প্রশ্নঃ আলাউদ্দীন খিলজীর মূল্য নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি আলােচনা কর।

অথবা, আলাউদ্দিন খিলজীর মূল্য নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি আলােচনা কর। এ পদ্ধতি প্রবর্তনে তিনি কতখানি সফল হয়েছিলেন?

অথবা, আলাউদ্দিন খিলজীর অর্থনৈতিক সংস্কার সংক্ষেপে নিরূপণ কর।

উপস্থাপনাঃ ভারত উপমহাদেশের ইতিহাসে সুলতান আলাউদ্দিন খিলজীই একমাত্র শসিক, যিনি একটি বৈপ্লবিক অর্থনৈতিক সংস্কার কার্যসূচি প্রবর্তন করে ইতিহাসে অমর হয়ে আছেন। তার অর্থনৈতিক সংস্কারের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে ‘দ্রব্য মূল্য নিয়ন্ত্রণ’। এজন্য ঐতিহাসিক লেনপুল তাকে A great political economist বলে আখ্যায়িত করেছেন।

আলাউদ্দিন খিলজীর মল্য নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতিঃ

ক. মূল্য নিয়ন্ত্রণ বিধি প্রবর্তনের কারণঃ

১. সেনাবাহিনী পােষণঃ ঐতিহাসিক ঈশ্বরী প্রসাদ বলেন, ভারতবর্ষে পৌনঃপুনিক মােঙ্গল আক্রমণ প্রতিরােধ, অভ্যন্তরীণ গােলযােগ প্রতিহত করা এবং বিজয়াভিযান বাস্তবায়নের জন্য আলাউদ্দিন খিলজী একটি বিশাল সুনিয়ন্ত্রিত সেনাবাহিনী গঠনের প্রয়ােজনীয়তা অনুভব করেন। এ সেনাবাহিনী যাতে স্বল্প ব্যয়ে নিজেদের প্রয়ােজনীয় দ্রব্যাদি ক্রয় করতে পারে, সেজন্য তিনি Price control system প্রবর্তন করেন।

২. গণমানুষের ব্যাপক কল্যাণঃ ঐতিহাসিক লেনপুল বলেন, অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা, ব্যাপক গণমানুষের সুবিধা এবং সালতানাতের সার্বিক উন্নতির জন্য সুলতান। নিত্যপ্রয়ােজনীয় দ্রব্যাদির বাজার দর নির্ধারণ করে দেন।

৩. মুদ্রাস্ফীতিরােধঃ আলাউদ্দিন খিলজীর দাক্ষিণাত্য অভিযানে আহরিত বিপুল ধনরত্বের প্রাচুর্যে রাজকোষ পূর্ণ হয়েছিল, তাতে মুদ্রাস্ফীতি দেখা দেয়। এ মুদ্রাস্ফীতি রােধ করার জন্যও তিনি মূল্য নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি চালু করেন।

খ, পণ্যের বাজার বিন্যাসঃ সুলতান পণ্যের বাজার তিন ভাগে ভাগ করেন। যথা-

১. চাল, ডাল, তেল, লবণ প্রভৃতি ভােগ্য পণ্যের বাজার।

২. দাস-দাসী, গরু-মহিষ, ঘােড়া প্রভৃতির বাজার।

৩. কাপড়-চোপড় প্রভৃতির বাজার।

গ. প্রয়ােজনীয় দ্রব্যের মূল্য নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থাঃ

১. খাদ্যদ্রব্যের মূল্য নির্ধারণঃ আলাউদ্দিন খিলজী প্রথমত নিত্যপ্রয়ােজনীয় খাদ্যদ্রব্য চাল, ডাল, গম, চিনি, তেল ইত্যাদির মূল্য নির্ধারণ করে দেন। কোনাে ব্যবসায়ী নির্ধারিত মূল্য অপেক্ষা অধিক মূল্য দাবি করলে তাকে শাস্তি দেয়া হতাে।

২. গবাদি পশুর মূল্য নির্ধারণঃ আলাউদ্দিন খিলজী বিভিন্ন গবাদি পশুর মূল্যও নির্ধারণ করে দেন। যেমন- ভালাে তেজী অশ্ব ১২০ তঙ্কা, দ্বিতীয় শ্রেণির ৯০ তঙ্কা, তৃতীয় শ্রেণির ৭০ তঙ্কা, একটি দুগ্ধবতী ছাগল ১০, ১২ অথবা ১৪ জিতল। উল্লেখ্য ১ জিতল = বাংলাদেশী ৬ পয়সা।

