সাধারণভাবে আর্থনীতিক ন্যায় বলতে আর্থনীতিক মূল্যবোধের ভিত্তিতে ব্যক্তিবর্গের মধ্যে বৈষম্যের অবসানকে বোঝায়। ইতিবাচক অর্থে এ হল উৎপাদন ও বণ্টনের ক্ষেত্রে সকলের জন্য স্বাধীনতা। তবে এই স্বাধীনতা জনসাধারণের কল্যাণ সাধনের শর্ত সাপেক্ষ। তা ছাড়া কাজের পারিশ্রমিক প্রদানের ক্ষেত্রে যাবতীয় কৃত্রিম বৈষম্যমূলক ব্যবস্থার অবসান এক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য। আর্থনীতিক ন্যায়ের পরিপ্রেক্ষিতে দাবি করা হয় যে জাতীয় আর্থনীতিক ব্যবস্থাকে পুনর্বিন্যস্ত করতে হবে। এই পুনর্বিন্যাসের উদ্দেশ্য হল জাতীয় অর্থনীতির সুফলসমূহ সাধারণ মানুষের কাছে অধিকহারে পৌঁছে দেওয়া। অর্থাৎ আর্থনীতিক ন্যায়ের ধারণা কার্যক্ষেত্রে অনেকাংশে সমাজতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার প্রতিচ্ছবিতে পরিণত হয়। দরিদ্র ও পশ্চাদপদ দেশগুলিতে আর্থনীতিক ন্যায় বলতে দারিদ্র্য দূরীকরণ সম্পর্কিত বিভিন্ন আর্থনীতিক কার্যক্রমকে বোঝায়। এই সমস্ত কার্যক্রমের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল নিরন্ন মানুষের জন্য ক্ষুধার অন্নের ব্যবস্থা করা, দরিদ্র জনতার পরিধেয় ও আবাসনের ব্যবস্থা করা। তা ছাড়া মানুষের সামগ্রিক উন্নতির জন্য যাবতীয় সুযোগ সুবিধা সরবরাহ করাও আর্থনীতিক ন্যায়-ধারণার অন্তর্ভুক্ত। বস্তুত সমাজতান্ত্রিক ও জনকল্যাণমূলক রাষ্ট্রব্যবস্থার মধ্যে আর্থনীতিক ন্যায়ের ধারণাকে প্রতিফলিত হতে দেখা যায়।

সামাজিক ন্যায়ের সঙ্গে আর্থনীতিক ন্যায়ের সম্পর্কযুক্ত:

সামাজিক ন্যায়ের ধারণার সঙ্গে আর্থনীতিক ন্যায়ের ধারণা ওতপ্রোতভাবে সম্পর্কযুক্ত। স্বভাবতই সামাজিক ন্যায় সম্পর্কিত আলোচনার অনেক কিছুই আর্থনীতিক‌ ন্যায় সম্পর্কিত আলোচনার অন্তর্ভুক্ত হয়ে পড়ে। সামাজিক ন্যায় প্রতিষ্ঠার প্রয়োজনে এমন কার্যপ্রক্রিয়ার কথা বলা হয়েছে যা প্রধানত আর্থনীতিক প্রকৃতির। আধুনিক বিজ্ঞান, প্রযুক্তি ও শিল্পায়নের পরিপ্রেক্ষিতে আর্থনীতিক ন্যায়ের ধারণা অধিকতর তাৎপর্যপূর্ণ প্রতিপন্ন হয়। বর্তমানে অধিকাংশ রাষ্ট্রই দেশ ও দেশবাসীর সামগ্রিক উন্নয়ন ও কল্যাণের স্বার্থে পরিকল্পিত অর্থব্যবস্থা অবলম্বন করেছে। পরিকল্পিত অর্থব্যবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে আর্থনীতিক ন্যায়ের ধারণা বিশেষভাবে প্রাসঙ্গিক প্রতিপন্ন হয়। উন্নতিশীল দেশগুলিতে পরিকল্পিত অর্থব্যবস্থা ও সমাজকল্যাণমূলক পরিকল্পনাসমূহের সার্থক বাস্তবায়নের জন্য বিভিন্ন সাবেকী আর্থনীতিক অধিকার এবং কায়েমী স্বার্থসমূহের মূলে আঘাত করতে হয়। জনসাধারণের স্বার্থে ব্যক্তিগত সম্পত্তি অধিগ্রহণ করতে হয় এবং ব্যক্তিগত মালিকানার বিকাশ ও ভূমিকার উপর যুক্তিসঙ্গত নিয়ন্ত্রণ আরোপ করতে হয়। এই সমস্ত কার্যপ্রক্রিয়ার মাধ্যমে আর্থনীতিক ন্যায় প্রতিষ্ঠিত হয়।

আর্থনীতিক ন্যায় সম্পর্কে উদারনীতিক ও মার্কসবাদী ধারণা:

