উত্তর-কমিউনিস্ট রাষ্ট্রে রাষ্ট্রব্যবস্থা ও আর্থনীতিক ব্যবস্থার মধ্যে স্বাতন্ত্র্যকে পুনরায় প্রতিষ্ঠিত করা অন্যতম গুরুদায়িত্ব হিসাবে প্রতীয়মান হয়। রাষ্ট্র ও অর্থনীতির মধ্যে স্বতন্ত্রীকরণের ক্ষেত্রে দুটি প্রক্রিয়া ওতপ্রোতভাবে সম্পর্কযুক্ত। এই দুটি প্রক্রিয়া হল: বাজারিকরণ (marketization) এবং বেসরকারিকরণ (privatization)। বাজারিকরণ বলতে চাহিদা-যোগান সম্পর্কিত বাজারি শক্তিসমূহের পুনরুজ্জীবনকে বোঝায়। বেসরকারিকরণ বলতে বোঝায় রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন সম্পত্তিকে ব্যক্তিগত মালিকানাধীনে স্থাপন করা। কিন্তু এই পরিবর্তন সাধনের প্রক্রিয়া ও উদ্দেশ্য সম্পর্কিত সিদ্ধান্ত বিভিন্ন রাজনীতিক ও আর্থনীতিক বিকল্পসমূহের দ্বারা বিশেষভাবে প্রভাবিত হয়। উত্তর-কমিউনিস্ট রাষ্ট্রসমূহ বিভিন্ন পথে বাজারিকরণ ও বেসরকারিকরণের ব্যাপারে অগ্রসর হয়। উত্তর-কমিউনিস্ট দেশগুলি বাণিজ্যিকীকরণ ও বেসরকারিকরণের ক্ষেত্রে নতুন রাজনীতিক আর্থনীতিক মডেল গ্রহণ করে। কতকগুলি দেশ ইঙ্গ-মার্কিন মডেলের উদারনীতিবাদ গ্রহণ করে। আবার কতকগুলি দেশ পশ্চিম ইউরোপের সামাজিক গণতান্ত্রিক মডেলের দিকে ঝুঁকে পড়ে। আবার কতকগুলি দেশ অধিকতর ব্যবসা-বাণিজ্যিক নীতি অনুসরণ করে।
১৯৮৯ সালের আগে কমিউনিস্ট আর্থনীতিক ব্যবস্থা পরিত্যাগ করে পুঁজিবাদী অর্থনীতিক ব্যবস্থা অবলম্বনের কোন ঘটনা কোন দেশেই ঘটে নি। স্বভাবতই এ বিষয়ে কোন স্বীকৃত মডেলের সৃষ্টি হয় নি। এই কারণে বেসরকারিকরণের প্রক্রিয়াটি মোটেই সহজ-সরল বা সুস্পষ্ট ছিল না। উত্তর-কমিউনিস্ট রাষ্ট্রসমূহের লক্ষ্য ছিল আর্থনীতিক উন্নয়ন এবং রাষ্ট্রের ক্ষমতাকে নিয়ন্ত্রণ। তারজন্য আর্থনীতিক সম্পদকে রাষ্ট্রীয় মালিকানা থেকে সরিয়ে ব্যক্তিগত মালিকানায় স্থাপন প্রয়োজনীয় হয়ে পড়ে। অর্থাৎ বেসরকারিকরণ আবশ্যক হয়ে পড়ে।
পূর্বতন কমিউনিস্ট আমলে বাজার ব্যবস্থা ছিল না। স্বভাবতই আর্থনীতিক সম্পদসমূহের কোন বাজার দাম ছিল না। কিন্তু বেসরকারিকরণের জন্য সম্পদের বাজার দাম নির্ধারণ অপরিহার্য হয়ে পড়ে। বাজার দাম নির্ধারণের বিষয়টি দুরূহ হয়ে দাঁড়ায়। বাজার দাম নির্ধারণের জন্য আর্থনীতিক সম্পদ বলতে অনেক কিছুর মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য হল। কলকারখানা, দোকানপাট, জমিজমা, আবাসন প্রভৃতি।
