজিক ও অর্থনৈতিক শৃঙ্খলে বন্দী। লেখকের উদ্দেশ্য ছিল, কিন্তু শরীর ও মনের অসুস্থতার জন্য কাহিনী পূর্ণতা পায়নি। 

‘মাটি ঘেষা মানুষ’ও অসমাপ্ত উপন্যাস। (পরে এই উপন্যাস সমাপ্ত করেন সুধীরঞ্জন মুখোপাধ্যায়)। এখানে চাষীর মেয়ে রেবতী তার সতেজ স্বভাবের স্বাতন্ত্রে কলের মজুর সর্পদষ্ট রেবতীকে বাঁচিয়ে শেষে গোবিন্দের বৌ হয়ে শহরে এসে শ্রমিক জীবনের চেতনায় উজ্জীবিত হয়েছে : “রেবর্তী বুঝতে শিখেছে গরীব চাষাভূযোর ঘরের মেয়েদের কথা, চাষীর লড়ায়ে মেয়েদের অংশ নেবার কথা।” 

“মাটির কাছের কিশোর কবি’ মানিকের আর একটি অসমাপ্ত উপন্যাস (খগেন্দ্রনাথ মিত্র পরে এই উপন্যাস সম্পূর্ণ করে ১৩৬৫ বঙ্গাব্দের শারদীয়া ‘আগামী’ পত্রিকায় প্রকাশ করেন)। 

‘শান্তিলতা’তে দেখা যায়, বস্তীর সুন্দরী মেয়ে শাস্তিলতা প্রথমে সুখেন্দুকে ফিরিয়ে দিয়েও পরে তাকে বিয়ে করেছে। শান্তিলতার অনুপ্রেরণায় সুখেন্দুর সংগ্রামী শ্রমিকে পরিণত হওয়া এবং তার সংগ্রামের স্বার্থে মৃত্যুবরণ এই উপন্যাসে সব চাইতে উল্লেখযোগ্য ঘটনা। ‘মাঝির ছেলে’ উপন্যাসটিতে নায়ক নাগার সুখ-দুঃখ, বর্তমানের দারিদ্র্য যন্ত্রণা ও ভবিষ্যতের স্বপ্ন প্রতিফলিত হলেও উপন্যাসটি বিশেষত্ব বর্জিত।

মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের গল্প-সংকলন:

উপন্যাসের মতোই মানিকের অসংখ্য গল্পগুলিও বাংলা সাহিত্যের মণি-মঞ্জুষায় উজ্জ্বল রত্নবিশেষ। এই গল্পগুলির মধ্যে কোথাও মধ্যবিত্ত ভাবনা, কোথাও ফ্রয়েডীয় ভাবনা, কোথাও মার্ক্সীয় ভাবনার প্রতিফলন লক্ষ্য করা যায়। ‘‘সমুদ্রের স্বাদ’ গল্পগ্রন্থের প্রথম সংস্করণের ভূমিকায় মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় স্বয়ং তাঁর সাহিত্যসৃষ্টির পেছনে দুটি দৃষ্টিভঙ্গীর কথা জানিয়েছিলেন : “প্রথম বয়সে লেখা আরম্ভ করি দুটি স্পষ্ট তাগিদে, একদিকে চেনা চাষী, মাঝি, কুলি, মজুরদের কাহিনী রচনা করার, অন্যদিকে নিজের অসংখ্য বিকারের মোহে মূৰ্চ্ছাহত মধ্যবিত্ত সমাজকে নিজের স্বরূপ চিনিয়ে দিয়ে সচেতন করার। মিথ্যা শূন্যকে মনোরম করে উপভোগ করার নেশায় মরমর এই সমাজের কাতরানি গভীরভাবে মনকে নাড়া দিয়েছিল। জানা ছিল না যে স্বাভাবিক নিয়মেই এ সমাজের মরণ আসন্ন ও অবশ্যম্ভাবী এবং তাতেই মঙ্গল—সঙ্কীর্ণ গণ্ডী ভেঙ্গে বিরাট জীবন্ত সমাজে আত্মবিলোপ ঘটার মধ্যেই আগামী দিনের অফুরন্ত সম্ভাবনা।”

