উদারনীতিক গণতন্ত্র বর্তমান পৃথিবীর ব্যাপক অংশে প্রবর্তিত আছে। বিভিন্ন ধরনের রাজনীতিক ব্যবস্থার মধ্যে উদারনীতিক গণতন্ত্রের ধারণা অপেক্ষাকৃত জটিল বলে অনেকে মনে করেন। ব্লনডেল তাঁর সম্পাদিত গ্রন্থ Comparative Government-এ মন্তব্য করেছেন: “Liberal Democracy is…difficult to define, as the major components of the combined index (free elections, existence of an opposition, etc.) seem to defy rigorous operationalisation.” উদারনীতিক গণতন্ত্র হল এক বিশেষ ধরনের রাজনীতিক ব্যবস্থা। এর মধ্যে উদারনীতিক দর্শন, চিন্তা ও ভাবধারা প্রতিপন্ন হয়। গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে উদারনীতিক দর্শনের বাস্তবায়ন এর মূল লক্ষ্য। মোটামুটিভাবে সপ্তদশ শতাব্দীতে উদারনীতিক গণতান্ত্রিক ধ্যান-ধারণার বিকাশ ঘটে। এই সাবেকি উদারনীতিক গণতন্ত্রের দু’টি মূল নীতি হল রাজনীতিক স্বাধীনতা ও চিন্তার স্বাধীনতা। প্রাচীন গ্রীক দার্শনিকরা এ দু’টি নীতির স্রষ্টা হিসাবে পরিচিত। পরবর্তীকালে বেহাম, জেমস্, মিল, জে. এস. মিল প্রমুখ দার্শনিক উদারনীতিক গণতন্ত্রের বিকাশ সাধন করেন। তার ফলে এই রাজনীতিক ব্যবস্থার উপর ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ ও হিতবাদের সুস্পষ্ট প্রভাব পড়ে। ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদের বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়া হিসাবে ক্রমশ সমাজতান্ত্রিক ধ্যান-ধারণার আবির্ভাব ঘটে। বিংশ শতাব্দীতে সাবেকি উদারনীতিক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার কিছু কিছু পরিবর্তন ঘটে। ডিউই, কোহেন প্রমুখ চিন্তাবিদ্ উদারনীতিক গণতন্ত্রের আধুনিক রূপকে ব্যক্ত করেছেন।
উদারনীতিক গণতন্ত্রের আলোচনা প্রসঙ্গে ফাইনারের বিশ্লেষণ:
উদারনীতিক গণতন্ত্রের আলোচনা প্রসঙ্গে ফাইনার এই রাজনীতিক ব্যবস্থার ভিত্তি হিসাবে কয়েকটি মূল ধারণার কথা বলেছেন। তিনি এই ব্যবস্থার গণতান্ত্রিক ভিত্তির উপর জোর দিয়েছেন। গণতান্ত্রিক ভিত্তি বলতে তিনি বুঝিয়েছেন:
-
(ক) জনমতের উপর প্রতিষ্ঠিত ও জনমতের কাছে দায়িত্বশীল শাসনব্যবস্থাই হল গণতন্ত্র:
-
(খ) এই জনমত বলতে বোঝায় জনগণের প্রকাশ্য ও স্বাধীন মতামতকে; এবং
-
(গ) সকলের সম্মতির উপর প্রতিষ্ঠিত বলে ধরে নিলেও বাস্তবে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় সংখ্যাগরিষ্ঠের মতামতের প্রাধান্য অর্থাৎ সংখ্যাগরিষ্ঠের শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়।
ফাইনারের মতে উদারনীতিক গণতন্ত্র হল শর্তাধীন গণতন্ত্র। তিনি বলেছেন: “….liberal democracy is a qualified democracy” কারণ এই ব্যবস্থায় ব্যক্তি ও শ্রেণী বিশেষের স্বার্থের নিরাপত্তার দ্বারা সরকারের ক্ষমতা সীমাবদ্ধ। তা ছাড়া এই ব্যবস্থা সংখ্যাগরিষ্ঠের শাসনের নামে শ্রেণী বিশেষের স্বার্থ রক্ষার উপায়ে পরিণত হয়। এই ব্যবস্থা উদারনীতিক, কারণ সমাজের বৈচিত্র্য বা বহুমুখীনতাকে এখানে স্বীকার করা হয়ে থাকে। এই রাজনীতিক ব্যবস্থায় সমাজের প্রতিষ্ঠান ও সংগঠনসমূহের স্বাধীন ও স্বাতন্ত্র্য্যমূলক কর্মধারা স্বীকৃত। তবে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদী ধারণার প্রভাবে অনেক ক্ষেত্রে এই রাজনীতিক ব্যবস্থায় সমাজের সামগ্রিক স্বার্থকে উপেক্ষা করা হয়।
