মার্কসীয় দর্শনে বিশ্বাসী হয়ে, একনিষ্ট যুক্তিবাদী মন নিয়ে অধ্যাপক, গবেষক সাংবাদিক গোপাল হালদার সাহিত্য সমালোচনায় আত্মনিয়োগ করেন। এক অনন্য যুক্তিজালে তাঁর আধুনিক সাহিত্য প্রবন্ধটির অবয়ব গঠিত। বিশিষ্ট ভাষাতত্ত্ববিদ আচার্য সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের প্রিয় ছাত্র অধ্যাপক গোপাল হালদার প্রথম থেকেই ছিলেন মার্কসীয় দর্শনে বিশ্বাসী। মানুষের সামগ্রিক আত্মবিশ্বাসের স্বার্থেই লেখক গোপাল হালদার তাঁর লেখনীকে সচল রাখেন। তিনি বিভিন্ন ক্ষেত্রে ঐতিহাসিক বস্তুবাদী দৃষ্টিকোণ থেকে সাহিত্য ও সংস্কৃতির মূল্যায়ন করেছেন। তিনি একাধারে ছিলেন অধ্যাপক, সাহিত্যিক, রাজনীতিবিদ, গবেষক, সাংবাদিক, পত্রিকা সম্পাদক। ফলত মানবতার মূল মন্ত্রকে গ্রহণ করে তিনি তাঁর ভবিষ্যৎ কর্মপন্থাকে বেছে নিয়েছিলেন। বলা বাহুল্য এরই জন্য বাংলা ভাষায় সাহিত্য-সংস্কৃতির বিশেষ পণ্ডিত হিসাবে তিনি আখ্যাত হয়ে আছেন। বর্তমান প্রবন্ধটি অর্থাৎ আধুনিক সাহিত্য তাঁর ‘বাংলা সাহিত্য ও মানব স্বীকৃতি’ নামক গ্রন্থের অন্তর্গত। সাহিত্যের মূল্যায়ন করতে গিয়ে তিনি যে তাত্ত্বিক আলোচনার মধ্য দিয়ে মূল সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন তার মূল বৈশিষ্ট্য হল, মার্কসীয় দর্শনের প্রতি তাঁর অগাধ আস্থা। আধুনিক সাহিত্য প্রবন্ধটিতে তারই ইঙ্গিত মেলে। এক একনিষ্ঠ যুক্তিবাদী মন নিয়ে সমালোচনায় আত্মনিয়োগ করেছেন। যে যুক্তিগুলি ছিল আধুনিক সাহিত্য সৃষ্টির প্রেক্ষাপটে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে।
প্রবন্ধের শুরুতে লেখক জানিয়েছেন সাহিত্যে আধুনিকতা বলতে আমরা কী বুঝি ? যা বুঝি তা হল আপেক্ষিক মাত্র। কারণ আজ যে বিষয় বা রীতিকে (আমাদের) আধুনিক বলে মনে হয় আগামী দিনে বা অদূর ভবিষ্যতে তা আধুনিক রূপে চিহ্নিত নাও হতে পারে। কারণ আজ যে জিনিস আধুনিক, আগামী দিনে তা প্রাচীন, এটাই জাগতিক নিয়ম। তাই সাহিত্যে চরম বিচার বলে কিছু নেই। রবীন্দ্রনাথ এই আধুনিকতার সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বলেছেন—সাহিত্যে আধুনিক জিনিসটা হঠাৎ বাঁকের মুখে পড়ে যাওয়াকেই আধুনিকতা বলা যায় অর্থাৎ সাহিত্যের কোন বাঁককে আধুনিক হিসাবে চিহ্নিত করা যায় প্রাবন্ধিক জানালেন। আধুনিকতার অস্তিত্ব নিরূপিত হয় বিচারকের মানস ক্রিয়ার ওপর নির্ভর করে। যেহেতু সাহিত্য মনের ফসল, মনের