টিম দুন্নের শ্রেণীকরণ: আন্তর্জাতিক সম্পর্ক সম্পর্কিত উদারনীতিক চিন্তাভাবনা সব সময় একই ধারায় প্রবাহিত হয়নি। এক্ষেত্রে সময় ও চিন্তাবিদভেদে পার্থক্য বর্তমান। এই পার্থক্যের পরিপ্রেক্ষিতে ঐতিহাসিক বা কালগত বিচারের থেকে বিষয়বস্তুগত বিচারে উদারনীতিবাদকে তিন ভাগে বিভক্ত করা যায়। আন্তর্জাতিক সম্পর্ক সংক্রান্ত উদারনীতিবাদের এই তিনটি ভাগ হল-

  • (১) উদারনীতিক আন্তর্জাতিকতাবাদ (Liberal Internationalism), 

  • (২) উদারনীতিক আদর্শবাদ (Liberal Idealism) এবং 

  • (৩) উদারনীতিক প্রাতিষ্ঠানিকতাবাদ (Liberal Institutionalism)। 

আন্তর্জাতিক সম্পর্কবিজ্ঞানী টিম দুন্নে (Tim Dunne) তাঁর Liberalism শীর্ষক রচনায় উদারনীতিবাদী বক্তব্যের এই শ্রেণীকরণ করছেন।

(১) উদারনীতিক আন্তর্জাতিকতাবাদ:

বিশিষ্ট উদারনীতিক আন্তর্জাতিকতাবাদীদের মধ্যে দু’জন চিন্তাবিদের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এই দু’জন হলেন অষ্টাদশ শতাব্দীর জার্মান দার্শনিক ইমানুয়েল কান্ট (Immanuel Kant) এবং অষ্টাদশ শতাব্দীর ইংরেজ দার্শনিক জেরেমি বেন্থাম (Jeramy Bentham)।

উদারনীতিক আন্তর্জাতিকতাবাদের মূল কথা:

উদারনীতিক আন্তর্জাতিকতাবাদের মূল বক্তব্য হল যে, অগণতান্ত্রিক রাষ্ট্রনেতা এবং ক্ষমতার ভারসাম্য (balance of power)-এর মত অচল নীতিসমূহের দ্বারা প্রাকৃতিক বা স্বাভাবিক শৃঙ্খলা বা ব্যবস্থা বিঘ্নিত হয়েছে। এর প্রতিকারের পথ হিসাবে এই শ্রেণীর উদারনীতিবাদীরা বিশ্বাস করেন যে, বিশ্ববাসীর মধ্যে পারস্পরিক সংযোগ-সম্পর্ক বৃদ্ধির মাধ্যমে অধিকতর শান্তিপূর্ণ আন্তর্জাতিক সম্পর্ক গড়ে তোলা সম্ভব। ব্যবসাবাণিজ্য ও পরিভ্রমণের মাধ্যমে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তের অধিবাসীদের মধ্যে এ ধরনের সংযোগ সম্পর্কের সৃষ্টি, বিকাশ ও বিস্তার হতে পারে। কান্ট এবং বেন্থাম উভয়েই আন্তর্জাতিক সম্পর্কের নৃশংসতার বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন। কান্ট আন্তর্জাতিক সম্পর্কের এই বর্বর অবস্থাকে বলেছেন, ‘আইনকানুনহীন অসভ্য অবস্থা’ (‘the lawless state of savagery’)। অথচ সমকালীন রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার অভ্যন্তরে অধিকার, নাগরিকতা ও সাংবিধানিকতার নতুন যুগের সূত্রপাত ঘটেছে। কান্ট-বেহাম দু’শতাব্দীরও অধিককাল আগে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ক তাঁদের বক্তব্য ব্যক্ত করেছেন। এতদসত্ত্বেও তাঁদের ধ্যানধারণাই উদারনীতিক আন্তর্জাতিকতাবাদী চিন্তাচেতনার ভিত্তি প্রস্তুত করেছে। এঁদের মূল কথা হল আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে যুক্তির মাধ্যমে ন্যায় ও স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠিত হতে পারে। টিম দুরে (Tim Dunne) বলেছেন: “The idea of natural order underpinning human society is the cornerstone of liberal internationalism.”

কাণ্ট: জার্মান দার্শনিক কান্ট স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য অপরিহার্য হিসাবে কতকগুলি বিষয়ের কথা বলেছেন। এই বিষয়গুলি হল ব্যক্তিগত চেতনার রূপান্তর সাধন, সাধারণতান্ত্রিক সাংবিধানিকতাবাদ এবং যুদ্ধের অবসানের ব্যাপারে রাষ্ট্রসমূহের মধ্যে একটি যুক্তরাষ্ট্রীয় চুক্তি সম্পাদন। এই যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাকে এক স্থায়ী শান্তি চুক্তির সঙ্গে সংযুক্ত করতে হবে। এ ক্ষেত্রে কোন ‘অতিরাষ্ট্র’ (superstate) বা বিশ্ব-সরকার (World government)-এর কথা বলা হয়নি।

বেন্থাম: আন্তর্জাতিক বিবাদ-বিসংবাদের মীমাংসার জন্য যুদ্ধের পথে অগ্রসর হওয়ার এক সাধারণ প্রবণতা রাষ্ট্রসমূহের মধ্যে দেখা যায়। এই প্রবণতা হল একটি সমস্যা। এই সমস্যার উপর বেহাম গুরুত্ব আরোপ করেছেন। আন্তর্জাতিক বিরোধের নিষ্পত্তির স্বার্থে তিনি সাধারণ ট্রাইবুন্যাল প্রতিষ্ঠার কথা (Common tribunal) বলেছেন। বেন্থামের মতানুসারে মতপার্থক্য থেকে যুদ্ধের প্রয়োজনীয়তার সৃষ্টি হয় না। যুক্তরাষ্ট্রীয় দেশগুলি পারস্পরিক বিবদমান স্বার্থসমূহকে ভুলে অধিকতর শান্তিপূর্ণ যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার পরিচয় নিয়ে আত্মপ্রকাশ করতে পারে। বেন্থামের যুক্তি অনুসারে বিভিন্ন দেশ বা জাতির স্বার্থসমূহের মধে, কোথাও কোন প্রকৃত সংঘাত নেই (“between the intersts of the nations there is nowhere any real coenflict.”)। স্থায়ী শান্তির জন্য এই পরিকল্পনার অর্থ হল নিজের দেশে সামাজিক ক্ষেত্রে ব্যক্তিবর্গের মধ্যে সম্পাদিত সামাজিক চুক্তিকে আন্তর্জাতিক ব্যবস্থার স্তরে রাষ্ট্রসমূহের মধ্যে প্রসারিত করা। এর অর্থ হল রাষ্ট্রসমূহকে আইনানুগ অধিকার ও কর্তব্যসমূহের এক ব্যবস্থার বাধ্যবাধকতার সামিল করা। উদারনীতিক আন্তর্জাতিকতাবাদীদের অভিমত অনুযায়ী একটি বিশ্ব-সরকার (World government) ছাড়াই একটি বিধি শাসিত আন্তর্জাতিক সমাজ গড়ে তোলা সম্ভব।

(২) উদারনীতিক আদর্শবাদ:

উদারনীতিক আন্তর্জাতিকতাবাদ ও আদর্শবাদের মধ্যে অল্পবিস্তর সাদৃশ্য আছে। উভয় মতবাদই বিভিন্ন রাষ্ট্রের স্বার্থসমূহকে নির্বীর্ষ করার জন্য বিশ্বজনমতের ক্ষমতার উপর গুরুত্ব আরোপের পক্ষপাতী। সীমাবদ্ধ সাদৃশ্য সত্ত্বেও আন্তর্জাতিক সম্পর্কের আলোচনায় আদর্শবাদ হল একটি স্বতন্ত্র মতবাদ। আদর্শবাদের স্বাতন্ত্র্যের বড় পরিচয় হল যে, এই মতবাদ একটি আন্তর্জাতিক শৃঙ্খলা গড়ে তোলার উপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করে। আদর্শবাদীদের অভিমত অনুযায়ী আন্তর্জাতিক সম্পর্ক সংক্রান্ত সমস্যার অন্যতম কারণ হল রাষ্ট্রসমূহের স্বাধীনতা; রাষ্ট্রের স্বাধীনতা এক্ষেত্রে সমস্যার সমাধান নয়। এ বিষয়ে আন্তর্জাতিকতাবাদীদের সঙ্গে আদর্শবাদীদের পার্থক্য বর্তমান। আন্তর্জাতিক সমস্যার সমাধানের ব্যাপারে আদর্শবাদীরা দুটি বিষয়ের উপর জোর দেন। (ক) সুস্পষ্ট নীতিমানমূলক (normative) চিন্তাভাবনা আবশ্যক। এর উদ্দেশ্য হবে শান্তি স্থাপন এবং উন্নততর বিশ্বব্যবস্থা গড়ে তোলা। (খ) রাষ্ট্রসমূহ একটি আন্তর্জাতিক সংগঠনের অংশ হিসাবে অবস্থান করবে। আন্তর্জাতিক সংগঠনের নিয়মনীতির ভিত্তিতে রাষ্ট্রসমূহ পরিচালিত হবে। আন্তর্জাতিকতাবাদীদের মত আদর্শবাদীরাও যুদ্ধের অবসানের ব্যাপারে আগ্রহী ও উদ্যোগী ছিলেন। এ বিষয়ে এই দুই শ্রেণীর উদারনীতিবাদীদের বক্তব্য উনিশ শতকের গোড়ার দিক থেকে উনিশ শতকের তিরিশের দশকের শেষের দিক পর্যন্ত গুরুত্ব লাভ করেছিল। উদারনীতিক আদর্শবাদের মূল বিষয় ছিল একটি আন্তর্জাতিক সংগঠন গড়ে তোলা। এই আন্তর্জাতিক সংগঠনের উদ্দেশ্য হবে শান্তিপূর্ণ পরিবর্তন, নিরস্ত্রীকরণ, সালিসী-মীমাংসা এবং প্রয়োজনে শক্তিপ্রয়োগের ব্যবস্থা করা। ১৯২০ সালে জাতিসঙ্ঘ প্রতিষ্ঠিত হয়।

হবসন: মুক্ত বাণিজ্যের মত অবাধ অর্থনীতিক ব্যবস্থার মাধ্যমে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে শান্তি স্থাপন সম্ভব হবে, এ বিষয়ে আদর্শবাদীরা সন্দিহান ছিলেন। আদর্শবাদী চিন্তাবিদ হবসন (J.A. Hobson) -এর অভিমত অনুযায়ী আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে সংঘর্ষের প্রাথমিক কারণ হল সাম্রাজ্যবাদ বা বিদেশী মানুষজনকে বশীভূত করা এবং তাঁদের সম্পদ-সামগ্রীকে করায়ত্ত করা। কিন্তু উদারনীতিক আন্তর্জাতিকতাবাদীদের মতানুসারে পুঁজিবাদ হল মূলত শাস্তিমূলক ব্যবস্থা। হসন আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বিবাদ বিসংবাদের কারণ হিসাবে পুঁজিবাদকেই দায়ী করেছেন। পুঁজিবাদের উদ্ভব ব্যাখ্যা করতে গিয়ে হসন বলেছেন যে, উন্নত পুঁজিবাদী দেশগুলিতে ভোগ্যপণ্য সামগ্রিকভাবে ভোগ করা হয় না। এই অবস্থায় পুঁজিপতিরা দেশের সীমানার বাইরে অধিকতর মুনাফার সন্ধানে যাবতীয় উদ্যোগ-আয়োজন গ্রহণ করে। এ রকম পরিস্থিতিতে পুঁজিবাদী রাষ্ট্রসমূহের মধ্যে ক্ষমতার প্রতিযোগিতা শুরু হয়। শুরু হয় সামরিক শক্তির প্রয়োগ। তার ফলে অবধারিতভাবে যুদ্ধ বেধে যায়।