উদারনীতিক গণতন্ত্র হল গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার একটি বিশিষ্ট রূপ। সাম্য, স্বাধীনতা ও অধিকার হল। এর মূলনীতি। এর মৌলিক বৈশিষ্ট্যগুলিকে নিম্নলিখিতভাবে পর্যালোচনা করা যেতে পারে।
(১) উদারনীতিক গণতন্ত্রে রাজনীতিক সাম্যের উপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়। জনসাধারণকেই যাবতীয় রাজনীতিক ক্ষমতার একমাত্র উৎস হিসাবে গণ্য করা হয়। এক্ষেত্রে জনগণের শাসন কার্যত সংখ্যাগরিষ্ঠের শাসনে পরিণত হয়। কারণ বর্তমানে রাষ্ট্রের আয়তন ও জনসংখ্যা দুই–বিশাল ও বিপুল। তাই নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মাধ্যমে জনগণ পরোক্ষভাবে রাষ্ট্র পরিচালনায় অংশগ্রহণ করে। এইভাবে সংখ্যাগরিষ্ঠের শাসন হলেও কার্যত গণতান্ত্রিক সরকার সর্বসাধারণের মঙ্গলার্থে পরিচালিত হয়। কোন বিশেষ ব্যক্তি, গোষ্ঠী বা শ্রেণীর স্বার্থে সরকার কাজ করে না।
(২) এ ধরনের শাসনব্যবস্থায় সংখ্যালঘিষ্ঠের স্বার্থ অবহেলিত হয় না। তাদের স্বার্থ সংরক্ষণের জন্য বিবিধ সক্রিয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। যেমন—বিভিন্ন পদ্ধতির মাধ্যমে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিত্বের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়।
(৩) উদারনীতিক গণতন্ত্রে নাগরিক জীবনের সমুদয় পৌর ও রাজনীতিক অধিকার স্বীকৃত হয়। ব্যক্তিগত স্বাধীনতার অধিকার, শিক্ষার অধিকার, পরিবার গঠনের অধিকার, নির্বাচিত হওয়ার অধিকার, সরকারী চাকরি লাভের অধিকার প্রভৃতি সবরকম রাজনীতিক অধিকার ভোগের সুযোগ উদারনীতিক গণতন্ত্রে বর্তমান থাকে। বল বলেছেন: “Civil liberties, such as freedom of speech, religion, freedom from arbitrary arrest, are recognised and protected within the political system.” ভারত, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র প্রভৃতি উদারনীতিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে এই সমস্ত অধিকার সংবিধানেই বিধিবদ্ধ আছে।
(৪) এ ধরনের শাসনব্যবস্থায় আইনের অনুশাসন প্রতিষ্ঠিত হয়। আইনের দৃষ্টিতে সাম্য এবং আইনসমূহের দ্বারা সমভাবে সংরক্ষিত হওয়ার অধিকার উদারনীতিক গণতন্ত্রে স্বীকার করা হয়। ভারতীয় সংবিধানের ১৪ ধারায় এর উল্লেখ আছে।
(৫) উদারনীতিক গণতন্ত্রে একাধিক রাজনীতিক দলের অস্তিত্ব স্বীকৃত। বহুদলীয় ব্যবস্থায় বিভিন্ন শ্রেণীর বহুবিধ স্বার্থ ও সমস্যাদির প্রতিনিধিত্ব সম্ভব হয়। তা ছাড়া বিরোধী দলগুলি ক্ষমতাসীন দলের স্বৈরাচারী মনোভাবকে প্রতিহত করে গণতন্ত্রের স্বরূপ বজায় রাখতে পারে। বল বলেছেন: “There is more than one political party competing for political power.”
