মোঙ্গল আক্রমণ: উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত নীতি
আলাউদ্দিন খলজি সিংহাসনে আরোহণের প্রায় সঙ্গে সঙ্গে উত্তর-পশ্চিম সীমান্তে মোঙ্গলদের আক্রমণজনিত সমস্যার সম্মুখীন হন। ১২৯৬ থেকে ১৩০৮ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে প্রায় বাৎসরিক অনুষ্ঠানের মতো মোঙ্গলরা দিল্লি, পাঞ্জাব, মুলতান, সিন্ধু এবং গঙ্গা-যমুনা-দোয়াব অঞ্চলে উপর্যুপরি আক্রমণ চালায়। ইতিপূর্বে গিয়াসুদ্দিন বলবন উত্তর-পশ্চিম সীমান্তের নিরাপত্তার জন্য কিছু স্থায়ী ব্যবস্থা নিয়েছিলেন। তা ছাড়া, মধ্য-এশিয়ার রাজনীতির উত্থানপতনের সূত্রে মোঙ্গলদের আক্রমণে কিছুটা শিথিলতা এসেছিল। ইরানের ‘ইলখান’ মোঙ্গলদের সাথে দিল্লি-সুলতানির মোটামুটি একটা গুরুত্বপূর্ণ সম্পর্ক ছিল। ইলখানদের প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল ট্রান্স অক্সিয়ানার চাঘতাই মোঙ্গলরা। এদের নেতা দবা খান মধ্য-এশিয়ার যুদ্ধে ইলখানদের বিরুদ্ধে সাফল্য না পাওয়ার জন্য ভারতের দিকে আক্রমণ চালাতে শুরু করে। অবশ্য আলাউদ্দিন প্রায় প্রতিটি আক্রমণই অত্যন্ত দক্ষতার সাথে প্রতিহত করেন।
১২৯৬ খ্রিস্টাব্দের শেষদিকে কদর খাঁর নেতৃত্বে প্রায় এক লক্ষ মোঙ্গল সেনা উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত দিয়ে দিল্লির দিকে এগিয়ে আসে। আলাউদ্দিনের বিশ্বস্ত অনুচর জাফর খাঁ জলন্ধরের কাছে মোঙ্গলদের বাধা দেন এবং বহু মোঙ্গলসেনাকে হত্যা করে সুলতানি-বাহিনীর মর্যাদা বৃদ্ধি করেন। পরের বছরেই সালদির নেতৃত্বে মোঙ্গলরা আবার আক্রমণ চালায় এবং দিল্লির নিকটবর্তী শিরিদুর্গ দখল করে নেয়। এবারেও জাফর খাঁ মোঙ্গলদের পরাজিত ও বিতাড়িত করেন। মোঙ্গল সেনাপতি সালদিসমেত প্রায় সতেরশো মোঙ্গলকে বন্দি করে তিনি দিল্লিতে পাঠিয়ে দেন।
১২৯৯ খ্রিস্টাব্দের শেষদিকে দবা খাঁর পুত্র কুতলঘ খাজার নেতৃত্বে প্রায় দু-লক্ষ মোঙ্গল সেনা দিল্লি আক্রমণ করে। এবারে মোঙ্গলদের লক্ষ্য ছিল নিছক লুণ্ঠন নয়, দিল্লির রাজনৈতিক কর্তৃত্ব দখল করা। তাই তারা দিল্লি আসার পথে লুঠতরাজ বা ধ্বংসকার্য থেকে বিরত থাকে। মোঙ্গল সেনারা দিল্লির সাথে পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দিতে সক্ষম হয়। এমনকি নগরের কোনো কোনো রাস্তাতেও তারা প্রবেশ করে। সুলতান আলাউদ্দিন এবারে বেশ সংকটের মধ্যে পড়েন। দিল্লির কোতোয়াল আলাউলমুল্ক তাঁকে পরামর্শ দেন মুখোমুখি যুদ্ধের পরিবর্তে কূটকৌশলে কাল হরণ করার। কিন্তু অসমসাহসী আলাউদ্দিন তাকে স্পষ্ট জানিয়ে দেন যে, “চ্যালেঞ্জের মোকাবিলা না-করে দিল্লির রাজত্ব চালানো যায় না।” আলাউদ্দিন দিল্লিনগরী ও প্রাসাদের দায়িত্ব কোতোয়ালের ওপর অর্পণ করে যুদ্ধযাত্রার প্রস্তুতি নেন। যাওয়ার আগে কোতোয়ালকে ব্যঙ্গ করে বলে যান, “দিল্লির চাবি রইল। যে বিজয়ী হবে তার হাতে তুলে দেবেন এবং বিশ্বস্ততার সাথে তারই সেবা করবেন।”