আন্তর্জাতিক কর্তৃপক্ষের প্রয়োজনীয়তা: প্রথম বিশ্বযুদ্ধ উদারনীতিক চিন্তাধারাকে অন্য একটি সিদ্ধান্তে উপনীত করে। বলা হয় যে, শান্তি কোন স্বাভাবিক অবস্থা নয়। শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য বিশেষ ব্যবস্থা অবলম্বন করা আবশ্যক। দেশের ভিতরে যেমন একটি সরকারি ব্যবস্থা থাকে, তেমনি আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রেও সরকারি প্রশাসনিক ব্যবস্থা থাকা দরকার। জাতীয় সরকার যেমন অভ্যন্তরীণ বিবাদ-বিসংবাদের মীমাংসা করে, আন্তর্জাতিক সমাজেও সরকার রাষ্ট্রসমূহের পারস্পারিক সংঘাত-সংঘর্ষের নিষ্পত্তি করবে। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে বিবাদ-বিসংবাদের শান্তিপূর্ণ সমাধান সম্ভব না হলে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে শক্তির সাহায্য নেওয়া হবে। এ প্রসঙ্গে টিম দুরে (Tim Dunne) মন্তব্য করেছেন: liberal ideal ism rests on a domestic analogy.” নিরাপত্তার বিষয়টিকে গোপন দ্বিপাক্ষিক কূটনীতিক সমাধানের উপর ছেড়ে দেওয়া যায় না; অথবা ক্ষমতার ভারসাম্যের উপর অন্ধ বিশ্বাসের হাতে ছেড়ে দেওয়া যায় না। আন্তর্জাতিক সম্পর্ক পরিচালনার ক্ষেত্রে একটি আন্তর্জাতিক কর্তৃপক্ষের সদর্থক ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। এ বিষয়ে প্রবক্তা হিসাবে প্রাক্তন মার্কিন রাষ্ট্রপতি উইলসন (Woodrow Wilson)-এর নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য তাঁর অভিমত অনুযায়ী আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে শাস্তিকে সুনিশ্চিত ও নিরাপদ করার জন্য আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে নৈরাজ্য নিয়ন্ত্রণ করা দরকার। উইলসনের মতানুসারে জাতিসমূহের একটি সাধারণ সংস্থা গঠন করতে হবে। এই সংস্থাই শান্তি সংরক্ষণ করবে। টিম দুন্নে বলেছেন: “Wilson argued that a general association of nations must be formed’ to preserve the coming peace.” এ রকম একটি সাধারণ সংস্থার পরিকল্পনা বাস্তবে সাংগঠনিক রূপ ধারণ করে ‘জাতিসঙ্ঘ’ (League of Nations)- এর মাধ্যমে।

জাতিসঙ্ঘের অভিজ্ঞতা বিপর্যয়পূর্ণ। জাতিসঙ্ঘের সৃষ্টির প্রাক্কালে বাগাড়ম্বরপূর্ণ নীতিকথার ফুলঝুরি ছিল। যে সব ছিল অতিমাত্রায় আদর্শবাদী। বাস্তবে রাষ্ট্রসমূহ সংকীর্ণ আত্মস্বার্থের সীমাবদ্ধতাকে অতিক্রম করতে পারেনি। জাতিসঙ্ঘের বিপর্যস্ত অবস্থার সব থেকে বড় উদাহরণ হল, মার্কিনযুক্তরাষ্ট্র জাতিসংঙেঘর সদস্যপদ গ্রহণ করেনি। অথচ সমকালীন মার্কিন রাষ্ট্রপতি উইলসন ছিলেন এর অন্যতম শ্রষ্টা। টিম দুরে মন্তব্য করেছেন: ..liberal ideas made an important contribution to global politics even during the cold war. The principle of self-determination, championed by liberal internationalists for centuries, signalled the end of empire.”

(৩) উদারনীতিক-প্রতিষ্ঠানিকতাবাদ:

আন্তর্জাতিক সম্পর্ক আলোচনার ক্ষেত্রে উদারনীতিবাদের তৃতীয় প্রকারটি হল উদারনীতিক প্রাতিষ্ঠানিকতাবাদ। বিংশ শতাব্দীর চল্লিশের দশকে এই শ্রেণীর উদারনীতিকরা আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানসমূহের ব্যাপারে আগ্রহ প্রকাশ করেন। রাষ্ট্র সম্পাদনে সক্ষম নয়, এ রকম বিবিধ কাজকর্ম এই সমস্ত প্রতিষ্ঠান সম্পাদন করবে। এই বিষয়টি ইউরোপের সংহতিতত্ত্ব এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বহুত্ববাদের ক্ষেত্রে অনুঘটক হিসাবে কাজ করে। বিংশ শতাব্দীর সত্তরের দশকের গোড়ার দিকে বহুত্ববাদ বাস্তববাদের বিরুদ্ধে তাৎপর্যপূর্ণ চ্যালেঞ্জ সৃষ্টি করে। উদারনীতিক প্রাতিষ্ঠানিকতাবাদ বহুজাতিক করপোরেশনসমূহ (transnational corporations), বেসরকারী সংগঠনসমূহ (Ngo-non-governmental organisations) এবং নতুন ধরনের মিথষ্ক্রিয়ার উপর গুরুত্ব আরোপ করে। নতুন ধরনের মিথষ্ক্রিয়া বলতে পারস্পরিক নির্ভরশীলতা, সংহতি প্রভৃতিকে বোঝায়।

বৃহৎ শক্তিবর্গের মধ্যে ঐকমত্য: আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ইতিহাস অনুযায়ী জাতিসঙ্ঘ (League of Nations)-এর পতন উদারনীতিক আদর্শবাদের অবসান প্রতিপন্ন করে। উদারনীতিক প্রাতিষ্ঠানিকতা স্পষ্টত কম নীতিমানমূলক। সম্মিলিত জাতিপুঞ্জ (United Nations Organisation)-এর ক্ষেত্রে স ( Charter) এর রচয়িতারা বাধ্যতামূলক পদক্ষেপের ক্ষেত্রে বৃহৎ শক্তিবর্গের মধ্যে ঐকমত্যের অপরিহার্যতার ব্যাপারে সতর্ক ছিলেন। তাঁরা জানতেন যে, অন্যথায় বাধ্যতামুলক পদক্ষেপকে কার্যকর করা যাবে না। এই কারণে সম্মিলিত জাতিপুঞ্জের সনদের ২৭ ধারায় নিরাপত্তা পরিষদের বৃহৎ পঞ্চশক্তিকে ভেটো (veto) ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। এই কারণে ‘ঠান্ডাযুদ্ধ’ (Cold war)-এর অবসানের আগে অবধি ‘যৌথ নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা’ (collective security system)-কে কার্যকর করা হয়নি। ১৯৯০ সালের ২ রা আগষ্ট ইরাক কুয়েত আক্রমণ করলে সম্মিলিত জাতিপুঞ্জের যৌথ নিরাপত্তার ব্যবস্থা প্রথম প্রযুক্ত হয়।

আন্তর্জাতিক স্তরে সহযোগিতা: যুদ্ধোত্তর পর্বের গোড়ার দিকে উদারনীতিক প্রাতিষ্ঠানিকতাবাদীরা এই‌ বিষয়টি তুলে ধরেন যে, আধুনিকীকরণ প্রক্রিয়ার সঙ্গে এঁটে উঠা রাষ্ট্রের পক্ষে সম্ভব নয়। ‘সংহতি তত্ত্ব’ (integration theory)-এর অন্যতম প্রবক্ত হিসাবে পরিচিত ডেভিড মিত্রানি (Dvid mitrany) এই যুক্তি‌ খাড়া করেন যে, সাধারণ সমস্যাদির সম্যক সমাধানের জন্য জাতির সীমানা অতিক্রম করে সহযোগিতা (transnational cooperation) আবশ্যক। তিনি এই ধারণা পোষণ করতেন যে, এই সহযোগিতার প্রক্রিয়া সমাজজীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে শাখা বিভক্ত করবে। একটি ক্ষেত্রে সহযোগিতা অন্যান্য ক্ষেত্রে সহযোগিতার সম্ভাবনা সৃষ্ট করবে। উদানীতিক প্রাতিষ্ঠানিকতাবাদীদের অন্যতম মূল বিষয় হল বহুজাতিক সহযোগিতার সার্থক সুফলের উপর গুরুত্ব আরোপ করা। কল্যাণমূলক দায়িত্ব সম্পাদনের ক্ষেত্রে সার্বভৌম রাষ্ট্রসমূহের সামর্থ্য হ্রাস পাচ্ছে। এরকম পরিস্থিতিতে আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক প্রতিষ্ঠানসমূহ হল সার্বভৌম রাষ্ট্রের পরিপুরক ক্রিয়াকারী।

রাষ্ট্রকেন্দ্রিক দৃষ্টিভঙ্গি বাতিল: বিংশ শতাব্দীর ষাটের দশকের শেষের দিকে এবং সত্তরের দশকের গোড়ার দিকে এক নতুন প্রজন্মের চিন্তাবিদদের আবির্ভাব ঘটে। প্রধানত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এই শ্রেণীর‌ সমাজবিজ্ঞানীদের অধ্যয়ন অনুশীলন পরিলক্ষিত হয়। সংশ্লিষ্ট সমাজবিজ্ঞানীরা ইউরোপীয় সংহতিমূলক রচনাসমূহের দ্বারা বিশেষ ভাবে প্রভাবিত হন। রাষ্ট্রব্যবস্থার উপর আধুনিকীকরণের প্রভাব প্রতিক্রিয়া তাঁরা গভীরভাবে পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও ব্যাখা-বিশ্লেষণ করতে শুরু করেন। এই শ্রেণীর চিন্তাবিদ্রা ঐতিহ্যমূলক বাস্তববাদী এবং আচরণবাদীদের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ক রাষ্ট্রকেন্দ্রিক ধ্যান-ধারণাকে বাতিল করে দেন। উদারনীতিক প্রাতিষ্ঠানিক ভাববাদীদের কাছে আন্তর্জাতিক রাজনীতি রাষ্ট্রসমূহের একচেটিয়া এলাকা নয়। এ ক্ষেত্রে অন্যান্য ক্রিয়াকারীদের কার্যকর ভূমিকাকেও অস্বীকার করা যায় না। এই সমস্ত ক্রিয়াকারীদের উদাহরণ হিসাবে উল্লেখযোগ্য হল স্বার্থগোষ্ঠীসমূহ, বহুজাতিক করপোরেশনসমূহ, আন্তর্জাতিক বেসরকারী সংগঠনসমূহ প্রভৃতি। এই শ্রেণীর চিন্তাবিদদের প্রায়শই বহুত্ববাদী (pluralists) হিসাবেও চিহ্নিত করা হয়।

পুঁজিবাদের বিকাশ এবং বিশ্ব সংস্কৃতির উত্থানের পরিপ্রেক্ষিতে বহুত্ববাদীরা রাষ্ট্রসমূহের মধ্যে ক্রমবর্ধমান পারস্পরিক নির্ভরশীলতার উপর গুরুত্ব আরোপ করেন। রাষ্ট্রের পরিপূর্ণ স্বাধিকারের বিষয়টি পারস্পরিক নির্ভরশীলতার ধারণার দ্বারা সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ে। টিম দুন্নে (Tim Dunne) তাঁর Liberlism শীর্ষক রচনায় এবিষয়ে বলেছেন: “…this process in irreversible unlike realists however, liberal institutionalists behave that the decline of state autonomy is not necessarily regrettable, rather, they see transnationalism and inter dependence as phenomena which must be managed.”

আন্তর্জাতিক সম্পর্ক সংক্রান্ত উদারনীতিবাদী চিন্তাধারার শ্রেণীবিভাজন প্রসঙ্গে মতপার্থক্য পরিলক্ষিত হয়। আন্তর্জাতিক সম্পর্কবিজ্ঞানী জ্যাকসন (Robert Jackyon) ও জর্জ সোরেনসেন (George Sorensen) তাঁদের International Relations শীর্ষক গ্রন্থে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ক উদারনীতিবাদী চিন্তাধারাকে চারটি মূল ভাগে বিভক্ত করেছেন। যুদ্ধোত্তর কালে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক নিয়ে উদারনীতিবাদীদের চিন্তাভাবনা প্রধানত চারটি শ্রেণীতে বিভক্ত। উদারনীতিবাদের এই চারটি ধারা হল: 

  • (১) সমাজতাত্ত্বিক উদারনীতিবাদ (Sociological Liberalism), 

  • (২) পারস্পরিক নির্ভরশীলতার উদারনীতিবাদ (Interdependence Liberalism), 

  • (3) প্রাতিষ্ঠানিক উদানীতিবাদ (Institutional Liberalism) এবং 

  • (৪) সাধারণতান্ত্রিক উদারনীতিবাদ (Republican Liberalism)। 

আন্তর্জাতিক সম্পর্ক সম্পর্কিত সাম্প্রতিক উদারনীতিক ধ্যান ধারণার ব্যাপারে সম্যক পরিচয় পাওয়ার জন্য উপরিউক্ত চার ধরনের উদারনীতিক চিন্তাধারা সম্পর্কে আলোচনা করা আবশ্যক।

(১) সমাজতাত্ত্বিক উদারনীতিবাদ:

সমাজতাত্ত্বিক উদারনীতিবাদের মূল বক্তব্য হল আন্তর্জাতিক সম্পর্কের আলোচনা শুধুমাত্র বিভিন্ন জাতীয় সরকারের মধ্যেকার সম্পর্কের আলোচনার মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। অন্যান্য সম্পর্কের আলোচনাও আন্তর্জাতিক সম্পর্কের আওতায় আসে। এ ক্ষেত্রে অন্যান্য সম্পর্ক বলতে সাধারণ মানুষের, গোষ্ঠীসমূহের এবং বিভিন্ন সমাজের সম্পর্কের কথা বলা যায়। সরকারসমূহের মধ্যে সম্পর্কের থেকে জনসাধারণের মধ্যে সম্পর্ক অনেক বেশী সহযোগিতামূলক। বিশ্বব্যাপী ব্যাপক সংখ্যায় আন্তর্জাতিক সংযোগ সম্পর্কের বন্ধন-জাল গড়ে তোলা সম্ভব হলে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে শাস্তি অধিকতর সুদৃঢ় হবে। আন্তর্জাতিক সম্পর্কবিজ্ঞানী জ্যাকসন ও সোরেনসেন (Robert Jackson and George Sorensen) তাঁদের International Relations শীর্ষক গ্রন্থে মন্তব্য করেছেন: “Overlapping interdependent relations between people are bound to be more cooperative than relations between states because states are exclusive and, according to sociological liberalism, their interests do not overlap and cross-cut. A world with a large mumber of transnational networks will thus be more peaceful.”