আর্থনীতিক ন্যায়কে দুটি স্বতন্ত্র দৃষ্টিভঙ্গি থেকে দেখা হয়। এই দুটি দৃষ্টিভঙ্গি হল উদারনীতিক দৃষ্টিভঙ্গি এবং মার্কসবাদী দৃষ্টিভঙ্গি। সামাজিক ন্যায়ের মতো আর্থনীতিক ন্যায়ের ক্ষেত্রেও উদারনীতিক ও মার্কসবাদী চিন্তাবিদদের মধ্যে ব্যাপক মতবিরোধ বর্তমান। উদারনীতিবিদরা সমাজের আর্থনীতিক প্রয়োজন পূরণকেই আর্থনীতিক ন্যায় হিসাবে প্রতিপন্ন করার পক্ষপাতী। উদারনীতিবিদূরা আর্থনীতিক ন্যায়ের স্বার্থে রাষ্ট্র কর্তৃক জনকল্যাণমূলক কার্যসম্পাদন ও গতিশীল কর ব্যবস্থার মাধ্যমে আয় বৈষম্য হ্রাসের কথা বলেন। সপ্তদশ ও অষ্টাদশ শতাব্দীতে উদারনীতিবিদরা আর্থনীতিক ন্যায়ের মূল কথা হিসাবে উন্মুক্ত বাজার অর্থনীতিতে অবাধ প্রতিযোগিতাকে সমর্থন করেছেন। মার্কসীয় দৃষ্টিভঙ্গি অনুসারে একমাত্র ব্যক্তিগত সম্পত্তির অবসানের ভিত্তিতেই আর্থনীতিক ন্যায় প্রতিষ্ঠিত হতে পারে। কার্ল মার্কস সমাজের উৎপাদন ব্যবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে আর্থনীতিক ন্যায়ের বিষয়টিকে ব্যাখ্যা করেছেন। মার্কসীয় দর্শন অনুসারে ব্যক্তিগত সম্পত্তি ও পুঁজিবাদী উৎপাদন ব্যবস্থার অবসান ব্যতিরেকে আর্থনীতিক ন্যায় প্রতিষ্ঠিত হতে পারে না। একমাত্র শোষণহীন সমাজতান্ত্রিক আর্থনীতিক ব্যবস্থাতেই আর্থনীতিক ন্যায়ের প্রতিষ্ঠা সম্ভবপর। সমাজব্যবস্থায় ধনী-দরিদ্র এবং শোষক-শোষিতের মধ্যে ব্যবধান বর্তমান থাকলে আর্থনীতিক ন্যায় প্রতিষ্ঠিত হতে পারে না। মার্কসীয় ধারণা অনুসারে ব্যক্তিগত সম্পত্তির অবসান এবং সাম্যবাদের প্রতিষ্ঠার সঙ্গে আর্থনীতিক ন্যায় সম্পর্কযুক্ত।

আর্থনীতিক ন্যায় সম্পর্কে উদারনীতিক ও মার্কসবাদী ধারণার সমালোচনা:

আর্থনীতিক ন্যায় সম্পর্কিত মার্কসীয় মতবাদ বা উদারনীতিক মতবাদ কোনটিই সমালোচনার ঊর্ধ্বে নয়। মার্কসবাদীরা যে বণ্টন নীতির কথা বলেন তার সমালোচনা করা হয়। মার্কসীয় দর্শন অনুসারে সমাজতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় প্রত্যেকে তার কাজ অনুসারে পারিশ্রমিক পাবে; এবং চূড়ান্ত পর্যায়ে সাম্যবাদী সমাজব্যবস্থায় প্রত্যেকে তার সাধ্য অনুসারে কাজ করবে এবং প্রয়োজন অনুসারে পারিশ্রমিক পাবে। বণ্টনের এই নীতিকে ন্যায়সঙ্গত বলা যায় না। আবার এই নীতিকে মানবিক মূল্যবোধযুক্তও বলা যায় না। কারণ মানবিকতার আদর্শ অনুসারে অসহায় ও অক্ষম অবস্থায় মানুষকে সাহায্য করা দরকার। আবার উদারনীতিক মতবাদও সর্বাংশে স্বীকার্য নয়। উদারনীতিক মতবাদ অনুসারে আর্থনীতিক ন্যায়ের স্বার্থে নিয়ন্ত্রণমূলক আইন প্রণয়ন ও প্রয়োগ এবং যুক্তিসঙ্গত বিধিনিষেধ আরোপের কথা বলা হয়। কিন্তু এই সমস্ত ব্যবস্থাদি আর্থনীতিক ন্যায়ের ধারণাটিকে অতিমাত্রায় লঘু এবং অনেকাংশে অর্থহীন করে তুলবে। এই কারণে বলা হয় যে, বৃহত্তর জাতীয় আর্থ-সামাজিক স্বার্থ এবং ব্যক্তি ও গোষ্ঠীর অধিকার ও স্বার্থের মধ্যে নতুনভাবে সামঞ্জস্য সাধন ও ভারসাম্য রক্ষা করতে হবে।