৪১৯ শতকের দ্বিতীয়ার্ধের পর থেকে বাংলা নাটক রচনার ক্ষেত্রে যেমন এক প্রবল প্লাবন এসেছিল, তেমনি এই সময় থেকে বাংলার সখের নাট্যশালাতেও নবজীবন সঞ্চারিত হয়। সেই লেবেডেফের পর ধনী ব্যক্তিদের মধ্যে প্রসন্ন কুমার, নবীন বসু ও প্যারীমোহনের বাড়িতে যেসব অভিনয় হল তা অল্পকালের মধ্যেই লুপ্ত হয়ে গেল। এগুলি ছিল কোনো বিশেষ ব্যক্তির খেয়াল বা সখ চরিতার্থ করার উপায়। তাছাড়া সাধারণ দর্শকদের রুচি ও শিক্ষাদীক্ষা তখনও ঠিক স্থায়ী রঙ্গশালা গড়ে তোলার উপযুক্ত হয়নি। বাংলা নাটকের অভিনয় লেবেডেফ ও রবীন্দ্রনাথ বসু ছাড়া আর কেউ এখনও পর্যন্ত করেননি। অথচ বাংলা নাটক দেখার জন্যে দর্শকদের আগ্রহ জেগে উঠছে, কিন্তু নাটক কোথায় ? ১৮৫২ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৮৫৪-র মধ্যে কতকগুলি বাংলা নাটক লেখা হলেও সেগুলি কোথাও অভিনীত হয়েছে বলে জানা যায়নি।

১৮৫৭ সাল থেকে পুনরায় নাট্যাভিনয়ের যে ধারা সূচিত হল তার গতি অব্যাহতভাবে চলতে থাকল। নন্দকুমার রায়ের অনুবাদিত অভিজ্ঞান শকুন্তলা নাটকটির ১৮৫৭ সালে অভিনয়ের মধ্য দিয়ে এই ধারার উৎপত্তি। কলকাতার একজন প্রসিদ্ধ ব্যক্তি আশুতোষ দেবের (ছাতুবাবু) বাড়িতে এই অভিনয় হয়েছিল ৩০ জানুয়ারি সরস্বতী পূজার দিনে। এরই সঙ্গে আরও অনেক স্থানে নতুন নাটকের অভিনয় হতে থাকল। কিন্তু বাঙালি প্রতিষ্ঠিত নাট্যশালায় আর ইংরেজি নাটকের অভিনয় এক রূপ হয়নি; বা ইংরেজি নাটক অভিনয়ের জন্য বাঙালি কোনো নাট্যশালা স্থাপন করেননি। যাইহোক শকুন্তলার অভিনয় খুব ভালো হয়েছিল। যে যুবকটি তাঁর শকুন্তলার ভূমিকায় অবতীর্ণ হন তাঁর অঙ্গভঙ্গি চলাফেরা সত্যিই রমণীর মতো— অভিনয়ও চরিত্র-উপযোগী হয়েছিল। কোনো সুনিপুণ অভিনেতার কাছে শিক্ষালাভের সুযোগ না পেয়েও শুধুই শকুন্তলা চরিত্রে নয় অন্যান্য চরিত্রের অভিনয়েও তাঁরা নৈপুণ্য দেখিয়েছেন।

১৮৫৭-র ২২ ফেব্রুয়ারি ‘অভিজ্ঞান শকুন্তলা’র দ্বিতীয় বারের অভিনয়ও খুবই প্রশংসিত হয়। অভিনেতারা বক্তৃতা ও শরীরের ভঙ্গি উত্তমরূপে প্রকাশ করেন এবং শকুন্তলার অভিনয়ে তার বিচিত্র ভাবের অভিব্যক্তিতে অভিনয় খুবই আকর্ষণীয় হয়েছিল। বহু দর্শকের সমাগম হয় এবং অভিনয় সাফল্যে উৎসাহিত হয়ে তৃতীয়বার অভিনয়ের আয়োজন হয়। প্রথম ও দ্বিতীয় অভিনয়ে কে কোন্ ভূমিকা গ্রহণ করেন, সেকথা জানিয়েছেন মহেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় তাঁর স্মৃতিকথায়। বিশ হাজার টাকার অলংকারে ভূষিত হয়ে শরৎবাবু শকুন্তলার রানিবেশ দেখান, দুষ্মন্তের ভূমিকায় প্রিয়মাধব মল্লিক, দুর্বাসা—অন্নদা মুখোপাধ্যায়, অনুসূয়া—অবিনাশচন্দ্র ঘোষ, প্রিয়ম্বদা—ভুবনমোহন ঘোষ, ঋষিকুমারের ভূমিকায় ছিলেন মহেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়। শরৎবাবুর ভগ্নীপতি উমেশচন্দ্র দত্ত পেরেছিলেন Stage Manager-whistle দেওয়া, পর্দাক্ষেপণ ও পর্দা উত্তোলন-এর কাজ। কবিচন্দ্র বলে এক ব্যক্তি শকুন্তলার গানগুলি বেঁধে দিয়েছিলেন।

১৮৫৭-র ৫ সেপ্টেম্বর এই রঙ্গমঞে বাণভট্টের কাদম্বরীর উপাখ্যান অবলম্বনে ‘মহাশ্বেতা’ নাটকের অভিনয় হয়, ‘এডুকেশন গেজেট’-এ (১৮৫৭, ১৮ সেপ্টেম্বর) অভিনয়ের বিবরণ দেওয়া হয়। জানা যায় যে মনিমোহন সরকার কাদম্বরীর কাহিনির নাট্যরূপ দেন। সংগীতগুলি উৎকৃষ্ট হয়েছিল। সকলের অভিনয় উত্তম হয়নি, তবে তমলিকা, মহাশ্বেতা, কপিঞ্জলের অভিনয় ভালো হয়েছিল—বিশেষ করে কাদম্বরীর। নাট্যমঞ্চের ইতিহাসে এ থিয়েটারের অবদান কম ছিল না।