(৬) সার্বিক প্রাপ্তবয়স্কদের ভোটাধিকারের স্বীকৃতি এই রাজনীতিক ব্যবস্থার একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য। বল বলেছেন: “There are periodic elections based on universal franchise.” গণ-সার্বভৌমিকতার তত্ত্বকে বাস্তবে রূপায়িত করার জন্য উদারনীতিক গণতন্ত্রে সার্বিক প্রাপ্তবয়স্কের ভোটাধিকারকে অপরিহার্য মনে করা হয়।
(৭) উদারনীতিক গণতন্ত্রে সরকার পরিবর্তনের জন্য হিংসাত্মক বা বৈপ্লবিক কোন পন্থা অবলম্বন করতে হয় না। সাংবিধানিক উপায়ে শান্তিপূর্ণভাবেই সরকার বদল করা যায়।
(৮) এ ধরনের শাসনব্যবস্থায় ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার উপর যথেষ্ট গুরুত্ব আরোপ করা হয়। ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার জন্য উদারনীতিক গণতন্ত্রে একটি স্বাধীন ও নিরপেক্ষ বিচারব্যবস্থার কথা বলা হয়। বল বলেছেন: “There is some form of separation of powers, i.e., a representative assembly has some form of control over the executive and the judiciary is independent of both executive and legislature.”
(৯) উদারনীতিক গণতন্ত্রে ব্যক্তিগত সম্পত্তির অধিকার নাগরিকের অন্যতম মৌলিক অধিকার হিসাবে পরিগণিত হয়। তবে বর্তমানে কোন কোন উদারনীতিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে ব্যক্তিগত সম্পত্তির অধিকারের উপর কিছু কিছু বিধিনিষেধ আরোপ হয়েছে। ভারতীয় সংবিধানে সম্পত্তির অধিকারকে মৌলিক অধিকারের অধ্যায় থেকে বাদ দিয়ে সাধারণ আইনগত অধিকারে পরিণত করা হয়েছে।
(১০) জনকল্যাণকামী রাষ্ট্রতত্ত্বের পরিপ্রেক্ষিতে বর্তমান উদারনীতিক গণতন্ত্রে রাষ্ট্রের কর্মক্ষেত্রের পরিধি অধিকমাত্রায় বৃদ্ধি পেয়েছে। আর্থনীতিক ক্ষেত্রে অবাধ স্বাধীনতার নীতির পরিবর্তে পরিকল্পিত গণতান্ত্রিক অর্থব্যবস্থা গৃহীত হচ্ছে। সামাজিক ও অর্থনীতিক বৈষম্য দূর করার জন্য শিল্প-বাণিজ্যের নিয়ন্ত্রণ ও ক্ষেত্রবিশেষে জাতীয়করণ, গতিশীল করব্যবস্থা প্রভৃতি গ্রহণ করা হচ্ছে।
(১১) চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠীগুলি উদারনীতিক গণতন্ত্রে সরকারী সিদ্ধান্তের উপর প্রভাব বিস্তার করতে পারে। বিভিন্ন স্বেচ্ছামূলক সংগঠনের উপর কঠোর সরকারী নিয়ন্ত্রণ থাকে না। এই রাজনীতিক ব্যবস্থায় স্বার্থগোষ্ঠীগুলি নিজের স্বার্থসিদ্ধির জন্য সর্বতোভাবে উদ্যোগী হয়। বল বলেছেন: “Pressure Groups are able to operate to influence government decisions.”
