চব্বিশ পরগনা জেলার কাঁচড়াপাড়া গ্রামে ১৮১২ খ্রিষ্টাব্দে ঈশ্বর গুপ্তের জন্ম। তিনি ছিলেন স্বভাব কবি। অতি অল্প বয়সেই কবিতা রচনা করে তিনি সবাইকে তাক লাগিয়ে দেন। এগারো বছর বয়সেই তিনি তৎকালীন রীতিধর্মী কবিতা রচনা করে পেশাদার কবিয়ালদের অবাক করে দেন। ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত বাল্যকালে অত্যন্ত দুরন্ত স্বভাবের ছিলেন। সে জন্যই লেখাপড়ায় তিনি বেশি দূর অগ্রসর হতে পারেননি। ব্যক্তিগত জীবনে তিনি নানা সমস্যার শিকার হন। তিনি সংসারের মধুময় পরিবেশ কখনো পাননি। বাল্যকালে তিনি তার মাকে হারান। মায়ের মৃত্যুর পর পিতা দ্বিতীয় বিয়ে করেন। তিনি সৎমার প্রতি ছিলেন বিরূপ। সৎমার অনাদর তাকে অনেকটা অসংযত করে তোলে।
ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত কবিওয়ালাদের জীবনী ও রচনা সংগ্রহ করেন। কবিগানের ঢঙে কবিতা লিখে তিনি আনন্দ পেতেন। আধুনিক কাব্যরীতির অনুশীলনও তিনি করেছেন। তিনি সমাজ সচেতন ছিলেন। তার স্বদেশ চেতনা ছিল প্রখর। তার ইংরেজি প্রশস্তিও তিনি করেছেন। তার কবিমানসে পুরনো ও নতুনের অবস্থান ছিল সমভাবে। তাই তিনি কোনো এক ধারাকে আশ্রয় করে তাঁর চেতনাকে বিকশিত করতে পারেননি। তাই নবযুগের লক্ষণ তার কবিতায় সহজেই প্রত্যক্ষগোচর হয়।
ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তের মহৎকীর্তি ‘সংবাদ প্রভাকর’ পত্রিকা। যোগেন্দ্রনাথ ঠাকুরের সহযোগিতায় ১৮৩১ খ্রিষ্টাব্দে প্রথমে সাপ্তাহিক এবং ১৯৩৯ খ্রিষ্টাব্দে দৈনিক পত্রিকা হিসেবে পত্রিকাটি প্রকাশিত হয়। পত্রিকাটি বাংলা গদ্যের উন্মেষ যুগে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের শ্রীবৃদ্ধিতে অতুলনীয় অবদান রাখে। তিনি ছিলেন সংবাদ প্রভারকরের সম্পাদক। এছাড়া তিনি “পাষণ্ড পীড়ন”, ‘সংবাদ রত্নাবলি’ সংবাদ সাধুরঞ্জন ইত্যাদি পত্রিকাও সম্পাদনা করেছেন। তার প্রকাশিত গ্রন্থ: কালী কীর্তন (১৮৩৩), কবিবর ভারতচন্দ্র রায় গুণাকরের জীবন বৃত্তান্ত (১৮৫৫), প্রবোধ প্রভাকর (১৮৫৮) ইত্যাদি। এছাড়াও তিনি অনেক কবিতা রচনা করেছেন। মৃত্যুর পর তার কবিতাবলি রামচন্দ্র গুপ্ত, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, কালীপ্রসন্ন বিদ্যারত্ন প্রমুখের সম্পাদনায় প্রকাশিত হয়।
ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তকে যুগসন্ধিক্ষণের কবি বলার কারণ তখন ছিল পুরণো যুগের শেষ এবং নতুন যুগের অভ্যুদ্বয়ের সূচনা পর্ব। কিন্তু নতুন যুগ তখনো সম্পূর্ণ বিকাশ লাভ করেনি। তিনি পুরাতন ও নতুনের সন্ধিক্ষণের কবি। নতুনকে তিনি স্বাগত জানিয়েছেন সত্য কিন্তু পুরনোকে একেবারে বিসর্জন দিতে পারেননি। তিনি নিজে কবিগান করতেন। কবিওয়ালা হিসেবেও তার খ্যাতি ছিল। মধ্যযুগীয় ধারাকে রক্ষা করার চেষ্টা তিনি করেছেন। নতুন যুগ নিয়ে প্রতীচ্য ভাবনা ও ভাষা পেল নতুন মহিমা। বাংলা কাব্যজগৎ হঠাৎ সচকিত হয়ে উঠল। ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তের চেতনায়ও নতুন দোলা ছিল। তিনি প্রকৃতি বিষয়ক কবিতা লিখেন। স্বদেশপ্রেম তার কবিতায় প্রত্যক্ষগোচর হয়। প্রাত্যহিক জীবনের তুচ্ছ বিষয় অবলম্বনে নতুন ধাঁচে কবিতা লিখলেন তিনি। বাংলা কবিতায় এলো নতুন স্বাদ।
১৮০১ খ্রিষ্টাব্দ থেকে বাংলা সাহিত্যের আধুনিক যুগ সূচিত হলেও বাংলা কাব্য সাহিত্যে ১৮৬১ খ্রিষ্টাব্দে ‘মেঘনাদবধ কাব্য’ রচিত হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত প্রকৃত অর্থে আধুনিকতা আরম্ভ হয়নি। এ ষাট বছর (১৮০১-১৮৬১) কাব্যে আধুনিকতায় পৌছার চেষ্টা চলেছে মাত্র। ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তের জীবৎকাল ১৮১২ থেকে ১৮৫৯ খ্রিষ্টাব্দ। তিনি বড়ো হয়েছেন কলকাতার পরিবেশে। তিনি এ সময় মধ্যযুগের দেবদেবীর কাহিনি নির্ভর কাব্যরচনা বর্জন করে ব্যক্তি অভিজ্ঞতায় ছোটো ছোটো কবিতা লেখা শুরু করেন। তপসে মাছের মতো সামান্য প্রাণীও তার কাব্যের বিষয়বস্তু। তার কবিতায় স্পষ্ট করে মাতৃভূমির প্রতি দরদ লক্ষ করা যায়। প্রকৃতপক্ষে মধ্যযুগের শেষ প্রতিনিধি ভারতচন্দ্র এবং আধুনিক যুগের প্রথম পুরুষ মাইকেল মধুসূদন এ দুই মনীষীর মধ্যবর্তীকালে ঈশ্বর গুপ্তের আবির্ভাব। তার রচনার মধ্যে মধ্যযুগের কাব্য, বৈশিষ্ট্য ও আধুনিক যুগের সূচনা বৈশিষ্ট্য সমানভাবে লক্ষ করা যায় বলে তাকে যুগসন্ধির কবি বলা হয়।
বিশেষ দ্রষ্টব্যঃ উপরের লেখায় কোন ভুল থাকে তাহলে দয়া করে আমাদেরকে কমেন্ট করে জানাবেন আমরা সেটা ঠিক করে দেওয়ার চেষ্টা করবো, ধন্যবাদ।
Leave a comment