বহুত্ববাদী দৃষ্টিভঙ্গি: আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বাস্তববাদী ব্যাখ্যাকারকরা কেবলমাত্র সার্বভৌম রাষ্ট্রের সরকারসমূহের সম্পর্কের আলোচনার উপর জোর দেন। সমাজতাত্ত্বিক উদারনীতিবাদীরা আন্তর্জাতিক সম্পর্কের আলোচনায় এই দৃষ্টিভঙ্গিকে বাতিল করে দেন। এই শ্রেণীর উদারনীতিক চিন্তাবিদদের অভিযোগ অনুযায়ী বাস্তববাদীদের দৃষ্টিভঙ্গি সংকীর্ণ এবং একপাক্ষিক। কেবলমাত্র রাষ্ট্রসমূহের সম্পর্ক বিষয়ক আলোচনাই আন্তর্জাতিক সম্পর্ক নয়। আন্তর্জাতিক সম্পর্কের আলোচনা জাতিরাষ্ট্রসমূহের সম্পর্কের আলোচনার সীমাকে ছাড়িয়ে যায়। আন্তর্জাতিক আলোচনার মধ্যে আসে বিভিন্ন দেশের জনগণের, গোষ্ঠীসমূহের এবং সংগঠন সমূহের সম্পর্কও। আন্তর্জাতিক সম্পর্কের আলোচনায় সমাজতাত্ত্বিক উদারনীতিকরা সমাজ ও রাষ্ট্রের উপর জোর দিয়েছেন, জোর দিয়েছেন বিভিন্ন ধরনের ক্রিয়াকারীর উপর, কেবলমাত্র জাতীয় সরকারের উপর নয়। এই কারণে অনেকে এই শ্রেণীর উদারনীতিকদের ‘বহুত্ববাদী’ (Pluralish) বলার পক্ষপাতী।

জাতীয় সীমারেখা অতিক্রমী সম্পর্ক: সমাজতাত্ত্বিক উদারনীতিবাদীদের অভিমত অনুযায়ী জাতীয় সীমারেখা অতিক্রমী সম্পর্কসমূহ (transnational relation) আন্তর্জাতিক সম্পর্কসমূহের ক্ষেত্রে ক্রমশ অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে। জাতি-অতিক্রমী সম্পর্কসমূহের উপর গুরুত্ব আরোপের ক্ষেত্রে সমাজতাত্ত্বিক উদারনীতিকরা সাবেকি উদারনীতিবাদের একটি বিষয়ের উপর জোর দেন। তাঁরা বলেন যে শান্তি প্রতিষ্ঠার প্রয়াসের ক্ষেত্রে জাতীয় সরকারসমূহের মধ্যে সম্পর্কের থেকে জনসাধারণের মধ্যে সম্পর্কসমূহ অধিকতর সমর্থন যোগ্য ও সহযোগিতামূলক। জাতি-অতিক্রমবাদ (Transnationalism)-এর ধারণা ব্যাখ্যা করতে গিয়ে সমাজবিজ্ঞানী জেমস রোজেনাউ (James Rosenau) তাঁর The Study of Global Interdependence শীর্ষক গ্রন্থে বলেছেন: “…the process where by international relations conducted by governments have been supplemented by relations among private individuals, groups and societies that can and do have important consequences for the coruse of events.”

কার্ল ডায়টস: বিংশ শতাব্দীর পঞ্চাশের দশকে বিশিষ্ট চিন্তাবিদ কার্ল ডয়েটস (Karl Deutsch) বহুজাতিক সম্পর্কসমূহ নিয়ে বিস্তারিতভাবে অধ্যয়ন অনুশীলন করেন। তিনি এবং তাঁর সহযোগী সমাজ বিজ্ঞানীরা বিভিন্ন সমাজের সংযোগ সম্পর্ক ও লেনদেন নিয়ে গভীরভাবে পর্যালোচনা করেন। কার্ল ডয়েটস-এর অভিমত অনুযায়ী বিভিন্ন সমাজের মধ্যে উচ্চ পর্যায়ের বহুজাতিক সংযোগ সম্পর্কের বিকাশ ও বিস্তার ঘটলে শান্তিপূর্ণ সম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত হবে। এর ফলে শুধু যে যুদ্ধের আশঙ্কা দূরীভূত হবে তা নয় স্থায়ী শান্তি সুরক্ষিত হবে। এর ফলে নিরাপত্তামূলক জনসম্প্রদায় (security community) গড়ে উঠবে। এ রকম জনসম্প্রদায় বলতে সুসংহত একটি জনগোষ্ঠীকে বোঝায় “…a group of people which has become integrated.” এক্ষেত্রে সংহতি বলতে যে, সংশ্লিষ্ট জনগোষ্ঠীর মধ্যে জনসম্প্রদায়ের একটি চেতনা (ta sense of community) জাগ্রত হয়েছে। অর্থাৎ এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট জনগণ সহমত পোষণ করে যে, তারা তাদের বিবাদ-বিসংবাদ এবং সমস্যাদির সমাধান স্বাভাবিকভাবেই করতে পারে, তার জন্য ব্যাপক আকারে শক্তি প্রয়োগের প্রয়োজন হয় না। এ ধরনের নিরাপত্তাযুক্ত জনসম্প্রদায় (seurity community) সৃষ্টির সহায়ক শর্তসমূহের একটি তালিকা তিনি তৈরী করেছেন। এ ক্ষেত্রে সহায়ক শর্তগুলি হল: বর্ধিত সামাজিক যোগাযোগ, ব্যক্তিবর্গের অধিকতর সচলতা, অধিকতর শক্তিশালী আর্থনীতিক বন্ধন এবং পারস্পরিক মানবিক লেনদেনের বৃহত্তর ক্ষেত্র। কার্ল ডয়েটসের মতানুসারে উত্তর আটলান্টিক অঞ্চলে পশ্চিমী দেশসমূহের মধ্যে এরকম নিরাপত্তাযুক্ত জনসম্প্রদায়ের অভ্যুত্থান ঘটেছে।

বহুজাতিক সম্পর্কসমূহ: সমাজতাত্ত্বিক উদারনীতিকদের মধ্যে অনেকে এই ধারণা পোষণ করেন যে, বিভিন্ন দেশের জনগণের মধ্যে বহুজাতিক সম্পর্কসমূহ (Transnational relations) নতুন ধরনের এক মানবসমাজ সৃষ্টিতে সাহায্য করে। এই নতুন ধরনের মানবসমাজ জাতিরাষ্ট্রসমূহের পাশাপাশি এবং এমনকি জাতিরাষ্ট্রসমূহের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতার সম্পর্ক সহও অবস্থান করতে পারে। সমাজবিজ্ঞানী জন বার্টন (John Berton) তাঁর World Society শীর্ষক গ্রন্থে বহুজাতিক সম্পর্কের এক ‘মাকড়সার জালের মডেল’ Cobweb model) তুলে ধরেছেন। এই মডেলের মাধ্যমে প্রতিপন্ন হয় যে, কোন একটি জাতিরাষ্ট্রের মধ্যে বিভিন্ন জনগোষ্ঠী বসবাস করে। এই সমস্ত জনগোষ্ঠীর মধ্যে বিবিধ প্রকারের বাহ্যিক বন্ধন থাকে। এই সমস্ত জনগোষ্ঠীর মধ্যে বিভিন্ন রকমের স্বার্থও থাকে। এ রকম গোষ্ঠীসমূহের উদাহরণ হিসাবে ধর্মীয় গোষ্ঠী, শ্রমিক গোষ্ঠী, ব্যবসায়িক গোষ্ঠী প্রভৃতির কথা বলা যায়। জ্যাকসন ও সোরেনসেন (Robert Jackson and Sorensen) তাদের International Relations শীর্ষক গ্রন্থে এ বিষয়ে বলেছেন: “Burton implies that the cobwel model points to a world driven more mutually beneficial cooperation than by antagonistic conflict. In this way the cobweb model builds on an earlier liberal idea about the beneficial effects of cross-cutting or overlapping group memberships.”

(২) পারস্পরিক নির্ভরশীলতার উদারনীতিবাদ:

আধুনিকীকরণ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে রাষ্ট্রসমূহের মধ্যে পারস্পরিক নির্ভরশীলতার পরিধি ও মান-মাত্রা বৃদ্ধিপায়। জটিল পারস্পরিক নির্ভরশীলতার পরিপ্রেক্ষিতে বহুজাতিক ক্রিয়াকারী (transnational actors)-দের ভূমিকার গুরুত্ব বৃদ্ধি পায়; সামরিক শক্তির গুরুত্ব হ্রাস পায়; এবং নিরাপত্তার পরিবর্তে কল্যাণ সাধন রাষ্ট্রসমূহের প্রাথমিক লক্ষ্য হয়ে দাঁড়ায়। জটিল পারস্পরিক নির্ভরশীলতার মাধ্যমে অধিকতর সহযোগিতামূলক আন্তর্জাতিক সম্পর্কের এক দুনিয়া বিশেষ তাৎপর্য লাভ করে।

পারস্পরিক নির্ভরশীলতা ও যুদ্ধমুক্ত দুনিয়া: এই শ্রেণীর উদারনীতিবাদীদের অভিমত অনুযায়ী উন্নত শ্রমবিভাজনের ভিত্তিতে আন্তর্জাতিক অর্থনীতি রাষ্ট্রসমূহের মধ্যে পারস্পরিক নির্ভরশীলতা বৃদ্ধি করে এবং উগ্র সংঘাত-সংঘর্ষ হ্রাস করে। এতদসত্ত্বেও ঝুঁকি থেকে যায়। কারণ আধুনিককালের রাষ্ট্রসমূহ পিছিয়ে গিয়ে পুনরায় সামরিক তৎপরতার রাস্তা ধরতে পারে এবং অস্ত্র প্রতিযোগিতা ও হিংসাত্মক সংঘাতের সামিল হতে পারে। তবে এ রকম আশঙ্কা খুব একটা স্বাভাবিক নয়। আন্তর্জাতিক সম্পর্কবিজ্ঞানী রিচার্ড রোজক্রান্স (Richard Rosecrance) এ বিষয়ে বিস্তারিতভাবে আলোচনা করেছেন। তাঁর বক্তব্য অনুসারে অধুনা অপেক্ষাকৃত অনুন্নত দেশসমূহে যুদ্ধ বাধতে দেখা যায়। কারণ আর্থনীতিক উন্নয়নের অপেক্ষাকৃত নিম্নস্তরে উৎপাদনের উপাদান হিসাবে ‘ভূমি’র ভূমিকার প্রাধান্য অব্যাহত থাকে এবং আধুনিকীকরণ ও পারস্পরিক নির্ভরশীলতা হীনবল অবস্থায় থাকে।