(১২) উদারনীতিক গণতন্ত্রের জনকল্যাণমূলক আদর্শ ও সরকারের রাজনীতিক অংশের ঘন ঘন পরিবর্তনের জন্য সরকারের অ-রাজনীতিক অংশ বা স্থায়ী সরকারী কর্মচারীদের গুরুত্ব ও প্রাধান্য অত্যধিক বৃদ্ধি পায়। অর্থাৎ উদারনীতিক গণতন্ত্র বহুলাংশে আমলাতান্ত্রিক রূপ ধারণ করে।
(১৩) উদারনীতিক গণতন্ত্রে সংবাদপত্র, বেতার প্রভৃতি গণ-সংযোগের মাধ্যমগুলির স্বাধীনতা স্বীকৃত। এগুলিকে সরকার নিয়ন্ত্রণ করে না। গণ-সংযোগের মাধ্যমগুলি সরকারের সমালোচনা করতে পারে। বল বলেছেন: “…there is a substantial amount of independence and freedom from government control of the mass media, i.e. radio, television, newspapers.”
(১৪) উদারনীতিক গণতান্ত্রিক রাজনীতিক ব্যবস্থায় ক্ষমতা দখলের জন্য খোলাখুলি প্রতিযোগিতা হয়ে থাকে। এ ব্যাপারে কোনরকম গোপনীয়তা থাকে না। এই প্রতিযোগিতা প্রতিষ্ঠিত ও স্বীকৃত পদ্ধতি অনুসারে পরিচালিত হয়। বল বলেছেন: “The competition for power is open not secretive and is based on established and accepted forms of procedure.”
(১৫) রাজনীতিক ক্ষমতাযুক্ত বিভিন্ন পদে নিযুক্ত ও আসীন হওয়ার বিষয়টিও অপেক্ষাকৃত খোলামেলা। বল বলেছেন: “Entry and recruitment to positions of political power are relatively open.”
উদাহরণ: উদারনীতিক গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার উল্লেখযোগ্য উদাহরণ হিসাবে ইংল্যাণ্ড ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শাসনব্যবস্থার কথা বলা হয়। এই দুটি দেশে নাগরিক জীবনের সব রকম পৌর ও রাজনীতিক অধিকার স্বীকৃত। উভয় দেশের শাসনব্যবস্থাতেই গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের স্থান শীর্ষে। এই সমস্ত দেশে জনগণ হল সকল রাজনীতিক ক্ষমতার মূল উৎস। তা ছাড়া অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, হল্যাণ্ড, বেলজিয়াম প্রভৃতি দেশেও উদারনীতিক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা বর্তমান। বল বলেছেন: “The political system of Britain, France, Sweden, the United States, West Germany etc. can be grouped together under the label “liberal democratic’, thereby stressing certain important characteristics these political systems possess in contrast to other political systems.” বর্তমানে ভারত, শ্রীলঙ্কা প্রভৃতি দেশের রাজনীতিক ব্যবস্থাও এই শ্রেণীর।
উদারনীতিক গণতন্ত্রের আলোচনা প্রসঙ্গে সমালোচনা
বিরুদ্ধবাদীরা উদারনীতিক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার বিরুদ্ধে বিভিন্ন যুক্তির অবতারণা করে থাকেন।
(১) উদারনীতিক গণতন্ত্রে সামাজিক ও রাজনীতিক স্বাধীনতার উপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়। এই রাজনীতিক ব্যবস্থায় আর্থনীতিক স্বাধীনতাকে উপেক্ষা করা হয়। কিন্তু আর্থনীতিক স্বাধীনতা ছাড়া সামাজিক ও রাজনীতিক স্বাধীনতা অর্থহীন হয়ে পড়ে।
