“আমি একদিনও না দেখিলাম তারে। আমার বাড়ীর কাছে আরশী নগর, সেথায় এক পড়শী বসত করে।”
উত্তর: বাউল মত ও সাধনার শ্রেষ্ঠ ভাষ্যকার লালন শাহ। মরমি এ সাধককে বাউলগানের মহত্তর জনক বললেও অত্যুক্তি হয় না। অতুলনীয় সংগীত প্রতিভা ও তত্ত্বজ্ঞানের সমন্বয়ে তিনি বাউলগানের একটি স্বতন্ত্র ঘরানা নির্মাণ করতে সক্ষম হয়েছিলেন। সমালোচক ড. অসিত কুমার বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতে,
“রবীন্দ্রনাথ লালন ফকিরের বাউলগানের সংস্পর্শে এসে মুগ্ধ হন, প্রধানত তাঁর জন্যই লালন শাহ ফকিরের নাম বাউল সম্প্রদায়ের সংকীর্ণ সীমা ছাড়িয়ে আধুনিক শিক্ষিত সমাজে প্রচার লাভ করেছে, তাঁর গানগুলো নানাজনে সংগ্রহ করেছেন। ………….. তাঁর উপর নানা ধরনের গবেষণা হচ্ছে।” [বাংলা সাহিত্যের সম্পূর্ণ ইতিবৃত্ত।
অন্যদিকে ‘হিতকরী’ পত্রিকা সূত্রে জানা যায়, “নিজে লেখাপড়া জানিতেন না; কিন্তু তাঁহার রচিত অসংখ্য গান শুনিলে তাঁহাকে পরম পণ্ডিত বলিয়া বোধহয়। তিনি কোনো শাস্ত্রই পড়েন নাই; কিন্তু ধর্মালাপে তাঁহাকে বিলক্ষণ শাস্ত্রবিদ বলিয়া বোধ হইত। বাস্তবিক ধর্ম-সাধনে তাঁহার অন্তর্দৃষ্টি খুলিয়া যাওয়ায় ধর্মের সারতত্ত্ব তাঁহার জানিবার অবশিষ্ট ছিল না। ……………. যাহা হউক তিনি একজন পরম ধার্মিক ও সাধু ছিলেন, তৎসম্বন্ধে কাহারও মতদ্বৈধ নাই।”
লালন সম্বন্ধে একজন গবেষক এভাবে মত প্রকাশ করেছেন, “সত্যি তিনি তাঁর ব্যক্তিগত সাধনা, চর্চা, অনুশীলন ও উপলব্ধির দ্বারা বাউলসাধনাকে সর্বোচ্চ বিকাশের পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছিলেন। তাঁর কবিত্ব, ভক্তি এবং অসাম্প্রদায়িক মনোবৃত্তির জন্য বাউলদের মধ্যে তিনি সর্বাধিক নন্দিত ব্যক্তি।”
লালন শাহের জীবনদর্শন আলোচনায় দেখা যায় তিনি সৃষ্টি ও স্রষ্টা, মানবজীবন ও মৃত্যুকে কিভাবে দেখেছেন এবং গানের ভাষায় ও সুরে কিভাবে রূপ দিয়েছেন, তার মধ্যেই তাঁর দর্শন নিহিত আছে। তাঁর গানগুলো একাধারে তত্ত্বকথা, গীতি ও কবিতা। দীর্ঘজীবী লালন প্রায় পৌনে এক শতাব্দী ধরে গান রচনা করেছেন। তাঁর গানের সঠিক সংখ্যা নির্ণয় সম্ভব নয়। কেউ কেউ অনুমান করেন তা হাজারের কোঠা ছাড়িয়ে যাবে। মুহম্মদ আব্দুল হাই ও মুহম্মদ মনসুর উদ্দীন সম্পাদিত ‘হারামণি’ ৫ম খণ্ডে লালনগীতি শিরোনামে লালনের ২৫৫টি গান বিভিন্নভাবের অন্ত র্ভুক্ত করে সংকলিত হয়েছে। ভাবগুলো হলো: হামদ, নাত, আত্মতত্ত্ব, মনস্বত্ব, মনের মানুষ, গুরুতত্ত্ব, দেহতত্ত্ব, প্রেমতত্ত্ব, খোদাতত্ত্ব, মুরশিদি, সৃষ্টিতত্ত্ব, নবীতত্ত্ব, সেজদা, মারফতি, ইসলামি, দেহ সাধন প্রভৃতি। এছাড়া বিশুদ্ধ বৈষ্ণব ভাবে রাধাকৃষ্ণের কথা নিয়ে তিনি গান রচনা করেছেন। কোথাও বা গৌরাঙ্গ বিষয়ক গানে আত্মনিয়োগ করেছেন; আবার কোথাও লালন সুফিতত্ত্বের গভীরে ডুব দিয়ে ইসলামি ভাবধারার সত্য সন্ধানে ব্রতী হয়েছেন।