জাফর খাঁ, নুসরৎ খাঁ, উলুঘ খাঁ, আকৎ খাঁ প্রমুখকে নিয়ে আলাউদ্দিন কিলিতে মোঙ্গলদের মুখোমুখি হন। আলাউদ্দিন সেনাপ্রতিরোধ তৈরি করে যথার্থ সময়ের জন্য সেনাপতিদের অপেক্ষা করার নির্দেশ দেন। কিন্তু ধৈর্যচ্যুত হয়ে জাফর খাঁ সুলতানের অনুমতি ছাড়াই এক কোণ দিয়ে মোঙ্গলদের আক্রমণ করেন। বহু মোঙ্গলকে হত্যা করলেও তিনি নিজে মোঙ্গলদের হাতে নিহত হন। এর দুদিন পর বাকি মোঙ্গল সেনা ও কুলতঘ খাজা যুদ্ধ না করেই স্বরাজ্যে ফিরে যান। আলাউদ্দিনের সাহস ও দৃঢ়তা বিরাট সংকট থেকে সুলতানি সাম্রাজ্যকে রক্ষা করে। অবশ্য জাফর খাঁর মৃত্যুতে আলাউদ্দিন কিছুটা খুশিই হন। কারণ মোঙ্গলদের বিরুদ্ধে জাফরের ধারাবাহিক সাফল্য তাঁর উচ্চাকাঙ্ক্ষা যেমন বৃদ্ধি করেছিল; তেমনি যোগ্য ব্যক্তি হিসেবে জনগণের মনেও তাঁর একটা রোমান্টিক ভাবমূর্তি অঙ্কিত হচ্ছিল, যা আলাউদ্দিনের অভিপ্রেত ছিল না। তিন বছর বিরতির পর ১৩০৩ খ্রিস্টাব্দে মোঙ্গল নেতা তারঘা আবার ভারত আক্রমণ করে দিল্লিতে ঢুকে পড়েন। এই সময় আলাউদ্দিন চিতোরজয়ে ব্যস্ত ছিলেন। মোঙ্গল আক্রমণের সংবাদ পেয়ে তিনি দ্রুত ফিরে আসেন এবং মোঙ্গলদের সাথে যুদ্ধে লিপ্ত না হয়ে সিরিদুর্গে প্রবেশ করে আত্মরক্ষামূলক প্রতিরোধের সিদ্ধান্ত নেন। সম্ভবত, চিতোর ও তেলেঙ্গানা যুদ্ধের ক্ষয়ক্ষতি সামলে তৎক্ষণাৎ মোঙ্গলদের সাথে যুদ্ধে লিপ্ত হবার মতো যথেষ্ট শক্তি সুলতানের ছিল না। যাই হোক্, এই সময় মোঙ্গল সেনাদের অত্যাচারে সাধারণ মানুষের খুবই কষ্ট হয়। দু-মাস এইরকম চলার পর মোঙ্গলরা স্বদেশে ফিরে যায়। বারাণী লিখেছেন : “দিল্লির দরিদ্র জনসাধারণের কাতর আবেদন এবং সত্ত নিজামউদ্দিন আউলিয়ার প্রার্থনার ফলে মোঙ্গলরা দিল্লি ছেড়ে যেতে রাজি হয়েছিল।” কিন্তু ড. কে. এস. লাল মনে করেন, আলাউদ্দিনের নিষ্ক্রিয় প্রতিরোধ মোকাবিলার জন্য অনির্দিষ্টকাল দিল্লিতে থাকা দরকার ছিল। কিন্তু মধ্য-এশিয়া থেকে বেশিদিন বাইরে থাকা মোঙ্গলবাহিনীর পক্ষে সম্ভব ছিল না। তাই তারা ভারত ত্যাগ করে ফিরে যেতে বাধ্য হয়েছিল।
মোঙ্গলদের প্রতিটি আক্রমণ প্রতিহত করতে পারলেও তাদের অবাধে দিল্লির বুক পর্যন্ত ঢুকে পড়ার ঘটনায় আলাউদ্দিন কিছুটা চিন্তিত হন। এতদিন তিনি কেবল মোঙ্গলদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধমূলক যুদ্ধ করেছেন। এবার তিনি নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা হিসেবে সীমান্তবর্তী দুর্গগুলির সংস্কারসাধন এবং নতুন নতুন দুর্গ নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেন। দুর্গগুলির সৈন্যসংখ্যা বৃদ্ধি করেন এবং আক্রমণের মুহূর্তে দ্রুত সাহায্যদানের উদ্দেশ্যে দিল্লিতে একটি বিশেষ বাহিনী মোতায়েন রাখেন। এই কাজ তত্ত্বাবধানের জন্য একটি নতুন পদ সৃষ্টি করেন।
