“আমি পরশুরামের কঠোর কুঠার,
নিঃক্ষত্রিয় করিব বিশ্ব, আনিব শান্তি শান্ত উদার”- পরশুরাম কে? তাঁর কুঠারকে কঠোর বলা হয়েছে কেন? বিশ্বকে নিঃক্ষত্রিয় করার কথা তিনি কেন বলেছেন?

বিষ্ণুর ষষ্ঠ অবতার হিসাবে পরশুরাম পৃথিবীতে অবতীর্ণ হন। তাঁর পিতা ছিলেন জমদগ্নি এবং মাতা রেণুকা। ক্রোধী ঋষি হিসাবে পরশুরামের খ্যাতি ছিল। তিনি পিতার আদেশে তাঁর মাতাকে হত্যা করেন। পরে অবশ্য পিতৃ আজ্ঞা পালনের জন্য যে বর পান তাতে মাতার পুনর্জীবন, নিজের পাপের স্খালন এবং মাতৃহত্যার স্মৃতি ভুলে যাবার বর প্রার্থনা করে নেন।

পরশুরামের প্রধান অস্ত্র ছিল কুঠার। সেইজন্যই সম্ভবত তাঁর নাম হয়েছে পরশু (অর্থাৎ কুঠার) রাম। এই কুঠারকে কঠোর বলার কারণ, তিনি কুঠার দিয়ে অনেক নৃশংস হত্যাকাণ্ড সংঘটিত করেছিলেন। প্রধানত ক্ষত্রিয় বংশ নির্মূল করার কাজে এই কুঠার ব্যবহৃত হয়েছিল। সে হিসাবে এই কুঠারের প্রথম বলি রাজা কার্তবীর্য। জমদগ্নি ঋষির অনুপস্থিতিতে একবার কার্তবীর্য তাঁর আশ্রমে আসেন। রেণুকা যথাবিহিত আপ্যায়ণে কার্তবীর্য এবং পুত্রদের সন্তুষ্ট করলেও কার্তবীর্য হোমধেনুর বস হরণ কনের এবং আশ্রমের অনেক ক্ষতি করেন। পরশুরাম এই সংবাদ পেয়ে কার্তবীর্যের সহস্র বাহু ছেদ করে তাঁকে হত্যা করেন।

পরে অবশ্য কার্তবীর্যের পুত্ররা এর প্রতিশোধ নেয়। তাদের হাতে জমদগ্নি নিহত হন। প্রচণ্ড রোষে ক্ষিপ্ত হয়ে পরশুরাম প্রতিজ্ঞা কনের ক্ষত্রিয় বংশ তিনি নির্মূল করবেন। তাঁর সবল হাতের বলিষ্ঠ কুঠারে শুধু যে কার্তবীর্যের পুত্রগণ এবং তাদের অনুচরেরা মৃত্যুবরণ করে তাই নয়, পৃথিবীকে একশোবার তিনি ক্ষত্রিয়শূন্য করেন। সমস্ত ক্ষত্রিয়ের রক্তে সমস্ত পঞ্চক প্রদেশে যে পাঁচটি রক্তময় হ্রদ সৃষ্টি হয় তাতে তিনি তাঁর পিতৃপুরুষদের তর্পণ করেন। পৃথিবীকে ক্ষত্রিয়শূন্য করবার কাজে তাঁর প্রধান সহায়ক ছিল এই কুঠার, তাই তাঁর কুঠারকে বলা হয়েছে কঠোর।

নিজেকে পরশুরামের কুঠারের সঙ্গে তুলনা করে এবং বিশ্বকে নিঃক্ষত্রিয় করবার অভিপ্রায় জ্ঞাপন করে কবি তাঁর কবিতার এবং অংশে নিজের মানসপ্রবণতা সংগুপ্ত রাখতে পারেননি।

গত যুগের মতো এই যুগে বর্ণাশ্রম ব্যবস্থা নেই, ক্ষত্রিয় শ্রেণির সেই কঠোর বিভাগও আর নেই—কিন্তু রণহুংকার এবং রণসজ্জার সেই ক্ষত্রিয় বৃত্তি আধুনিক কালেও যায় নি। কবির নিশ্চয়ই এখানে প্রধান লক্ষ্য রণমদেমত্ত ব্রিটিশ জাতি। পৃথিবীর বিভিন্ন জায়গায় উপনিবেশ স্থাপন করে সে দিকে দিকে তাঁর অধিকারের মাত্রা বাড়াচ্ছে। দুর্বল, ভীরু জাতির স্বাধীনতা কেড়ে নেবার জন্য সে বাড়িয়ে দিচ্ছে তার রক্তাক্ত থাবা। এই অধিকার বজায় রাখবার জন্য সে যুদ্ধসাজে পৃথিবীতে হুংকার দিচ্ছে—অস্ত্রশস্ত্রের দাপটে সে পৃথিবীতে মহাবিভীষিকা জাগিয়ে রেখেছে। কবির বক্তব্য, এই যুদ্ধলিপ্সু জাতিকে তিনি নির্মূল করবেন। দুর্বল ভারতবাসীর ওপর তাদের নারকীয় অত্যাচারের তাণ্ডব আর তিনি চালাতে দেবেন না। এই রণ-উন্মাদ জাতিকে নির্মূল করতে পারলেই ভারতবাসী মাথা তুলে বাঁচবে, সমস্ত পৃথিবী স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলবে—পৃথিবীতে শান্তি পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হবে।