পারস্পরিক নির্ভরশীলতা এবং আধুনিকীকরণ ও শিল্পায়ন: বিভিন্ন দেশের মধ্যে বহুজাতিক সম্পর্ক বিকশিত ও বিস্তারিত হলে পারস্পরিক নির্ভরশীলতা স্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি পাবে। এই বহুজাতিক সম্পর্কের বিকাশ ও বিস্তার আধুনিকীকরণ প্রক্রিয়ার দ্যোতক। এই আধুনিকীকরণ প্রক্রিয়া আবার রাষ্ট্রসমূহের মধ্যে পারস্পরিক নির্ভরশীলতার মান ও মাত্রাকে বৃদ্ধি করে। জনসাধারণ ও সরকারসমূহ অন্যান্য দেশের ঘটনাবলীর দ্বারা প্রভাবিত হয়। ভিন দেশের মানুষ ও সরকারের ক্রিয়াকর্মকে উপেক্ষা করা যায় না। বিংশ শতাব্দীতে, বিশেষত বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধ্বে দুনিয়ার বিভিন্ন জায়গায় বহু সংখ্যক বিশেষভাবে শিল্পোন্নত দেশের অভ্যুত্থান ঘটেছে। এই ঘটনা রাষ্ট্রসমূহের নীতি নির্ধারণকে কার্যকরভাবে প্রভাবিত করেছে। এ বিষয়ে রিচার্ড রোজক্রান্স বিস্তারিতভাবে আলোচনা করেছেন। সুদীর্ঘকাল ধরে ইতিহাসের বিভিন্ন অধ্যায়ে সামরিক শক্তি ও রাজ্যক্ষেত্র বিস্তারের মাধ্যমে রাষ্ট্রসমূহ অধিকতর শক্তি অর্জনের চেষ্টা করেছে। কিন্তু অতিমাত্রায় শিল্পোন্নত দেশের ক্ষেত্রে প্রগতি ও প্রাধান্য কায়েম করার উপায় হিসাবে আর্থনীতিক উন্নয়ন ও বৈদেশিক বাণিজ্যের উপর অধিক গুরুত্ব আরোপ করা হয়। এই উপায়-পদ্ধতি অধিকতর প্রাসঙ্গিক, পর্যাপ্ত এবং কম ব্যয়সাধ্য। সাম্প্রতিককালে সামরিক শক্তি প্রয়োগের ব্যয় বিশেষভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে, কিন্তু এর থেকে সুবিধা লাভের বিষয়টি হ্রাস পেয়েছে। আগেকার দিনে রাজ্যক্ষেত্রের এলাকার বিস্তৃতি এবং প্রাকৃতিক সম্পদের প্রাচুর্য রাষ্ট্রের প্রাধান্য-প্রতিপত্তির মানদণ্ড হিসাবে পরিগণিত হত। বর্তমান বিশ্বে সংশ্লিষ্ট পরিস্থিতির পরিবর্তন ঘটেছে। সাম্প্রতিককালে মহান রাষ্ট্রে পরিণত হওয়ার চাবিকাঠি হিসাবে উচ্চ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত শ্রমশক্তি, বিত্ত ও মূলধনের প্রাচুর্য, উন্নত প্রযুক্তি প্রকৌশল,তথ্যাদির সহজলভ্যতা প্রভৃতির কথা বলা হয়। বস্তুত আর্থনীতিক ভিত্তি ও প্রকৃতির পরিবর্তন ঘটেছে। এবং এই পরিবর্তনটি আধুনিকীকরণের সঙ্গে সম্পর্কিত।

উদাহরণ সহযোগে ব্যাখ্যা: আন্তর্জাতিক সম্পর্কবিজ্ঞানী রিচার্ড রোজক্রান্স (R. Rosecrance) বিষয়টি উদাহরণ সহযোগে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করেছেন। তাঁর অভিমত অনুযায়ী ঠাণ্ডা যুদ্ধ (coldwar)-এর অবসানের পর চিরাচরিত সামরিক শক্তির গুরুত্ব, তাৎপর্য ও প্রয়োজনীয়তা বহুলাংশে অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়েছে। তারফলে বাণিজ্যিক রাষ্ট্রে পরিণত হওয়ার প্রবণতা রাষ্ট্রসমূহের মধ্যে, বিশেষত বৃহৎ রাষ্ট্রসমূহের মধ্যে বৃদ্ধি পেয়েছে। সুদীর্ঘকাল ধরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং পূর্বতন সোভিয়েত ইউনিয়নের মত বৃহৎ রাষ্ট্রসমূহ চিরাচরিত সামরিক-রাজনীতিক পথে হেঁটেছে। তারফলে এই সমস্ত রাষ্ট্র ব্যাপক সামরিক ব্যয়ভারে ভারাক্রান্ত হয়ে পড়েছে। সাম্প্রতিককালে এই সমস্ত রাষ্ট্র তাদের সাবেকি নীতির পরিবর্তন সাধন করেছে। যুদ্ধোত্তর কালে আর্থনীতিক ক্ষেত্রে পৃথিবীর সর্বাধিক সফল দেশ বলতে জাপান ও জার্মানীকে বোঝায়। এই দুটি দেশ সাবেকি সামরিক রাজনীতির পথকে পরিহার করেছে। সামরিক খাতে তাদের ব্যয় হ্রাস পেয়েছে। আর্থনীতিক ক্ষেত্রে তারা সাবলম্বী হয়েছে। ব্যাপকতর আন্তর্জাতিক শ্রমবিভাগ এবং অধিকতর পারস্পরিক নির্ভরশীলতার যুগে এই সমস্ত রাষ্ট্র ব্যবসা-বাণিজ্যের বিকাশ ও বিস্তারে আত্মনিয়োগ করেছে।

ডেভিড মিত্রানির সংহতির ক্রিয়ামূলক মতবাদ: পারস্পরিক নির্ভরশীলতার উদারনীতিবাদের প্রবক্তাদের মতানুসারে আর্থনীতিক ক্ষেত্রে পারস্পরিক নির্ভরশীলতার সুবাদে রাজনীতিক সংহতির সৃষ্টি হবে এবং শান্তি প্রতিষ্ঠার প্রক্রিয়া সুসংহত হবে। এ প্রসঙ্গে ডেভিড মিত্রানি (David Mitrany)-র সংহতির ক্রিয়ামূলক মতবাদ (Functionalist theory of integration) বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধোত্তরকালে উদারনীতিক আন্তর্জাতিক সম্পর্কবিজ্ঞানী ডেভিড মিত্রানি তাঁর A Working Peace System শীর্ষক গ্রন্থে এ বিষয়ে বিস্তারিতভাবে আলোচনা করেছেন। তাঁর অভিমত অনুযায়ী বহুজাতিক সম্পর্কসমূহের মাধ্যমে বিভিন্ন দেশের মধ্যে অধিকতর পারস্পরিক নির্ভরশীলতা শান্তি প্রতিষ্ঠার পথকে প্রশস্ত করবে। সহজ‌ সরলভাবেই এই উদারনীতিবিদ বলেছেন যে, বিশেষজ্ঞ প্রযুক্তিবিদরাই সহযোগিতার উপায়-পদ্ধতির ব্যবস্থা করবেন। এ বিষয়ে রাজনীতিবিদদের ভূমিকা থাকবে না। ক্রিয়াকর্মের বিভিন্ন ক্ষেত্রে রাজনীতিবিদদের বদলে‌ বিশেষজ্ঞ প্রয়োগবিরাই সাধারণ সমস্যাসমূহের সমাধান নির্দেশ করবেন। ক্রিয়ামূলক সহযোগিতার বিভিন্ন ক্ষেত্রগুলি হল পরিবহন, যোগাযোগ, মূলধন প্রভৃতি। পারস্পরিক সুফল প্রাপ্তির সুযোগ-সম্ভাবনা সম্পর্কে সচেতনা থেকে প্রযুক্তি ও আর্থনীতিক ক্ষেত্রে পারস্পরিক সহযোগিতার ক্ষেত্র সম্প্রসারিত হবে। আন্তর্জাতিক সংগঠন সমূহের ভিতরে কার্যকর সহযোগিতার সুবাদে সৃষ্ট জনকল্যাণমূলক উন্নয়ন সম্পর্কে নাগরিকগণ সম্যকভাবে অবহিত হলে, তাদের আনুগত্য রাষ্ট্রের পরিবর্তে আন্তর্জাতিক সংগঠন সমূহের দিকে যাবে।

হাস-এর নয়া ক্রিয়ামূলক মতবাদ: আন্তর্জাতিক সংহতির ক্ষেত্রে ডেভিড মিত্রানির ক্রিয়ামূলক মতবাদের পরে নয়া ক্রিয়ামূলক মতবাদ (neofunctionalist theory)-এর সৃষ্টি হয়। এই তথাকথিত নয়াক্রিয়ামূলক মতবাদের প্রবক্তা হিসাবে আন্তর্জাতিক সম্পর্কবিজ্ঞানী হাস (Ernst Haas)-এর নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এ বিষয়ে হাস প্রেরণা পেয়েছেন পশ্চিম ইউরোপের দেশগুলির মধ্যে গভীর সহযোগিতার ঘটনা থেকে। বিগত বিংশ শতাব্দীর পঞ্চাশের দশকের গোড়ার দিকে এই সহযোগিতার ঘটনা ঘটে। হাস প্রযুক্তিগত বিষয় ও রাজনীতিক বিষয়ের পৃথকীকরণ সম্পর্কিত ডেভিড মিত্রানির মতবাদকে স্বীকার বা সমর্থন করেনি। তাঁর অভিমত অনুযায়ী আন্তর্জাতিক সংহতি হল একটি প্রক্রিয়া। এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে রাজনীতিক ক্রিয়াকারীরা তাদের আনুগত্যকে একটি নতুন কেন্দ্রের দিকে স্থানান্তরিত করতে চায়। এই নতুন কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠানসমূহ আগে থেকে বিদ্যমান জাতীয় রাষ্ট্রসমূহের উপর এক্তিয়ার দাবি করে বা এই এক্তিয়ার তাদের থাকে। হাস (E. B. Hass) তাঁর The Uniting Europe: Political, Social and Economic Forces শীর্ষক গ্রন্থে এ বিষয়ে বিস্তারিতভাবে আলোচনা করেছেন।

আন্তর্জাতিক সহযোগিতার তাত্ত্বিক আলোচনায় বিংশ শতাব্দীর সত্তরের দশকের শেষের দিকে আর একটি সাধারণ তত্ত্বের আবির্ভাব ঘটে। এই সাধারণ মতবাদটি ‘জটিল পারস্পরিক নির্ভরশীলতা’ (complex interdependence) নামে পরিচিত। এই মতবাদটির পরিচয় পাওয়া যায় রবার্ট কেওহন ও যোসেফ নাই (Robert Keohane and Joseph Nye) কর্তৃক প্রণীত Power and Interdependence শীর্ষক গ্রন্থে। আন্তর্জাতিক সহযোগিতা সম্পর্কিত এই মতবাদটি অতিমাত্রায় আশাবাদী। আগেকার সরল প্রকৃতির পারস্পরিক নির্ভরশীলতার থেকে যুদ্ধোত্তর এই জটিল পারস্পরিক নির্ভরশীলতা গুণগত বিচারে পৃথক।

জটিল পারস্পরিক নির্ভরশীলতা: আগেকার দিনে রাষ্ট্রনেতাদের পররাষ্ট্রের নেতাদের সঙ্গে সংযোগ সম্পর্ক ও আলোচনার মাধ্যমে আন্তর্জাতিক সম্পর্কসমূহ নির্ধারিত ও পরিচালিত হত। সে সময় বিভিন্ন রাষ্ট্রের জাতীয় নেতৃবর্গের মধ্যে বিবাদ-বিসংবাদের ক্ষেত্রে সামরিক তৎপরতার সাহায্য নেওয়ার বিষয়টি ছিল জলভাত। আগেকার দিনে আর্থনীতিক ও সামাজিক বিষয়াদি সম্পর্কিত অধস্তন রাজনীতি (low politics)-র উপর প্রধান্য পেত নিরাপত্তা ও অস্তিত্ব সম্পর্কিত উর্ধ্বতন রাজনীতি (high politics)। জটিল পারস্পরিক নির্ভরশীলতার অবস্থায় সাবেকি পরিস্থিতির পরিবর্তন ঘটেছে। এই পরিবর্তনের পিছনে কারণ আছে। জটিল পারস্পরিক নির্ভরশীল অবস্থায় সামরিক শক্তিকে পররাষ্ট্রনীতির অপেক্ষাকৃত কম প্রয়োজনীয় হাতিয়ার হিসাবে গণ্য করা হয়। আজকাল রাষ্ট্রসমূহের মধ্যে সম্পর্ক বলতে কেবলমাত্র রাষ্ট্রনেতাদের মধ্যে সম্পর্ককে বোঝায় না। আন্তরাষ্ট্রীয় সম্পর্কের মধ্যে থাকে বিভিন্ন স্তরের বিভিন্ন ক্রিয়াকারীর মাধ্যমে এবং সরকারের বিভিন্ন অংশের সম্পর্ক। তাছাড়া রাষ্ট্রীয় এক্তিয়ারের বাইরে আছে ব্যক্তিবর্গ এবং গোষ্ঠীসমূহের মধ্যে অসংখ্য ধরনের বহুজাতিক সম্পর্কসমূহ (transnational relations)। স্বভাবতই বর্তমান আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ও পররাষ্ট্রনীতি অনেকাংশে স্বরাষ্ট্রনীতির মত হয়ে দাঁড়িয়েছে। জটিল পারস্পরিক নির্ভরশীলতার পরিপ্রেক্ষিতে রাষ্ট্রসমূহ জনকল্যাণ সম্পর্কিত অধস্তন রাজনীতি (low politics)-র উপর অধিক গুরুত্ব আরোপ করে; জাতীয় নিরাপত্তা সম্পর্কিত ঊর্ধ্বতন রাজনীতি (high politics)-র উপর খুব বেশী গুরুত্ব আরোপ করে না। প্রকৃত প্রস্তাবে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে জটিল পারস্পরিক নির্ভরশীলতা বলতে স্পষ্টত যা বোঝায় তা হল রাষ্ট্রসমূহের মধ্যে অধিকতর বন্ধুত্বপূর্ণ ও সহযোগিতামূলক সম্পর্ক।