৩. অন্যান্য দ্রব্যের মূল্য নির্ধারণঃ আলাউদ্দিন খিলজী শাক সবজি, ফল-ফলাদি, কাপড়, মুদি দ্রব্যাদি এমনকি সূচসহ সকল দ্রব্যের মূল্য নির্ধারণ করে দেন।

ঘ. মূল্য নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি কার্যকর করার ব্যবস্থাসমূহঃ

১. তদারকি বিভাগ গঠনঃ বাজার নিয়ন্ত্রণের জন্য শাহানা-ই-মেণ্ডি ও দিওয়ান-ই-রিয়াসাত নামক দু’জন কর্মকর্তা নিয়ােগ করেন। শাহানা শস্যসহ নিত্যপ্রয়ােজনীয় পণ্যের বাজার তদারক করতেন। দিওয়ান কাপড়-চোপড়, ভত্য, পশু ইত্যাদির বাজার নিয়ন্ত্রণ করতেন। তাদের অধীনস্ত নিম্ন পদস্থ আরাে অনেক কর্মচারী ছিল। তারা পণ্যের দাম, সরবরাহ ও ওজন তদারকি করতেন এবং এ ব্যাপারে সুলতানকে অবহিত করতেন।

২. গােয়েন্দা নিয়ােগঃ তদারকি বিভাগের কর্মকর্তা ও কর্মচারীর কার্যক্রম, বাজারের সার্বিক অবস্থা পর্যবেক্ষণ এবং অর্থনৈতিক প্রচেষ্টাসমূহ কার্যকরী হচ্ছে কিনা এজন্য গুপ্তচর নিয়ােগ করা হয়েছিল। তারা সর্বদা সুলতানের কাছে সঠিক পরিস্থিতি তুলে ধরেতেন।

৩. মজুদদারী প্রথা বিলােপঃ পণ্যদ্রব্য মজুদ করে যাতে মজুদদাররা কৃত্রিম অভাব সৃষ্টি করে মূল্য বাড়াতে না পারে তিনি তা নিরােধের ব্যবস্থা করেন। এমনকি উৎপাদনকারীরাও তাদের প্রয়ােজনের অতিরিক্ত পণ্য রাখার অধিকার পেত না।

৪. সরবরাহ সুনিশ্চিতকরণঃ পর্যাপ্ত সরবরাহের অভাবে যাতে খাদ্যশস্য নির্ধারিত মূল্য তালিকার ঊর্ধ্বে যেতে না পারে, সেজন্য তিনি খাদ্যশস্য রাজকীয় গুদামে জমা রেখে সরবরাহ সুনিশ্চিত করেন।

৫. সরকারি মজুদ ভাণ্ডার গড়ে তােলাঃ কৃষকের কাছ থেকে অর্থের বিনিময়ে রাজস্ব হিসেবে পণ্যদ্রব্য আদায় করে সেসব দ্রব্য সরকারি গুদামে মজুদ করা হতাে। বাজারে দ্রব্যের দুষ্প্রাপ্যতা সৃষ্টি হলে এ মজুদ থেকে সরবরাহ করা হতাে।

৬. শস্য বাজার স্থাপনঃ মূল্য নির্ধারণের সাথে সাথে সুলতান শস্য বাজারও স্থাপন করেন। শস্য বাজার দু’ধরনের ব্যবসায়ী দ্বারা পরিচালিত হতাে। স্থায়ী দোকানদার ও ভ্রাম্যমাণ বিক্রেতা। এ সকল বাজার থেকে জনগণ ন্যায্য মূল্যে খাদ্যশস্য কিনতে পারত।

৭. কালােবাজারী রােধঃ কোনােরূপ কালােবাজারীর কারণে যাতে সুলভ মূল্যে প্রয়ােজনীয় দ্রব্য সামগ্রী পাওয়ার ব্যবস্থা ব্যাহত না হয়, সেদিকে সরকারের দৃষ্টি নিবদ্ধ থাকত।

৮. মুনাফাখােরী নিরােধ ব্যবস্থাঃ মুনাফাখােরদের বিরুদ্ধে সুলতান কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। ব্যবসায়ীদের সরকারি চুক্তি মােতাবেক খাদ্যশস্য বাজারে আমদানি করতে হতাে। এর ব্যতিক্রম ঘটলে তাদের পরিবার পরিজনকে যিম্মি স্বরূপ আটক রাখা হতাে।

৯. শিল্প খাতে ঋণদানঃ শিল্প অর্থনীতির দিক বিবেচনা করে আলাউদ্দিন খিলজী উন্নতমানের বস্ত্র উৎপাদন ও সরবরাহে সুবিধাদানের জন্য ব্যবসায়ী শিল্পপতিদের ঋণ দান করেন।

