অনেকেই মনে করেন ‘শেষের কবিতা’র কাহিনি উপন্যাস রচনার অনুপযুক্ত। তবে সাগ্রহে স্বীকার করা ভালাে, এ অভিমত যথার্থ নয়। অমিত নামে যে যুবককে নিয়ে এ কাহিনি তার চিন্তা ও জীবনচরণে একটা লক্ষণীয় স্বাতন্ত্র্য বিদ্যামান। সে নিজে যে সমাজের অন্তর্ভুক্ত তাকে হাই সােসাইটি এবং অ্যারিস্টোক্রেট সােসাইটি হিসাবে চিহ্নিত করা যায়। কিন্তু এই সমাজের মধ্যে থেকে সে স্বতন্ত্র প্রচলিত প্রথার গড্ডলিকা প্রবাহে মিশে যায়নি। প্রেম ও দাম্পত্য জীবন সম্বন্ধে যে রােমান্টিক ধারণা ছিল তার পরিপূর্ণ বিকাশের উপযুক্ত পাত্রী সে একদিন খুঁজে পেয়েছে এবং তাকে ঘিরে দাম্পত্য জীবন রচনার স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছে। তার স্বল্পসৌধ হয়তাে একদা হঠাৎই ধূলিসাৎ হয়ে গেল পূর্বপ্রণয়ীর আবির্ভাবে, শেষ পর্যন্ত তার বিবাহ হয়ে গেল পূর্ব প্রণয়ীর সঙ্গেই, যাকে সে নির্বাচিত করেছিল নিজেই।
এই উপন্যাসের নায়িকা, অমিতকে দেখেছিল তার পরিবেশ থেকে বিচ্ছিন্ন করে একটি সতেজ ও প্রাণবন্ত রােমান্টিক যুবক হিসাবে। তার বােন ও পূর্ব প্রণয়িনীকে দেখে অমিত সম্পর্কে একটা ধারণা সে লাভ করেছে এবং সেই কারণেই বােধ হয় ভেতর থেকে একটা বাধা তার এসেছে। এই বাধার প্রকৃতি স্পষ্ট হয়নি, যেমন স্পষ্ট হয়নি শােভনলালের প্রতি তার অনুচ্চারিত ভালােবাসা। অমিত গ্রহণ করেছেন তার পূর্বপ্রণয়িনী কেতকীকে কিন্তু তার আশ্রয় লাবণ্য। লাবণ্যও সেইভাবেই শােভনলালকে গ্রহণ করেছে কিনা সেকথাও স্পষ্ট হয়নি। তবু সমস্যার প্রকৃতি এমন নয় যে তা এই উপন্যাসে কোনাে ছবি ছাড়া আর কারাে পক্ষে গ্রহণ করা সম্ভব ছিল না। উপন্যাস হিসাবে ‘শেষের কবিতা’র যদি কোনাে দুর্বলতা থাকে তবে তা এই যে, প্রথম পর্বে তার যে বিস্তার, শেষ পর্বে সেই বিস্তার আমরা পাই না—অনেক কিছুই আমাদের কল্পনার দ্বারা পূর্ণ করে নিতে হয়। তবে এক একজন সাহিত্যিকের রচনা পদ্ধতির মধ্যেই তাে এই বৈশিষ্ট্য নিহিত থাকে।
উপন্যাসের সবচেয়ে বড় গুণ অখণ্ড জীবনদৃষ্টি বা সামগ্রিক জীবনবােধ এবং এই গুণটি ‘শেষের কবিতা’য় লক্ষণীয় ভাবেই আছে। চরিত্রের যে-কোনাে ধরনের আংশিকতা রবীন্দ্রনাথকে পীড়িত করতাে, সেইজন্যই চরিত্রকে তিনি তার আংশিক আচরণে দেখাতে চাননি, অমিতের পরবর্তী কার্যকলাপের সঙ্গে বিচারের কালে যদি তার প্রথম পর্বের বাগ বাহুল্য ও সাহিত্য চিন্তাকে অপ্রাসঙ্গিক মনে হয় তবে তার কারণও ওই সামগ্রিকতার প্রতি আগ্রহ। চরিত্রকে সঠিকভাবে বুঝতে না পারলে তার প্রতি সুবিচার করা যায় না। নতুন কিছু এবং নতুন কোনাে পরীক্ষায় অমিতের আগ্রহ প্রমাণিত হওয়ার পর