জানালা, সেইহেতু আধুনিকতা মানস ক্রিয়া ছাড়া আর কিছুই নয়। এই মানস ক্রিয়ার ক্রমিক পট-পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে। আধুনিকতা সজাগ হয়ে ওঠে। তবে বিচারকের মর্জির ওপর সাহিত্যের আধুনিকতার অস্তিত্ব টিকে থাকলেও দেশে-দেশে কালে-কালে সাহিত্যের স্বরূপ যখন এক নয় তখন চিন্তা ভাবনার পটপরিবর্তন অবশ্যম্ভাবী। একটা স্থানে যে বিষয়টাকে আধুনিক হিসাবে মনে করা হয় অন্য স্থানে সে বিষয়টা নাও থাকতে পারে। তবে একার্থে আধুনিকতা অবশ্যই আছে তার বিষয় বিভিন্ন রূপ হলেও।
দেশ-কাল-পাত্রের ভেদাভেদে সাহিত্যের আধুনিকতার তারতম্য নির্ধারণ প্রসঙ্গে প্রাবন্ধিক উদাহরণ স্বরূপ গ্রহণ করেছেন মহাভারতের একটি ঘটনাকে। মহাভারতের কর্ণকুত্তীর সাক্ষাৎকে কেন্দ্র করে রবীন্দ্রনাথ লিখলেন কর্ণকুন্তী সংবাদ। দুটোর বিষয় এক হলেও প্রকাশ ভঙ্গির পার্থক্যের জন্যে রবীন্দ্রনাথের লেখাটি হয়ে উঠল আধুনিক। আবার অনুরূপভাবে বলা যায়, সাম্প্রতিক কালের অধিকাংশ রচনা আধুনিকতার ধ্বজাধারি। কিন্তু প্রাচীন কালের রচনাগুলি কেন যে মহিমা থেকে অপসারিত হয়েছে এ প্রশ্ন মাঝে মাঝে আসতে পারে। এ ক্ষেত্রে একটা বিষয় মুখ্য হয়ে ওঠে—মানুষের মূল্যবোধ’। প্রাচীন বা মধ্যযুগীয় সমগ্র সাহিত্যকে গভীর ভাবে পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে মানবের অস্তিত্ব মহিমাবোধ বারে বারে খুন্ন হয়েছে। নিয়তি তাড়িত মানব কেবলমাত্র সুষ্ঠুভাবে বাঁচার তাগিদে বারে বারে দেবতার দ্বারস্থ হয়েছে। আর যে সকল উচ্চশ্রেণির মানুষ দেবতাকে অবজ্ঞা করে আপন অস্তিত্বকে টিকিয়ে রাখতে এগিয়ে এসেছিলেন সামাজিক নির্দেশ বা যুগ ধর্মের নির্দেশে, দেবতা স্বয়ং এসে সেই সকল মানুষদের কঠোর হস্তে দমন করেছে। তাই বারে বারে ব্যহত হয়েছে মানুষের স্বাধীন চিন্তাভাবনার ধারা। কিন্তু সাম্প্রতিক সাহিত্যে এ ঘটনা বিরল। এখানে মানুষের মহিমা কীর্তনই মূল লক্ষ্য, এর জন্যে সাহিত্যে সত্যকার আধুনিকতা বলতে কী তা পরিস্ফুট হয়ে উঠেছে।
তবে মধ্যযুগীয় সাহিত্য যে কেবলমাত্র দেব নির্ভর তা নয়। সাধক কবি চণ্ডীদাস তো সর্বাগ্রে ঘোষণা করেছেন—“সবার উপর মানুষ সত্য, তাহার উপরে নাই।” তখনও যে মানুষের ওপর গুরুত্ব আরোপ করা হত এর মধ্যদিয়ে তার প্রমাণ মেলে। আবার সাম্প্রতিক কালের রচনা যে দেব নির্ভর নয় কিংবা এখানে কেবল মানুষের কথা বলা হয়েছে তা নয়। হয়তো এখন চণ্ডীমঙ্গল মনসামঙ্গল রচিত