১০. ব্যবসায় বাণিজ্যের ক্ষেত্রে কঠোর আদেশঃ ব্যবসায়ীরা যাতে ব্যবসায়ে কোনাে অসদুপায় অবলম্বন করতে না পারে সেদিকে কঠোর দৃষ্টি রাখা হতাে। তিনি ওজনে কমদানকারীর সমপরিমাণ মাংস তার শরীর থেকে কেটে নেয়ার আদেশ জারি করেন।

১১. ছাড়পত্র প্রদানঃ ঐতিহাসিক কে. এস. লাল বলেন, আলাউদ্দিন খিলজী সিল্ক, ব্রোকেড প্রভৃতি মূল্যবান বস্ত্র ক্রয়-বিক্রয়ের জন্য ব্যবসায়ীদের ছাড়পত্র প্রদান করেন এবং ছাড়পত্র ব্যতীত ব্যবসায় বাণিজ্য নিষিদ্ধ করেন।

১২. পরিবহন ব্যবস্থার নিশ্চয়তাঃ সুলতান পণ্য পরিবহন ব্যবস্থারও সুষ্ঠু নিশ্চয়তা প্রদান করেন। পণ্য পরিবহনকারীদের নাম তালিকাভুক্ত করে পণ্য পরিবহনে তাদের সর্ববিধ সুবিধা দেয়া হতাে।

১৩. গুপ্তচর প্রথার প্রচলনঃ অর্থনৈতিক প্রচেষ্টাসমূহ যথাযথ কার্যকর হচ্ছে কিনা তা নিরীক্ষার জন্য আলাউদ্দিন খিলজী একটি শক্তিশালী গুপ্তচর বাহিনী গঠন করেন।

১৪. রেশনিং প্রথাঃ প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময় আলাউদ্দিন খিলজী সরকারিভাবে রেশনিং প্রথা চালু করেন। কে. এস. লাল বলেন- The system of rationing was a novel idea of Alauddin Khiliy.

মূল্য নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতির সাফল্যের কারণঃ মূল্য নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি সাফল্যের অন্যতম কারণ হলাে, এ ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছিল এবং এর বিধি লঙ্ঘনের জন্য কঠিন শাস্তি দেয়া হতাে। দুই রাজ কর্মচারীর পাশাপাশি সুলতান নিজেও রাজার তদারকি করতেন। মােট কথা, কর্মকর্তা, কর্মচারী, ব্যবসায়ীদের সততা ও সহযােগিতার মনােভাবই হলাে সাফল্যের অন্যতম কারণ।

মূল্য নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতির ফলাফলঃ

১. দ্রব্যসামগ্রী সহজলভ্য হয়ঃ মূল্য নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতির ফলে প্রয়ােজনীয় দ্রব্যসামগ্রী জনগণের ক্রয় ক্ষমতার মধ্যে ছিল এবং চরম অসুবিধার সময়ও তারা সবকিছু হাতের নাগালে পেত।

২. জনগণ আকৃষ্ট হয়ঃ এ পদ্ধতির সফল বাস্তবায়নে জনগণের জীবনযাত্রার মান উন্নত হয়। তারা সুলতানের প্রতি কৃতজ্ঞ এবং তার বিভিন্ন কর্মসূচির প্রতি উৎসাহিত হয়।

৩. সেনাবাহিনীর দক্ষতা ও ক্ষমতা বৃদ্ধিঃ মূল্য নিয়ন্ত্রণের ফলে খিলজীর পক্ষে এক বিরাট সেনাবাহিনী পরিচালনা করা সম্ভব হয়েছিল। ড, ঈশ্বরী প্রসাদের মতে, “সেনাবাহিনীর ক্ষমতা এবং দক্ষতা বৃদ্ধি করে মােঙ্গল আক্রমণ প্রতিরােধ এবং রাজা ও সামন্ত নেতাদের বিদ্রোহ নিয়ন্ত্রণে রাখার মধ্য দিয়ে আলাউদ্দিন খিলজী গৃহীত সংস্কারের সাফল্যজনক পরিসমাপ্তি ঘটে।”

উপসংহারঃ দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি অর্থনীতিতে আলাউদ্দিন খিলজীর একটি মৌলিক সংযােজন। অর্থনৈতিক সংস্কারের জন্য ভারত উপমহাদেশের ইতিহাসে তিনি চিরস্মরণীয় হয়ে আছেন। তার মূল্য নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতির প্রশংসায় ঐতিহাসিক বারানী বলেন The unvarying price of grain in the markets was looked upon as one of the wonders of the time.