পারস্পরিক নির্ভরশীলতার উদারনীতিবাদ সম্পর্কিত স্ন্যাকসন ও সোরেনসেন (Robert Jackson and George Sorensen)-এর মন্তব্য প্রণিধানযোগ্য। এই দুই অধ্যাপক তাঁদের International Redations শীর্ষক গ্রন্থে বলেছেন: “Interdependence liberals are the more balanced in their approach than some other liberals for whom everything has changed for the better and the old world of violent conflict, unbridled state power, and the dictatorship of the national interest is gone forever. However, in adopting this middle-of-the-road position interdependence liberals face the problem of deciding exactly how much has changed, how much remains the same, and what the precise implications are for IR.”

(৩) প্রাতিষ্ঠানিক উদারনীতিবাদ:

প্রাতিষ্ঠানিক উদারনীতিবাদী বক্তব্য অনুযায়ী আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানসমূহ বিভিন্ন রাষ্ট্রের মধ্যে সহযোগিতার সম্পর্ক গড়ে তুলতে সাহায্য করে। এইভাবে আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান রাষ্ট্রসমূহের মধ্যে অবিশ্বাসের আবহাওয়া দূর করতে সাহায্য করে। আবার রাষ্ট্রসমূহের পারস্পরিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে ভয়ভীতির আশঙ্কা-আতঙ্ক থাকে। এ ধরনের আশঙ্কা-আতঙ্ক আন্তর্জাতিক নৈরাজ্যবাদের সঙ্গে সংযুক্ত সাবেকি সমস্যা হিসাবে পরিগণিত হয়। আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানসমূহ এ রকম আশঙ্কা-আতঙ্ক দূরীকরণের ব্যাপারেও সাহায্য করে। তবে রাষ্ট্রসমূহের মধ্যে সহযোগিতা সৃষ্টির ব্যাপারে আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানসমূহের সার্থক ভূমিকাকে বাস্তববাদীরা স্বীকার করেন না। এ বিষয়ে তাঁরা বিবিধ প্রশ্ন উত্থাপন করেন।

আন্তর্জাতিক সংগঠন রাষ্ট্রসমূহের মধ্যে সহযোগিতা সৃষ্টি করে:

প্রাতিষ্ঠানিক উদারনীতিবাদে আন্তর্জাতিক সংগঠনসমূহের বিবিধ সুফলের উপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করা হয়। এই শ্রেণীর উদারনীতিকরা দাবি করেন যে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংগঠন রাষ্ট্রসমূহের মধ্যে সহযোগিতার সম্পর্ক গড়ে তোলার ব্যাপারে সাহায্য-সহযোগিতা করে। আন্তর্জাতিক সংগঠনের এই সদর্থক ভূমিকা পর্যালোচনার ক্ষেত্রে এই শ্রেণীর উদারনীতিবাদীরা আচরণবাদী ও বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করেন। রাষ্ট্রসমূহের মধ্যে প্রাতিষ্ঠানিকীকরণের পরিসর পরিমাপের ব্যাপারে একটি অভিজ্ঞতাবাদী উপায় অবলম্বন করা হয়। আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানগুলি আন্তঃরাষ্ট্রীয় সহযোগিতাকে সম্প্রসারিত করার ব্যাপারে কতখানি ইতিবাচক ভূমিকা পালন করেছে তা এইভাবে মূল্যায়ন করা যায়।

আন্তর্জাতিক সংগঠনের সদর্থক ভূমিকা:

আন্তর্জাতিক সংগঠনসমূহের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক সম্পর্ককে অব্যবস্থা ও বিশৃঙ্খল অবস্থা থেকে নিয়ন্ত্রিত ও শান্তিপূর্ণ মিথষ্ক্রিয়ার অবস্থায় পরিণত করা যায়। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংগঠন গড়ে তুলতে পারলে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের প্রকৃতিগত রূপান্তর সাধন সম্ভব। এ রকম আন্তর্জাতিক সংগঠনের উদাহরণ হিসাবে তৎকালীন জাতিসঙ্ঘের (League of Nations) কথা বলা হয়েছে। তবে আধুনিক কালের প্রাতিষ্ঠানিক উদারনীতিবাদীরা তাঁদের আদর্শবাদী পূর্বসূরীদের মত অতটা আশাবাদী নন। এঁদের অভিমত অনুযায়ী আন্তর্জাতিক সংগঠনসমূহ রাষ্ট্রসমূহের মধ্যে সহযোগিতাকে অপেক্ষাকৃত সহজ করে তুলতে পারে; এই সম্ভাবনাকে অস্বীকার করা যায় না। কিন্তু এ কথা বলা যায় না যে, এই সমস্ত আন্তর্জাতিক সংগঠন নিজেরাই স্বয়ংসম্পূর্ণভাবে এবং সুনিশ্চিতভাবে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের গুণমানগত চেহারা-চরিত্র বদলে দিতে পারে। তবে এই শ্রেণীর উদারনীতিবাদীরা বাস্তববাদী চিন্তাবিদদের মত একথাও স্বীকার বা সমর্থন করেন না যে আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানগুলি হল অর্থহীন অকার্যকর বিষয় বা শক্তিধর রাষ্ট্রসমূহের হাতের পুতুলমাত্র। প্রাতিষ্ঠানিক উদারনীতিবাদীদের মতানুসারে আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানসমূহের স্বাধীন ও স্বতন্ত্র গুরুত্ব আছে। এই সমস্ত প্রতিষ্ঠান রাষ্ট্রসমূহের মধ্যে সহযোগিতার সম্পর্ক গড়ে তুলতে পারে।

আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের ধারণা:

প্রাতিষ্ঠানিক উদারনীতিবাদীদের অভিমত অনুযায়ী আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান বলতে আন্তর্জাতিক সংগঠনকে বোঝায়। উদাহরণ হিসাবে ন্যাটো (NATO-North Atlantic Treaty Organisation), ইউরোপীয় ইউনিয়ন (European Union) প্রভৃতির কথা বলা হয়। আবার নির্দিষ্ট একটি এলাকায় রাষ্ট্রীয় ক্রিয়াকর্ম নিয়ন্ত্রণকারী নিয়মকানুনকেও আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান হিসাবে চিহ্নিত করা হয়। এ ক্ষেত্রে উদাহরণ হিসাবে জাহাজ চলাচল সম্পর্কিত বিধিব্যবস্থার কথা বলা যায়। সংশ্লিষ্ট বিধি ব্যবস্থা সংযুক্তভাবে ‘শাসন’ (regime) হিসাবে পরিচিতি পায়। তবে এই ‘শাসন’ (regime) এবং ‘সংগঠন’ (organisation) সাধারণত একই সঙ্গে চলে থাকে। এ ক্ষেত্রে উদাহরণ হিসাবে বলা হয়েছে যে, ব্যবসা বাণিজ্যের শাসন’ (trade regime) নির্ধারিত ও পরিচালিত হয় ‘বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা (WTO – World Trade Organigsation)-র দ্বারা। তবে আনুষ্ঠানিক সাংগঠনিক ব্যবস্থা ছাড়াও ‘শাসন’ (regime) থাকতে পারে। এ ক্ষেত্রে উদাহরণ হিসাবে বলা যায় যে, সম্মিলিত জাতিপুঞ্জের (UNO – United Nations Organization) তত্ত্বাবধানে আয়োজিত ‘সমুদ্র সম্মেলন’ (Sea conferences) সমূহের আইনকানুনের আনুষ্ঠানিক কোন আন্তর্জাতিক সংগঠন নেই।

প্রাতিষ্ঠানিক উদারনীতিবাদীদের যুক্তি অনুযায়ী উচ্চমানের প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ উল্লেখযোগ্যভাবে বহুকেন্দ্রিক নৈরাজ্যবাদের ক্ষতিকর প্রভাব-প্রতিক্রিয়াকে উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস করে। রাষ্ট্রসমূহের মধ্যে অবিশ্বাসের আবহাওয়া আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে অতিমাত্রায় ক্ষতিকর এক্তিয়ার সৃষ্টি করে। আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানসমূহ এই অবিশ্বাসের আবহাওয়াকে অপসারিত করতে সাহায্য করে। এই সমস্ত প্রতিষ্ঠান সদস্যরাষ্ট্রসমূহকে অবিরত অসংখ্য তথ্য- সংবাদ সরবরাহ করে। তারফলে অন্যান্য রাষ্ট্রসমূহ বিভিন্ন বিষয়ে বা ক্ষেত্রে কি করছে না করছে সে বিষয়ে সদস্যরাষ্ট্রসমূহের অজানার অন্ধকার দূর হয় এবং অবিশ্বাস ও আশংঙ্কার কালো মেঘ কেটে যায়। পররাষ্ট্রের ব্যাপারে ভয়ভ্রান্তি এইভাবে অনেকাংশ অপসারিত হয়। অধ্যাপক জ্যাকসন ও সোরেনসেন বিষয়টিকে উদাহরণ সহযোগে উপস্থাপিত করেছেন। আপস-মীমাংসা ও বিরোধ দূরীকরণের ব্যাপারে ইউরোপীয় ইউনিয়নের বহু ও বিভিন্ন এবং অভিজ্ঞ ও ব্যাপক ব্যবস্থা বর্তমান। সংশ্লিষ্ট উপায়-পদ্ধতির মধ্যে ইউরোপীয় কমিশন, ইউরোপীয় সংসদ, মন্ত্রিপরিষদ প্রভৃতিও থাকে। এই সমস্ত ব্যবস্থার মাধ্যমে পারস্পরিক সুবিধার জন্য সহযোগিতার সুযোগ-সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়। তারফলে রাষ্ট্রসমূহের মধ্যে সম্পর্কের স্থায়িত্ব ও ধারাবাহিকতার সৃষ্টি হয়। আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানসমূহ এমন এক পরিমণ্ডলের সৃষ্টিতে সাহায্য করে, যার ফলে স্থায়ী শান্তির সহায়ক অবস্থার সৃষ্টি হয়। ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্যরাষ্ট্রসমূহ তাদের পারস্পরিক অঙ্গীকার রক্ষার ব্যাপারে দায়বদ্ধ থাকে।

(৪) সাধারণতান্ত্রিক উদারনীতিবাদ:

সাধারণতান্ত্রিক উদারনীতিবাদীদের অভিমত অনুযায়ী গণতান্ত্রিক রাজনীতিক ব্যবস্থাসমূহ পরস্পরের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে। কারণ হিসাবে কতগুলি বিষয়ের কথা বলা হয়। এই বিষয়গুলি হল শান্তিপূর্ণ পথে বিবাদ-বিসংবাদের মীমাংসার অভ্যন্তরীণ নীতি, তাদের সাধারণ নৈতিক মূল্যবোধ; এবং আর্থনীতিক সহযোগিতা ও পারস্পরিক নির্ভরশীলতার সুবাদে তাদের পারস্পরিক সুযোগ-সুবিধার বন্ধন। এই সমস্ত কিছুর ভিত্তিতে গণতান্ত্রিক রাজনীতিক ব্যবস্থাসমূহের মধ্যে শান্তিপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে ওঠে। স্বভাবতই শান্তিপূর্ণ পৃথিবীর বাসনাকে বাস্তবায়িত করার জন্য সুসংহত উদারনীতিক গণতান্ত্রিক রাজনীতিক ব্যবস্থাসমূহের বিকাশ ও বিস্তার বাঞ্ছনীয়।

গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা এবং শান্তি ও সহযোগিতা-পূর্ণ আন্তর্জাতিক সম্পর্ক: সাধারণতান্ত্রিক উদারতিবাদীদের মতানুসারে অন্যান্য রাজনীতিক ব্যবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে উদারনীতিক গণতন্ত্রসমূহ অধিকতর আইনানুগামী এবং শান্তিপূর্ণ। গণতান্ত্রিক রাজনীতিক ব্যবস্থাসমূহ পরস্পরের বিরুদ্ধে সংঘাত সংঘর্ষের সামিল হয় না। অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষের দিকে প্রজাতান্ত্রিক রাষ্ট্রসমূহ প্রসঙ্গে জার্মান দার্শনিক কান্ট (Immanuel Kant) তাঁর Perpetual Piece শীর্ষক রচনায় প্রথম এ ধরনের মন্তব্য করেছেন। পরবর্তীকালে এ বিষয়ে অধিকতর উন্নত মানের চর্চাও আলোচনা হয়েছে। দীর্ঘমেয়াদী বিশ্বশান্তির সম্ভাবনাকে সফল করার ব্যাপারে নীতিনির্ধারক ও পণ্ডিতদের ভাবনা-চিন্তা উপরিউক্ত মূল ধারণার উপর প্রতিষ্ঠিত। বর্তমান বিশ্বে সাম্প্রতিক বছরগুলিতে গণতান্ত্রিক-ব্যবস্থার অনুগামী দেশসমূহের সংখ্যা দ্রুত গতিতে বৃদ্ধি পেয়েছে। স্বভাবতই অধিকতর শান্তিপূর্ণ পৃথিবী গড়ে উঠার সম্ভাবনা বৃদ্ধি পেয়েছে। এই পৃথিবীতে সংঘাত-সংঘর্ষের পরিবর্তে পারস্পরিক সহযোগিতাপূর্ণ আন্তর্জাতিক সম্পর্কের সৃষ্টি হবে।

সাধারণতান্ত্রিক উদারনীতিবাদ বিশেষভাবে নীতিমানমূলক উপাদান সমৃদ্ধ। এই শ্রেণীর উদারনাতিবাদীদের অধিকাংশই দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করেন যে, ইতিমধ্যে বিশ্বরাজনীতির অনেকখানি সদর্থক বিকাশ ঘটেছে এবং ভবিষ্যতে আরও বিকাশ ঘটবে। স্বাধীন রাষ্ট্রসমূহের মধ্যে শত্রুতা, সংঘাত এবং যুদ্ধ থাকবে না। সাধারণতান্ত্রিক উদারনীতিকরা এ বিষয়ে আশাবাদী যে, আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে শান্তি ও সহযোগিতা বিরাজ করবে। প্রগতির ভিত্তিতে অধিকতর গণতান্ত্রিক দুনিয়া গড়ে উঠবে। এই শ্রেণীর উদারনীতিকরা মনে করেন যে, বিশ্বব্যাপী গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে বিকশিত করার ব্যাপারে তাঁদেরও দায়িত্ব আছে। এই দায়িত্ব পালনের মাধ্যমে তাঁরা শান্তি প্রতিষ্ঠার পথ প্রশস্ত করতে পারবেন। বিভিন্ন রাজনীতিক মূল্যবোধের মধ্যে শান্তি হল মৌলিক প্রকৃতির।

উদারনীতিক গণতন্ত্রসমূহের মধ্যে শান্তি কায়েম হয়। এর পিছনে তিনটি উপাদান বা বিষয় বর্তমান।

[1] বিবাদ বিসংবাদের শান্তিপূর্ণ মীমাংসার ব্যাপারে গণতান্ত্রিক নিয়ম-নীতি: অন্তরাষ্ট্রীয় ক্ষেত্রে সংঘাত-সংঘর্ষের শান্তিপূর্ণ সমাধানের উপর ভিত্তিশীল রাজনীতিক সংস্কৃতির অস্তিত্ব এ ক্ষেত্রে বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। উদারনীতিক গণতান্ত্রিক রাজনীতিক ব্যবস্থায় শান্তিপূর্ণ আন্তর্জাতিক সম্পর্ককে সমর্থন ও উৎসাহিত করা হয়। কারণ নাগরিকরাই গণতান্ত্রিক সরকারকে নিয়ন্ত্রণ করে। নাগরিকরা অন্য গণতান্ত্রিক সরকারের সঙ্গে সংঘাত বা যুদ্ধকে সমর্থন করতে পারে না।

[2] সাধারণ নৈতিক ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রসমূহের মধ্যে শান্তিপূর্ণ সম্পর্ক: উদারনীতিক গণতন্ত্রসমূহ সাধারণ নৈতিক মূল্যবোধযুক্ত। এই মূল্যবোধ কান্টের কথায় ‘প্রশান্ত মিলন’ (Pacific Union)-এর ভিত্তিভূমি প্রস্তুত করে। এই মিলন বা সংযোগ কোন আনুষ্ঠানিক শান্তিচুক্তি নয়। এ হল শান্তির একটি এলাকা। সংশ্লিষ্ট সকল গণতান্ত্রিক দেশের সাধারণ নৈতিক বনিয়াদের উপর এই শান্তির এলাকা গড়ে উঠে। স্বরাষ্ট্রীয় সংঘাত-সংঘর্ষের শান্তিপূর্ণ পথে মীমাংসাকে উগ্র আচরণের থেকে নৈতিক বিচারে অধিকতর উন্নত মনে করা হয়। এই মানসিকতাকে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রসমূহের মধ্যে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে কার্যকর করা হয়। মতামত প্রকাশের স্বাধীনতা এবং স্বাধীন সংযোগ সম্পর্কের ভিত্তিতে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে পারস্পরিক সমঝোতার সৃষ্টি হয়। এ রকম পরিস্থিতি পরিমণ্ডলে নাগরিকদের মতামত অনুযায়ী রাজনীতিক প্রতিনিধিরা আচরণ করেন।

[3] গণতান্ত্রিক দেশগুলির মধ্যে আর্থনীতিক সহযোগিতা এবং পারস্পরিক নির্ভরশীলতার বন্ধন: আর্থনীতিক সহযোগিতা ও পারস্পরিক নির্ভরশীলতার মাধ্যমে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রসমূহের মধ্যে শান্তিপূর্ণ সম্পর্ক সুদৃঢ় হয়। আন্তর্জাতিক অর্থনীতিক সহযোগিতা ও লেনদেনের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রসমূহ পারস্পরিক লাভ পেয়ে থাকে। প্রশান্ত মিলন’ (Pacific Union)-এর মাধ্যমে ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে উৎসাহ-উদ্দীপনা (spirit of commerce)-র সৃষ্টি হয়।

সাধারণতান্ত্রিক উদারনীতিবিদদের অধিকাংশই এই অভিমুখ পোষণ করেন যে, গণতান্ত্রিক শান্তি হল একটি গতিশীল প্রক্রিয়া; স্থায়ী কোন অবস্থা নয়। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রসমূহের মধ্যে ‘প্রশান্ত মিলন’ (Pacific Union) সংঘটিত হয় দীর্ঘকালীন প্রক্রিয়ায় এবং উপরিউক্ত তিনটি ভিত্তিভূমির উপর ন্যূনতম গণতান্ত্রিক শর্তসমূহ পূরণ সাপেক্ষে কতকগুলি দেশ সংযুক্ত হলেই ‘প্রশান্ত মিলন’ গড়ে উঠে না। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রসমূহের উন্নতিতে বাধা আসতে পারে। গণতান্ত্রিক দেশগুলি অগণতান্ত্রিক বিধি-ব্যবস্থায় সরে আসতে পারে। তবে সাধারণতান্ত্রিক উদারনীতিবিদরা স্পষ্ট করে পথটি নির্দেশ করে দিয়েছেন, যে পথে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রসমূহ ‘প্রশান্ত মিলন’-এ উপনীত হতে পারবে। কতকগুলি গণতান্ত্রিক দেশের মধ্যে কখন এবং কেন গণতান্ত্রিক শান্তির সৃষ্টি হয়, তাও সাধারণতান্ত্রিক উদারনীতিকরা সংক্ষেপে ও সুস্পষ্টভাবে বিবৃত করেছেন।

উদারনীতিবাদের সমালোচনা

আন্তর্জাতিক সম্পর্ক সম্পর্কিত উদারনীতিক বক্তব্য বিরুদ্ধবাদীদের দ্বারা সমালোচিত হয়েছে। সমালোচকরা আন্তর্জাতিক সম্পর্কের উদারনীতিক আলোচনার বিরুদ্ধে বিবিধ যুক্তির অবতারণা করেন। এই সমস্ত যুক্তির মধ্যে কতকগুলি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।

[1] বক্তব্যের বিভিন্নতা ও সামঞ্জস্যহীনতা: আন্তর্জাতিক সম্পর্ক সম্পর্কে উদারনীতিবাদের বক্তব্য একমুখী বা একরকম নয়। বিভিন্ন পরিস্থিতির সমর্থনে উদারনীতিবাদীরা বিবিধ যুক্তির অবতারণা করেছেন। এই সমস্ত যুক্তি বা বক্তব্যের মধ্যে পরস্পর বিরোধিতাও আছে। পূর্বতন যুগোশ্লাভিয়ার যুদ্ধে হস্তক্ষেপের প্রয়োজনীয়তাকে অনুজ্ঞামূলক বলে সমর্থন করেছেন উদারনীতিক আন্তর্জাতিকতাবাদী (liberal internationalists)-রা। এক্ষেত্রে মিখায়েল ইগনাটিয়েফ (Michael Ignatieff)-এর নাম উল্লেখযোগ্য। এই শ্রেণীর উদারনীতিবাদীরা বিশ্বজনীন উদারনীতিক নিয়ম-নীতির কথা বলেন, সকল মানুষের সমমূল্যের কথা বলেন। অপরদিকে অন্যান্য উদারনীতিকদের অভিমত হল যে, নিজের রাষ্ট্রের নাগরিকদের প্রতি কর্তব্যের তুলনায় সমগ্র মানবজাতির প্রতি দায়বদ্ধতা কম তাৎপর্যপূর্ণ। সুতরাং ক্ষেত্রবিশেষে উদারনীতিকরা হস্তক্ষেপকে সমর্থন করেন, ক্ষেত্রবিশেষে করেন না। আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ে উদারনীতিকদের এ ধরনের অবস্থানকে সমর্থন করা যায় না। আন্তর্জাতিক সম্পর্কবিজ্ঞানী হফম্যান (S. Hoffmann)-এর অভিমত অনুযায়ী অধঃপতিত রাষ্ট্রসমূহের কাছে সার্বভৌমত্ব, গণতন্ত্র, জাতীয় আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার এবং মানবাধিকার—এই চারটি নীতি বিবদমান হিসাবে প্রতিপন্ন হয়। এই অবস্থায় উদারনীতিবাদী বক্তব্যসমূহ অবিন্যস্ত হয়ে পড়ে।

[2] যুক্তি ও বিজ্ঞান সংহতি সৃষ্টি করেনি: আন্তর্জাতিক বিষয়ে উদারনীতিক অবস্থানে সংকটের সৃষ্টি হয়েছে আর একটি কারণে। বিশ্বের আলোকিতকরণ সম্পর্কিত যে দৃষ্টিভঙ্গি ক্রমান্বয়ে অসমর্থিত ও বাতিল হয়ে যাচ্ছে, তার সঙ্গে উদারনীতিবাদ সম্পর্কযুক্ত। রাজনীতিক ক্ষেত্রে যুক্তি ও বিজ্ঞানের প্রয়োগ। জনগোষ্ঠীগুলিকে ঐক্যবদ্ধ বা সুসংহত করেননি। এ ক্ষেত্রে উদারনীতিক আন্তর্জাতিকতাবাদীদের আশা বাস্তবায়িত হয়নি। রাজনীতিক জনগোষ্ঠীগুলির বিচ্ছিন্নতামূলক প্রকৃতি স্পষ্টত প্রতিপন্ন হয়। জাতিসত্তা, ভাষা ও ধর্মীয় পাথকের ক্ষেত্রে এই বিচ্ছিন্নতার প্রকাশ প্রায়শই পরিলক্ষিত হয়।