হয় না, তথাপি—বেহুলা লখিন্দর নাগ পঞ্চমী, বেদের মেয়ে জ্যোৎস্না এখনো সাড়ম্বরে মানুষের হৃদয় জয় করছে। কয়েক শত বৎসর আগে চণ্ডীদাস শ্রেষ্ঠ জীব হিসাবে মানুষকে স্বীকৃতি জানালেও রাজ্যে দুর্ভিক্ষের কারণে শুদ্র সম্বুককে শ্রীরাম চন্দ্র শিরচ্ছেদ করেছিলেন। আধুনিক কালের মানুষও তো, ডাইনি সন্দেহে মানুষকে পিটিয়ে মারছে। তবে রামচন্দ্রের কাজকে তখনকার মানুষ সমর্থন জানালেও একালের মানুষ প্রায়ই দেখা যায় প্রতিবাদে সরব হয়ে উঠছে। এই সরব হয়ে ওঠা এবং ব্যক্তিত্বের দাবি প্রতিষ্ঠা করার মধ্যেই নিহিত আছে আধুনিকতার বীজ। এই ব্যক্তিত্ব বোধ, ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্যবোধ আধুনিক যুগের ধারক ও বাহক। পুরাতন সাহিত্যের তুলনায় আধুনিক সাহিত্যে ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্য ও ব্যক্তি সত্তার স্বতস্ফূর্ত স্ফুরণ বিশেষভাবে লক্ষিত হয়। এই পরিবর্তন নিঃসন্দেহে মৌলিক ও স্বাতন্ত্র্যের দাবিদার।
এখন প্রশ্ন হল, এই ব্যক্তি স্বাতন্ত্রবোধ ব্যক্তিগত আশা প্রেম ভালোবাসা সাহিত্যে প্রকাশ লাভ করতে শুরু করল কেমনভাবে। প্রাচীন ও মধ্য যুগীয় ভাবধারাকে কীভাবে নস্যাৎ করে আধুনিক সাহিত্যের জয়যাত্রা শুরু হল ? এর উত্তরে সমালোচক তিনটি বিষয়কে আলোচনার ক্ষেত্র হিসাবে নিরূপণ করেছেন। (১) ইউরোপে ইতালিতে চতুর্দশ শতকে রেনেসাঁসের আবির্ভাব। (২) ফরাসি বিপ্লব (৩) ১৯১৭ সাল রুশ বিপ্লব।
এই তিনটি সামগ্রিক উত্থানের মধ্য দিয়ে লেখক প্রমাণ করতে চেয়েছেন, সাহিত্যে ব্যক্তিত্বের মূল্য আরোপের সঙ্গে সঙ্গে, ‘বিপ্লবী-নিয়তির’ দ্বারা আধুনিকতার শুভ সূচনা হয়েছে মধ্যযুগের শেষের দিকে। ভারতচন্দ্রের অন্নদামঙ্গলে ভিখারি শিবকে দেখে হয়তো এখনকার মানুষজন অনেকই কৌতুক অনুভব করবে, কারণ কালের অমোঘ নিয়মে ধীর ও মন্থর গতিতে সমগ্র পরিস্থিতির আমূল পরিবর্তন সংঘটিত হচ্ছে, সেই কারণে দেবতারূপী ভিখারি শিবও একালের সাহিত্যে অবান্তর মাত্র। আর এই বোধবুদ্ধির উন্মেষ ঘটেছে রেনেসাঁসের মধ্য দিয়ে।
প্রথম পর্বে চতুর্দশ শতকে ইতালিতে রেনেসাঁসের আবির্ভাবে। পুরাতন গতানুগতিক ভাবধারাকে একেবারে নস্যাৎ করে আত্মবিশ্বাসে বলীয়ান হয়ে মানুষ ঝাঁপিয়ে পড়ল নিজ সংগ্রামে ভাগ্য সূর্যকে পরিস্ফুট করার তাগিদে। এর ফলে কী সাহিত্য, কী সমাজ, কী বিজ্ঞান, কী দর্শনে সামগ্রিক দিক দিয়ে এক আলোকোজ্জ্বল পরিবেশের মধ্য দিয়ে মানুষ যাত্রা শুরু করল, আধ্যাত্মিক মানুষ পরিণত হল আধিভৌতিক মানুষে। পেত্রাক বোকাচ্চিও, রাফায়েল, গ্যালিলিয়ো, কোপারনিকাস প্রমূখ মনীষীদের আবির্ভাবে জাতীয় জীবনে এক ধর্ম নিরপেক্ষ, বিশ্ব দৃষ্টিভঙ্গির প্রবর্তন সূচিত হল।