বেসরকারিকরণের প্রক্রিয়ায় উত্তর কমিউনিস্ট রাষ্ট্রসমূহ বিবিধ সমস্যার সম্মুখীন হয়। সমস্যাগুলি কতকগুলি প্রশ্নকে কেন্দ্র করে। প্রশ্নগুলি হল: আর্থনীতিক সম্পদসমূহ কার হাতে দেওয়া হবে, কীভাবে দেওয়া হবে; নিলামের পদ্ধতি অনুসরণ করা হবে কিনা; বিদেশী বিনিয়োগ অনুমোদন পাবে কিনা—এ রকম অসংখ্য প্রশ্ন বেসরকারিকরণের প্রক্রিয়াকে অতিমাত্রায় জটিল করে তোলে। উন্নয়নমুখী অর্থনীতি গড়ে তোলার ক্ষেত্রে প্রতিটি বিকল্পের পৃথক প্রকৃতির সুযোগ-সুবিধা আছে। কিন্তু উত্তর কমিউনিস্ট শাসকদের শাসনে মূল সমস্যা ছিল অসাম্য যেন বৃদ্ধি না পায় এবং জনসাধারণের মধ্যে যেন অসন্তোষ দেখা না দেয়। বিভিন্ন দেশে বেসরকারিকরণ বিভিন্নভাবে সম্পাদিত হয়েছে। দেশভেদে এবং আর্থনীতিক সম্পদের প্রকৃতিগত পার্থক্যের পরিপ্রেক্ষিতে বেসরকারিকরণ সম্পাদিত হয়েছে বিভিন্ন পথে। কিছু দেশে বৃহৎ ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানসমূহ নিলামে বিক্রি করা হয়েছে সর্বোচ্চ ডাকের ভিত্তিতে। অনেক ক্ষেত্রে বিদেশীরা নিলামে সর্বোচ্চ দামে বড় বড় কারবার কিনে নেয়। ছোটখাট ব্যবসাগুলি সরাসরি তাদের কর্মচারীদেরই বিক্রি করে দেওয়া হয়। অনেক দেশে কারখানার শেয়ার জনসাধারণের মধ্যে বণ্টন করা হয়।
বেসরকারিকরণের প্রতিটি মডেল নিয়ে কেতাবি আলোচনার অভাব নেই। যাইহোক প্রতিটি মডেল এককভাবে বা অন্য মডেলের সঙ্গে মিশ্রভাবে সাফল্য পেয়েছে; আবার কোথাও বা তেমন সাফল্য পায়নি।
উত্তর কমিউনিস্ট দেশগুলিতে বেসরকারিকরণের ফলাফল সবসময় সন্তোষজনক হয় নি। অনেক দেশে ব্যাপক বেকারত্ব ও সামাজিক অস্থিরতার আশঙ্কায় বেসরকারিকরণের প্রক্রিয়া অতি ধীর গতিতে অগ্রসর হয়েছে। উত্তর-কমিউনিস্ট দেশগুলিতে অবস্থিত আর্থনীতিক প্রতিষ্ঠানসমূহ বাজার অর্থনীতির অনুপযোগী প্রতিপন্ন হয়। অধিকাংশ ফার্ম নিয়োগের মাত্রাতিরিক্ত আধিক্যের কারণে বিশেষভাবে ভারাক্রান্ত। কল কারখানাগুলি সেকেলে; স্বভাবতই মুনাফা অর্জনে অক্ষম। ইস্পাতশিল্প ও কয়লাখনির মত বৃহদায়তন বিশিষ্ট শিল্পসংস্থাসমূহ সর্বাধিক সমস্যার সৃষ্টি করে। কারণ এই সমস্ত ফার্ম শিল্পায়ন প্রক্রিয়ার একেবারে গোড়ার দিকে তৈরী হয়েছে। আন্তর্জাতিক বাজারের প্রতিযোগিতায় এঁটে ওঠার সামর্থ্য এই সমস্ত শিল্প সংস্থার নেই। এ রকম সংস্থাকে লাভজনক করে তোলার জন্য আয়তনকে ছেঁটে ছোট করে নিয়ন্ত্রণাধীন করা দরকার। কিন্তু সে ক্ষেত্রে বেকারসমস্যা মাথা চাড়া দিয়ে উঠার আশঙ্কা আছে। অথচ পূর্ববর্তী কমিউনিস্ট আমলে এই সমস্ত ফার্মে প্রয়োজনের অতিরিক্ত হাজার হাজার মানুষ কাজ করত। এই কাজের সূত্রেই অসংখ্য মানুষের রুজি রোজগার হত, অন্নসংস্থান