আলাউদ্দিনের প্রতিরক্ষামূলক ব্যবস্থা সত্ত্বেও মোঙ্গল আক্রমণ অব্যাহত থাকে। ১৩০৫ খ্রিস্টাব্দে আলিবেগ এবং তারতাক্-এর নেতৃত্বে মোঙ্গলরা পাঞ্জাবের পথ ধরে ধ্বংসকার্য চালাতে চালাতে আমরোহা পর্যন্ত ঢুকে পড়ে। অবশ্য গাজি মালিক এবং মালিক কাফুরের নেতৃত্বে সুলতানি-বাহিনী মোঙ্গলদের পরাজিত করে। দুই নেতাসহ বহু মোঙ্গল সৈন্য বন্দি হয়। সুলতানের নির্দেশে আলিবেগ ও তারাতাক্’-কে হাতির পায়ে পিষ্ট করে হত্যা করা হয় এবং বন্দি-সেনাদের ছিন্ন মুগুগুলিকে গম্বুজের আদলে শিরির দুর্গের ওপর সাজিয়ে দেওয়া হয়। এই সময় আলাউদ্দিন গাজি মালিককে পাঞ্জাবের প্রশাসক নিযুক্ত করেন। দক্ষ ও বিশ্বস্ত এই সেনানায়ক অতঃপর সাফল্যের সাথে মোঙ্গল আক্রমণগুলি প্রতিহত করেন।
১৩০৫ খ্রিস্টাব্দের বিপর্যয়ের প্রতিশোধ নেবার উদ্দেশ্যে পরের বছরেই (১৩০৬ খ্রিঃ) বিশাল মোঙ্গলবাহিনী দু-দিক দিয়ে ভারত আক্রমণ করে। কুবাক-এর নেতৃত্বে মোঙ্গলদের একটি দল রাভী নদীর তীরে উপস্থিত হয়। ইকবালমন্দ-এর নেতৃত্বে দ্বিতীয় দলটি উপস্থিত হয় নাগৌরে। এবারেও গাজি মালিক ও মালিক কাফুর মোঙ্গলদের বিরুদ্ধে অগ্রসর হন এবং তাদের পরাজিত করেন। কুবাক বন্দি হন। ইকবালমন্দ কোনোক্রমে পালিয়ে প্রাণ বাঁচান। এবারেও সুলতানি বাহিনীর হাতে বহু মোঙ্গল সেনা ও তাদের স্ত্রী-পুত্র (যুদ্ধের সময় মোঙ্গলরা সপরিবারে থাকত) বন্দি হয়। নারী ও শিশুদের দাস হিসেবে বিক্রি করা হয় এবং সেনাদের হত্যা করে তাদের ছিন্নমুণ্ডগুলিকে বদাউন গেটের কাছে গম্বুজাকারে সাজিয়ে দেওয়া হয়। আলাউদ্দিনের আমলে মোঙ্গলদের শেষ আক্রমণ ঘটে ১৩০৭ ১৩০৮ খ্রিস্টাব্দে। ইকবালমন্দের নেতৃত্বে মোঙ্গলরা সিন্ধুর তীরে উপস্থিত হওয়ামাত্র সুলতানি-বাহিনী তাদের ঘিরে ধরে। ইকবালমন্দ নিহত হন। বহু মোঙ্গল সেনাকে বন্দি করে দিল্লি এনে হত্যা করা হয়। এখন থেকে কুতুবউদ্দিন মোবারকের আমল পর্যন্ত মোঙ্গলরা ভারতের বিরুদ্ধে কোনো অভিযান পাঠায়নি।
আলাউদ্দিন খলজির অনমনীয় দৃঢ়তা এবং মধ্য-এশিয়ার রাজনৈতিক অস্থিরতা মিলিতভাবে অন্তত কয়েক বছরের জন্য ভারতের উত্তর-পশ্চিম সীমান্তকে কিছুটা শান্তি দিয়েছিল। পশ্চিম ও মধ্য-এশিয়ার শাসকরা তখন মোঙ্গলদের প্রতিহত করে স্বীকার করেন যে, সুলতানি সেনাবাহিনীর সমরদক্ষতা মধ্য এশীয় দেশগুলির থেকে কম তো নয়ই, বরং বেশি। তাই আলাউদ্দিনের আমলে মোঙ্গলরা ভারত আক্রমণের ব্যাপারে যথেষ্ট দ্বিধাগ্রস্ত ছিল। ১৩০৬ খ্রিস্টাব্দে মোঙ্গল-নেতা দাবা খাঁর মৃত্যু তাদের মনোবল আরও ভেঙে দেয়। অতঃপর চাঘতাই মোঙ্গলদের নেতৃত্বের প্রশ্নে অস্থিরতা দেখা দেয়। তাই বহির্দেশে আক্রমণ সংগঠিত করা থেকে তারা বিরত থাকে। অবশ্য আলাউদ্দিনের সামরিক শক্তির প্রাধান্য ছিল মোঙ্গলদের পিছু হটার প্রধানতম কারণ। ড. লাল (K. S. Lal) লিখেছেন : “The Mongol menace which had made his predecessors tremble on their throne was put to an end by him (Alauddin).” বারাণী ও ফেরিস্তা এ ব্যাপারে পাঞ্জাবের শাসনকর্তা গাজি-মালিকের ভূমিকার প্রশংসা করেছেন। মধ্য-এশিয়ায় মোঙ্গলদের অন্তর্দ্বন্দ্বের সুযোগে গাজি-মালিক দীপালপুরে সর্বক্ষণের জন্য একটি শক্তিশালী বাহিনী মোতায়েন রেখে এবং কাবুল, গজনি, কান্দাহার প্রভৃতি স্থানে বারবার অভিযান চালিয়ে ওই সকল অঞ্চল থেকে অর্থ সংগ্রহ করে মোঙ্গলদের মনোবল অনেকটা ভেঙে দিতে সক্ষম হন।
মোঙ্গল আক্রমণের সম্ভাব্যতা ও ভীতি দ্বারা আলাউদ্দিনের রাষ্ট্রনীতি গভীরভাবে প্রভাবিত হয়েছিল। যেমন—–(১) মোঙ্গল আক্রমণ প্রতিহত করার জন্য আলাউদ্দিন বিশালসংখ্যক ও শক্তিশালী একটি সামরিক বাহিনী গড়ে তুলতে বাধ্য হন। এই বাহিনী দ্বারা উত্তর-দক্ষিণ ভারতে সাম্রাজ্য বিস্তারের কাজ সহজ হয়। (২) বিশাল সামরিক বাহিনীর ব্যয় মেটানোর জন্য প্রয়োজন হয় অতিরিক্ত অর্থের। এজন্য তিনি রাজস্ব ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন করেন। নতুন নতুন কর আরোপ করে এবং প্রচলিত করের হার বৃদ্ধি করে রাজকোষকে স্ফীত করতে বাধ্য হন। (৩) সেনাবাহিনীর জীবনযাত্রার মান বজায় রাখার জন্য নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদির দাম তিনি নির্দিষ্ট করে দিতে বাধ্য হন। (৪) মোঙ্গলদের বিরুদ্ধে আলাউদ্দিনের ধারাবাহিক সাফল্য তাঁর মর্যাদা ও প্রতিপত্তি দারুণভাবে বৃদ্ধি করে। পরাজিত মোঙ্গল সেনাদের নৃশংসভাবে হত্যা করে এবং তাদের স্ত্রী-পুত্রদের দাস হিসেবে বিক্রি করে আলাউদ্দিন জনমনে সুলতান সম্পর্কে এমন একটা ভীতির ভাব গড়ে দেন, যার ফলে সুলতানের বিরুদ্ধে যে কোনো ধরনের আন্দোলনের সম্ভাবনা হ্রাস পায়। (৫) সর্বোপরি, মোঙ্গল আক্রমণ রোধ এবং সাম্রাজ্যবাদী কর্মসূচি রূপায়ণকে সুলতান পরিস্থিতির প্রেক্ষিতে গুরুত্ব দেন। কিন্তু এর ফলে দেশবাসীর নৈতিক ও বৈষয়িক উন্নয়নের দিকটি অবহেলিত থেকে যায়। পরিকাঠামো সংস্কার ও উন্নয়নের কাজে শৈথিল্য থাকার ফলে পরবর্তী দুর্বল শাসকদের আমলে আইন-শৃঙ্খলার অবনতি ঘটে। সীমান্তের নিরাপত্তা ও সামরিক বাহিনীর ভরণপোষণের চাপ সুলতানি অর্থব্যবস্থাকে কিছুটা ভারসাম্যহীন করে দেয়। ফলে অসামরিক বৃহত্তর জনগোষ্ঠী আর্থিক দুর্গতির সম্মুখীন হয়।
Leave a comment