দ্বিতীয় পর্বে ফরাসি বিপ্লবের মধ্য দিয়ে বিশ্বের সামাজিক প্রাকৃতিক পরিবেশের আমূল পরিবর্তন সাধিত হয়েছিল। দার্শনিক রুশোর সেই মূলমন্ত্র — Man is born in free but every where is in chain. এর দ্বারা মানুষ উদ্বুদ্ধ হল। অন্তরাত্মার জাগরণের পরাধীনতার শৃংখল ভেঙে স্বাধীনতা সংগ্রামে লিপ্ত হয়ে পড়ল। এতদিন ধরে মানুষের যে স্বাধীন চিন্তা ভাবনা বিশেষ এক রাজশক্তির প্রভাবে বারে বারে ব্যহত হত তা একেবারে মুক্তির ডাকে উন্মুখ হয়ে উঠল। দিদেরা, ভলটেয়ার, রুশো, হুইটম্যান প্রমুখ ব্যক্তির লেখনীর যাদু স্পর্শে সাম্য, মৈত্রী, ও মুক্তির পথ দিয়ে মানুষের সত্যকার অধিকার প্রতিষ্ঠা পেল।
তৃতীয় পর্বে ১৯১৭ সালের রুশ বিপ্লব প্রাবন্ধিকের নির্দেশিত ‘বিপ্লবী নিয়তি’র দ্বারা গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রের দ্বারোদ্ঘাটন হল। রবীন্দ্রনাথের ভাষায়—“আমরা সবাই রাজা আমাদের এই রাজার রাজত্বে।” মানুষের বিচার-বুদ্ধি, কাজ-কর্ম, চলাফেরা, প্রকাশ এই ধাক্কার দ্বারা সব মিলিয়ে সচল হয়ে তীব্র বেগে ধেয়ে যেতে লাগল। এই সূত্রে বলা যায়—“ইউরোপীয় রেনেসাঁসে উদ্বোধন ঘটেছে মানুষের মহিমা বোধের, ফরাসি বিপ্লবে ঘটেছে মানুষের অধিকারের ব্যক্তিগত ও গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠা, আর সোভিয়েত বিপ্লবে ঘটেছে মানুষের বিপ্লবী যাত্রার সূচনা।”
তাই স্বীকার করতে দ্বিধা নেই—মানুষ যে বিপ্লবী শক্তির অধিকারী, মানুষ যে নিজের নিজের প্রচেষ্টায় আপন ভাগ্য গড়ে নিতে এবং তা নিয়ন্ত্রণ করতে পারে তার সম্যক পরিচয় পাওয়া গেল ইতিহাসের এই তিনটি বড়ো রকমের অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে। ইউরোপের নবজাগরণ, ফরাসি বিপ্লব ও রাশিয়া বিপ্লব যদি না বিশ্বের দরবারে এমন সাড়ম্বরে সংঘটিত হত তাহলে মধ্যযুগীয় অভিশাপ মানব জীবনের ওপর থেকে কেমন করে অপসারিত হত তা ধারণার অতীত। যাই হোক মানব জীবনে সমাজ সভ্যতায় বিশেষ এক পরিবর্তনের জন্য বিপ্লব যে আবশ্যক বর্তমান প্রবন্ধের লেখক তা যুক্তি সহযোগে প্রমাণ করেছেন এবং এর জন্য লেখকের পান্ডিত্য কত বড়ো মাপের তা প্রমাণিত হয়েছে।
Leave a comment