হত। উত্তর-কমিউনিস্ট দেশগুলির নতুন গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় কোন রাজনীতিক সরকারের পক্ষে এ রকম বৃহদায়তনের কোন ফার্মকে বন্ধ করে দেওয়া সম্ভব নয়। কারণ সংসদীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় জনসমর্থন ও ভোটের বালাই বড় বালাই। ভোট ব্যাঙ্ককে দুর্বল করার ঝুঁকি রাজনীতিক সরকার নেবে না।
আপাত বিচারে বাজারিকরণ প্রক্রিয়া সহজ-সরল বলে প্রতীয়মান হয়। কারণ বাজারিকরণ হল কমিউনিস্ট ব্যবস্থার কেন্দ্রীয় পরিকল্পনাকে পরিহার করে চাহিদা-যোগানের বাজারি শক্তিসমূহকে পুনরায় সক্রিয় করা। প্রকৃত প্রস্তাবে বাজারিকরণ প্রক্রিয়াটিও বিশেষভাবে জটিল। বাজারিকরণ প্রক্রিয়ার গতি-প্রকৃতি নিয়ে তাত্ত্বিক আলোচনায় মতপার্থক্য আছে। একদল চিন্তাবিদ দ্রুত গতিতে বাজারিকরণের পক্ষপাতী। অন্য একদল চিন্তাবিদ ধীর গতিতে বাজারিকরণের কথা বলেন।
দ্রুতগতিতে বাজারিকরণ হল আসলে এক ধরনের ঝাঁকুনি দিয়ে চিকিৎসা বা শক থেরাপি’ (shock therapy)। এই শ্রেণীর চিন্তাবিদ্রা রাতারাতি পরিবর্তনের পক্ষপাতী। তাঁদের অভিমত অনুযায়ী বাজারিকরণ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে কমিউনিস্ট আমলের কেন্দ্রীয় পরিকল্পনার অবসান ঘটবে; ব্যবসা-বাণিজ্যে রাষ্ট্রীয় অনুদানের অবসান ঘটবে; এবং দামের বিষয়টি উন্মুক্ত হবে। এই দ্রুত গতির পরিবর্তন বেদনাদায়ক হতে পারে এবং প্রাথমিকভাবে মুদ্রাস্ফীতি বিশেষভাবে বাড়তে পারে। কিন্তু এই সমস্ত সমস্যা হবে ক্ষণস্থায়ী। বিপরীতক্রমে ধীর গতিতে বাজারিকরণের মাধ্যমে পরিবর্তন জনিত সমস্যাদি দীর্ঘমেয়াদি হবে।
অন্য একদল চিন্তাবিদ এ প্রসঙ্গে ভিন্নমত পোষণ করেন। তাঁরা ক্রমান্বয়িক বাজারিকরণের পক্ষপাতী। এঁদের অভিমত অনুযায়ী উত্তর-কমিউনিস্ট রাষ্ট্রে আর্থনীতিক রূপান্তরের প্রকৃতি সর্বাধিক গভীর বা নিবিড়। এই কারণে এই পরিবর্তন ক্রমান্বয়িক হওয়া আবশ্যক। তা হলে সামাজিক বিশৃঙ্খলা বা অপসংহতির আশঙ্কা অনেকাংশে হ্রাস পাবে। অন্যথায় নবজাত উত্তর-কমিউনিস্ট রাষ্ট্রসমূহের আর্থনীতিক ও গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা বিপন্ন হয়ে পড়ার সমস্যা সৃষ্টি হবে। রাতারাতি বাজারিকরণ ঘটলে ব্যবসায়ীরা মর্জিমাফিক জিনিসপত্রের দাম বাড়াবে। মূল্যবৃদ্ধি ঘটবে লাগামছাড়াভাবে। মুদ্রাস্ফীতি মাত্রা ছাড়িয়ে যাবে। জনসাধারণের উপর দারিদ্র্যের কোপ পড়বে। বাজারিকরণ প্রক্রিয়া সম্ভৃত পরিবর্তনের উপর মানুষ আস্থা হারাবে।