লাবণ্যর প্রত্যাখ্যান সহ্য করা এবং কেটি মিটারকে কেতকী মিত্র করে গড়ে তােলার পরীক্ষা একমাত্র অমিতের পক্ষেই যে সম্ভব একথা সহজেই বোঝা যায়। চরিত্রকে অখণ্ড দৃষ্টিতে দেখেছেন বলেই লাবণ্যকে তিনি অমিতের সহধর্মিণী করে তুলতে পারেননি। লাবণ্য যেরকম মেয়ে তাতে তার অভিজ্ঞতায় এটুকু বুঝে ফেলাও অসম্ভব ছিল না যে, পরিবেশ বিচ্ছিন্ন অমিতকে কেবল নিজের সাহচর্য এবং অমিতের রােমান্টিক কল্পনা বিলাসে সমর্থন জুগিয়ে দীর্ঘবকাল বাঁচিয়ে রাখা যাবে না। দাম্পত্য একটা প্রয়ােজনের বন্ধন। কোনো বন্ধনকেই সে অস্বীকার করে না, স্বভাবেই যার একটা ছেলেমানুষী আছে, তাকে ভালােবাসা যায়- তাকে নিয়ে ঘর বাঁধা যায় না। একথা লাবণ্যর মতাে মেয়ের না বােঝার কথা নয়।
‘শেষের কবিতা’র উপন্যাস বিষয়ে অপূর্ণতার অভিযােগ করতে গিয়ে শেষতম যে প্রসঙ্গটি তােলা হয় তা এর তাত্ত্বিক রহস্যময়তা। প্রেমের মহৎ স্বীকৃতির জন্যেই প্রেমের পাত্রকে দাম্পত্য বন্ধনে মলিন করা উচিত নয়—এই ধরনের এক তত্ত্বকথা ‘শেষের কবিতা’ উপন্যাসে লালিত করা হয়েছে বলে অনেকে মনে করেন। কেবল এই তত্ত্বকথাই যদি উপন্যাসটির সর্বস্ব হতাে তাহলে ‘শেষের কবিতা’ কবিতাই হতাে, উপন্যাস নয়, সুখের কথা, তা হয়নি। যারা এই তত্ত্বের বাস্তব অস্তিত্বকে অস্বীকার করতে চান তারা রবীন্দ্রনাথের ‘নষ্টনীড়’ ছােটো গল্পটির দৃষ্টান্ত স্মরণ করে বলতে পারেন, মনে প্রেমের আদর্শ পুরুষ ও গৃহে স্বামীদেবতার পূজা যদি একই সঙ্গে সম্ভব হতাে তাহলে চারুলতার নীড় নষ্ট হবার কোনাে কারণ ঘটত না।
কথাটা অযৌক্তিক নয়, কিন্তু একটা কথা মনে রাখা দরকার গৃহ এবং ঘর বাঁধার স্বপ্ন দুটোই প্রধানত মেয়েদের, ‘নষ্টনীড়’ গল্পে এই সমস্যা ঘটেছিল এক নারীর। তার একপ্রান্তে ছিল এমন একটি পুরুষ যাকে সে ভালােবাসতে পেরেছিল এবং যার সঙ্গে সে সম্পূর্ণ মানসিক সাযুজ্য খুঁজে পেয়েছিল। ‘শেষের কবিতা’ উপন্যাসে এ সমস্যা প্রধানত অমিতের, লাবণ্যর নয়। উপরন্তু লাবণ্যর একদিকে আছে অমিতের মতাে পুরুষ যাকে সে ভালােবাসতে পেরেছে চূড়ান্তভাবে কিন্তু আশ্রয় করতে পারেনি ; অন্যদিকে আছে শােভনলাল যার অনুচ্চার ভালােবাসা তাকে মুগ্ধ করেছে এবং সম্ভবতঃ দাম্পত্য আশ্রয় যার কাছে পাওয়ার ব্যাপারে তার সন্দেহ জাগেনি। এই দুটি ব্যাপার স্মরণ রাখলে ‘নষ্টনীড়’ ও ‘শেষের কবিতা’র প্রকৃতি ও সমস্যা অভিন্ন বলে আমাদের মনে হবে না এবং ‘শেষের কবিতা’র ঔপন্যাসিক মর্যাদা সম্বন্ধে সন্দিহান হবার অবকাশও আমাদের ঘটবে না। অর্থাৎ ‘শেষের কবিতা’র কাহিনি বস্তু উপন্যাসােপযােগী নয়, একথা সবৈব মিথ্যা।
Leave a comment