(২) এ ধরনের শাসনব্যবস্থায় রাজনীতিক সাম্যকে স্বীকার করা হয়, কিন্তু আর্থনীতিক সাম্যকে সম্পূর্ণভাবে উপেক্ষা করা হয়। অথচ আর্থনীতিক ক্ষেত্রে অসাম্য থাকলে রাজনীতিক ক্ষেত্রে সাম্য প্রতিষ্ঠা অসম্ভব। ল্যাস্কির মতানুসারে আর্থনীতিক গণতন্ত্র ছাড়া রাজনীতিক গণতন্ত্র মূল্যহীন।
(৩) উদারনীতিক গণতন্ত্রকে জনমত পরিচালিত শাসনব্যবস্থা বলা হয়। কিন্তু এই ব্যবস্থায় ধনতান্ত্রিক অর্থব্যবস্থা ও ধনবৈষম্যের কারণে সুষ্ঠু জনমত গঠিত হতে পারে না। কারণ আর্থিক দিক থেকে প্রতিপত্তিশালী শ্রেণী জনমত গঠন ও প্রকাশের মাধ্যমগুলিকে নিয়ন্ত্রণ করে। সুতরাং এই ব্যবস্থায় যে জনমত গঠন করা হয়। তা বিত্তবান শ্রেণীর স্বার্থবাহী মতামত বই কিছু নয়। একে প্রকৃত জনমত বলা যায় না।
(৪) এ ধরনের শাসনব্যবস্থায় বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ও নিরপেক্ষতা অলীক প্রতিপন্ন হয়। কারণ উদারনীতিক গণতন্ত্রের ধনবৈষম্যমূলক ব্যবস্থায় বিচারকদের স্বাধীনতা ও নিরপেক্ষতা বজায় রাখা সম্ভব হয় না। তার ফলে ন্যায়বিচারের আশা দুরাশায় পরিণত হয়।
(৫) উদারনীতিক গণতন্ত্রে একাধিক রাজনীতিক দলের অস্বিত্ব স্বীকৃত। তার ফলে বিশৃঙ্খলা, বিভ্রান্তি, অনৈক্য প্রভৃতি বহুদলীয় ব্যবস্থার যাবতীয় ত্রুটি এ ধরনের শাসনব্যবস্থায় দেখা দেয়।
(৬) উদারনীতিক গণতন্ত্রে সংখ্যালঘিষ্ঠের স্বার্থ ও প্রতিনিধিত্বের যে সকল পন্থা-পদ্ধতির কথা বলা হয় তা বাস্তবে কার্যকরী ও ফলপ্রসু হতে দেখা যায় না।
(৭) এ ধরনের শাসনব্যবস্থায় সম্পত্তির ব্যক্তিগত মালিকানা এবং উৎপাদন ও বণ্টনের উপর সামাজিক নিয়ন্ত্রণের অনুপস্থিতির জন্য সরকারের জনকল্যাণমূলক পরিকল্পনাও ফলপ্রসূ হয় না।
(৮) অনেক ক্ষেত্রেই জনগণের শাসন মুষ্টিমেয়ের শাসনে পরিণত হয় এবং কার্যক্ষেত্রে আমলাতন্ত্রের প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত হয়। তা ছাড়া নির্বাচনও সবসময় অবাধ হয় না।
ব্যাপক সমালোচনা সত্ত্বেও উদারনীতিক গণতন্ত্রের উপযোগিতাকে একেবারে অস্বীকার করা যায় না। এ ধরনের শাসনব্যবস্থায় জনগণ বেশ কিছুটা স্বাধীনতা ভোগ করতে পারে এবং অন্যায়ের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করার সুযোগ লাভ করে। সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও অ-গণতান্ত্রিক স্বৈরাচারী শাসনের তুলনায় সাধারণ মানুষের কাছে উদারনীতিক গণতন্ত্র কাম্য।
উদারনীতিক গণতন্ত্রের আলোচনা প্রসঙ্গে বলের পর্যালোচনা:
বল উদারনীতিক রাজনীতিক ব্যবস্থার মূল্যায়ন ও পর্যালোচনা করেছেন। তাঁর অভিমত অনুসারে উদারনীতিক গণতান্ত্রিক রাজনীতিক ব্যবস্থা বহু ও বিভিন্ন উপাদানের সমন্বয়ে গঠিত হয়। এই উপাদানগুলির পারস্পরিক উপযোগিতা প্রসঙ্গে রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের মধ্যে মতানৈক্য পরিলক্ষিত হয়। বল বলেছেন: “A major problem is the relative importance of the different varriables.” উদাহরণ হিসাবে তিনি বলেছেন যে, দক্ষিণ আফ্রিকায় প্রতিযোগিতামূলক দলীয় ব্যবস্থা বর্তমান। অপরদিকে তান্জিনিয়ায় এক-দলীয় ব্যবস্থা বর্তমান। অথচ জনসাধারণের পৌর অধিকার ও স্বাধীনতাসমূহ তাঞ্জানিয়ার থেকে দক্ষিণ আফ্রিকায় অধিকতর কঠোরভাবে সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা হয় কিনা সে বিষয়ে সন্দেহের অবকাশ আছে। কারণ আগে দক্ষিণ আফ্রিকায় রাজনীতিক দলগুলির মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা বলতে কেবলমাত্র শ্বেতাঙ্গ রাজনীতিক দলগুলির মধ্যে প্রতিযোগিতাকে বোঝাত। দেশবাসীর সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশই আনুষ্ঠানিক রাজনীতিক ক্ষেত্রে অনুপ্রবেশের অধিকার থেকে বঞ্চিত। তা ছাড়া বিচার-বিভাগ শাসন-বিভাগীয় নিয়ন্ত্রণ থেকে কতদূর মুক্ত এবং গণ-সংযোগের মাধ্যমগুলি সরকারী নিয়ন্ত্রণ থেকে কতটা স্বাধীন তাও উদারনীতিক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বলে বিবেচিত হয়। বল বলেছেন: “The degree to which the judi ciary is independent of executive control or the mass media free of government censorship are very important questions.” ১৯৭৫ সালে জারি করা জরুরী অবস্থার প্রাক্কালে শ্রীমতী গান্ধীর সরকার সংবাদপত্রের উপর সেন্সরশিপ চালু করেছিল এবং বিনাবিচারে বিরোধী রাজনীতিক নেতাদের গ্রেপ্তার ও আটকের ব্যবস্থা করেছিল। এই কারণে বিরুদ্ধবাদীরা শ্রীমতী গান্ধীর শাসনাধীন ভারতকে উদারনীতিক গণতন্ত্রের পর্যায়ভুক্ত করার পক্ষপাতী ছিলেন না। এ প্রসঙ্গে বলের অভিমত হল: “But here we meet the problems of change and the fact that few political system are static.” বল এ ক্ষেত্রে একটি তাৎপর্যপূর্ণ প্রশ্ন উত্থাপন করেছেন। বিষয়টি হল, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রাক্কালে ব্রিটিশ সরকার সুদূরপ্রসারী ব্যাপক ক্ষমতা করায়ত্ত করেছিলেন। এই সমস্ত ক্ষমতার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল: বিনাবিচারে গ্রেপ্তার ও আটক, সংবাদপত্রের উপর নিষেধাজ্ঞা, সম্পত্তি বাজেয়াপ্তকরণ, নির্বাচনের উপর স্থগিতাদেশ, শ্রমিকদের নির্দেশ প্রদান প্রভৃতি। এখন বলের প্রশ্ন হল এই সমস্ত কিছুর পরিপ্রেক্ষিতে গ্রেট ব্রিটেন কি উদারনীতিক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা থেকে বিচ্যুত হয়েছিল? তবে এ প্রসঙ্গে বল বলেছেন: “Of course the nature of the emergency, the agreement of all the main political parties and the apparent consent of the British people to these draconian powers were very important consideration, yet the example does underline some of the difficulties in classification.” এ প্রসঙ্গে পরিশেষে বলের আর একটি দীর্ঘ মন্তব্য বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য। তিনি বলেছেন: “…the concept of liberal democracy is flexible enough to be able to group together various systems by emphasising certain essential characteristics and usefully to contrast these systems with other broad categories of political system.”
Leave a comment