লালন শাহের প্রতিটি গানেই কোনো বা কোনো ভাব, দর্শন, বক্তব্য ও অভিপ্রায় ব্যক্ত হয়েছে। মুহম্মদ আবদুল হাই ও ড. আহমদ শরীফ সম্পাদিত ‘মধ্যযুগের বাঙলা গীতিকবিতা’ সঙ্কলনের ‘বাউল পদাবলী’র অন্তর্গত ২নং গানে লালন আল্লাহর একত্ববাদ সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে বলেছেন,
‘নামটি লা শরিকালা,
সবার শরিকা সেই একেলা।
আপনি তরঙ্গ আপনি ভেলা’,
এখানে বলা হয়েছে আল্লাহ সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী, বিশ্বজগতের স্রষ্টা।
‘দেহতত্ত্ব’ নিয়ে লালন শাহের অসংখ্য গান আছে। দেহের মধ্যে তিনি একদিকে যেমন মনের মানুষরূপী ঈশ্বরকে খুঁজেছেন অচিন পাখি রূপকে, অন্যদিকে তেমনি দেহের বিশ্লেষণও করেছেন। যেমন-
খাঁচার ভিতর অচিন পাখি কেমনে আসে যায়।
ধরতে পারলে মন বেড়ী দিতাম তাহার পায় ।। (পদ- ১৩)
নিজের আত্মার পরিশুদ্ধি ও পরিচয়ই খোদাপ্রাপ্তির উপায়, তাই আত্মার স্বরূপ উপলব্ধির সাধনাই বাউলদের ব্রত। জীবনের পরম ও চরম সাধনা হচ্ছে খোদাকে চেনা। বাউলের রূপক অভিব্যক্তিতে সে পরমাত্মা হচ্ছেন-মনের মানুষ, অটল মানুষ, অধর মানুষ, মানুষ রতন, পড়শী, মনমনুরা, অচিন পাখি, অলখসাঁই প্রভৃতি। বাউল রচনা সাধারণত রূপকের আবরণে আচ্ছাদিত। সে রূপক দেহাধার, বাহ্যবস্তু ও ব্যবহারিক জীবনের নানাকর্ম ও কর্মপ্রচেষ্টা থেকে গৃহীত। দেহের আধারে যে চৈতন্য, সে-ই তো আত্মা। এ নিরাকার আত্মার স্বরূপ জিজ্ঞাসা শরীরতত্ত্বে মানুষকে করেছে কৌতূহলী। বাউলগানে জগৎ ও জীবনের সৃষ্টিও স্রষ্টার গভীরতর রহস্য ও তত্ত্ব সহজভাবে উদঘাটিত হয়েছে। যে পড়শী বহুকাল থেকে বাস করে দেহে, এত কাছে থাকার পরও সেই পড়শীর সন্ধান মানুষ পায় না। সেই পড়শীকে একদিনও দেখা গেল না। আত্মারূপে পরমাত্মা বিরাজ করে। কাছে থাকে, দেখা যায় না, ধরা যায় না, তাই ক্ষোভ লালন তাঁর গানে এ মানবদেহকে কখনো ‘ঘর’ কখনো খাঁচা’ আবার কখনো ‘আরশি নগর’ নামে অভিহিত করেছেন। দেহ ঘরের বসতির পরিচয় সন্ধানে ব্যাকুল লালনের উচ্চারণ,
‘আমার বাড়ীর কাছে আরশী নগর,
এক পড়শী বসত করে।
আমি একদিনও না দেখিলাম তারে’।। (পদ-৫)
দেহ বিচারের মাধ্যমে নিজেকে চিনতে আর জানতে পারলেই সেই পরমপুরুষের সন্ধান লাভ সম্ভব। লালন তাই ‘আত্মতত্ত্ব’ জেনে তাকে নিজ দেহ ঘরে খোঁজার পরামর্শ দিয়েছেন। তাঁকে বাইরে খুঁজে কোনো ফল হবে না। কেননা,
‘আত্মারূপে সেই অধর
সঙ্গী অংশ কলা তার-
ভেদ না জেনে
বনে বনে
‘ফিরলে কি হয়।’ (পদ-৮)
মনের মানুষের সন্ধান, সাহচর্য ও মিলনের জন্য লালনের মন ব্যাকুল ও উৎকণ্ঠিত। কিন্তু হীন সাধন গুণে তাঁকে পেয়েও পাওয়া যায় না। সাধনা সিদ্ধি হয় না বলে,