উদ্ধৃতিটি দীর্ঘায়ত হলেও এর মধ্যে ঝাপ্সা বা অবিশেষিত কিছুই নেই। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় মধ্য-বিশ শতকের বাংলাদেশের সামাজিক বিশৃঙ্খলার ঘনিষ্ঠ রূপকার; যে সময়ে তথাকথিত ভদ্রলোকশ্রেণীর একটা অংশ নীচে নেমে এল এবং তথাকথিত দীন শ্রেণীর একটা অংশ প্রবল হয়ে উঠলো, সেই অধ্যায়ের বিবিধ লক্ষণ চূড়ান্তভাবে লক্ষ্যণীয় তাঁর রচনায়।

‘আত্মহত্যার অধিকার’ গল্পে নীলমণির জীবন-যাপনের কোন ব্যবস্থা বা সুযোগ নেই বর্তমান সামাজিক অবস্থায়। “সকলে যেখানে বাঁচিতে চায়, লাখ মানুষের জীবিকা একা জমাইতে চায়, কিন্তু কাহাকেও বাঁচাইতে চায় না, সেখানে সে বাঁচিবে কিসের জোরে ?” এই খোলাখুলি প্রশ্ন তুলেই গল্পটির বক্তব্যের আবেদন জাগরণ। বর্ষার অত্যাচারে চৈতালী ঘূর্ণির মুখে ঝরাপাতার মতো ছিন্নভিন্ন নীলমণির ‘নিঃস্ব’ পরিবার। তবু নীলমণি আজন্ম অর্জিত মান-সম্মানের ক্ষয়-ক্ষতিয়ান এখনো তলিয়ে দেখতে চায়। “ছেলে মেয়ে বৌকে বর্ষাবাদলে মাথা গুঁজবার ঠাই দিতে পারে না, অত মান-অপমান কি জন্যে?” –স্ত্রী নিভার এই প্রশ্নে তার মাথায় খুন চাপে, তামাক ফুরিয়ে যাবার সামান্য ছুতোয় মেয়ে ‘শ্যামার’ ওপর “আকাশের বজ্রের মতো” ‘ধমকে ওঠে। অথচ পায়ের নীচে মৃত্যুর সুনিশ্চিত খাদ। তবু বুভুক্ষু ছেলের “তীরের ফলার মত” কান্না, “লঙ্কাবাটার মতো” মেয়ের মুখের চাউনী, “নিমুনিয়ার সঙ্গে নিভার ব্যাকুল কলহ” দেখেও সে প্রতিবেশী ধনী সরকারদের আশ্রয়ে যেতে চায়নি। কারণ রাত দুপুরে বিপদে পড়ে আশ্রয় নিতে গেলে বা শিশুর জন্য এক টুকরো শুকনো ন্যাকড়া চাইলে যাদের ‘উপেক্ষার আবিল দৃষ্টি’, সইতে হয় তাদের আশ্রয় তার কাছে অসহ্য। কিন্তু আত্মসম্মান আর টিকে থাকার ন্যূনতম প্রয়োজনে শুরু হয়েছে যখন প্রকৃতি আর পরিবেশের সাথে অন্য মানুষগুলোর কজির লড়াই, “পেটের ক্ষুধা, দেহের ক্ষুধা, শীত, বর্ষা, রোগ, বিধাতার অনিবার্য জন্মের বিধান” ইত্যাদির চাপে নুয়ে পড়েছে যার দেহ, স্ত্রী-পুত্র-কন্যার ভরণ-পোষণের ভার বইতে না পেরে দারিদ্র্যের আঘাতে দুমড়ে গেছে যে অক্ষম মানুষটির সহজাত কামনা, “বাঁচিয়া থাকাটা শুধু আজ এবং কাল নয়, মুহূর্তে মুহূর্তে নিষ্প্রয়োজন” – সেখানে “নীলমণির মান-অপমান জ্ঞানটা” যে শেষ পর্যন্ত টিকবে না তা মধ্যবিত্ত পরিবার-উদ্ভূত মানিক জানেন। আর এই জানার দুঃসহ যন্ত্রণাতেই এই গল্পের নামকরণে থমকে উঠেছে প্রশ্ন— ‘অন্নপূর্ণার ভাণ্ডারে’ উপবাসী থাকার চেয়ে, শেষে সম্বল আত্মসম্মানকে বন্ধক দিয়ে ‘পঞ্চাশ মাইল গভীর বায়ুস্তরে’ ডুবে থেকে প্রতি মুহূর্তে দম আটকে মরার চেয়ে হতভাগ্য মানুষটিকে ‘আত্মহত্যার অধিকার’ দান কি অধিকতর কাম্য নয়?