[3] সংশয় সন্দেহ: সমালোচকদের অভিযোগ অনুযায়ী উদারনীতিবাদের বিশ্বজনীন নীতিসমূহ বিপজ্জনক। উদারনীতিবাদের মধ্যে যাঁরা সমভোগবাদী মানসিকতাসম্পন্ন তাঁদের মনে কতকগুলি বিষয়ে সংশয়-সন্দেহ বর্তমান। উদারনীতিক মূল্যবোধের কতকগুলি বিষয়ে বিশ্বজনীন লক্ষ্য বা আদর্শ আছে। এক্ষেত্রে উদাহরণ হিসাবে গণতন্ত্র, পুঁজিবাদ এবং ধর্মনিরপেক্ষতার কথা বলা যায়। কিন্তু এই সমস্ত উদারনীতিক মূল্যবোধ পশ্চিমী সংস্কৃতিসমূহের ঐতিহ্য এবং প্রথাগত বিভিন্ন ক্রিয়াকর্মকে ক্ষুণ্ণ করে।

[4] র‍্যাডিক্যাল সমালোচক: উদারনীতিক মূল্যবোধসমূহের উদ্দেশ্যের ব্যাপারে র‍্যাডিক্যাল সমালোচক রাও সন্দিহান। এ প্রসঙ্গে মার্কসবাদী লেখক ইমানুয়েল ওয়ালার স্টেইন (Immanual Wallerestein)-এর নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তাঁর অভিমত অনুযায়ী বিশ্বজনীনতা (Universalism) হল দুর্বলের কাছে শক্তিধরের উপহার বিশেষ। এই উপহার দুর্বলদের দ্বিধা-দ্বন্দ্বের মধ্যে ফেলে দেয়, এই উপহার নিলেও ক্ষতি এবং না নিলেও ক্ষতি।

[5] ঠাণ্ডাযুদ্ধের অবসানের পরে অশান্তি: ১৯৮৯ সালে ঠাণ্ডা যুদ্ধ (cold war)-এর অবসানকে উদারনীতিবাদীরা অতি উচ্ছ্বাসের সঙ্গে গ্রহণ করেছিলেন। কিন্তু অনতিবিলম্বে তা হতাশায় পরিণত হয়। পরবর্তী কালে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে একের পর এক সংঘাত-সংঘর্ষের সৃষ্টি হয়েছে। এ রকম ঘটনার উদাহরণ হিসাবে আফগানিস্তান, সোমালিয়া, বুরুতি রুয়াণ্ডা, চেচনিয়া, লাইবেরিয়া প্রভৃতি গুটিকয়েক ঘটনা থেকেই স্পষ্টত প্রতিপন্ন হয় যে, পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে ঠাণ্ডাযুদ্ধের সময়কার উত্তেজনা চাপা অবস্থায় অব্যাহত ছিল।

[6] আলোকিত অঞ্চলে অন্ধকার: একবিংশ শতাব্দীর প্রারম্ভে বিশ্বরাজনীতির চেহারা-চরিত্র পর্যালোচনা করলে অনুধাবন করতে অসুবিধা হয় না যে, উদারনীতিবাদীদের দৃষ্টিভঙ্গির ঔজ্জ্বল্য অনেকখানি হারিয়ে গেছে। অনেক ক্ষেত্রেই আলোকিত অঞ্চল অন্ধকারে ঢাকা পড়েছে। উদারনীতিক অঞ্চলের দোরগোড়াতেই বসনিয়া এবং কোসোভো (Kosovo)-র অনভিপ্রেত ঘটনা ঘটেছে। আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশেষজ্ঞ টিম দুন্নে (Tim Dunne) তাঁর Liberalism শীর্ষক রচনায় মন্তব্য করেছেন: “The key question for Liberalism at the dawn of a new century is whether it can reinvent itself as a non-universalising, non-Westernizing political idea, which preserves the traditional liberal value of human solidarity without undermining cutural diversity.”

[7] আন্তর্জাতিক সম্পর্কের আলোচনায় উদারনীতিবাদের প্রধান প্রতিপক্ষ হল নয়াবাস্তববাদ (neorealism)। আদর্শবাদী উদারনীতিবাদের সঙ্গে হতাশাবাদী বাস্তববাদের বিরোধ সুবিদিত। আন্তর্জাতিক সম্পর্কের আলোচনায় উদারনীতিবাদের সঙ্গে বাস্তববাদের বিতর্কের কারণে উদারনীতিবাদীদের মধ্যে বিভাজনের সৃষ্টি হয়েছে। সাম্প্রতিককালে এক শ্রেণীর ‘দুর্বল উদারনীতিবাদী’ (weak liberals)-দের উদ্ভব ঘটেছে। এই শ্রেণীর উদারনীতিবাদীরা বাস্তববাদীদের কাছাকাছি চলে এসেছেন। অপরদিকে সবল উদারনীতিবাদীরা আন্তর্জাতিক রাজনীতি প্রসঙ্গে সুস্পষ্টভাবে উদারনীতিক দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করেন। যাই হোক নয়াবাস্তববাদীরা বিভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বিশ্বরাজনীতি সম্পর্কিত উদারনীতিবাদী বক্তব্যের বিরূপ সমালোচনা করেন।

  • মানবপ্রকৃতি প্রসঙ্গে মতপার্থক্য: দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রাক্কালে উদারনীতিবাদী ও বাস্তববাদীদের মধ্যে বিতর্কের কেন্দ্রীয় বিষয় ছিল ‘মানব প্রকৃতি। বাস্তববাদীরা মানবপ্রকৃতি প্রসঙ্গে নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করেন। এই শ্রেণীর চিন্তাবিদদের অভিমত অনুযায়ী মানুষ অপকর্ম করতে পারে। অপরদিকে উদারনীতিবাদীরা মানব প্রকৃতি সম্পর্কে সার্থক দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করেন।
  • ইতিহাস সম্পর্কে দৃষ্টিভঙ্গির পার্থক্য: উদারনীতিবাদীদের অভিমত অনুযায়ী ইতিহাসের মধ্যে প্রগতিমূলক উপাদান-উপকরণ উপস্থিত আছে। নয়াবাস্তববাদীরা এই বক্তব্যকে স্বীকার বা সমর্থন করেন না। নয়াবাস্তববাদীদের অভিযোগ অনুযায়ী সুদীর্ঘকাল ধরে উদারনীতিক অবস্থাসমূহ অব্যাহত থাকা সত্ত্বেও রাষ্ট্রসমূহের মধ্যে উগ্র-হিংস্র সংঘাত-সংঘর্ষ আটকানো যায়নি। এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যায় যে, আর্থনীতিক সহযোগিতা নতুন কিছু বিষয় নয়। ইতিহাস সম্পর্কে ক্ল্যাসিক্যাল বাস্তববাদীদের দৃষ্টিভঙ্গি অপ্রগতিমূলক। ঐতিহাসিক পরিবর্তন সত্ত্বেও রাষ্ট্রের প্রকৃতির পরিবর্তন হয় না। অপরিবর্তিত নৈরাজ্যবাদী অবস্থার মধ্যেই রাষ্ট্রগুলির অবস্থান। নৈরাজ্যবাদের সামনে রাষ্ট্রসমূহ নিজেদের স্বার্থ সংরক্ষণের ব্যাপারে সদাই সতর্ক ও সচেষ্ট। নিজেদের নিরাপত্তাকে নিরাপদ করার জন্য রাষ্ট্রগুলি তাদের চিরশত্রুর বিরুদ্ধে অস্ত্রসজ্জার ব্যাপারে বিশেষভাবে আন্তরিক হয়। অনেক ক্ষেত্রে একটি রাষ্ট্রের নিরাপত্তা অন্য একটি রাষ্ট্রের নিরাপত্তাহীনতাকে প্রতিপন্ন করে। তারফলে অস্ত্রসজ্জার প্রতিযোগিতা শুরু হয় এবং পরিণামে যুদ্ধ বেধে যায়।
  • উদারনীতিক আশাবাদ অর্থহীন: নয়াবাস্তববাদীদের অভিমত অনুযায়ী নৈরাজ্যবাদকে অপসারিত করা অসম্ভব। নৈরাজ্যবাদী পরিস্থিতি-পরিমণ্ডলে উদারনীতিক কোন রাষ্ট্রের মনে এই আশঙ্কার অস্তিত্ব অব্যাহত থাকে যে, যে-কোন দিন তার কোন উদারনীতিক বন্ধুরাষ্ট্র শত্রুরাষ্ট্রের ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে পারে। স্বভাবতই উদারনীতিক রাষ্ট্রের পক্ষেও নৈরাজ্যবাদকে অতিক্রম করা সম্ভব হয় না। সুতরাং নৈরাজ্য-বাদের অস্তিত্ব অব্যাহত থাকাকালীন সময়ে নিরাপত্তার জন্য অস্ত্রসজ্জার অপরিহার্যতা অনস্বীকার্য। উদারনীতিক আশাবাদ সম্পর্কে সুনিশ্চিত করে কিছুই বলা যায় না। সুতরাং উদারনীতিক আশাবাদ অর্থহীন।
  • অমান্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের যুক্তি সঠিক নয়: আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানসমূহের ব্যাপারে উদারনীতিবাদীরা অতিমাত্রায় আশাবাদী ও সদর্থক অভিমত ব্যক্ত করেছেন। নয়াবাস্তববাদীরা সে সব কথা স্বীকার বা সমর্থন করেন না। আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানসমূহের মাধ্যমে রাষ্ট্র সহযোগিতামূলক ভূমিকা পালন করতে পারে। এ কথা ঠিক। কিন্তু রাষ্ট্র তা করে নিজের স্বার্থে এবং নিজের সিদ্ধান্ত অনুসারে। আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে শক্তিধর রাষ্ট্রসমূহের প্রাধান্যই কায়েম হয়। শক্তিধর রাষ্ট্রগুলিই আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানগুলিকে রঙ্গমঞ্চ হিসাবে ব্যবহার করে।
  • সাধারণতান্ত্রিক উদারনীতির সমালোচনা: নয়াবাস্তববাদীরা সাধারণতান্ত্রিক উদারনীতিবাদের বিরুদ্ধে বিরূপ সমালোচনা করেছেন। তাঁদের অভিযোগ হল যে একটি উদারনীতিক বা গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র কর্তৃত্ববাদী বা অন্যকোন ধরনের অ-গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে রূপান্তরিত হতে পারে। আবার গণতান্ত্রিক অগণতান্ত্রিক নির্বিশেষে আজকের মিত্র কালক্রমে শত্রুতে পরিণত হতে পারে।

উদারনীতিবাদের মূল্যায়ন:

আন্তর্জাতিক সম্পর্কের আলোচনায় উদারনীতিবাদীরা নয়াবাস্তববাদীদের অভিযোগসমূহের জবাব দিয়েছেন। তবে উদারনীতিবাদীরা দুভাবে নয়াবাস্তবাদীদের আক্রমণের মোকাবিলা করেছেন। একদল উদারনীতিক কতকাংশে রক্ষণাত্মক ভাবে বাস্তববাদীদের কিছু কিছু বক্তব্যকে অনেকাংশে স্বীকার করে নিয়েছেন। এই শ্রেণীর উদারনীতিকরা দুর্বল উদারনীতিক (Weak liberals) হিসাবে পরিচিতি পেয়েছেন। আর একদল উদারনীতিক নিজেদের অবস্থান থেকে নড়তে নারাজ। এঁরা সবল উদারনীতিক (Strong liberals) হিসাবে চিহ্নিত হয়েছেন। সবল উদারনীতিকদের মধ্যে যাঁদের নাম উল্লেখযোগ্য তাঁরা হলেন: রোজেনাউ (J. N. Rosenau), ডয়েল (M. W. Doyle), ডয়েটস্ (K. W. Deutsch), বার্টন (1. Burton), রোজক্রান্স (R. Rosecrance), জুন (M. Zurn) এবং রুসেট (B. M. Russett)। এই সমস্ত সবল উদারনীতিকদের অভিমত অনুযায়ী পৃথিবীর পরিবর্তন ঘটেছে। এই পরিবর্তন মৌলিক পথে সম্পাদিত হচ্ছে এবং এই পরিবর্তনের গতিমুখ উদারনীতিকদের বক্তব্যের অনুগামী। যাইহোক আন্তর্জাতিক সম্পর্ক প্রসঙ্গে উদারনীতিক মতবাদের মূল্যায়ন প্রসঙ্গে কতকগুলি বিষয় বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।