সে আর লালন একখানে রয়,
তবু লক্ষ যোজন ফাঁক রে। (পদ-৫)
অর্থাৎ, সীমাবদ্ধ জ্ঞানের জন্য তাঁকে পেয়েও পেলেন না লাবন। এক্ষেত্রে লালন জোর দিয়েছে ‘আত্মতত্ত্ব’ জানার উপর। লালনের অভিব্যক্তি-
‘আপনারে চিনলে পরে যায় অচেনারে চেনা।’ (পদ-১২)
নিজেকে জানলে পরমাত্মাকে জানা যাবে। লালনের গানে এভাবে পরমাত্মা-আত্মা, অস্তিত্ব ও অন্তরোপলব্ধির কথা এসেছে।
লালন শাহের মধ্যে জাতি বা ধর্মভেদ ছিল না। তিনি মন্দির মসজিদ তীর্থের, ভেদ-অভেদের, কথা ও সেগুলোর প্রয়োজনীয়তার কথা স্বীকার করেননি। তিনি মানুষকে মানুষ হিসেবে দেখেছেন এবং তাঁর মতে,
‘এই মানুষে আছে রে মন,
যারে বলে মানুষ-রতন।’ (পদ-১০)
বাউল সাধক এ দর্শন সামনে রেখে মনুষ্যত্বের পরাকাষ্ঠা দেখিয়েছেন। তাঁর অপর উক্তি,
সব লোকে কয় লালন কি জাত সংসারে।
লালন কয়, জেতের কিরূপ, দেখলাম না এ নজরে ।। (পদ-২০)
এটাই লালনের বিশ্ব মানবতার দর্শন। তিনি জাতির বিচার করেননি। তিনি এমন একটি সহিষ্ণু সমাজের স্বপ্ন দেখেছেন যেখানে জাতিভেদ, শ্রেণী- বৈষম্য ও ধনী-গরিবের ব্যবধান থাকবে না। তাই বলেছেন,
এমন সমাজ কবে গো হবে
যেদিন হিন্দু-মুসলমান-বৌদ্ধ-খ্রিষ্টান
জাতি গোত্র নাহি রবে।’
লালনের গান বাউল সম্প্রদায়ের গুহ্য সাধনার বাহন হলেও এর ভিতর সমাজী কুমার বিকাশ লক্ষণীয়। ভূগোল, পরিবেশ এবং বাংলার ও বিভিন্ন পেশা সম্পর্কে তাঁর অভিজ্ঞতার ভাণ্ডার ছিল পূর্ণ। তাঁর গানে তার পরিচয় বিদ্যমান।।
ক. হাতের কাছে হয় না খবর
কি দেখতে যাও দিল্লী লাহোর, (পদ-৩)
বাউল ধর্ম বেদ বিরোধী। বৈদিক ধর্মকে বাউলরা তাঁদের সাধনার পরিপন্থি ও অন্তরায় বলে বিবেচনা করেন। এ বিষয়ে লালন সতর্ক করে বলেছেন-
‘বেদ-বেদান্ত পড়বে যত বাড়বে তত লক্ষণা’।। (পদ-১২)
এছাড়াও তিনি বাউলসাধনার সংকেত-প্রতীক দিয়ে দেহবাদী গুহ্য সাধনার নানা কথা গানে ব্যক্ত করেছেন। তাঁর ভাষা ছিল স্নিগ্ধ গীতি মূর্ছনায় পূর্ণ, উপমা-রূপক, সূক্ষ্ম ইঙ্গিতের ব্যঞ্জনা এবং ভাবের গভীরতায় বিস্ময়কর। দৃষ্টান্ত:
‘মন, তুই রৈলি খাঁচার আশে,
খাঁচা যে তোর তৈরি কাঁচা বাঁশে,
কোনদিন খাঁচা পড়বে খসে,
লালন কয় খাঁচা খুলে
সে পাখী কোনখানে পালায়’।। (পদ-১৩)
এখানে মানবজীবনের ক্ষণস্থায়িত্ব ও মৃত্যুর কথা সাংকেতিক ভাষায় ব্যক্ত হয়েছে।
পরিশেষে বলা যায় যে, লালন শাহ কেবল বাউল নন, তিনি একাধারে সুফি ও দার্শনিক। চৈতন্যের প্রেমধর্ম তাঁর আকর্ষণীয় বিষয় ছিল। সেই সাথে সুফিবাদী চিরস্থায়ী তরিকাভুক্ত সাধক লালন শাহ মুরশিদ তত্ত্বকে মূলভিত্তি করে মানবজাতিকে ভালোবাসার জন্য আবেদন জানিয়েছেন। মানুষ-গুরু নিষ্ঠার মাধ্যমে এ ভাব সাধক বিশ্বপ্রেমের আদর্শ প্রচার করে গেছেন। এখানেই তাঁর জীবনদর্শন বা মতাদর্শের শ্রেষ্ঠত্ব।
Leave a comment