নানাবিধ সামাজিক ঘটনায় ও পারিপার্শ্বিক পরিমণ্ডলের পরিবর্তনশীল চাহিদায় মধ্যবিত্তমনের রূপান্তর মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের গল্পে লক্ষ্য করা যায়। তিনি বলেছিলেন: “মধ্যবিত্ত ভদ্রদের পরিণাম জানতাম না বটে; তবে পচা ভদ্রতার মিথ্যা খোলস খুলে সবাই ছোটলোক হোক এ পরিণাম যে কামনা করতাম আমার অনেক গল্পেই তা ঘোষণা করবার চেষ্টা করেছি।” সেরকম ধরনের একটি গল্প ‘কে বাঁচায় কে বাঁচে’। বিচিত্র এক আত্মপ্রায়শ্চিত্তের কাহিনী। অফিসে যাবার পথে ‘অনাহারে মৃত্যু’ প্রথম দেখেই মৃত্যুঞ্জয়ের মধ্যে আত্মগ্লানির শুরু। তখন থেকেই“ভাবছি, আমি বেঁচে থাকতে যে লোকটা না খেয়ে মরে গেল, এ অপরাধের প্রায়শ্চিত্ত কি? জেনে শুনেও এতকাল চারবেলা করে খেয়েছি পেট ভরে ধিক্, শত ধিক্ আমাকে।”

এই আবেগের চাপ যত বেড়েছে বিবেকের দুঃসহ উত্তাপে ততই পুড়েছে বলে সহকর্মীর কাছে উপেক্ষিত ‘মানবসভ্যতার সবচেয়ে প্রাচীন সবচেয়ে পচা’ ঐতিহ্য আদর্শবাদের কল্পনা-তাপস এই মানুষটি। সহকর্মী নিখিলের মতো রিলিফ ফাণ্ডে নামমাত্র টাকা পাঠিয়ে কিম্বা ‘বেঁচে থাকতে যতটুকু দরকার খাই’ ইত্যাদি সুবিধেবাদী সংসারী গৃহস্থের সান্ত্বনা বা ‘পচা ভদ্রতার’ বুলি আউড়ে মৃত্যুঞ্জয় নিজের কাছে এবং নিরস্ত্র মানুষগুলোর কাছে অনপরাধ থাকতে পারে নি। পারে নি তার স্ত্রী পর্যন্ত : “ছেলে মেয়েগুলির জন্য সত্যি আমার ভাবনা হয় না। কেবলি মনে পড়ে ফুটপাতের ওই লোকগুলির কথা।” মাইনের সব টাকা রিলিফ ফাণ্ডে দিয়ে, তার “আমার টুলুর মার এক বেলার ভাত বিলিয়ে” দিয়েও যথেষ্ট হয়নি তার কাছে, অফিস ছেড়ে “পাড়ায় পাড়ায় লঙ্গরখানা খুঁজে বার করে অন্নপ্রার্থীর ভিড় দেখে” তাদের মুখে এক ভাগ্যের কথা, দুঃখের কাহিনী শুনে শুনে একদিন মৃত্যুঞ্জয় স্বেচ্ছায় এসে মিশেছে তাদের পাশে, তাদের বেশে“গাঁ থেকে এইছি। খেতে পাইনে বাবা। আমায় খেতে দাও।”

একথা ঠিক, আমাদের দেশের মধ্যবিত্ত জন্ম থেকেই আকাশ আলো করা ফুল। সে মাটি থেকে তারা প্রাণরস সংগ্রহ করতে পারতো সেই ব্রাত্য জনজীবনের সঙ্গে ভূমিলগ্ন হয়নি তাদের ভূমিকা। প্রকৃতপক্ষে, মানিকের গল্পেই মধ্যবিত্ত মানুষেরা প্রথম স্বেচ্ছাকৃত আত্মবিলোপের মাধ্যমে (মার্কসের ভাষায় ‘declassed’ হয়ে) সর্বহারার জীবনসংগ্রামে অংশী ও সঙ্গী হয়েছে।

‘পাষণ্ড’ গল্পে উদ্বাস্তুদের বাস্তব ও দৃঢ় জীবনসংগ্রামের সঙ্গে সমীরের পরিচয় হয়েছে। এইভাবে আপন অভিজ্ঞতার ক্ষেত্রকে নতুন চেতনায় রূপান্তরিত করার পর সে নতুন করে জীবন আরম্ভ করার সংকল্প করেছে। আবার ‘ধর্ম’ গল্পে জমিদার রামপ্রাণ চৌধুরীর মিলে ধর্মঘটী মজুরদের ঐক্যবদ্ধ সংগ্রাম দেখে সৌমেন ও তমসা পারস্পরিক মন পাওয়া-না-পাওয়ার ব্যক্তিগত সুখ-দুঃখ ঘুচে গিয়ে জীবনের বৃহত্তর পথে পদক্ষেপের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করেছে। “হে রাত আটটায় তারায় ভরা আকাশ, একবার বিদীর্ণ হও। কোটি বজ্রের গর্জনে ফেটে চৌচির হয়ে যাও। আমার বাংলার ছেলেমেয়েরা আজ খিদেয় কাতর হয়ে একখানা রুটির জন্য, এক মুঠো ভাতের জন্য সংগ্রাম শুরু করেছে নিরুপায় মায়ের সঙ্গে” – ‘আর না কান্না’ গল্পের মধ্যে এই আত্মবাদী মনোভঙ্গী শিল্পের দিক থেকে কতদূর সার্থক সে সম্পর্কে সংশয় থাকতে পারে। দুর্ভিক্ষের যন্ত্রণায় কাতর হয়ে আর্তনাদ করছে এক নিম্নমধ্যবিত্ত বাঙালী পরিবার। এখানে ছোট ছোট ছেলেমেয়েগুলির উপোসী মুখগুলি যে কোন মানুষকে অভিভূত করবেই। কঠিন দুর্দিনে বেঁচে থাকার আকাঙক্ষায় আবেগের সমস্ত পিছুটান মুছে ফেলে দাম্পত্য সম্পর্কের অদ্ভুত বোঝাপড়া দেখে বিস্ময় জাগে কারণ, স্ত্রীকে যেখানে “তাড়াতাড়ি খেয়ে নিয়ে তাকে বিশ্রাম করতে বলাটাই সুমিষ্ট আদর”, যেখানে “চিন্তা ভয় ক্ষোভ দুঃখ”, এর চাপে মনে হয় “স্নেহ-মমতা, আনন্দ-উদ্দীপনা ন্যাকামী”। আর সব কিছুর মূলে আছে যেখানে রুক্ষ জীবনের ভয়াবহ পালাবদলের পেছনে জীবনসংগ্রামের দুঃসহ গ্লানি : “সব বিষয়ে সব কিছুর গোনা-গাঁথা ওজন করা হিসাব দিয়ে কোন মতে দিন গুজরান।”