[1] বিশ্বরাজনীতি পরিবর্তিত হচ্ছে। নাটকীয়ভাবে এই পরিবর্তন ঘটছে। এই পরিবর্তন জাতীয় রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা থেকে বহুজাতিক (Transnational) রাজনীতিক ব্যবস্থার দিকে। সবল উদারনীতিকরা এ ধরনের যুক্তি অবতারণার পক্ষপাতী।

[2] জটিল পারস্পরিক নির্ভরশীলতার তত্ত্ব ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে যে এর গতি অনেকাংশ বাস্তববাদীদের বক্তব্যের দিকে। পারস্পরিক নির্ভরতার মতবাদে রাষ্ট্রসমূহের প্রাথমিক গুরুত্বকে স্বীকার করা হয়েছে। কিন্তু বাস্তববাদী বক্তব্যের পরিপূরক হিসাবে উদারনীতিক চিন্তাধারাকে কিভাবে গ্রহণ করা হবে তা পরিস্কার নয়।

[3] আন্তর্জাতিক সম্পর্কবিজ্ঞানী কেওহন (R. D. Keohane) আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানসমূহের ভূমিকার উপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করেছেন। তারফলে তাঁর বক্তব্য কিছুটা নয়াবাস্তববাদীদের বক্তব্যের কাছাকাছি এসেছে। তাঁর ব্যাখ্যার গোড়ার দিকের বক্তব্য অনুযায়ী রাষ্ট্রসমূহ হল প্রধান ক্রিয়াকারী। আন্তর্জাতিক ব্যবস্থা হল নৈরাজ্যবাদী। এবং রাষ্ট্রসমূহের ক্ষমতা বিশেষভাবে তাৎপর্যপূর্ণ। দুর্বলের উপর সবলের কর্তৃত্ব কায়েম হয়। এই বক্তব্যের প্রাণকেন্দ্রেও উদারনীতিক মর্মবাণী আছে। এই মর্মবানী হল আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানসমূহ সহযোগিতার সহায়ক ভূমিকা পালন করতে পারে। 

[4] রাষ্ট্রসমূহের মধ্যে পারস্পরি সহযোগিতা শর্তসাপেক্ষ। এ ক্ষেত্রে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ শর্ত হল রাষ্ট্রসমূহের মধ্যে সাধারণ স্বার্থের অস্তিত্ব। রাষ্ট্রসমূহের মধ্যে সাধারণ স্বার্থ থাকলে তারা তাদের আপেক্ষিক লাভ নিয়ে বড় একটা মাথা ঘামায় না। এ রকম পরিস্থিতিতে আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানসমূহ সহযোগিতার প্রক্রিয়াকে অগ্রবর্তী করতে পারে। অপরদিকে সাধারণ স্বার্থ না থাকলে রাষ্ট্রসমূহের মধ্যে দেখা দেবে প্রতিযোগিতা, অবিশ্বাস, আশঙ্কা-আতঙ্ক প্রভৃতি। এ রকম পরিস্থিতিতে আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান কার্যকর ভূমিকা পালন করতে পারে না।

[5] সবল উদারনীতিবাদীরা আধুনিক কালের আর্থনীতিক পারস্পরিক নির্ভরশীলতার উপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করেন। আর্থনীতিক ক্ষেত্রে এই পারস্পরিক নির্ভরশীলতা রাষ্ট্রসমূহকে পরস্পরের কাছাকাছি নিয়ে আসে। অধুনা অর্থনীতির বিশ্বায়ন ঘটেছে। বিশ্বব্যাপী বাজারের পরিপ্রেক্ষিতে উৎপাদন ও ভোগ নির্ধারিত ও পরিচালিত হয়। বর্তমানে আর্থনীতিক ক্ষেত্রে এই বিশ্বায়নের বাইরে থাকার দায় বহন করা কার্যত অসম্ভব। সম্প্রতিককালে উদারনীতিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রসমূহের একটি সুসংহত গোষ্ঠী পরিলক্ষিত হয়। এই সমস্ত দেশ ও তাদের জনগোষ্ঠীসমূহ উদারনীতিক গণতন্ত্রের পৃষ্ঠপোষক। এই সমস্ত দেশ তাদের পারস্পরিক আন্তর্জাতিক সম্পর্ক নতুন এবং অধিকতর সহযোগিতামূলক পথে পরিচালিত করে। এই সমস্ত রাষ্ট্রের কাছে আগেকার নৈরাজ্যবাদী অবস্থায় প্রত্যাবর্তন অভাবনীয়।

[6] স্বরাষ্ট্রীয় বা অভ্যন্তরীণ রাজনীতি ও আন্তর্জাতিক রাজনীতির মধ্যে পার্থক্য যতটা সুস্পষ্ট বলে বাস্তববাদীরা দাবি করেন, পার্থক্য ততটা স্পষ্ট নয়। প্রকৃত প্রস্তাবে অনেক রাষ্ট্রেই আইনানুগ ও কার্যকর সরকারের অনস্তিত্ব পরিলক্ষিত হয়। এ ক্ষেত্রে উদাহরণ হিসাবে আফগানিস্তান, বসনিয়া, সোমালিয়া, লাইবেরিয়া প্রভৃতি রাষ্ট্রের নাম করা যায়। তেমনি আবার কতিপয় রাষ্ট্রের গোষ্ঠীসমূহ এক ধরনের সরকারী ব্যবস্থা গড়ে তুলেছে। এ ক্ষেত্রে উদাহরণ হিসাবে ইউরোপীয় ইউনিয়ন (EU-European Union)-এর কথা বলা যায়। জ্যাকসন ও সোরেনসেন (Robert Jackson and George Sorensen) তাঁদের International Relations শীর্ষক গ্রন্থে মন্তব্য করেছেন: “Polities is not stopping at the waters edge. Anarchy does not necessarily mean complete absence of legitimate and effective authority in international politics.”

[7] অধিকাংশ বাস্তববাদীরা যুদ্ধের অনুপস্থিতিকেই শান্তি বলার পক্ষপাতি। শান্তি বিভিন্ন ধরনের এবং বিভিন্ন মাত্রার হতে পারে। এ প্রসঙ্গে ‘উষ্ণশান্তি’ (Warm peace) এবং ‘ঠান্ডা শাস্তি’ (cold peace)-র কথা বলা হয়। উদারনীতিক গণতান্ত্রিক দেশগুলির নিরাপত্তা সমষ্টির শাস্তি হল “উষ্ণ শাস্তি’। এই শান্তি অধিকতর নিরাপদ। অপরদিকে ঠান্ডা যুদ্ধের চূড়ান্ত পর্যায়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং অধুনা বিলুপ্ত সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যেকার শান্তি হল ‘ঠান্ডা শাস্তি’।

[8] ইতিহাসের ধারায় যুদ্ধের চেহারা-চরিত্রে নাটকীয় পরিবর্তন ঘটেছে। যুদ্ধ কালক্রমে এবং ক্রমান্বয়ে অধিকতর ধ্বংসাত্মক প্রকৃতিপ্রাপ্ত হয়েছে। আধুনিক বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির দ্বারা সমৃদ্ধ হয়ে যুদ্ধের ভয়াবহতা সকল কল্পনাকে ছাড়িয়ে গেছে। বিংশ শতাব্দীর দুটি বিশ্বযুদ্ধে তার অল্প কিছু পরিচয় পাওয়া গেছে। আবার অধুনা আধুনিক আণবিক মারণাস্ত্র এবং আণবিক যুদ্ধ সমগ্র মানবসভ্যতার সমাপ্তি সম্পাদনের ক্ষমতাযুক্ত। সবল উদারনীতিকদের প্রবল যুক্তি হল এ রকম পরিস্থিতি পরিমণ্ডলের চাপে রাষ্ট্রসমূহের মধ্যে পারস্পরিক সহযোগিতার প্রবণতা বৃদ্ধি পাওয়ার সম্ভাবনা অধিক। আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিজ্ঞানী মুয়েলার (I. Mueller) তাঁর Retreat from Doomsday: The obsolescence of Major War শীর্ষক গ্রন্থে এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। তবে নয়াবাস্তববাদীরাও স্বীকার করেন যে, আণবিক অস্ত্রসমূহের ভয়াবহতা যুদ্ধের আশঙ্কাকে প্রতিহত করে।

[9] সবল উদারনীতিকরা বিশ্বাস করেন যে, নিকট ভবিষ্যতে যথার্থ প্রগতি সম্ভব। পৃথিবীর বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ প্রান্তে সেই অভিমুখে পরিবর্তন পরিলক্ষিত হচ্ছে। কোন বিশ্বসরকার এখনও গড়ে উঠেনি, এ কথা ঠিক। কিন্তু আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বিভিন্ন ক্ষেত্রে নয়াবাস্তববাদীরা যে সমস্ত নেতিবাচক ফলাফলের কথা বা নিখাদ নৈরাজ্যবাদের কথা বলেন, বর্তমান বিশ্ব সে সবকে অতিক্রম করে গেছে। পরিবর্তনকে প্রগতি হিসাবে প্রতিপন্ন করার ক্ষেত্রে উদারনীতিবাদীরা বাস্তববাদীদের থেকে অধিকতর সন্তোষজনক অবস্থায় অবস্থিত বলে মনে করা হয়। ঠাণ্ডাযুদ্ধের অবসান উদারনীতিবাদীদের অবস্থানকে অধিকতর সন্তোষজনক করেছে। বিশ্বরাজনীতি মোটামুটি উদারনীতিক লক্ষ্যেই পরিবর্তিত হচ্ছে। কিন্তু প্রগতির ক্ষেত্রে অগ্রগতি আশানুরূপ নয় এবং পশ্চাদবর্তী পরিবর্তনও উড়িয়ে দেওয়া যায় না। এই সমস্ত ক্ষেত্রে উদারনীতিবাদীদের অবস্থান দুর্বল।

[10] সাম্প্রতিককালের উদারনীতিক চিন্তাভাবনায় আন্তর্জাতিক সম্পর্কের দুর্বল দিকগুলির মোকাবিলা করার চেষ্টা করা হয়েছে। আন্তর্জাতিক সম্পর্কবিজ্ঞানী মোরাবসিক (Andrew Moravesik) তাঁর Negotiating the Single European Act: National Interests and Conventional Statecraft in the European Community শীর্ষক রচনায় এ নিয়ে বিশদভাবে আলোচনা করেছেন। তিনি উদারনীতিক মতবাদের পুনর্গঠনের কথা বলেছেন। এই পরিশিলীত উদারনীতিকরা আদর্শবাদী বা কল্পনাবিলাসী হবে না। আন্তর্জাতিক নীতির ক্ষেত্রে মৌলিক ক্রিয়াকারীরা হল যুক্তিবাদী ব্যক্তিবর্গ এবং বেসরকারী গোষ্ঠীসমূহ। সমাজের ব্যক্তিবর্গ এবং গোষ্ঠীসমূহের চাহিদাই রাষ্ট্রীয় নীতির মধ্যে প্রতিফলিত হয়। অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে সরকারী নীতির মাধ্যমে প্রকাশিত হয় ব্যক্তিবর্গ ও গোষ্ঠীসমূহের আশা-আকাঙ্খাসমৃদ্ধ বিবিধ কর্মসূচীর ক্রমান্বয়িক পছন্দের বিন্যাস। আন্তর্জাতিক ব্যবস্থায় প্রতিটি রাষ্ট্রই তার পছন্দমত পেতে চেষ্টা করে। কিন্তু আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে অন্যান্য রাষ্ট্রের পছন্দসমূহের চাপও থাকে। এ সমস্ত প্রতিকূলতার মধ্যেই প্রতিটি রাষ্ট্রকে তাঁর আন্তর্জাতিক সম্পর্ক নির্ধারণ ও পরিচালনা করতে হয়। এ প্রসঙ্গে জ্যাকসন ও সোরেনসেন (Robert Jackson and George Sorensen)-এর অভিমত প্রণিধানযোগ্য। এই দুই আন্তর্জাতিক সম্পর্ক-বিজ্ঞানী তাঁদের International Retations শীর্ষক গ্রন্থে বলেছেন: “Moravesik’s efforts demonstrates the attempt to provide a ‘general resentment of positive liberal IR theory’ which is based on strong liberal assumptions. The assertion is that such a liberal theory is better than both realism and neoliberal institutionalism at explaining foreign policy, historical change in the international system, and peaceful relations between consolidated liberal democracies.” এই দুই আন্তর্জাতিক সম্পর্কবিজ্ঞানী আরও বলেছেন: “Another recent attempt by strong liberals to update liberal thinking is the theory of ‘structural liberalism by Daniel Dendueg and G. John Ikenberry (1999). They seek to characterize the major features of the Western order, that is, the relations between Western liberal democracies.”