উত্তর-কমিউনিস্ট আমলে আর্থনীতিক রূপান্তরের মূল্যায়ন
উত্তর-কমিউনিস্ট দেশগুলিতে আর্থনীতিক পরিবর্তনের প্রকৃতি প্রসঙ্গে সাধারণভাবে একটি কথা বলা যায়। আইনের অনুশাসন এবং আর্থনীতিক উন্নয়নের মধ্যে নিবিড় সংযোগ সম্পর্ক বর্তমান। আইনের অনুশাসন যেখানে ব্যাপক ও শক্তিশালী আর্থনীতিক রূপান্তর ও উন্নয়ন সেখানে সফল। বিপরীতক্রমে আইনের অনুশাসন হীনবল হলে আর্থনীতিক রূপান্তর সাধনের প্রক্রিয়ার সাফল্য সুদুর পরাহত হয়ে পড়ার আশঙ্কা দেখা দেয়। কারণ সে রকম পরিস্থিতি পরিমণ্ডলে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক উৎপাদক বা বিনিয়োগকারীরা নির্ভাবনায় বিনিয়োগ করতে পারে না। আবার অপরদিকে সরকারি কর্তাব্যক্তিরা এবং রাজনীতিক নেতারা দেশের আর্থনীতিক সম্পদকে নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করার জন্য নিজেদের পদমর্যাদাকে যথাসম্ভব ব্যবহার করে।
পূর্ব ইউরোপ এবং বাল্টিক অঞ্চলে ১৯৮৯ সালের তুলনায় গড় অভ্যন্তরীণ উৎপাদন প্রায় সিকি শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। আর্থনীতিক সংস্কার সাধন প্রক্রিয়ার সুবাদে আর্থনীতিক ক্ষেত্রে এই অগ্রগতি সম্ভব হয়েছে। আবার অপরদিকে পূর্বতন সোভিয়েত ইউনিয়নের অন্তর্ভুক্ত জর্জিয়া, মলডোভা প্রভৃতি দেশে গড় অভ্যন্তরীণ উৎপাদন অর্ধাংশের অধিক হ্রাস পেয়েছে। বলকান অঞ্চল আর্থনীতিক ক্ষেত্রে কোন প্রকৃত প্রগতির পরিচয় দিতে পারে নি।
এক্ষেত্রে ব্যাখ্যা হিসাবে কতকগুলি বিষয় উল্লেখ করা আবশ্যক। এই বিষয়গুলি হল: শিল্পায়ন প্রক্রিয়া, ব্যক্তিগত সম্পত্তি ও বাজার অর্থনীতি সম্পর্কে প্রাক্ কমিউনিস্ট আমলের অভিজ্ঞতার আধিক্য; সোভিয়েত ইউনিয়নের নিয়ন্ত্রণাধীনে কম সময় থাকা; ইউরোপীয় ইউনিয়নের দিক থেকে সুদৃঢ় সমর্থন প্রভৃতি। বিপরীতক্রমে যে সমস্ত উত্তর-কমিউনিস্ট দেশ উপরিউক্ত বিষয়াদিতে বিপরীত অবস্থানযুক্ত, সেই সমস্ত দেশ আর্থনীতিক রূপান্তর প্রক্রিয়ায় তেমন সাফল্য লাভে সমর্থ হয়নি। সংশ্লিষ্ট দেশগুলিতে উন্মুক্ত বাজার অর্থনীতির কারণে অনিয়ন্ত্রিত মুদ্রাস্ফীতির সৃষ্টি হয়েছে। তার ফলে জীবনযাত্রার মানের দ্রুত অবনতি ঘটেছে। এই সমস্ত দেশে যেভাবে বেসরকারিকরণ সম্পাদিত হয়েছে, তার ফলে আর্থনীতিক পরিস্থিতির অধিকতর অবনতি ঘটেছে। দেশের মূল্যবান আর্থনীতিক সম্পদসমূহের বেশকিছু কমিউনিস্ট আমলের কর্তাব্যক্তি (nomenklatura) বা মুষ্টিমেয় বেসরকারি ব্যক্তি কুক্ষিগত করে নেয়। দুর্নীতিপরায়ণ রাজনীতিকরা এতে সমর্থন জোগায়।
Leave a comment