আসলে, “দুর্ভিক্ষ-পোষক সদাশয় কংগ্রেস সরকার”-এর ভেতো বাঙালীকে ভাত খাওয়া থেকে বঞ্চিত করার বিরুদ্ধে যে অম্লাক্ত শ্লেষ এ গল্পের অক্ষরে অক্ষরে মুদ্রিত, তাই আবার ফিরে এসেছে ‘আপদ’ গল্পে। চাল বাড়ন্ত হওয়ার দুঃসংবাদটিকে “স্বাধীনতা পাওয়ার বাসি পচা সংবাদ”-এর সঙ্গে তুলনা করে দেখবার মানসিকতা অর্জন করেছিলেন মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়৷

যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশে পুঁজিপতি হবার চেষ্টায় স্ত্রীকে শুদ্ধু সঁপে দিতে হয় তাকেই, “যাকে ঘুষ দিতে হয়”। অথচ গল্পের নায়ক মাখন ছিল মধ্যবিত্ত ঘরের “পরীক্ষায় ভাল পাশ করা গরীবের ছেলে”। গল্পকার দেখিয়েছেন, বিবেকার্ত মধ্যবিত্তের মূল্যবোধ ধ্বসে পড়ে যে পরিবেশের চাপে, তার প্রথম আঘাত আসে পরিবারের কারণে। সুশীলা জানতো বড় হবার, টাকা রোজগার করবার ক্ষমতা মাখনের আছে, আর “তাই খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে তোমায় মারিয়া করে জিদ জাগালাম।” দুরস্ত লোভে দাম্পত্য সম্পর্কের স্বার্থপর ব্যর্থতার দিকটিও তুলে ধরেছেন লেখক উভয়ের পারস্পরিক অন্তবিশ্লেষণে যেমন “ওমা, এত ভাল ছেলের চাকরি কি না একশ টাকার!” কত অবজ্ঞা, অপমান, লাঞ্ছনা, গঞ্জনা স্বামীকে দিয়েছে সুশীলার মনে পড়ে। মনে পড়ে মাখনের “সুশীলার আগের ব্যবহার”। অথচ আজ সেই স্ত্রী গলায় অন্য সুর, চোখে অন্য রঙ। দামী মোটরে চড়ে হাওয়া খেতে বেরিয়ে সুশীলার মধ্যে জেগেছে একদিকে “বাজে মোটর গাড়ির চলা দেখে মুখ বাঁকানো সুখ”, অন্যদিকে ‘‘ট্রামের হাতল ধরে আর বাসের পিছনে মানুষকে ঝুলতে দেখে সুশীলার মায়া হয়, এক অদ্ভুত মায়া। যাতে গর্ব বেশী”। অথচ “সে মধ্যবিত্ত ভাল ঘরের মেয়ে।” তবু মাত্র তিন বছরে তার স্বামী ট্রামে ঝোলার অবস্থা থেকে দামী মোটরে চড়ার অবস্থায় পৌঁছেছে। আর এর মূলে আছেন কনট্রাক্টর দাসবাবু, যাকে দেখে সুশীলার মনে হয়, “শ্বশুর ভাসুর ইত্যাদি গুরুজনের চেয়েও ইনি গুরুজন। ইনি দেবতার সামিল।” অর্থের প্রয়োজনে পারিবারিক সম্পর্কগুলির রূপাত্তরের দিকে, ছিন্নযোগ মূল্যবোধের দিকে লেখকের কি অকম্পিত তর্জনী সঙ্কেত। বস্তুতপক্ষে, মাখন নয় এ গল্পে সুশীলা চরিত্রই লেখকের আগাগোড়া ব্যঙ্গের লক্ষ্যবস্তু। কেননা, “দাস সাহেবের দৃষ্টি তার মুখে বুকে কোমরে চলাফেরা করছে টের পায় সুশীলা” যেমন, তেমনি আপনার স্ত্রী’? দাসের এই ইঙ্গিতময় প্রশ্ন শুনে তা প্রমাণের জন্য “পরণের বেনারসী রঙের মতো” সলজ্জ ভঙ্গীতে বৌসুলভ আচরণ করা, সোয়া লাখ টাকার কনট্রাক্ট পাওয়া যাবে শুনে নিঃশ্বাস আটকে যাওয়া, দাসের বাড়িতে ঘরের সাজসজ্জা আর আসবাবপত্র দেখে নিজেদের বাড়িতে বিশেষত্ব আমদানীর চিন্তা, দাস ও মাখনের কন্ট্রাক্ট-সংক্রান্ত কথাবার্তা গভীর আগ্রহের সঙ্গে শোনবার ও বোঝবার চেষ্টা, কালীঘাটে পুজো দিয়ে যাবার প্রস্তাব (ভগবানকে ঘুষ দেওয়ার ইঙ্গিত?) ইত্যাদির মাধ্যমে গল্পকার যেন চূড়ান্ত ব্যঙ্গে চরিত্রটির লোভের স্বরূপকে উদঘাটিত করেছেন। স্বামীর সক্রিয়তা নিশ্চয়ই আছে, তবু মনে হয় এই লোভই যেন অনিবার্য নিয়তি হয়ে অজগরের সামনে দৃষ্টিস্তম্ভিত হরিণীর মতো তাকে শেষ পর্যন্ত দাসবাবুর লালসার গহ্বরের সামনে এনে দাঁড় করিয়েছে। তার পরিচয় ধরা পড়েছে গল্পের শেষাংশে। মাখন কনট্রাক্ট লাভ করার তৃপ্তিতে এবং দাসবাবুর কাছে সুশীলাকে ছেড়ে যাওয়ার যন্ত্রণায় ট্যাক্সি ড্রাইভারকে বলেছে জোরে– ‘আরো জোরসে’ গাড়ী চালাতে!

মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের মার্ক্সীয় ভাবনার প্রকাশ:

মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের মার্ক্সীয় ভাবনার প্রকাশ ঘটেছে ‘শিল্পী’, ‘হারানের নাতজামাই’ গল্পে। ‘শিল্পী’ গল্পে মদন তাঁতী এক প্রবাদ-প্রতিম পুরুষ। তার আশ্চর্য কারিগরী, তার তেজ, ভালো সুতো দিয়ে ভালো জিনিষ বোনবার জন্য তার একনিষ্ঠা ও জেদ তাঁতীমহলে ছিল সম্ভ্রমের বস্তু, তাদের গভীর বিশ্বাস আর শ্রদ্ধা জন্ম দিয়েছিল এই প্রবচনের “মদন যখন গামছা বুনবে” – উল্টো পিঠে যার অর্থ, সূর্য যখন পশ্চিমে উঠবে। আর এই একটিমাত্র কথার বলিষ্ঠ প্রয়োগেই দানা বেঁধে উঠেছে সমগ্র কাহিনীর সমস্যা ও চরিত্রটির প্রতি আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু। সমস্যার কারণ হল ভুবন ঘোষাল নামক জনৈক দালালের দ্বারা ব্যবসায়ী মিহিরবাবুর সুতোর কৃত্রিম অভাব তৈরী করে তাতীর স্বাধীন ইচ্ছাকে নষ্ট করার প্রচেষ্টা। “প্রায় বেগার খাটা মজুরি নিয়ে সস্তা ধুতিশাড়ী, গামছা বুনে” দেবার বৃত্তিতে পরিণত করার চেষ্টার বিরুদ্ধে মদনের অনুকরণে তাতীদের মধ্যে প্রতিবাদ উন্মেষ বা শ্রেণীগত ঐক্যের সূচনা হয়।

প্রসঙ্গত উল্লেখ করা যায়, বস্ত্রশিল্পকে অধিগত করে বল্গাহীন মুনাফা লাভের লোভে গিল্ডগুলিকে ভেঙে দিয়ে তাতীদের সর্বহারা শ্রেণীতে নামিয়ে দেবার ক্ষেত্রে ইংলন্ডে বণিক এবং দেশীয় অভিজাত শ্রেণী একসময় নিয়েছিলেন নির্মম ভূমিকা। হানসিয়াটিক লীগ, মার্চেন্টস্ অব দি স্টেপল্, এডভেঞ্চারার্স কোম্পানীর ‘হানসা’ বা লাখোপতি ব্যবসায়ীদের ‘ক্লথিয়ার’ রূপে তাঁতীদের প্রতি মর্মান্তিক দুর্বিচার করেছিল।

এর কারণ প্রথমত, মুদ্রাশাসিত বুর্জোয়া সমাজে শিল্প প্রতিভার সঙ্কট এমনি ঘনিয়ে উঠেছিল (মার্কস বলেছিলেন, পুঁজিবাদী উৎপাদন, চিন্তার রাজ্যের উৎপাদনের প্রতি শত্রুভাবাপন্ন, যেমন চিত্রকলা ও কাব্য), যে চাষী, মজুর বা ভদ্রঘরের যেখানেই তার আবির্ভাব হোক, মানুষের বাঁচার অবস্থা এমনি হয়ে উঠেছিল যে দেশে কোনমতে বেঁচে থাকার উপায়টুকু আয়ত্ত করতে গেলেও অন্তর্দৃষ্টিকে বা সৌন্দর্যচেতনাকে ঝাপসা হয়ে যেতে দিতে হবে। অথচ জীবিকার জন্যে নমনীত হওয়ার অর্থ—নিজেকে অপচয় করা, যা তার শিল্প-সাধনার সুনিশ্চিত ব্যর্থতা।

দ্বিতীয়ত, ‘শিল্পী’র শিল্প-সাধনা যেমন ব্যক্তিগত হয়েও নিগূঢ় কারণে তার চেতনায় সমবায়িক মানুষের সামগ্রিক অভিঘাত মূর্ত হয়ে ওঠে, তেমনি মদনের শিল্প-নিষ্ঠার (বা বৃত্তি নিষ্ঠা) মধ্য দিয়ে তাঁতীদের বৃত্তিগত সঙ্কটকে ‘ছোটগল্পে’র পরিসরে তুলে ধরতে চেয়েছেন গল্পকার। নয়ত ‘শিল্পী’ নামের কোনও অর্থ থাকে না (তুলনামূলক বিচারে গল্পটির ইংরেজী অনুবাদে ‘Craftsman’ নামকরণ কিছু পরিমাণে এদিক দিয়ে সার্থক। কিন্তু সম্পূর্ণ সার্থক হতে পারেনি, কারণ ‘শিল্পী’ নামের ব্যঞ্জনার ছিটেফোটাও তাতে নেই)।

তৃতীয়ত, সমষ্টিমানুষের মধ্যে ‘শিল্পী’ যেমন সর্বাধিক ‘চেতনা সম্পন্ন’ তেমনি আবার আক্রমণের প্রথম আঘাত যেহেতু তাকেই সবচেয়ে বেশি সইতে হয়, তাই মানুষী দুর্বলতার চাপে হঠাৎ হয়ত যে নুয়ে পড়ে, তারপরই রূপকারী বিবেকের স্বাতন্ত্রেই সে জেগে ওঠে, আত্মমর্যাদার সঙ্গে শ্রেণী মর্যাদার টানাপোড়েনে জীবনকে জটিল এবং আকর্ষণীয় করে বুনতে চায়। মদন তারই নিঃসংশয় নিদর্শন।

বাংলা কথাসাহিত্যে এই আপোষহীন সংগ্রামী মনোভাবের পরিচয় দিয়েই মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় নিত্যকালের জন্য স্মরণীয় হয়ে আছেন।